বাংলাদেশের অজানা কিছু গবেষণার গল্প

“এই যে মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে, এটাই সায়েন্স।” সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর কল্যাণে এই কথা আপনি হয়তো একাধিকবার শুনে থাকবেন। “বিজ্ঞান কী?” এরূপ প্রশ্নের জবাবে এরকম কথা শুনে আপনার হাস্যরসের উদ্রেক হতেই পারে। কিন্তু আপনাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, “বিজ্ঞানের সংজ্ঞা কী? বিজ্ঞান বলতে আপনি কী বোঝেন?”, সেক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে একটু বেকায়দায় পড়লেও অনায়াসেই আপনি পরের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিতে পারবেন। “বিজ্ঞান মানে হলো গণিতের সব মজার ধাঁধা। বিজ্ঞান মানে বজ্জাত রোবট কিংবা এলিয়েন… বিজ্ঞান মানে মহাকাশ, কয়েক আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্র, আপেক্ষিকতা তত্ত্ব।” আমাদের অনেকের কাছে বিজ্ঞান মানে এগুলোই। এগুলো বিজ্ঞানের অংশ বটে, কিন্তু এগুলো বাদ দিয়েও বিজ্ঞানের জীবনঘনিষ্ঠ একটা দিক আছে, ‘মানুষের বিজ্ঞান’। পোশাকি ভাষায় যা আমাদের কাছে ‘পাবলিক হেলথ’ কিংবা ‘জনস্বাস্থ্য’ নামে পরিচিত। এ বিষয়ে যেন আমরা সহজে ভাবতেই চাই না।

ভাইরাস, জীবাণুর আক্রমণ, রোগবালাই— এগুলোও যে ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে, তা করোনাভাইরাস আসার ফলে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি আমরা। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা উঠে-পড়ে লেগেছেন এর পেছনে। করোনাভাইরাস তো বটেই, অন্য সব রোগের জীবাণু নিয়েও গবেষণা চলছে বিস্তর। আশার কথা হলো, আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরাও জনস্বাস্থ্যের এমন মারাত্মক কিছু সমস্যার দারুণ সব সমাধান দিয়েছেন দেশের গবেষণাগারে বসেই। কিন্তু এসব সম্বন্ধে আমাদের খুব একটা জানাশোনা নেই বললেই চলে। দেশের অজানা এসব গবেষণার গল্প নিয়েই লেখক হাসান উজ-জামান শ্যামল লিখেছেন তার প্রথম বই ‘এটাই সায়েন্স: বাংলাদেশের অজানা কিছু গবেষণার গল্প‘। তবে লেখক জনস্বাস্থ্যের কেবল একটি দিক ‘পরিষ্কার পানি ও পয়নিষ্কাশন’ এ বিষয়ের যুগান্তকারী সব গবেষণা নিয়েই সাজিয়েছেন তার বই।

লেখক নিজে একজন অণুজীববিজ্ঞান ও জনস্বাস্থ্যের গবেষক। এজন্য বোধহয় গবেষণার এসব কাঠখোট্টা ব্যাপার গল্পাকারে বলতে তিনি শতভাগ মুনশিয়ানা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন।

মহামারি কলেরা পুরো বিশ্বের ন্যায় আমাদের দেশবাসীকেও ভুগিয়েছে একসময়। কিন্তু এখন অণুজীববিজ্ঞানের ক্লাসরুম বা গবেষণাগারের বাইরে এ রোগের নাম খুব একটা শোনা যায় না। তার মানে এই না যে কলেরা দেশ থেকে একদম বিলুপ্ত হয়ে গেছে। দেশে অবস্থিত বিশ্বমানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর’বিতে কলেরাসহ নানা বিষয়ের দারুণ সব গবেষণা হয়ে আসছে কয়েক যুগ ধরেই। এই গবেষণাগারে বসেই বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন— দেশে কবে কলেরা আঘাত হানতে পারে তার একটা পূর্বাভাস তারা দিয়ে দিতে পারেন। কলেরার প্রকোপ যখন হয়, তখন আশ্চর্যজনকভাবে বঙ্গোপসাগরে শ্যাওলার পরিমাণও বেড়ে যায়। শ্যাওলাতে যে সালোকসংশ্লেষণ হচ্ছে, সেটা আবার স্যাটেলাইট থেকেই শনাক্ত করা যায়। এভাবে বিজ্ঞানীরা শুধুমাত্র গবেষণাগারে বসেই কলেরার বিপদসংকেত দেওয়ার একটা পদ্ধতি দাঁড়া করিয়ে ফেললেন। ফলে কলেরার প্রকোপ দেখা দেওয়ার আগেই যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে এর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো যায়।

স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কলেরার বিস্তার সম্পর্কে আগাম একটি ধারণা পাওয়া যায়; Image Source: scientificamerican.com

