এক বলে দুই রান দরকার। পুরো বিশ্ব তাকিয়ে আছে দুজন মানুষের দিকে। একদিকে ইংল্যান্ডের বোলার আর্চার আর অন্যদিকে নিউজিল্যান্ডের হার্ডহিটার ব্যাটসম্যান গাপটিল। গাপটিলের দরকার দুই রান আর আর্চারের দরকার উইকেট না হয় ডট বল। বোলিং প্রান্ত থেকে দৌড়ে আসছেন আর্চার, ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে আছেন গাপটিল। পুরো বিশ্ব যেন থমকে গেছে ঐ মুহুর্তে। ক্রিকেটপ্রেমী প্রতিটি মানুষ যেন আর্চার বা গাপটিলের জায়গায় নিজেকে নিয়ে দাঁড় করায়। দুরু দুরু বুকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে। আর্চার বল করে, গাপটিল ব্যাট চালায়; ফিল্ডার থ্রো করে, গাপটিল রান আউট হয়; আর ইংল্যান্ড প্রথমবারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের খাতায় নাম লেখায়।
কথা হচ্ছিলো ২০১৯ বিশ্বকাপের এক মহাকাব্যিক ফাইনাল নিয়ে। এজন্যই হয়তো এটা প্রায়শই দাবী করা হয় যে, অন্য যেকোনো খেলার চাইতে ক্রিকেটের সাহিত্য সবচাইতে বেশি সমৃদ্ধ। যদিও এক্ষেত্রে বেসবলও জোর দাবী রাখে, তবে সন্দেহাতীতভাবে ক্রিকেটকেই এগিয়ে রাখা যায়। এখন মনে প্রশ্ন আসতে পারে- কেন এটি এত সমৃদ্ধ? কারণ হচ্ছে, এটি শুধুমাত্র নির্ধারিত ওভারেরই খেলা নয়, এমনকি এটি দিনব্যাপী ধারাবাহিক খেলাও বটে; কারণ এখানে মৌলিক সরলতা মেনে খেলা হয় যেখানে কৌশল, চাতুর্যতা আর নৈপুণ্যই প্রধান উপজীব্য বিষয়; কারণ হচ্ছে এটা প্রায় সময়ই সামাজিক ইতিহাসের ভেতরের খবর তুলে ধরে (লিঙ্গ আর জাতিগত ভেদাভেদের পাশাপাশি শ্রেণীবিবাদও); কারণ হচ্ছে এটা এমন একটা খেলা যেটার ছক কাটতে হয় মনের ভেতর।
ক্রিকেট নিয়ে এত কথা বলার কারণ একটাই, আর তা হচ্ছে আজকের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুই হচ্ছে ক্রিকেট। তবে সেটা শুধুমাত্র মাঠের ক্রিকেট খেলাকেই কেন্দ্র করে নয়; বরং সাহিত্যে ক্রিকেটের খেলাকে কেন্দ্র করে বলা যায়। আজকের আলোচনায় থাকছে ক্রিকেট সাহিত্য নিয়ে রচিত সেরা দশটি বই, যেগুলো বাছাই করেছে বিখ্যাত দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা।
১. ডেইজ ইন দ্য সান – ন্যাভাইল কার্ডাস
ধারণা করা হয়, আধুনিক ক্রিকেট সাহিত্য লেখা হয়েছে কার্ডাসের হাতেই, কেননা ১৯২০ এর দশকে ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান পত্রিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় আর খ্যাতিমান ক্রিকেট রিপোর্টার ছিলেন তিনি। তর্কসাপেক্ষে হলেও এটা মানতে হবে যে, কার্ডাসই প্রথম ব্যক্তি যিনি খেলোয়াড়দেরকে তাদের খেলার দুনিয়ার বাইরেও বীর আর উপন্যাসের চরিত্রের মতো জনপ্রিয়তা দিয়েছেন। তিনি আরো বিশ্লেষণ করে জানান যে, খেলার ছন্দ এবং খেলোয়াড়ের অনুভূতির সাথে দর্শকদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া খেলার মধ্যে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে। যদিও পরবর্তী বছরগুলোতে কার্ডাসের তত্ত্বগুলোকে বিশিষ্ট পন্ডিত ভুল বলে প্রমাণ করেন আর সে সুবাদেই তার খ্যাতি দুত্যি হারায়; কিন্তু এ কথা স্বীকার করতে হয় যে, কার্ডাসই মূলত ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।
