সুব্রামানিয়াপুরম: কাল্ট ক্লাসিক তামিল ক্রাইম ড্রামা

কিছু কিছু সিনেমা আছে যেগুলো কোনো নির্দিষ্ট একটি ইন্ডাস্ট্রি বা জনরাকে সমৃদ্ধ করে, মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। এসব সিনেমার প্রভাব পরবর্তীকালে ঐ ইন্ডাস্ট্রি বা জনরার সিনেমাগুলোতে দেখা যায়। ২০০৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তামিল পেরিওডিক ক্রাইম ড্রামা সুব্রামানিয়াপুরম এমনই একটি সিনেমা। ক্রাইম জনরায় তামিল ইন্ডাস্ট্রি তথা পুরো ভারতের চলচ্চিত্রেই এর প্রভাব দেখা গিয়েছে। ২০০০ সালের পর পর তামিল নিউ ওয়েভ নামে বাধাধরা রীতিনীতিকে ভাঙার যে চল শুরু হয়; সেটিরও বেশ গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্ভুক্তি এটি, যা অসংখ্য শিল্পীকে অনুপ্রাণিত করেছে হিট সিনেমার শিওর শট ফর্মুলার বেড়াজাল ডিঙাতে, নিজেদের মতো করে গল্প বলতে।

এর আগে কয়েকটি সিনেমায় অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করা মহালিঙ্গম শশীকুমার এ সিনেমার মাধ্যমেই ডিরেক্টর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এর স্ক্রিপ্ট লেখেন তিনি। একটি মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ও করেন। 

পঞ্চপান্ডব; Image Credit : Company Productions

সুব্রামানিয়াপুরম শুরু হয় একটি পয়েন্ট অফ ভিউ শটের মাধ্যমে। স্ট্যাবিলাইজেশন অভাবে ভোগা ক্যামেরা দুয়েকবার গোত্তা খেয়ে এসে পৌঁছায় একটি কারাগারে। পর্দায় ভেসে ওঠে কারাগারটির অবস্থান এবং সময়কাল- মাদুরাই, ২০০৮।

দীর্ঘকাল কয়েদ বাসের পর একজন কয়েদিকে আমরা ছাড়া পেতে দেখি। কিন্তু কারাগারের গেটেই তাকে উপুর্যুপরি ছুরিকাঘাত করা হয়। এ দৃশ্য সেখানে থাকা পুলিশদের হতভম্ব করে দেয়। কেননা, এত লম্বা সময় হাজতে থেকেও এই কয়েদি কারো সাথে দেখা করেনি; কথা পর্যন্ত বলেনি। তার শত্রু কে যে এত বছর বিদ্বেষ পুষে রেখেছে? আর মুক্তি পাওয়ার সাথে সাথেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে? 

ওপেনিং সিকোয়েন্সে ভয়াবহ ছুরিকাঘাত দেখানোর পর শশীকুমার আমাদেরকে নিয়ে যান অতীতে। আশির দশকে মাদুরাইয়েরই সুব্রামানিয়াপুরম নামক জায়গায়। আমরা দেখতে পাই আজহাগার (জাই সম্পত), পারামান (শশীকুমার), কাসি (গাঞ্জা কারুপ্পু), ডোপা (বিচিত্রন) এবং ডুমকা (মারী)-কে। এদের মধ্যে বাকি সবাই শারীরিকভাবে সুস্থ-সবল হলেও ডুমকা ভোগে জটিলতায়। ছোটবেলায় পোলিও সংক্রান্ত জটিলতায় তার একটি পা চিমসে গিয়েছে। কিন্তু শারীরিক বৈকল্য তার পঞ্চপাণ্ডবের যোগ্য সদস্য হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। 

সিনেমার প্রথমভাগ মূলত কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলো স্টাবলিশ করতেই ব্যয় করেন শশীকুমার। এতে সুব্রামানিয়াপুরম নামক এলাকার সামাজিক বৈশিষ্ট্য এবং কাঠামোর একটি চিত্র ফুটে ওঠে আমাদের সামনে। আমরা দেখতে পাই, পঞ্চপাণ্ডবের সকলেই বেকার। তাদের সময় কাটে মদের নেশায় চুর হয়ে আর প্রাক্তন কাউন্সিলর সোমুর বাসার কাছে আড্ডা দিয়ে। সোমুর বাড়িতে তিনি ছাড়াও থাকেন তার ভাই কানুগু (সামুথিরাকানি)। এরা ছাড়া আছেন সোমুর স্ত্রী এবং তার তিন সন্তান। যার মধ্যে বড় জনের নাম তুলসী (সোয়াথি রেড্ডি)। এছাড়া তুলসীর একজন মামাও রয়েছেন সেই সংসারে। 

