চলচ্চিত্র নিয়ে অবিরাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা পছন্দ করতেন সত্যজিৎ রায়। তার সেই অনুসন্ধিৎসু মনের পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায় তার নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর ভাব, ভাষা এবং বিষয়ের বৈচিত্র্যে। বিশেষ করে যেসব চলচ্চিত্রে তিনি মৌলিক চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ করেছেন, সেগুলোতে তার স্বাতন্ত্র্য এবং মৌলিকত্ব আরও যেন বেশি স্পষ্টরূপে প্রকাশ পেয়েছে।
সত্যজিৎ রায়ের এমনই একটি নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্র ‘নায়ক’। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা‘র (১৯৬২) পর এই চলচ্চিত্রটিতে তিনি দ্বিতীয়বারের মত মৌলিক চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ করেন। ‘নায়কে’ সত্যজিৎ রায় একজন জনপ্রিয় চলচ্চিত্র তারকার মনস্তত্ত্ব উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন। তার ভীতি, একাকীত্ব, অনুশোচনাবোধ এবং নিরাপত্তাহীনতার মত বিষয়গুলো সুচারুভাবে উপস্থাপিত হয়েছে এই চলচ্চিত্রে।
অরিন্দম মুখোপাধ্যায় চলচ্চিত্র জগতের একটি সুপরিচিত মুখ। একটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নেওয়ার জন্য বিমানের টিকিট না পেয়ে তিনি কলকাতা থেকে দিল্লী ট্রেনে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে ট্রেনের রেস্তোরাঁয় তার সাথে পরিচয় ঘটে অদিতি সেনগুপ্ত নামের এক শিক্ষিত রুচিশীল তরুণীর। ‘আধুনিকা’ নামে একটি মেয়েদের পত্রিকা সম্পাদনা করে সে। পত্রিকাটিকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে সে অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে ইচ্ছুক হয়। এরপর কথায় কথায় প্রকাশ পায় অরিন্দমের নানামাত্রিক অনুভূতির কথা। মূলত অরিন্দমের এই মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধানই ‘নায়ক’ চলচ্চিত্রের কাহিনির ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। পাশাপাশি সমান্তরালে সৃষ্ট আরও কিছু চরিত্রের মাধ্যমে সমাজের সুযোগসন্ধানী নোংরা রূপটির প্রতি ঘৃণা প্রকাশিত হয়েছে।
কাহিনীভিত্তিক বা ঘটনাভিত্তিক না হয়ে সত্যজিৎ রায়ের এ চলচ্চিত্রটি অনেকটা বিষয়ভিত্তিক। কোন ঘটনা বা গল্প এই নির্মাণটিকে এগিয়ে নেয়নি, বরং একটি মনস্তাত্ত্বিক অনুভব বা বিষয় দ্বারা তাড়িত হয়ে সত্যজিৎ রায় তার ‘নায়ক’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন। কাহিনীর প্রয়োজনে এখানে চরিত্র সৃষ্টি হয়নি, বরং চরিত্র থেকেই টুকরো টুকরো গল্প বের করে এনেছেন পরিচালক।
এ চলচ্চিত্রের নায়ক অরিন্দম মুখোপাধ্যায় আমাদের সমাজের যেকোনো তারকা ব্যক্তিত্বের প্রতিনিধি। তাদের নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহের কমতি থাকে না। দূর থেকে মনে হয় তারা অন্য জগতের মানুষ। কিন্তু খ্যাতি বা জনপ্রিয়তার আড়ালে তারাও যে রক্তমাংসের সাধারণ মানুষ, তাই স্পষ্ট হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। এই চলচ্চিত্রের অদিতি সেনগুপ্ত একজন আধুনিক শিক্ষিত তরুণী। নায়ককে দেখে মুগ্ধ হওয়ার চেয়ে নায়কের অনুভবের জগত নিয়ে তার আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে বেশি। অদিতির জিজ্ঞাসু মন এবং অরিন্দমের নিজেকে লুকিয়ে রাখার প্রবণতা প্রকাশ পায় তাদের প্রাথমিক কথোপকথনে।
অদিতি: এই যে আপনার দারুণ খ্যাতি, এটা কেমন লাগে?