২. অস্ট্রেলিয়া ৫৫ – অ্যালেন রোজ
অ্যালেন রোজ একাধারে বিশিষ্ট কবি, ভ্রমণ লেখক এবং লন্ডন ম্যাগাজিন এর সম্পাদক ছিলেন। তবে এর বাইরে অ্যালেনের আরেকটা পরিচয় ছিল, আর সেটা হচ্ছে অবজারভার পত্রিকার খেলা, বিশেষত ক্রিকেট রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতেন। সে সুবাদেই ইংল্যান্ড জাতীয় দলের সাথে অস্ট্রেলিয়া, সাউথ আফ্রিকা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যান। বই সমতুল্য দৈর্ঘ্যের সফরের রিপোর্টগুলোতে ক্রিকেটের প্রতি তার ভালোবাসা আর ভালোলাগাগুলো প্রকাশ করেন, যেগুলো মুহুর্তেই ঐশ্বর্য ছড়িয়ে দেয়। অস্ট্রেলিয়া ৫৫ বইটিতে ফুটে উঠেছে অ্যালেনের দৃষ্টিতে অ্যাশেজ সিরিজ ব্যাটেল, লেন হ্যাটনের নেতৃর্ত্বদানকারী সফরকারী দল, এবং আয়োজক দেশগুলো সম্পর্কে রোজের অভিব্যক্তি।
এই সিরিজটি খুব বেশি উত্তেজনার সৃষ্টি করে, যেমন- ব্রিসবেনকে ইংল্যান্ড মাতিয়ে রেখেছিল, সিডনি, মেলবোর্ন আর অ্যাডিলেড জয় করে ইংল্যান্ড অ্যাশেজ সিরিজ জিতে নিজেদের ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখেছিল; ইংল্যান্ডের ক্যাপ্টেন লেন হ্যাটনকে গ্রিক পৌরাণিক কাহিনীর কোনো বীরের সাথে তুলনা করা চলে, যিনি কি না দলের বিপর্যয়ে একাই দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে বয়ে আসা ঝড়ের বিপরীতে দাঁড়িয়েছিলেন। ক্রিক ইনফোর গিডিওন হেইয়ের কথাগুলোকে তুলে অ্যালেন রোজ বলেন,
জ্বি হ্যাঁ, এটাই ক্রিকেট; এটাই সেই ক্রিকেটের সাহিত্য।
৩. বিয়োন্ড অ্যা বাউন্ডারি – সিএলআর জেমস
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম একজন চিন্তাবিদ ছিলেন সিএলআর জেমস, যিনি ক্রিকেটের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। জীবনের পুরোটা সময় জুড়ে খেলে, খেলা দেখে এবং ক্রিকেট নিয়ে লিখে তিনি সেসব গল্প শুনিয়েছেন, যেখানে ক্রিকেট সম্পর্কে তার আবেগ উন্মোচিত হয়েছে, সেসব খেলোয়াড়দের কথা বলেছেন যাদের তিনি জানেন এবং ভালোবাসেন, এর পাশাপাশি ক্রিকেট খেলার মনস্তত্ব এবং নান্দনিকতার কথা বলেছেন, এবং এর সাথে জড়িত শ্রেণীবিবাদ, দ্বন্দ্ব এবং রাজনীতির কথাও প্রকাশ করেছেন।
বিয়োন্ড অ্যা বাউন্ডারি এমন একটি রচনা যেখানে শুধুমাত্র ক্রিকেট খেলাই নয়, বরং ক্রিকেটের সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হয়েছে, এবং পাশাপাশি একটা প্রশ্নও সবার জন্যে করা হয়েছে,
তারা ক্রিকেট সম্পর্কে কতটুকু জানেন, নাকি শুধু ক্রিকেটটাকেই জানে?
