স্টার ওয়ার্স: গ্যালাক্সিজুড়ে যুদ্ধের দামামা

স্টার ওয়ার্স সিরিজের মুভিগুলোকে টাইমলাইন অনুসারে সাজালে এটি চার নম্বর অবস্থানে থাকে। তবে প্রকাশের সময় অনুসারে তালিকা করলে এটি প্রথমে থাকে। ১৯৭৭ সালে এটি মুক্তি পায়। বর্তমানে এর নাম ‘স্টার ওয়ার্স: আ নিউ হোপ’ থাকলেও শুরুতে শুধুমাত্র ‘স্টার ওয়ার্স’ নামেই মুক্তি পায়। নাম কেন পরিবর্তিত হয়েছে তার পেছনেও কারণ আছে।

স্টার ওয়ার্সের এই চমৎকার ইউনিভার্সের স্রষ্টা হলেন কমিকের প্রবাদ পুরুষ জর্জ লুকাস। ১৯৮০ সালের দিকে জর্জ লুকাস যখন স্টার ওয়ার্সের সিক্যুয়েল ‘এম্পায়ার স্ট্রাইক ব্যাক’ তৈরি করেন, তখন তিনি ভাবেন এই প্রেক্ষাপটে আরো কিছু কাহিনী বলার আছে তার। সেসব কাহিনী হবে মূল কাহিনীর আগের সময়ের। অর্থাৎ সেগুলো হবে মূল সিনেমার প্রিক্যুয়েল। কাহিনী অনুসারে সারিবদ্ধ করলে ১৯৮০ সালে নব-নির্মিত এম্পায়ার স্ট্রাইক ব্যাক-এর অবস্থান হবে পাঁচ নাম্বারে। সে হিসেবে আগের কাহিনী ‘স্টার ওয়ার্স’ হবে চার নাম্বারে। সেজন্য মূল কাহিনীর সাথে মিল রেখে, আগের ঘটনার পরম্পরার সাথে মিলিয়ে, স্টার ওয়ার্স-এর নাম প্রদান করেন ‘স্টার ওয়ার্স: এপিসোড ৪ – আ নিউ হোপ’। ৫ নম্বর মুভি তথা এম্পায়ার স্ট্রাইক ব্যাক প্রচুর সাফল্য পায়, এমনকি আগের মুভির সাফল্যকেও ছাড়িয়ে যায়। এই সাফল্যের উপর ভর করে ১৯৮১ সালে জর্জ লুকাস মূল স্টার ওয়ার্স মুভিটিকে আবারো রিলিজ করেন। সে সময় এর নাম পালটে আ নিউ হোপ প্রদান করা হয়

স্টার ওয়ার্স: আ নিউ হোপ এর পোস্টার; ছবি: লুকাস ফিল্ম/ডিভাইন আর্ট

স্টার ওয়ার্সের সকল মুভিকে অনুধাবন করতে হলে একটি বিষয়ে জানা থাকা আবশ্যক। ফোর্স, এটি জাগতিক সকল প্রাণের মাঝে বিদ্যমান। ফোর্সের মাধ্যমে সকল প্রাণী একে অপরের সাথে যুক্ত। ফোর্সের সাথে সকল প্রাণী সংযুক্ত থাকলেও একে অনুধাবন করতে পারে খুব স্বল্প একটি সংখ্যা। অনুধাবনের মাধ্যমে একে নিজের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারে আরো স্বল্প একটি সংখ্যা। যারা এ ফোর্স নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাদেরকে বলে ‘ফোর্স উইল্ডার’।

এই ফোর্স ব্যবহারের মাধ্যমে একজন ফোর্স উইল্ডার জাদুকরী কাজ করতে পারেন। চোখ বন্ধ করেই কোনোকিছু দেখতে পারেন, আশেপাশে অশুভ কিছু হলে তা আঁচ করতে পারেন, কোনো মাধ্যম ছাড়াই অন্য ফোর্স উইল্ডারের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন, দূর থেকে কোনোকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। যেমন হাতের ইশারায় কারো গলা টিপে ধরতে পারেন, প্রচণ্ড বেগে ধাবমান বুলেটকে থামিয়ে দিতে পারেন, শূন্যে ভাসতে পারেন, অন্য কোনো বস্তুকে শূন্যে ভাসাতে পারেন ইত্যাদি।

