কলকাতা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির একটি বড় নাম সৃজিত মুখোপাধ্যায়। অটোগ্রাফ, বাইশে শ্রাবণ, হেমলক সোসাইটি, মিশর রহস্য, জাতিস্মর– বক্সঅফিস কাঁপানো এতসব সিনেমার নেপথ্যে যে মানুষটি তার কিন্তু আরো একটি অদ্ভুত সৃষ্টি আছে। সেটির কথা আমরা খুব একটা শুনি না। সে সিনেমাটি হয়তো বক্সঅফিসে সাড়া ফেলতে পারেনি, কিন্তু যে কজন মানুষ সেটি দেখেছিল তাদের চিন্তায় দারুণভাবে আলোড়ন তুলেছিল। সিনেমাটির নাম নির্বাক।
পরীক্ষামূলক তো বটেই। পাশাপাশি অনেক নতুন বিষয়ের সাথে সৃজিত আমাদের পরিচয় করান। প্রথম দেখায় বোঝা যায় না কী হচ্ছে না হচ্ছে। বুঝে উঠতে গিয়েই যেন শেষ দৃশ্য এসে পড়ে। দ্বিতীয়বার দেখার সময় কিছুটা পরিষ্কার হতে থাকে পরিচালকের সাজিয়ে দেয়া গল্পগুলো। তৃতীয়বারের দেখায় ভালো না বেসে উপায় থাকে না সৃজিতের নতুন ঢঙের নতুন গল্প বলা।
চারটি দিকের গল্প নিয়ে নির্মিত নির্বাক। একজন পুরুষ, একটি গাছ, একটি নেড়ি কুকুর এবং একটি লাশের গল্প। চারটিই প্রেমের গল্প এবং প্রতিটি গল্পেই একজন করে চরিত্র থাকে যে কথা বলতে পারে না। পরিচালক সৃজিত মুখার্জীর মাথায় গল্পগুলো দানা বাঁধতে শুরু করে আমেরিকার ফ্লোরিডায় অবস্থিত বিখ্যাত চিত্রকর সালভাদর দালির জাদুঘর দি দালি মিউজিয়ামে। দালির অ্যান্থ্রোপোমরফিক সুররিয়ালিজম সিরিজের একটি ছবি দেখে সৃজিতের মাথায় এক অদ্ভুৎ চিন্তা খেলে গেল। ছবিটি আদতে গাছের হলেও দূর থেকে দেখলে তাকে মানুষের মুখের অবয়ব বলেও মনে হয়।
মানুষের অবয়বের এই গাছটি যদি মানুষের মতো করে ভাবতো, মানুষের মতো করে ভাবনাগুলো প্রকাশ করতো, মানুষের মতো প্রেমে পড়তো, কামুক হতো কিংবা অভিমান করতে পারতো তাহলে কেমন হতো? গাছ জীবন্ত, গাছ ব্যথা পায়, গাছ অনুভূতিতে সাড়া দেয়, বলে গিয়েছেন বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু। কিন্তু গাছের প্রেম আছে কিনা তা কি কেউ বলতে পারে?
