“ভাষাটা তৈরি হয়ে গেলে আমার ডাকে সাড়া দিয়ে সারা পৃথিবী থেকে ছুটে আসবে সব মহানায়কেরা।
লেলিনের দেশ থেকে আসবে আন্দ্রে তারকোভস্কি, মার্কিন মুল্লুক থেকে স্ট্যানলি কুব্রিক, চার্লস চ্যাপলিন, বার্গম্যান, ডি সিকা, রসোলিনি, ফেলিনি, গদা, ত্রুফো, ব্রেসো, ওযু, কুরোসাওয়া, বার্তোলুচ্চি।
আমি দু’হাত দিয়ে আলিঙ্গন করব গ্রিফিতের নতুন জন্ম, আইজেনিস্টাইনের বিপ্লব আর বুনুয়েলের পরাবাস্তবতা …
আমরা একটা সিনেমা বানাবো”
সংলাপটি বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের দীর্ঘতম ফিকশন ফিল্মের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বাংলা চলচ্চিত্র আমরা একটা সিনেমা বানাবো এর। সম্পূর্ণ সাদা-কালোয় নির্মিত রঙিন স্বপ্নের ২১ ঘণ্টা ব্যাপ্তির এ ছবিকে ধারাবাহিকভাবে আটটি চ্যাপ্টারে ভাগ করা হয়েছে, যার প্রথম দুই চ্যাপ্টার বা শুরুর পাঁচ ঘণ্টা ত্রিশ মিনিটের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে রিভিউটি লেখা। বস্তুত ছবিটিকে নির্মাতা আশরাফ শিশিরের ভিন্নধর্মী এক নিরীক্ষণ বলা যায়। যে নিরীক্ষণ আমাদের বার বার শুনিয়েছে ক্যামেরা অবসকিউরা, ম্যাজিক ল্যান্টার্ন, সাদাকালো, রঙিন, স্বল্পদৈর্ঘ্য, পূর্ণদৈর্ঘ্য, মুক্তদৈর্ঘ্য, স্যুররিয়ালিজম, ইম্প্রেশনিজম, এক্সপ্রেশনিজম, কিউবিজম, ডাডায়িজম, মডার্নিজম, পোস্ট-মডার্নিজম, রিয়্যালিজম, ম্যাজিক রিয়্যালিটি, নিওরিয়্যালিজম, ম্যাজিক রিয়্যালিজম আর পয়েটিক রিয়্যালিজমের কথা।
প্রোটাগনিস্ট স্বপ্নদ্রষ্টা তৈরি করতে চেয়েছে শক্তিশালী একটি সার্বজনীন সিনে ল্যাঙ্গুয়েজ। যা হবে প্রতিবাদ, ভালবাসা আর ঘৃণা প্রকাশের ভাষা। পোড় খাওয়া এ শহরে মানুষ তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করে উদ্ভ্রান্ত উন্মাদ বলে সম্বোধন করেছে। কিন্তু সে পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ায়নি বলেই কেউ কেউ তার কথায় বিশ্বাস এনে তার ‘আমরা একটা সিনেমা বানাবো’র স্বপ্নকে লালন করে সিনেমার পোকাকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করেছে। সবাই সবার দৃষ্টিভঙ্গি আর অবস্থান থেকে যুগ যুগ সময় ধরে একসাথে একটাই সিনেমা বানাতে চেয়েছে। কিন্তু বাস্তবতার সামনে যেন স্বপ্নের অপমৃত্যুর শঙ্কা উঁকি দেয়। তখন উপলব্ধি আসে- যার সিনেমা হলে সিনেমা দেখার সামান্য পয়সা নেই, সে কী করে একটি সিনেমা বানাবে!