অরিন্দম: বেশ তো, ভালই তো!
অদিতি: কিন্তু এই যে বেশি করে পাওয়া, এর মধ্যে একটা ফাঁক, একটা অভাববোধ, কোন রিগ্রেটস নেই?
অরিন্দম: দেখুন মিস সেনগুপ্তা, আমাদের খুব বেশি কথা বলতে নেই। আমরা ছায়ার জগতে বিচরণ করি তো, কাজেই আমাদের রক্ত মাংসের জ্যান্ত শরীরটা জনসাধারণের সামনে খুব বেশি করে তুলে না ধরাই ভাল। কী বুঝলেন?
তারকা ব্যক্তিত্বদের এমন অচেনা লাগার কারণ হয়তো তাদের রহস্যময়তা। নায়ক অরিন্দমের মাঝেও নিজেকে লুকিয়ে রাখার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয় চলচ্চিত্রের শুরুতে। কিন্তু পরবর্তীতে খোলস ভেঙে বেরিয়ে এসে সে তার স্মৃতির অলিগলি উন্মুক্ত করে দেয় অদিতির সামনে। অরিন্দমের মনস্তাত্ত্বিক উন্মোচনে পরিচালক সাহায্য নিয়েছেন সাতটা ফ্লাশব্যাক এবং দু’টো স্বপ্নদৃশ্যের।
১৯৬৬ সালের ৬ মে মুক্তি পেয়েছিল ‘নায়ক’। এই চলচ্চিত্রে নায়ক অরিন্দমের চরিত্রে অভিনয় করেন মহানায়ক উত্তমকুমার এবং অদিতির চরিত্রে অভিনয় করেন শর্মিলা ঠাকুর। উত্তমকুমারকে নায়ক হিসেবে কল্পনায় রেখেই দার্জিলিঙে বসে এই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায়। মূলত মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসে সংগ্রামের মাধ্যমে ‘নায়ক’ হয়ে উঠার যে গল্প তিনি এই চলচ্চিত্রে দেখিয়েছেন, তার সাথে উত্তমকুমারের নিজের জীবনেরও অনেকটা মিল ছিল।
নায়কের জীবনের নানা দিককে উন্মুক্ত করার পথে টুকরো টুকরো স্মৃতি এবং গল্পকে এই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যে অপূর্ব সম্মোহনী ক্ষমতায় আবদ্ধ করেছেন সত্যজিৎ রায়। নায়ক অরিন্দমকে আবিষ্কারের যাত্রা শুরু হয় এক অদ্ভূত স্বপ্নদৃশ্যের মাধ্যমে। দেখা যায় শুধু টাকার মাঝে হেঁটে চলেছেন প্রচণ্ড উৎফুল্ল নায়ক। হঠাৎ বেজে উঠে টেলিফোন। শব্দ ধরে এগিয়ে গিয়ে নায়ক দেখেন, টেলিফোনের রিসিভারটা আছে একটা কঙ্কালের হাতে। ভয়ে পিছিয়ে যান তিনি। টাকার স্তূপগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে অজস্র কঙ্কালের হাত। এরপর হঠাৎ করেই টাকার চোরাবালিতে ডুবে যেতে শুরু করেন নায়ক। এ সময় ভারি মেকাপে সজ্জিত আরেকটি মূর্তিকে দেখা যায়। তার কাছে আকুল হয়ে নায়ক বলেন, “শঙ্করদা, আমাকে বাঁচান!” কিন্তু বাঁচানোর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শঙ্করদা তাকে সাহায্য করেন না। নায়ক ডুবে যান টাকার চোরাবালিতে। ভয়ে আতঙ্কে ঘর্মাক্ত অবস্থায় স্বপ্ন ভেঙে জেগে ওঠেন তিনি। সমাজ এবং পরিপার্শ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে টাকার মোহে আটকা পড়ার যে আতঙ্ক, তা প্রতিফলিত হয় এই স্বপ্নদৃশ্যে। পাশাপাশি দর্শকের মনে প্রশ্নও রেখে যান, কে এই শঙ্করদা যিনি ডুবতে থাকা নায়ককে বাঁচালেন না?
