১
পর্যটন নগরী কক্সবাজার। দৈনন্দিন ব্যস্ততার ভিড়ে সুযোগ পেলেই পর্যটকরা ছুটে আসেন সাগরের হাওয়ায় শরীর-মন চাঙা করতে। সেই কক্সবাজার সৈকতেরই এক পরিছন্ন কর্মী তারা মিয়া। ভোর রাতে প্রকৃতির বুক থেকে মানুষের ফেলা বর্জ্য সংগ্রহ করাই তার কাজ। এরকমই এক ভোরে সৈকতের পাশে থাকা ঝাউবনে সে আবিষ্কার করলো গাছে হেলান দেওয়া এক ব্যক্তিকে।
সমুদ্রের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে, অনেকটা সম্মোহিতের মতোই। পা দুটো সামনে মেলে দেওয়া, আড়াআড়িভাবে পড়ে থাকা পা দুটো ক্রসাকৃতি ধারণ করেছে। ছুতার মিস্ত্রিদের কানের পেছনে গুঁজে থাকা পেন্সিলের মতো তার কানের পেছন থেকেও উঁকি দিচ্ছে একটা সিগারেট। কোলের ওপর পড়ে রয়েছে আরেকটি আধখাওয়া সিগারেট। ছুটি কাটাতে আসা ধোপদুরস্ত কর্পোরেট ব্যক্তিরাও সৈকতে কোট-টাই পরে বালিতে পা মাড়ান না, কিন্তু এ ব্যক্তি তাদেরকেও হার মানিয়েছেন। তারা মিয়া আরেকটু সামনে পা বাড়াতেই অস্বাভাবিকতা টের পেল। তার সামনে কোনো রক্তমাংসের জ্যন্ত মানুষ হেলান দিয়ে আয়েশ করছে না, তার সামনে একটা লাশ পড়ে আছে!
২
মেজর সাইফ হাসান। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে সাসপেন্ড হওয়ার পর বাবার বন্ধু কর্নেল আজহার চৌধুরীর সাথে মিলে গড়ে তোলে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে পরিচালিত এক প্রাইভেট ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি। নাম ‘সিক্রেট শ্যাডো’। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে হলেও বিশ্বের অনেকগুলো বড় শহরেই ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে এর শাখা। ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট, অ্যানালাইসিস উইং আর ট্র্যাক অ্যান্ড ট্রেস উইংসহ বেশ কিছু ডিপার্টমেন্ট একসাথে কাজ করে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ সরকারের আস্থা বাগিয়ে নিয়েছে। আনঅফিশিয়ালি বাংলাদেশের এসপিওনাজ কার্যক্রমও পরিচালনা করে এই সংগঠন।
৩
প্রধানমন্ত্রির কক্সবাজার সফরের মাত্র এক সপ্তাহ আগে সৈকতে পড়ে থাকা লাশের কারণে বেশ হইচই পড়ে গেল নিরাপত্তাকর্মীদের মধ্যে। হত্যা নাকি আত্মহত্যা, তা নিয়ে ঘাঁটতেই বের হয়ে এলো আরও অস্বাভাবিক কিছু জিনিস।
লাশের গায়ে থাকা অনেকদিনের পুরনো ফর্মাল কাপড়চোপড় থেকে খুব সাবধানে কেউ তুলে ফেলেছে। প্যান্টের গোপন পকেট থেকে পাওয়া গেল ছোট্ট একটা কাগজ। কাগজে ফার্সি ভাষায় লেখা, ‘তামাম শুদ’! এই তামাম শুদের অর্থ খুঁজে বের করতে গিয়েই খুন হতে হলো ডিবি অফিসার জাহিদকে। টনক নড়ে উঠলো এনএসআই-এর, কক্সবাজারে পর পর দুটো খুনের কারণ খুঁজতে পাঠানো হলো অফিসার আযীনকে। নিজ হোটেলের সামনে জাহিদের খুন হওয়ার পর মাঠে নেমে পড়লো সাইফ হাসানও। কে জানতো সামান্য কেঁচো হিসেবে দেখা সৈকতের লাশ হয়ে উঠবে কেউটে সাপ?
৪
১ ডিসেম্বর, ১৯৪৮
সমারটন পার্ক সৈকত, অ্যাডিলেইড, অস্ট্রেলিয়া
অ্যাডিলেইড পুলিশের কাছে ফোন এলো সৈকতে এক ব্যক্তির লাশ পড়ে আছে। সৈকতের দিকে চেয়ে থাকা সেই সম্মোহনী দৃষ্টি। আড়াআড়ি ভাজ করে রাখা পা, কানের পেছনে গুঁজে রয়েছে সিগারেট। লেবেলহীন জামা-কাপড় থেকে লাশের কোন পরিচয়ই বের করতে পারলো না অস্ট্রেলীয় পুলিশ। পকেট থেকে দুটো টিকিটের সাথে বের হলো কোনো বই থেকে ছিঁড়ে নেওয়া একটুকরো কাগজ। কাগজে প্রিন্ট করে লেখা রয়েছে, “Tamam Shud”।
৭০ বছর আগের সেই অমীমাংসিত রহস্যের সাথে বাংলাদেশের এই রহস্যের সম্পর্ক কোথায়? ফারসি ভাষার ‘তামাম শুদ’ বা ‘দ্য এন্ড’-ই বা কী নির্দেশ করছে?