দারুণ শৈল্পিক এবং শক্তিশালী এই মুক্তদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের ভাষা। ধরাবাঁধা সময় সেই ভাষা প্রকাশে কোনো বাঁধা হতে পারেনি নির্মাতার বদান্যতায়। বরং, তা জীবনের সাথে মিলেমিশে আমাদের সিনেমা হয়ে উঠতে চেয়েছে প্রতিমুহূর্তে। নিষ্পাপ তরুণ, যে সামান্য একটি পিঁপড়া মেরে অনুশোচনাতে ভোগে, সে-ই কিনা জ্যান্ত একজন মানুষকে হত্যা করেছে শুধুমাত্র সিনেমার তাগিদে। আপাত স্বপ্নদ্রষ্টা এক সিনেমাপাগলের স্বপ্নভঙ্গ স্থান করে নিয়েছে ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট ফরম্যাটে। তবে ফুল ফ্রেমে দেখলে যেখানে ঠাঁই নিয়েছে ভালবাসা-বিচ্ছেদ, বেঁচে থাকা, পুনর্মিলন, রাজনীতি, মানুষ, শহর, নদী, গ্রাম, প্রকৃতি, স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন, মানুষ ও মনুষ্যত্ব। প্রতিষ্ঠিত নানা তত্ত্ব ও ভাষার বিভিন্ন আঙ্গিক উপস্থাপন এবং পরীক্ষণের ইঙ্গিত দিয়েছে ছবির দৃশ্যায়ন।
সিনেমাটোগ্রাফার সাব্বির মাহমুদ, মোহাম্মদ আশরাফুল, সমর ঢালীর ত্রয়ী প্রয়াসে ক্যামেরাতে নান্দনিকভাবে দৃশ্যমান হয়েছে স্পটভিউ। স্বপ্নদ্রষ্টা ডিরেক্টরের নির্দেশনা মেনে সিনেমাকে বেশ অভিনব উপায়ে অনুসরণ করে যেতে দেখা গেছে এক্সপেরিমেন্টাল ক্যামেরাকে। কখনো এরিয়েল শটে ভবের দুনিয়ায় পাশাপাশি শুয়ে থাকা দুজন পাশা খেলুড়েকে ফ্রেমবন্দি করেছে। কখনো আবার লংশটে আকাশের সাথে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে গেছে সীমাহীন প্রান্তরে। দেখে মুগ্ধ না হবার কোনো উপায় নেই। আর্ট ডিরেকশনও ছিল নন্দনতত্ত্বের শৈল্পিক ছোঁয়া। বিশেষত, কাপড়ের গিঁট দিয়ে সন্তানের বয়স গণনার ব্যাপারটি চমৎকার। সংলাপে ভাবগাম্ভীর্য যেমন প্রাধান্য পেয়েছে, তেমনি বুদ্ধিদীপ্ত সরস আলাপও শুনিয়েছে। ঈশ্বরদী মসজিদে বিশ টাকার বাতাসা দিয়ে বিয়ে সেরে ফেলার চিন্তা, স্নো-পাউডারের প্যাকেটের মতো কাউকে সুন্দর বলে আখ্যায়িত করার উপমা, “ছাওয়াল এখন হিট অবস্থায় আছে” বলে সান্ত্বনা, কিংবা “মাইয়া মানুষকে জাহান্নামের লাকড়ি” বলে অভিহিতকরণ সেসবের সাক্ষ্য বহন করে। অবশ্য ভিডিও এডিটিং একরকম ভাল হলেও সর্বোচ্চ মানের হয়নি। সেক্ষেত্রে শট টু শট ট্রাঞ্জিশন ইফেক্টস এবং ফেইড ইন ফেইড আউটের যথেচ্ছ ব্যবহার এড়ানো গেলে পুরোপুরি সন্তোষজনক বলা যেত।
আমরা একটা সিনেমা বানাবোর টাইটেল সং উৎফুল্লতার সাথে সিনেমাপ্রেমকে প্রকাশ করতে সমর্থ। ফিল্মের অর্থবহ শব্দ বিন্যাস সিনেম্যাটিক আবহ ধরে রাখায় পর্যাপ্ত সহায়তা দেয়। তদুপরি চরিত্রকে অনুসরণ করে সাইকেলসমেত সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাবার দৃশ্যে সাইকেলের যে খটখট আওয়াজ তাতে ফলি সাউন্ড ব্যবহারের প্রতি সচেতন প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। শিরোনামহীনের ‘এ রাতে’ গানটি দৃশ্য প্রাসঙ্গিকতায় ফিল্মের অমোঘ হাহাকারের আবেদনের সাথে ওতপ্রোতভাবে একাকার হয়ে অবর্ণনীয় এক অনুভূতির সঞ্চার করে।
“তোমাকে চেনা চেনা লাগে। তুমি কি আকিরা কুরোসাওয়া?”