ফোর্স যেহেতু ব্যক্তির ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাই ফোর্সের বহুল ব্যবহার থাকতে পারে। কেউ চাইলে একে ভালো কাজে ব্যবহার করতে পারে আবার কেউ চাইলে একে খারাপ উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করতে পারে। যারা এই ফোর্সকে নিজেদের স্বার্থের জন্য তথা খারাপ কাজের জন্য ব্যবহার করে তাদেরকে বলে সিথ। আর যারা ভালো কাজের উদ্দেশ্যে তথা পুরো গ্যালাক্সিতে শান্তি সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবহার করে তাদেরকে বলে জেডাই (Jedi)। সিথ ও জেডাইদের আলাদা আলাদা কাউন্সিল আছে। সেখানে দলপতি আছে, শিক্ষক আছে, শিস্য আছে।

জেডাইদের মাঝে যারা অভিজ্ঞ তাদেরকে বলা হয় জেডাই নাইট। জেডাই নাইটদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে এক বা একাধিক জেডাই মাস্টার। জেডাই নাইটরাই পরবর্তীতে জেডাই মাস্টার হন। এসব নাইট ও মাস্টাররা সবসময় সাহসী, শক্তিশালী, দূরদর্শী ও স্বার্থহীন হয়ে থাকে। একইভাবে সিথের সদস্যরাও সাহসী হয়ে থাকে। জেডাই ও সিথের দুই বিপরীতমুখী উদ্দেশ্য ও তাদের পারস্পরিক যুদ্ধ নিয়ে এই মুভি।

যে সময়ের প্রেক্ষাপটে এই মুভি সে সময়ে গ্যালাক্সিতে বড় অরাজকতা বিরাজ করছে। সমগ্র গ্যালাক্সি জুড়ে জেডাই ফোর্সেকে দমিয়ে রেখেছে সিথ ফোর্স। এদের মাঝে কিছু কিছু জেডাই বিচ্ছিন্নভাবে বিদ্রোহ করছে। সকল বিদ্রোহীরা একত্রে একটি দলের অন্তর্ভুক্ত। দলের নাম রেবেল এলায়েন্স বা বিদ্রোহী ঐক্যজোট। এদেরকে ডাকা হয় রেবেলিয়ান নামে। একসময় এক যুদ্ধে রেবেলিয়ানরা গ্যালাক্টিক সাম্রাজ্যের ছোট একটি অংশের বিরুদ্ধে জয় লাভ করে। সে সময় রেবেলিয়ানদের কিছু গুপ্তচর গ্যালাক্টিক সাম্রাজ্যের বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করেন। এসব তথ্যের একটি হলো ডেথ স্টার এর ব্লু-প্রিন্ট। ডেথ স্টার হলো একটি অতিকায় স্পেস স্টেশন। আকৃতিতে একটি উপগ্রহের সমান। নাক্ষত্রিক পরিবেশে যুদ্ধ করার জন্য সকল ধরনের অস্ত্রই আছে অতিকায় ডেথ স্টারের মাঝে। এতে এমন প্রযুক্তি আছে যা দিয়ে দূর থেকে পুরো একটি গ্রহকেই ধ্বংস করা সম্ভব।

বিধ্বংসী ডেথ স্টার; ছবি: পিন্টারেস্ট/লুকাস ফিল্ম

রেবেলিয়ানরা বিধ্বংসী এই ডেথ স্টারকে ধ্বংস করার জন্য তৎপর হতে শুরু করে। তাদেরকে নেতৃত্ব দেন তাদের নেতা প্রিন্সেস লেইয়া। ডেথ স্টার ধ্বংসের জন্য তিনি পরিকল্পনাও করেন। যেহেতু ব্লু প্রিন্ট জানা আছে তাই এটি ধ্বংস করতে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যাবে। কিন্তু সমস্যা বাধায় সাম্রাজ্যের অভিযান। সাম্রাজ্যের আক্রমণে বন্দী হয়ে যায় প্রিন্সেস লেইয়া ও তার দল। তবে লেইয়া বেশ বিচক্ষণ, ধরা পড়বার ঠিক আগ মুহূর্তে তার সকল পরিকল্পনার ডিজিটাল রূপ স্থানান্তর করে দেয় একটি রোবটের কাছে। রোবটের নাম R2-D2। এই রোবট অন্য আরেকটি রোবটকে সাথে নিয়ে কৌশলে বের হয়ে যায় শত্রুর মহাকাশযান থেকে। ঘটনাক্রমে তারা চলে আসে ট্যাটুইন নামের একটি গ্রহে। ঐ রোবটের নাম C-3PO। সিনেমা জগতের সকল রোবটদের মাঝে এ দুটি রোবট খুব বিখ্যাত। পুরো গ্রহ মরু, নিষ্প্রাণ, সেখানে বেঁচে থাকতে হলে অনেক সংগ্রাম করতে হয়। সেখানে সূর্য উঠে দুটি।