সৃজিত প্রেমে পড়া একটি গাছের গল্প তুলে এনেছেন বড়পর্দায়। এটি পার্কের রাস্তার পাশের আর দশটি গাছের মতোই। তার ছায়ায় একটি বেঞ্চ পাতা। সেই বেঞ্চে প্রায়ই এক মেয়ে এসে বসে। গাছটির ভালো লাগতে শুরু করে তাকে। গাছটির সাথে মেয়েটির কোনো কথোপকথন নেই, কোনো শব্দের চালাচালি নেই। কিন্তু গাছটি ঠিকই তার প্রেম ব্যক্ত করে, প্রেমিকার কাঁধে হাত রাখে নিজস্ব ভঙ্গিতে, প্রেমিকাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। গাছের স্বপ্নের সেই দৃশ্যটি নির্বাক সিনেমার একটি দুর্দান্ত দৃশ্যায়ন। পার্কের গার্ডের বাঁশির শব্দে সুখস্বপ্নে ব্যাঘাত ঘটে গাছটির। উত্তেজনায় ঘাম দেখা যায় তার পাতায় পাতায়।
প্রেমিকার ভূমিকায় অভিনয় করেন সুস্মিতা সেন। দীর্ঘদিনের ক্যারিয়ারে প্রথম বাংলা সিনেমায় দেখা যায় তাকে। মূলত তাকে ঘিরেই আবর্তিত হতে থাকে গল্প, চারটি গল্পের মিলন হয় তার চরিত্রের মাধ্যমে। সুস্মিতা সেনের চরিত্রটির কোনো নাম দেননি সৃজিত। পুরো সিনেমা জুড়ে নাম উহ্য রেখে ‘কাস্ট ক্রেডিট’-এ সুস্মিতা সেনের নামের পাশে লেখা থাকে শুধু ‘ওম্যান’।
ওম্যানের মূল যে প্রেমিক- রাহুল সেনগুপ্ত, সে ভূমিকায় আমরা দেখতে পাব যীশু সেনগুপ্তকে। প্রেমিকের সাথে তার বহুদিনের একটা ঝগড়া চলতে থাকে। রাহুল চায় তাকে বোম্বে নিয়ে যেতে, কিন্তু সে তার শহর ছেড়ে, নিজের পাড়া ছেড়ে, পার্ক কিংবা ঐ গাছটাকে ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি না।
রাহুল চলে আসে কলকাতায়। সে রাহুলকে নিয়ে হাজির হয় সেই পার্কে, পরিচিত সেই বেঞ্চে বসে বোম্বে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে আলাপ করতে। কিন্তু সেই গাছটি নানাভাবে যন্ত্রণা দিতে থাকে রাহুলকে। তবু এক পর্যায়ে যখন মেয়েটি তার প্রেমিকের সব কথা মেনে নিয়ে কলকাতা ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়, খুব কষ্ট হয় গাছটির। তার কান্না বৃষ্টি হয়ে ধরা দেয় আমাদের সামনে। ভীষণ অভিমানে আত্মহত্যা করে বসে গাছটি। আত্মহত্যার উপলক্ষ্য এনে দেয় শেষ রাতের ঝড়।
তৃতীয় গল্পটি কুকুরী, তার মালিক এবং মালিকের মেয়ে বন্ধুর ত্রিকোণ প্রেমের। সৃজিত গল্পটি ধার করেছিলেন ইন্দ্রদ্বীপ দাসগুপ্তের ‘পায়েস’ নামের কুকুরীর কাছ থেকে। সে কুকুরী তার মালিকের প্রতি ভীষণ রকমের অধিকারিক হয়ে উঠেছিল। সৃজিত এবং কবি শ্রীজাত নির্বাকের গল্পগুলো নিয়ে আলোচনা করছিলেন ইন্দ্রদ্বীপ দাশগুপ্তের বাড়িতে। সেখানে কারো কোনো মনোযোগ না পেয়ে ভীষণ ক্ষীপ্ত হয়ে গিয়েছিল পায়েস। এখান থেকেই অনুপ্রেরণা নিয়ে গড়ে উঠেছে সিনেমার তৃতীয় গল্পটি।