৪. দ্য আর্ট অফ ক্যাপ্টেন্সি – মাইক ব্রেয়ার্লি
ক্রিকেট খেলায় একজন অধিনায়কের ভূমিকা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধারাবাহিকভাবে মর্যাদা হ্রাস করেছে। পরিসংখ্যান কষার এই যুগে, একজন ব্যাটসম্যান এবং একজন বোলারের গড়পড়তা অবদান বিবেচনা করা যেতেই পারে খেলায় তার ভূমিকা বিশ্লেষণ করে, কিন্তু বিপরীত দিকে একজন অধিনায়কের অবদান মূল্যায়ন করা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু এক থা প্রমাণিত যে, অন্য যেকোনো খেলার চেয়ে ক্রিকেটে একজন অধিনায়কের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আলোচ্য বইটি যে কেবল একজন অধিনায়কের নানা কৌশল, চিন্তাধারা এবং প্রতিকূল অবস্থায় টিকে থাকার মনস্তত্ত্বই বিশ্লেষণ করে না, বরং খেলাটা যে কতটা জটিল, মনস্তাত্ত্বিক এবং কৌশলগত সেটাও প্রমাণ করে।
৫. কনসার্নিং ক্রিকেট – জন আর্লোট
আর্লোট ছিলেন যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের প্রকাশিত কবিদের মধ্যে একজন, তবে পরবর্তীতে তিনি হ্যাম্পশায়ার রেডিওর ক্রিকেট কমেন্টেটরে যোগদান করে ক্রিকেট জগতের একজন কিংবদন্তী লেখকে পরিণত হন। উইলিয়াম হ্যাজলিট, যাকে আর্লোট গুরু মানতেন, তার লেখায় অনুপ্রাণিত হয়েই মূলত ক্রিকেট নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী লেখা লিখেছিলেন জন আর্লোট। ইংল্যান্ড জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ইয়ান বোথাম বলেছিলেন,
তিনি নিজেই ক্রিকেট ছিলেন। তার মতো একজন ধারাভাষ্যকার কখনও হয়নি, আর কখনও হবেও না।
৬. বিয়োন্ড ব্যাট এন্ড বল – ডেভিড ফুট
ডেভিড ফুট ছিলেন গার্ডিয়ানের সবচাইতে যত্নশীল ক্রিকেট বিষয়ক লেখক। এই বইতে জনপ্রিয় এগারোজন খেলোয়াড়ের জীবনী তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন ফুট; তবে তিনি এই এগারোজনের খেলায়াড়ের আড়ালে থাকা ব্যক্তিগত জীবনকে উন্মোচন করেছেন, যেন খেলার মাঠে তাদের কৃতিত্ব অর্জনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনের এক মিশ্রিত উপাখ্যান।
টম রিচার্ডসনের মাধ্যমে ১১ জনের জীবনী শেষ হয়েছে। টম ছিলেন ১৮৯০ দশকের ইংল্যান্ডের সেরা বোলারদের একজন, যিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য এবং সাহসী। অবসর নেয়াটা তার জন্য বেশ কষ্টকর হয়ে উঠেছিল (যদিও বেশিরভাগ পেশাদার খেলোয়াড়দের একই অনুভূতি হয়); টম রিচার্ডসন এই অবসরের পক্ষপাতি ছিলেন না।
৭. দ্য ক্রিকেট ওয়্যার – গিডিওন হেই
টাইমসের মতে, ক্রিকেট নিয়ে সেরা ৫০টি বইয়ের মধ্যে এটি অন্যতম একটি।
১৯৭৭ সালের মে মাসে ক্রিকেট বিশ্ব পরিচিত হয় ৩৯ বছর বয়সী সিডনির এক ব্যবসায়ীর সাথে, যার নাম কেরি প্যাকার; যিনি তার নিজের টিভি ড্রামা ওয়ার্ল্ড সিরিজ এর জন্য ৩৫ জন বাছাই করা আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড়দের সাথে চুক্তি করেছিলেন। এই ক্রিকেট ওয়্যারটা হচ্ছে মাঠের খেলা আর পর্দার খেলার মধ্যকার বিভক্তির চূড়ান্ত মানদণ্ড।
