হুমায়ূন আহমেদের বহুমুখী রচনার মধ্যে অনুবাদকর্মও আছে কিছু। তার অনুবাদে পিটার ব্লেটির ইংরেজি উপন্যাস, ‘দি একসরসিস্ট’-এ খুন, বীভৎসতা, রহস্য, রোমাঞ্চ- কমবেশি সবধরনের উপাদানের এক মিশেল রয়েছে। উপন্যাসটি কি আদৌ অনুবাদ, নাকি মৌলিক সাহিত্যকর্ম- তা নিয়েও ধাঁধায় পড়তে হয়। এর কারণ হিসেবে অনুবাদকের সহজ, সাবলীল এবং স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থাপনার কৃতিত্ব দিতেই হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে চাকরিরত অবস্থায় বেশ অর্থাভাবে পড়ে মাত্র দু’ হাজার টাকার বিনিময়ে ‘দি একসরসিস্ট’ উপন্যাসটি ১৯৮৪ সালে সেবা প্রকাশনীর মাধ্যমে প্রথম অনুবাদ করেন হুমায়ূন আহমেদ। অনুবাদের জন্য এই উপন্যাসটিকে বেছে নেবার মূল কারণ হিসেবে কাহিনীর ভৌতিক ব্যাপারগুলোতে বিদ্যমান গ্রহণযোগ্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তার মনে ধরে। হুমায়ূন আহমেদের পরবর্তী ভৌতিক গল্পগুলো রচনাকালেও দি একসরসিস্টের প্রভাব বজায় ছিল বলে মনে করতেন তিনি।
‘দি একসরসিস্ট’ মূলত অতিপ্রাকৃত ও ভৌতিক ধাঁচের, একসরসিজম (কালো জাদু বা পিশাচ সম্পর্কিত) নির্ভর ভিনদেশি এক পটভূমিতে রচিত। চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে, একই সমান্তরালে একসরসিজম এবং মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে রচিত উপন্যাসটি কখনো ভয়ে পাঠকের গায়ে কাঁটা ধরিয়ে দেবে, পরক্ষণেই আবার মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার সাহায্যে সে ভয় প্রশমিত করবে। পাঠক থাকবেন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের এক দোলাচলে। কথার জাদুকর হুমায়ূন আহমেদের কলমে যেন উপন্যাসটি বাংলা ভাষায় আরো জীবন্ত হয়েছে।
উপন্যাসের প্রেক্ষাপট আমেরিকা। এক ডিভোর্সি অভিনেত্রী ক্রিস ও তার কিশোরী কন্যা রেগানকে ঘিরে মূল কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। রেগানের কৈশোরে অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটতে থাকে কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা। প্রতি রাতে শোবার ঘরে সে অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক শব্দ শুনতে পায় এবং কাল্পনিক এক সঙ্গীর সাথে কথা বলে। মনস্তত্ত্ব বিজ্ঞানের বিশ্লেষণ থেকে বলা যায়, মায়ের ডিভোর্সের কারণে বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন রেগান হয়তো তার কল্পনার বন্ধুটিকে বাবার তীব্র অভাববোধ মেটানোর ‘বদলি’ হিসেবে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু স্থানীয় ধর্মযাজকদের মতে, রেগানের দেহে ভর করেছে ‘অশুভ’ পিশাচ বা শয়তান।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় রেগান তাই একপ্রকার মানসিক অসুস্থ হলেও ধর্মযাজকদের ভাষায় রেগানের শারীরিক ও মানসিক দুরবস্থাকে ‘স্পিরিচুয়ালিজম’ বলা চলে। সে অর্থে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে রেগানের মাকে কখনো মনস্তত্ত্ববিদের শরণাপন্ন হতে দেখা যায়, আবার নিমেষেই তিনি ছুটে যান গির্জার ফাদারের কাছে কথিত ‘অশুভ শক্তি’র হাত থেকে মেয়েকে বাঁচানোর প্রবল অভিপ্রায়ে। পাশাপাশি রেগানের সাথে সংঘটিত অস্বাভাবিক ঘটনাটি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের আওতাভুক্ত হবার সম্ভাবনাও কম ছিল না বিধায় প্রকৃত রহস্য উন্মোচনে আইন-শৃঙ্খলাকারী কর্মকর্তার তৎপরতাও পুরো উপন্যাস জুড়ে চোখে পড়ে। উপন্যাসের একপর্যায়ে দু’জন ধর্মযাজকের রহস্যময় পৈশাচিক মৃত্যু দেখা যায়।
অপরদিকে, উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র রেগানের দেহে অনূভুত তীব্র ‘ব্যাখ্যাতীত’ ব্যথার অভিজ্ঞতা ও বর্ণনাও পাওয়া যায়, যা চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ভিত্তিহীন। বস্তুত বিজ্ঞান ও ধর্মবিশ্বাসের কখনও সম্মুখ দ্বৈরথ কখনও পুনরায় যুগপৎ ছুটে চলাকেই দি এক্সরসিস্ট উপন্যাসের মূল প্রাণ বা চালিকাশক্তি মনে হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত ‘বৈজ্ঞানিক’ ব্যাখ্যা যেখানে সন্তোষজনক, ‘অমীমাংসিত’ রহস্য সেখানে আবার রোমাঞ্চকর!