ট্রেনের রেস্তোরাঁয় পুনরায় অদিতি সেনগুপ্তের সাথে নায়কের দেখা হলে পাওয়া যায় এই উত্তর। একটি ফ্লাশব্যাকের মাধ্যমে পরিচালক আমাদেরকে নিয়ে যান শঙ্করদার কাছে। পাড়ার থিয়েটারে তার সাথে কাজ করে অরিন্দমের অভিনেতা হয়ে ওঠা। অথচ অরিন্দমের ফিল্মে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে তার ছিল তীব্র আপত্তি। মঞ্চের স্বাধীনতার সাথে ফিল্মের তুলনা করে তিনি বলেছিলেন, “ফিল্মের একটা গ্ল্যামার আছে জানি। কিন্তু তার সাথে আর্টের কোন সম্পর্ক নেই। থাকতে পারে না।” শঙ্করদার মৃত্যুর পরদিনই অরিন্দম ফিল্মের অডিশন দিয়ে তার যাত্রা শুরু করে। যার হাতে অরিন্দমের পরিপুষ্টি, তার নিষেধ অগ্রাহ্য করে ফিল্মে আসায় একটা অপরাধবোধ কাজ করে নায়কের মাঝে। ফ্লাশব্যাকের এই দৃশ্যটির মাধ্যমে তা পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
এভাবেই বাকি ফ্লাশব্যাকগুলোর মধ্য দিয়ে নায়কের প্রথম অভিনয়, প্রথম চলচ্চিত্র মুক্তির আগের দিনের আতঙ্কের মত স্মৃতিময় মুহূর্তগুলোকে তুলে এনেছেন চলচ্চিত্রকার। অরিন্দমের মাঝে আরও দেখিয়েছেন প্রতিযোগিতা থেকে সৃষ্ট প্রতিশোধপরায়ণতা, ইমেজ সচেতনতা থেকে কাছের বন্ধুকে দূরে ঠেলে দেওয়ার মত প্রবণতাগুলো। নায়কের শ্রোতা অদিতিকে আমরা আবিষ্কার করি বুদ্ধিমত্তার আলোকে দীপ্ত একটি চরিত্র রূপে। নায়কের মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলোর ভাল-মন্দ সে খুব সচেতনভাবে উপলব্ধি করে। শুরুতে চলচ্চিত্রের নায়কদের প্রতি তার একটি অবজ্ঞার ভাব থাকলেও ক্রমশ তা রূপান্তরিত হয় সহানুভূতিতে।
অদিতি এবং অরিন্দম ছাড়া চলচ্চিত্রের অন্যান্য চরিত্রগুলোও বিচিত্রধর্মী। তাদের মধ্যে স্বার্থান্ধতা এবং সুযোগসন্ধানী মনোভাব প্রবল। বিজ্ঞাপন ব্যবসায় নিয়োজিত এক কর্মকর্তা আকৃষ্ট করতে চান শিল্পপতিকে। কিন্তু শিল্পপতির মনোযোগ বিজ্ঞাপন কর্মকর্তার স্ত্রীর দিকে। শিল্পপতি তাদেরকে আমন্ত্রণ করেন তার দিল্লীর বাড়িতে। শিল্পপতির এই নোংরা আগ্রহ অনুভব করে ভেঙে পড়লে বিজ্ঞাপন কর্মকর্তা তার স্ত্রী একটু এ্যক্টিং করতে অনুরোধ করেন। বলতে থাকেন, “এটা তো একটা খেলা। একটা স্ট্র্যাটেজি।” এভাবে ছোট ছোট চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির সুযোগসন্ধানী রূপটিকে পরিচালক আমাদের সামনে উন্মোচিত করেছেন।
সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রযাত্রায় ‘নায়ক’ একটি ব্যতিক্রমী সৃষ্টি। গ্রামীণ মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তকে নিয়ে কাজ করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে এখানে তিনি কাজ করেছেন সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণিকে নিয়ে। এজন্যই হয়তো অনেক সমালোচকের কাছে ‘নায়ক’ যথেষ্ট সমাদর লাভ করে নি। সময় এবং সমাজের রূঢ় রূপটিকে যথেষ্ট পরিমাণে ধারণ না করায় তারা এটিকে স্রেফ বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্ররূপে গ্রহণ করেছেন।