প্রত্যেক ঘটনার পেছনে রয়েছে গোপন কোনো দলের গভীর ষড়যন্ত্র, তারা চায় সমগ্র পৃথিবীর ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ হাতের মুঠোয় পেতে। আর তার জন্য তারা হন্যে হয়ে খুঁজে ফেরে গোপন কোনো বস্তু, যার সাথে জড়িয়ে রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন কোনো ঘটনা। মূলধারার হিস্ট্রিকাল থ্রিলারের এই ধাঁচ থেকে বের হতে পারেনি আবুল ফাতাহ-এর ‘দ্য এন্ড’-ও। যদিও লেখক কোনো কাল্পনিক তত্ত্বের আশ্রয় নেননি, গল্পের কেন্দ্র সেই ‘তামাম শুদ’ বাস্তব পৃথিবীরই অমীমাংসিত একটি রহস্য, আর লেখকের মুন্সিয়ানার পরিচয় মেলে ঠিক এখানটাতেই।
৭০ বছর আগের সমারটন বীচে পাওয়া অজ্ঞাতব্যাক্তির লাশের পরিচয় আজও খুঁজে পায়নি অস্ট্রেলীয় পুলিশ, তাই ব্যক্তি পরিচিত হয়ে উঠেছেন ‘সমারটন ম্যান’ নামে, আর মামলার নাম বিখ্যাত হয়েছে ‘তামাম শুদ’ কেস হিসেবে। ফার্সি ভাষায় তামাম শুদের অর্থ ‘দ্য এন্ড’, আর তাই বইয়ের নাম হিসেবে এটিই বেছে নিয়েছেন লেখক। কিন্তু কী এই তামাম শুদ?
সমারটন ম্যানের পকেট থেকে পাওয়া ছেড়া কাগজ মূলত মধ্যযুগীয় কবি ও দার্শনিক ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াত-এর এক দুর্লভ সংস্করণের শেষ পৃষ্ঠা থেকে ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে। আর বইয়ের শেষে ‘সমাপ্ত’ হিসেবে লেখা ‘তামাম শুদ’-ই স্থান পেয়েছে তার পকেটে। যে বইটি থেকে ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে তা খুঁজে পাওয়ার পর আবিষ্কার হলো বইয়ের পেছনে কে যেন এলোমেলোভাবে কিছু ইংরেজি অক্ষর লিখে রেখেছে।
এটি কি কোনো সাংকেতিক কোড? সমারটন ম্যান কি কোনো গুপ্তচর ছিলেন? এটি কি কোনো হত্যা ছিল? নাকি আত্মহত্যা? এই সমারটন ম্যানের পরিচয় কী কিংবা কীভাবে তিনি মারা গেলেন তা বের করতেও ব্যর্থ হয়েছে অস্ট্রেলীয় পুলিশ। এমনকি শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে জনগণ আর বিশেষজ্ঞদের কাছে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন এই বিশেষ কোডের অর্থ খুঁজে বের করার জন্য। তবে গত ৭০ বছরে এর অর্থ আজও পর্যন্ত বের করতে পারেনি কেউই।
সমারটন ম্যানের এই অমীমাংসিত রহস্যের উপর কেন্দ্র করেই গল্প দাঁড় করিয়েছেন আবুল ফাতাহ। থ্রিলারের শুরুর দিকে গল্প ধীরে ধীরে এগোলেও কিছুদূর যাওয়ার পর খুব দ্রুতগতিতেই ছুটতে শুরু করে ঘটনার দৌড়। গল্পের মূল নায়ক হিসেবে সাইফ হাসানকে অনেকটা অজেয় হিসেবেই তুলে ধরা হয়েছে। তবে সবচেয়ে দৃষ্টিকটু জিনিসটি সম্ভবত আযীন খানের চরিত্রায়ন। সাইফ খানের সহকারী হিসেবে এই এনএসআই এজেন্টের আচরণ অনেকটাই অপরিপক্ব। তবে উল্টোদিকে সাইফের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কুরিয়ার অফিসের কেরানী থেকে গুপ্তঘাতক হওয়া গুস্তাভ অস্ত্রোভস্কি ছিল যথেষ্ট পরিণত।
থ্রিলারের একটি ছোটখাট খুঁত সম্ভবত জাহিদের কাছে থাকা ‘তামাম শুদ’ লেখা কাগজটি। সাইফ পরবর্তীতে থানায় কাগজটি জাহিদ তাকে দেখিয়েছিল বললেও জাহিদ তাকে কাগজটি দেখায়নি, এমনকি কাগজটি যে জাহিদের কাছেই ছিল, তা সাইফের জানার কথা নয়। এটি ছাড়া থ্রিলারের শেষে রহস্য ছাড়াতে গিয়ে গল্পের প্লটের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক বের করার জোরালো প্রচেষ্টা থেকে গেছে লেখকের ব্যাখ্যায়।
তবে হিস্ট্রিকাল থ্রিলার হিসেবে ‘দ্য এন্ড’ যথেষ্ট সফল। সম্পূর্ণ গল্পচ্ছলেই লেখক ইতিহাস বলে গিয়েছেন, মেদহীন ইতিহাস পাঠকের জন্য ক্লান্তিকর হয়ে ওঠেনি।
থ্রিলারের শেষে মূল ‘তামাম শুদ কেস’-এর ছবিগুলোও বইটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। সামান্য কিছু বানান ভুল ছাড়া বইয়ের ব্যাকরণগত দিক প্রায় নিখুঁত। বইয়ের প্রচ্ছদও লেখকের আরেকটি গুণের কথা জানান দেয়।
বইয়ের নাম: দ্য এন্ড
লেখক: আবুল ফাতাহ
জঁরা: হিস্ট্রিকাল থ্রিলার
প্রকাশক: রোদেলা প্রকাশনী
প্রকাশকাল: একুশে বইমেলা ২০১৮
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৩১৯
মুদ্রণমূল্য: ৩৮০ টাকা
অনলাইনে বইটি কিনতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন এই লিঙ্কে: দ্য এন্ড