R2-D2 ও C-3PO; ছবি: লুকাস ফিল্ম

অন্যদিকে প্রিন্সেস লেইয়ার পরিকল্পনা সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য দরকার ওবি-ওয়ান কেনোবি নামে একজন জেডাই নাইটকে। আর এই ওবি-ওয়ান কেনোবি অবস্থান করছে এই মরুময় গ্রহেই।

এদিকে রেবেলিয়ানরা চাইলেই সাম্রাজ্যকে হারিয়ে ডেথ স্টারকে ধ্বংস করে দিতে পারবে না। কারণ সিথ ফোর্স নামক সেই ডার্ক সাইডে আছে একজন অপ্রতিরোধ্য ব্যক্তি, নাম ডার্থ ভেডার। তাকে প্রতিহত করা বেশ দুরূহ, তার একার ক্ষমতার কাছে পুরো গ্যালাক্সির ক্ষমতা নস্যি। কেন সে এত বেশি ক্ষমতাবান আর কেন তাকে প্রতিহত করা প্রায় অসম্ভব তার পেছনেও কারণ আছে। সে কারণ জানতে হলে প্রবেশ করতে হবে স্টার ওয়ার্স সিরিজের গভীরে। গভীরে যেতে হলে দেখতে হবে সিরিজের ছয়টি সিনেমা।

এই সিনেমা উপলব্ধি করতে গেলে আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সম্বন্ধে ধারণা থাকতে হবে। একটি হলো লুক স্কাইওয়াকার এবং অন্যটি হলো হান সলো। দুই রোবট যে গ্রহে অবতরণ করেছে সে গ্রহে আশ্রিত বা পালিত হিসেবে থাকে লুক স্কাইওয়াকার। তার বাবা ছিল একজন জেডাই নাইট এবং বাবার মতো তেজদীপ্ত স্বভাব তার মাঝেও বিদ্যমান। হান সলো একজন পাইলট, যিনি মহাকাশযান বিষয়ে অভিজ্ঞ। টাকার প্রতি লোভ আছে কিঞ্চিৎ, টাকার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার সাহস আছে তার মাঝে।

প্রিন্সেস লেইয়া এবং তার দুই পাশে লুক স্কাইওয়াকার ও হান সলো; ছবি: লুকাস ফিল্ম

যেহেতু আন্তঃনাক্ষত্রিক স্থানে যুদ্ধ ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড করতে হয়েছে সেহেতু এই গল্প চিত্রিত করতে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে কর্তৃপক্ষকে। প্রচুর ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ১৯৭৭ সালে তখনকার প্রযুক্তি ব্যবহার করে আন্তঃনাক্ষত্রিক বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলা আসলেই বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল এবং পরিচালক সফলভাবে সেটা করতে পেরেছেনও। বর্তমানের নিখুঁত ইফেক্টের সাথে তুলনা করলে হয়তো এটি অনেক পিছিয়ে থাকবে কিন্তু সে সময়ের জন্য এটি ছিল রীতিমতো এক বিপ্লব।

সিনেমা রিলিজ হবার পর দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়ে এটি দেখতে। সিনেমার শুরুতে যখন পর্দায় বড় হয়ে এসে ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসে ‘A long time ago in a galaxy far, far away’, তখন দর্শকেরা আসলেই পুলকিত হয়

Source: Pinterest

স্টার ওয়ার্স সিরিজের সবগুলো মুভির কাহিনী একটি সামগ্রিক কাহিনীর অধীন। সবগুলো সিনেমা দেখলে পুরো সিরিজের স্বপ্নিল একটি গল্পের স্বাদ অনুধাবন করা যায়। সবগুলো সিনেমার কাহিনী যখন ভেতরে ভেতরে এক প্লটে সাজানো হবে তখন অনন্য এক ভালোলাগা কাজ করবে। সে কাহিনীর খুঁটিনাটি নিয়ে আরো লেখা প্রকাশ করা হবে শীঘ্রই। তার আগে এই মুভিটি দিয়েই শুরু করুন স্টার ওয়ার্স।

May the force be with you

ফিচার ছবি- লুকাস ফিল্ম

Related Articles

Exit mobile version