কবির উত্তর দেয়— “না, আমি তোমার সিনেমার নায়ক।”
এমতাবস্থায় উদ্ভ্রান্ত ওকে চিনতে পেরে বলে উঠে— “হ্যাঁ, The ant killer!”
বলাই বাহুল্য, সংলাপ এই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। চরিত্রগুলোকে যেভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে তা সার্বিকভাবে প্রশংসার যোগ্য। প্রাধান্য বিস্তারকারী চরিত্রগুলোর বাইরে ইমরান চরিত্রটিকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি সংযোজন হিসেবে ভাল লেগেছে। ডিটেনশন ক্যাম্পের এই যুবক তার পরিবারের পাকিস্তান প্রেমকে অগ্রাহ্য করে ভালবাসার মোহে বাংলাদেশকে নিজের দেশ ভাবতে চায় বলেই কিনা তা নতুন চিন্তার উদ্রেক ঘটায়। তেমনি বন্ধুসমাজে চরিত্রটির যে সামাজিক অবস্থান, তাতে দর্শকমনে ভাবাবেগ সৃষ্টিতে সমর্থ হবে। চিত্রনাট্যের এ ভাল দিকগুলোর পাশাপাশি অজানা কৌতূহল উদ্দীপক বিষয়ও আছে। যেমন: করিম মাস্টারের বাড়িতে সেবাশুশ্রূষা পাবার পরেও উদ্ভ্রান্ত ডিরেক্টর কেন তাকে চিনতে পারল না, কেন তার হারানো শৈশবে ফিরে যেতে ব্যর্থ হলো এর কোনো সদুত্তর গল্পে পাওয়া যায় না। ব্যাপারটা স্মৃতিভ্রষ্টতা হয়ে থাকলেও দ্বিতীয় চ্যাপ্টার পর্যন্ত সেটি প্রচ্ছন্ন থাকে।
আমরা একটা সিনেমা বানাবো চলচ্চিত্রের ভাষা এবং চলচ্চিত্র আন্দোলন নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে ভাবনার কথা জানান দেয়। পৃথিবীতে দিনে দিনে অন্যায়-শোষণ-নিপীড়ন বাড়ছে। যার ফলে প্রতিবাদের ভাষাকে হতে হচ্ছে আরও প্রবল আরও শক্তিশালী। এতে দিনকে দিন সার্বজনীন সেই ভাষা কঠিন থেকে কঠিনতর রূপে আবির্ভূত হবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় পৃথিবীর যাবতীয় দুঃখ-কষ্টের শেষ নির্যাসটুকু ঋত্বিক ঘটক এসে মদের বোতলে ঢেলে না দেয়া পর্যন্ত সিনেমার পরিসমাপ্তিতে অসম্পূর্ণতা থাকার সম্ভাবনার কথা যুবক আফসোসের সুরে জানায়। যুবক উদ্ভ্রান্ত বেশে জানিয়ে দেয়- সিনেমা শুধু ঘরে বসে টিভিতে দেখার জিনিস নয়। কারণ, লার্জার দ্যান লাইফের সেই মজা পৌঁছে দিতে হবে সবার কাছে; দুয়ারে দুয়ারে, যাতে স্পষ্ট আভাস মেলে সিনেমা মুভমেন্টের।
সবশেষে বলতে চাই, নির্মাতা আশরাফ শিশির মানবিক সম্পর্কের গল্প বুনে আমরা একটি সিনেমা বানাবো-তে প্রতিধ্বনিত করেছেন সিনেমার জয়গান। যেখানে আলেখ্য হয়েছে সিনেমার ভাষা এবং বোঝাপড়া। সে সূত্র মিলিয়েই নির্মাতা তার এ ফিল্মকে উৎসর্গ করেছেন তাদের উদ্দেশ্যে যারা সিনেমার স্বপ্ন দেখে পুরো জীবন নষ্ট করে ফেলেছে, অথচ শেষপর্যন্ত বিনিময়ে কিছুই পায়নি। উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ১৯ ও ২০ জুলাই দুই দিনব্যাপী পাবনা জেলার ঐতিহ্যবাহী ‘রূপকথা’ সিনেমাহলে প্রয়োজনীয় বিরতিসহ প্রথমবারের মতো পুরো ২১ ঘণ্টার ফিল্মটি প্রদর্শিত হয়।