২২শে শ্রাবণ-এর শুটিংয়ের সময় চতুর্থ গল্পটি মাথায় আসে সৃজিতের। ‘একবার বল’ গানে একটি দৃশ্য ছিল প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায়ের, মর্গে। সেই দৃশ্য শুট করতে করতে সৃজিতের মনে হয়, মর্গের ঘরটা একটা বাড়ি আর প্রতিটি লাশের ড্রয়ার একেকটা করে ফ্লাট, সেখানে একেকটা পরিবার থাকে। সেখানে বিয়ে হয়, হানিমুন হয়, নতুন নতুন স্বপ্নেরা ভিড় করে। এ গল্পটিতে ঋত্বিক চক্রবর্তীর অভিনয় বহুদিন দাগ কেটে থাকবে দর্শকের হৃদয়ে।
সৃজিত সিনেমাটিকে উৎসর্গ করেছেন সালভাদর দালির প্রতি। যেমনটি তিনি বলেছিলেন, দালির আঁকা গাছের ছবিটি দেখেই গল্পের বুনট বাঁধতে শুরু করে তার মাথায়। কিন্তু সেই দালিকেই আবার হাজির করেছেন বড়পর্দায়। নির্বাক-এর প্রথম গল্পে আমরা যে চরিত্রটি দেখতে পাই, স্যামসন গোমেজ, তার সম্পূর্ণটাই যেন সালভাদর দালির ব্যক্তিজীবনের একটি বিশেষ দিককে ঘিরে। দালির আত্মজীবনী ‘দ্য সিক্রেট লাইফ অব সালভাদোর দালি’তে দালি নিজেকে ঠিক এভাবেই ধরা দেন। স্যামসন গোমেজের ভূমিকায় সম্ভবত জীবনের সেরা অভিনয় করে ফেলেছেন অঞ্জন দত্ত।
স্যামসন গোমেজ ‘নার্সিটিস্টিক পারসোনালিটি ডিজঅর্ডারে’ ভোগা একজন মানুষ। নিজের সাথেই তার যত ভালোবাসাবাসি। আয়নায় নিজের সাথে ভাব বিনিময় করেন, নিজের সাথে প্রেম করেন, আবার তার ভেতরের আমিটার সাথে সঙ্গমেও লিপ্ত হন।
নামটি যেমন নির্বাক সিনেমাটিতে কথোপকথন তাই খুবই সামান্য। শব্দের অযথা অপব্যয়ের বদলে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ব্যবহার করা হয়েছে নানান ঢঙে। নীল দত্তের আয়োজন সেসব। তাছাড়া শেষ গল্পটিতে পুরাতন কিছু হিন্দী গান বাজতে শোনা যায়। ঋত্বিক চক্রবর্তীর ভেতরের কথাগুলোই গান হয়ে বেরিয়েছে যেন।
কলকাতার মানুষের সিনেমারূচি সৃজিত-গৌতম ঘোষ-কৌশিক প্রভৃতি পরিচালকের হাত ধরে খানিকটা এগিয়ে গেলেও নির্বাকের মতো সিনেমাকে ভালোভাবে নিতে পারেননি তারা। তাই সৃজিতের সিনেমাগুলোর মাঝে শুধু এই নির্বাকেই ফ্লপ তকমাটি লেগে যায়।
নির্বাক নতুন চিন্তার স্ফুরণ। তাকে সিনেমার বড়পর্দায় সাজিয়ে দেবার পরীক্ষায় সফল হয়েছেন পরিচালক এবং তার কুশলীরা। এক্ষেত্রে অবশ্যই ডিরেক্টর অব ফটোগ্রাফি সৌমিক হালদারের নামটি চলে আসে। কুকুরী বিঙ্গি, যার আসল নাম চি চি, তার ভাব এত চমৎকারভাবে ক্যামেরাবন্দী করায় বাহবা পাবেন সৌমিক। সাথে সাথে টাইটেলের শ্যাডোগ্রাফি দর্শকের মনে থাকবে বহুদিন।
খানিক নেতিবাচকতাও থেকে যায়। গাড়ি দূর্ঘটনায় মারা যাওয়া মর্গের লাশ কেন এত পরিপাটি, সুশ্রী হবে? কেন ঝড়ের পরে ভেঙে যাওয়া গাছটির এমন দশা হবে? অঞ্জন দত্ত এবং ঋত্বিকের দারুণ অভিনয়ের সাথে সুস্মিতার দূর্বল বাংলা উচ্চারণ যেন ভীষণ খাপছাড়া।
কলকাতার সিনেমা হিসেবে নতুন এবং একটি বড় পদক্ষেপ নির্বাক। ভালো-খারাপ দর্শকের নিজের কাছে, তবুও এমন বাংলা সিনেমা যে আগে তৈরি হয়নি তা নির্দিধায় বলা যায়।
ফিচার ছবি- SVF