বন্ধুত্ব আর ভায়োলেন্স; Image Credit: Company Productions

পাঁচ বন্ধুদের মধ্যে বিশেষ করে পারামান আর আজহাগারকে প্রায়শই পুলিশের হাতে পাকড়াও হতে দেখা যায়। তাদের সকল অপকর্মের অভিযোগ কেউ একজন ফোন করে জানিয়ে দেয় পুলিশকে। আর পুলিশও তাদেরকে নিয়ে যায় থানায়। কিন্তু তারা তাদেরকে বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারে না। কেননা, সবসময়ই তাদেরকে বটবৃক্ষের মতো আগলে রাখে সোমু আর কানুগু। ধরা পড়লে সাথে সাথে জামিনের বন্দোবস্ত করে দেন তারা। অর্থাৎ, সরাসরি বলতে গেলে পঞ্চপাণ্ডবকে আমরা বলতে পারি ক্ষমতাসীন দলের পাতি নেতা। এবং দুই ভাই অবতীর্ণ হন তাদের গডফাদার রূপে। এলাকায় প্রভাব বজায় রাখার ক্ষেত্রে কানুগুদের প্রতিপক্ষও রয়েছে। তার সাথে এদের পাওয়ার স্ট্রাগল শুরু হয়। অন্যদিকে, এলাকার অন্যান্য যারা বাসিন্দা রয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই ছাপোষা। নিজেদের দিনাতিপাত নিয়েই তারা ব্যস্ত থাকেন। রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির ব্যাপারে তাদেরকে ব্রতী হতে দেখা যায় না। 

এই যখন অবস্থা, তখন আজহাগার আর তুলসীর মাঝে প্রেমের সূচনা হতে দেখা যায়। পারামান বন্ধুকে এই সম্পর্কে যেতে নিষেধ করে। কিন্তু রোমান্টিক সিনেমার হিরোদের মতো করে আজহাগার বন্ধুর পরামর্শ পায়ে ঠেলে। সিনেমার গল্প যে ভয়াবহ দিকে মোড় নেবে, তার আভাস আমরা পেতে শুরু করি ধীরে ধীরে। স্থানীয় মন্দির কমিটির অনুষ্ঠানে ডাক পান না সোমু। এ আভাস আরো পাকাপোক্ত হয় ইন্টারমিশনের ঠিক আগে আগে। যখন নিজের পার্টির জেলা প্রধানের পদটাও সোমুর হাতছাড়া হয়৷ এজন্য নিজের স্ত্রীর নানা গঞ্জনা সহ্য করতে হয় তাকে। নিজের ভাইয়ের মান-সম্মান রক্ষা করতে এবং তাকে জেলা প্রধানের পদে আসীন করতে বিশদ এক ছক কষে কানুগু। যে ছকের মুখ্য গুঁটি আবার পারামান, আজহাগার এবং কাসি।

ফলে তিন বন্ধুকে একটি হত্যা পরিকল্পনার বাস্তব রূপ দিতে অবতীর্ণ হতে দেখি আমরা। যা পরবর্তীতে আরো গভীর সমস্যার মুখোমুখি করে তাদেরকে। কারণ হঠাৎ করেই তারা আবিষ্কার করে যে, বটের ছায়া সরে গেছে তাদের মাথার উপর থেকে। তিন বন্ধু ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। এই ষড়যন্ত্রের বদলাও তারা নেবে। কিন্তু কীভাবে? 