দ্য ক্রিকেট ওয়্যার বইটি যে কেবল এই দুই খেলার উত্তেজনাকর আর দ্বন্দ্বকর মুহুর্তই উপস্থাপন করে তা নয়, বরং এটি উচ্চশ্রেণীর ক্রিকেটপ্রেমী এবং মৃত্যুর আগ অবধি এমনকি মৃত্যুর পরেও অস্ট্রেলিয়ার সেরা একজন ধনীর জীবনীও বিবরণ করে। তার মৃত্যুতে একটা কথা বেশ প্রচলিত হয়েছিল- হয়তো এটাই ক্রিকেটের শেষ এবং হয়তো এরই মাধ্যমে ক্রিকেটের শুরু হলো।
গিডিওন হেই ৩০টিরও অধিক বই লিখেছেন, যার মধ্যে ২০টিই হচ্ছে ক্রিকেট প্রসঙ্গে। আর এই দ্য ক্রিকেট ওয়্যার হচ্ছে ক্রিকেট প্রসঙ্গে তার প্রথম বই, যেটা ছাপা হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। যদিও পরবর্তীতে পরিমার্জন করা হয়েছে।
৮. ওয়ান মোর রান – স্টিফেন চাল্ক
আশ্চর্যজনক হলেও এটাই সত্য যে, ক্রিকেট প্রসঙ্গে এত এত বই লেখা হলেও ক্রিকেটের কোনো একক খেলা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ বই খুব কমই আছে, আর এই বই হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রসিদ্ধ। অফ স্পিনার এবং গল্পপটু বোম্বার ওয়েলসের স্মরণে চাল্ক তার লেখায় নিয়ে এসেছেন ১৯৫৭ সালে শ্যাল্টনহামে গ্লাস্টোশ্যায়ার এবং ইয়র্কশ্যায়ারের মধ্যকার তিনদিনের খেলাকে।
৯. অ্যা কর্নার অফ অ্যা ফরেন ফিল্ড – রামাচন্দ্র গুহা
ভারত বহুকাল যাবত ক্রিকেট বিশ্বের সিন্ডারেলা ছিল: ডন ব্র্যাডমান কখনো পা ফেলেননি সেখানে, না গিয়েছে শীর্ষস্থানীয় কোনো ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়রা। তবে এই ব্যাপারটা সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দিয়েছে আইপিএল, যা এক জাদুকরী প্রভাব বিস্তার করেছে পুরো বিশ্বজুড়ে। স্টেডিয়াম কানায় কানায় পরিপূর্ণ, টিভি দর্শকদের পরিমাণও অত্যধিক, টান টান উত্তেজনা, ধারাভাষ্যকারদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস- এসবের মূলে রয়েছে আইপিএল নামক টুর্নামেন্টটি।
১০. ক্রিকেট: দ্য গেম অফ লাইফ – সিল্ড ব্যারি
- ক্রিকেট রাইটার্স ক্লাব বুক অফ দ্য ইয়ার ২০১৬ এর বিজেতা
- এমসিসি বুক অফ দ্য ইয়ারের প্রতিযোগী
- ক্রিকেট বুক অফ দ্য ইয়ার বাই স্পোর্টস বুক অ্যাওয়ার্ডস এর প্রতিযোগী
সাম্প্রতিককালে ক্রিকেট সম্পর্কিত দশটি বইয়ের মধ্যে এটি নির্দ্বিধায় নিজের জায়গা করে নেবে তা আর বলতে হয় না। তবে এটি আধুনিক ক্লাসিক হিসেবেও স্বীকৃতি পাবে, যদি সম্পাদনাটা আরো সূক্ষ্মভাবে করা হয়ে থাকে। তা সত্ত্বেও এটি দারুণ উপভোগ্য আর বিশ্লেষণধর্মী একটি প্রবন্ধ, কেননা এতে বর্ণিত হয়েছে খেলোয়াড় এবং ক্রিকেট খেলার অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। চল্লিশ বছর ধরে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ লেখক হিসেবে ব্যারি তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা আর ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে ক্রিকেটকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।
ক্রিকেট সম্পর্কে আরও জানতে আজই পড়ুন এই বইগুলো