উপন্যাসটিতে পাঠক মনোবিজ্ঞানের কিছু বিষয়ের সাথে পরিচিত হবেন। এ বিষয়ে আগ্রহীরা চমৎকৃত হবেন এবং বাস্তব উদাহরণের ভিত্তি ও মনোবিজ্ঞানের আশ্রয়ে আবিষ্কার করবেন, মানুষের অজানা ও অস্বাভাবিক কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, যা উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কিশোরী রেগানের মাঝে স্পষ্ট। উদাহরণস্বরূপ- সাইকোকাইনেসিস, নিউরোসিস, সাইকোসিস, স্পিরিচুয়ালিজম, নিউরাস্থেনিয়া, অটোমেটিজম ইত্যাদির কথা বলা যায়।
অনুবাদের ভাষা ও উপস্থাপনা
হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের পাঠক মাত্রই তার ঝরঝরে, সাবলীল অথচ ও হাস্যরস সমৃদ্ধ রচনাশৈলীর সাথে পরিচিত। ‘দি একসরসিস্ট’ অনুবাদ করতে গিয়েও হুমায়ূন আহমেদ যথারীতি তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর ছিলেন। এজন্য উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে পাঠক বিভ্রান্ত হতে পারেন এই ভেবে যে, এটি হুমায়ূন আহমেদের মৌলিক উপন্যাস নয় তো! যদিও উপন্যাস সম্পর্কে প্রকাশক এবং অনুবাদক স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন, এটি সরাসরি অনুবাদকৃত নয়, বরং কিছুটা ভাবানুবাদই।
অনুবাদের যথার্থতা আরেকটু তাত্ত্বিকভাবে মূল্যায়ন করতে গিয়ে জনপ্রিয় কবি ও অনুবাদক মুহম্মদ নূরুল হুদার মতে বলা যায়, কোনো অনুবাদকর্মকে মূল ভাষা থেকে অনুবাদের ভাষায় সফলভাবে রূপান্তরের ক্ষেত্রে চারটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় রয়েছে: পাঠ্য পর্যায় (মূল বইটি সঠিকভাবে পাঠ), প্রাসঙ্গিক পর্যায় (মূল বইয়ের সাথে প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখা), তথ্যসংযোগ পর্যায় (বিভিন্ন তথ্যসূত্রের যথাযথ ব্যবহার) এবং স্বাভাবিকত্ব পর্যায় (অনুবাদে মূলের স্বাভাবিকতা বজায় রাখার নিশ্চয়তা)। অনুবাদকর্মে এই চারটি পর্যায় সফলভাবে পার হওয়া গেলে অন্য ভাষায় অনূদিত কর্মে মৌলিক ভাষার স্বাদ আস্বাদন সম্ভব। হুমায়ূন আহমেদের ‘দি একসরসিস্ট’ উপন্যাসের অনুবাদে এই চারটি পর্যায়ের সবগুলোই বেশ সহজ ও সফলভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে।
হুমায়ূন আহমেদের ভাষ্যমতে, পিটার ব্লেটি রচিত মূল ইংরেজি উপন্যাসটিতে বেশ কিছু যৌনতার বর্ণনা থাকলেও বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের জন্য তিনি অপ্রয়োজনীয় যৌন সংবেদনশীল কথাবার্তা বা ঘটনার বর্ণনা পরিহার করার চেষ্টা করেছেন। আর বিদ্যমান অংশটুকু পরিণত পাঠকদের জন্য যথার্থই হবে।
হুমায়ূন আহমেদ নিঃসন্দেহে সফল এক ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকার হিসেবে সমাদৃত হয়েছেন। অনূদিত উপন্যাসটি পাঠ শেষে তাকে একজন সার্থক অনুবাদকও মনে হবে।