তাদের বদলা নেওয়ার সিদ্ধান্ত এবং তার ফলাফলের উপর ভিত্তি করেই সুব্রামানিয়াপুরম এগিয়ে যায় ক্লাইম্যাক্সের দিকে। 

সিনেমার সেটে জাই আর শশীকুমার; Image Credit: Company Productions

দৈর্ঘ্য বিবেচনায় সিনেমার প্রথমভাগ দ্বিতীয়ভাগের তুলনায় বড়। এবং সাদা চোখে প্রথম ভাগকে আড়ম্বরহীন বলেও মনে হতে পারে। তবে সিনেমার কাল্ট ক্লাসিক তকমা পাওয়ার জন্যে বা সফলতা অর্জনে উভয় ভাগই সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম ভাগকে আমরা ধরে নিতে পারি পরবর্তীতে যা হবে, তার জন্য মঞ্চ প্রস্তুতের ক্ষেত্র হিসেবে। দ্বিতীয়ার্ধে যেসব ঘটনা ঘটে, সেসব ঘটনা এবং চরিত্রের প্রতি দর্শকের ইমোশন তৈরিতে প্রথমভাগের গুরুত্ব অপরিসীম। এছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব এবং প্রিয় নায়কের সিনেমা মুক্তি উপলক্ষে তামিলদের যে উৎসবমুখরতা, তারা জীবনকে যেভাবে উদযাপন করে; এসবও ফুটে ওঠে এখানে। সাথে থাকে একটা হৃদয়গ্রাহী প্রেমকাহিনী এবং বন্ধুবাৎসল্যও। তাই খানিকটা ধীরগতির হলেও প্রথমার্ধ মনোযোগের সাথে দেখা উচিত। তাহলে দ্বিতীয়ার্ধে সিনেমার পরিপূর্ণ এক্সপেরিয়েন্স গ্রহণ করা যাবে। 

সিনেমার দ্বিতীয়ার্ধে এসে নৃশংসতার ব্যাপারটি মহিমান্বিতরূপে ফুটে ওঠে। সুব্রামানিয়াপুরমের সহজাত পরিবেশ ব্যাহত হয়। আমরা আমাদের পরিচিত চরিত্রসমূহকে নিজেদের সরলতা হারাতে দেখি। সকলের ভেতরে বাস করা জানোয়ার যেন আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে। ফলে একের পর এক প্লট আর কাউন্টার প্লটের ঘাত-প্রতিঘাতের দেখা মেলে। আসে নতুন বটের ছায়া। আর সিনেমার করাল দিকের উপস্থাপনেও শশীকুমার অবিচল। রক্তারক্তি, শিরশ্ছেদ, ঘিঞ্জি গলির ভেতর দিয়ে প্রাণ হাতে নিয়ে দৌঁড়ানো বা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য নায়কোচিত ভঙ্গিতে ছোরা তুলে নেওয়া; এসব তিনি দেখিয়েছেন কোনো রাখঢাক না রেখে। ফলে ক্রাইম জনরার যে পাল্পি ব্যাপারটি, সেটি ফুটে উঠেছে অনুপমভাবে।এদিক থেকে শশীকুমারের কাজে স্করসেজি বা টারেন্টিনোর প্রভাব দৃশ্যমান।

Image Credit: Company Productions

পাল্পি ব্যাপারটি সিনেমার মিউজিকেও সমভাবে উপস্থিত, যার দায়িত্বে ছিলেন জেমস ভাসানথান, যিনি আবার শশীকুমারের শিক্ষক ছিলেন স্কুলে। প্রতিষ্ঠিত কারো কাছে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়ে নিজের মাস্টারের কাছে যান পরিচালক। কাথিরের সিনেম্যাটোগ্রাফিও যোগ্য সঙ্গ দিয়েছে পরিপূর্ণভাবে গল্পের আবহ বিনির্মানে, যা স্টোরিটেলিংয়ে এনেছে প্রগাঢ়তা।

পুরো সিনেমাজুড়েই বাজেট ঘাটতির ব্যাপারটি দৃশ্যমান। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আত্মনিয়োগ এবং ভালোবাসায় এই খামতি কোনো বাধা হতে পারেনি। বরং পেয়েছে কাল্ট ফলোয়িং। ভারতের সবচেয়ে সেরা ক্রাইম ড্রামা বলে বিবেচিত হয় গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর (২০১২)। এটি নির্মাণের সাহস অনুরাগ কাশ্যপ সুব্রামানিয়াপুরম দেখেই পেয়েছিলেন বলে স্বীকার করেছেন। আর এমন সিনেমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে যে সিনেমা, সেটি তো দেখা যায়ই।

This article is in Bangla language. It contains the review of Subramaniapuram (2008) film. Necessary sources are hyperlinked in the article.

Related Articles

Exit mobile version