তবে নির্মাণশৈলীর দিক থেকে বাংলা চলচ্চিত্রে একটি অনন্য স্থান দখল করে আছে ‘নায়ক’। শিল্প নির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত বিশেষভাবে শ্যুটিং সেটের ট্রেনের কামরাগুলো বানিয়েছিলেন। চিত্রগ্রহণে ট্রেনের ঝাঁকুনি, ঝকঝক শব্দ সহ প্রতিটি সূক্ষ্ম জিনিসকে নিখুঁতভাবে চলচ্চিত্রে আনার চেষ্টা করেছেন পরিচালক। অতিপ্রিয় অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে বাদ দিয়ে সত্যজিৎ রায় এই চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মত কাজ করেন উত্তমকুমারের সাথে। উত্তমকুমার ছাড়া নায়কের এই চরিত্রে অন্য কাউকে যেন মানাতোও না। উত্তমকুমারও অত্যন্ত আনন্দ নিয়ে প্রথমবারের মত কাজ করেন সত্যজিৎ রায়ের সাথে। ‘নায়ক’ চলচ্চিত্রের বেশিরভাগ দৃশ্যই এক টেকে ‘ওকে’ হয়ে যাওয়া।
স্নিগ্ধ রোমান্টিক মুহূর্তের অপূর্ব প্রতিফলন আছে এই চলচ্চিত্রে। দেখা গেছে দীর্ঘ সময় কথা বলতে বলতে অদিতি এবং অরিন্দম- দু’জনের মাঝে একটি সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কিন্তু সম্পর্কটিকে প্রাতিষ্ঠানিক কোন রূপ দেওয়ার সিনেম্যাটিক চিন্তাভাবনায় তারা ডুবে যায়নি। কোন চাওয়া পাওয়াও নেই দু’জনের মধ্যে, তারা যেন শুধু সময়টাকেই উপভোগ করতে চেয়েছে। ট্রেনযাত্রার শেষে অদিতি তার নেওয়া সাক্ষাতকারের পাতাগুলো অরিন্দমের সামনেই ছিঁড়ে ফেলে। অরিন্দম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “মন থেকে লিখেবেন নাকি?” অদিতি উত্তরে বলে, “মনে রেখে দেব।” অর্থাৎ নায়ককে সে যে রূপে আবিষ্কার করেছে, তা তার মনের কুঠুরিতেই আবদ্ধ রাখবে। বাইরের কাউকে জানানোর ইচ্ছা তার নেই।
১৯৬৬ সালে বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ডে’র পাশাপাশি ‘শ্রেষ্ঠ ফিচার ফিল্ম’ এবং ‘শ্রেষ্ঠ কাহিনি ও চিত্রনাট্য’ বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে ‘নায়ক’।
শুধু গল্প নয়, বরং একটি বিষয় বা অনুভবও যে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুপ্রেরণা হতে পারে, তা প্রকাশ পেয়েছে সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ এ। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এটি ছিল একটি ভিন্নমাত্রার সংযোজন। তাই ‘নায়ক’ রয়ে যায় ঠিক নায়কের মতন হয়তো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে আমাদের স্মৃতির অতলে, হৃদয়ের গভীরে।