শুধু তা-ই না, দেশের বিজ্ঞানীরা ক্রমাগত গবেষণার মাধ্যমে একসময় দেখলেন ‘কোপিপড’ নামক এক প্রাণীর দেহে অবস্থান করতে পারে কলেরার জীবাণু। ফিল্টার প্রক্রিয়ার যে কলেরার জীবাণু প্রতিরোধ করা যায় না, সে কিনা বাস করে তুলনামূলক বড় আকারের কোপিপডের দেহে! বিজ্ঞানীরা খাবার পানি সংগ্রহের সময় পরিষ্কার জীবাণুমুক্ত এক টুকরা কাপড় দিয়ে তা ছেঁকে নিতে বললেন মানুষকে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে এ প্রক্রিয়া ব্যবহারে কলেরায় মৃত্যুর হার অর্ধেকে নেমে এলো। এখন এক টুকরা পুরনো শাড়ির আঁচল দিয়েই গ্রামবাসী কলেরাকে দমিয়ে দিতে পারে!

সমাধানটা খুবই সাদামাটা দেখালেও এর বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য অনেক। সাধারণত জনস্বাস্থ্যের কোনো বিষয়ে পরিবর্তন সহজে সাধারণ মানুষ গ্রহণ করতে চায় না। যেমন: পানি ফুটিয়ে পান করা, গভীর নলকূপের পানি পান করা— এমন বিষয়গুলো মানুষ যতটা না সহজে গ্রহণ করেছিল, এই নিতান্ত সাধারণ শাড়ির আঁচল পদ্ধতি মানুষ মন থেকেই গ্রহণ করেছিল। ফলে কলেরায় মৃত্যুহার কমে গিয়েছিল অনেকাংশেই।

এক টুকরা পুরনো শাড়ির আঁচল দিয়ে রুখে দেওয়া যেতে পারে কলেরার জীবাণুকে; Image Source: Dr. Anwar Huq/fic.nih.gov

দেশের মাটিতে বসে দেশের লোকজনের মনস্তত্ত্বকে বিশ্লেষণ করে এমন গবেষণা সত্যিই অনেক বড় মাইলফলক। দেশের বিজ্ঞানীদের অভিনব সব গবেষণার গল্প লেখক খুব সাবলীলভাবেই তুলে ধরেছেন পাঠকের কাছে। পাঠক গল্পের মোহে হারিয়ে গিয়ে বুঝতেই পারবেন না যে— তিনি শুধু গল্পই শোনেননি, তিনি আসলে গুটিকয়েক আস্ত গবেষণাপত্রই পড়ে ফেলেছেন! কেননা, প্রত্যেকটি গল্পের বিপরীতে লেখক হাজির করেছেন একাধিক গবেষণাপত্রের রেফারেন্স, এবং সেগুলোর উৎসও উল্লেখ করেছেন অধ্যায় শেষে। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক বইয়ে এ এক অনন্য সংযোজন করেছেন লেখক হাসান উজ-জামান শ্যামল।

এভাবে লেখক দেখিয়েছেন, দেশের বিজ্ঞানীদের বিচক্ষণতায় রোহিঙ্গা শিবিরে কলেরার মতো মহামারি এখনো প্রবেশের সুযোগ পায়নি। বেঁচে গিয়েছে হাজার হাজার প্রাণ। অথচ বিশ্বের শরণার্থী শিবিরগুলোতে কলেরা মহামারি যেন এক অতি সাধারণ বিষয়। কলেরা থেকে বাঁচতে বিজ্ঞানীরা যখন নলকূপের পানি খাওয়ার পরামর্শ দিলেন, ঠিক তখনই দেখা দিল আরেক সমস্যা। আর্সেনিকের বিষে নীল হয়ে প্রতি বছর মারা যেত লাগল হাজার হাজার মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানীরা ক্রমাগত গবেষণা চালিয়ে গেলেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় চললো এই গবেষণা। দেশব্যাপী পানিশুমারিসহ এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন বিজ্ঞানীরা যার ফলে পানি দূষণ ও আর্সেনিক সমস্যার দারুণ সব সমাধান বের হয়ে গেল।

লেখকের গল্প বলার ঢঙ মধুর ও প্রাঞ্জল। মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ এসব ব্যাপারে সমাধান দেওয়া যেন কোনো রহস্যের সমাধান করার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এদিক দিয়ে বইটিকে বিজ্ঞান থ্রিলার বললেও অত্যুক্তি করা হবে না একটুও।

লেখক ও গবেষক হাসান উজ-জামান শ্যামল; Image Source: Hassan Uz Zaman Shamol/facebook

জনস্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণায় এক বিশেষ দিক হলো- শুধু গবেষণাগারেই এর শেষ হয় না। বরং গবেষণা শুরু হয় গবেষণাগারে, যার শেষ হয় হাটের মাঝে, জনমানুষের ভীড়ে। মানুষের মনস্তত্ত্ব বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক বড় একটি বিষয় এখানে। দেশের গবেষকরা লোকজনের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে ‘ট্রিগারিং’ মেথড প্রয়োগ করে যেভাবে লোকজনের এ বদ-অভ্যাসকে বদলে দিলেন— এ ঘটনা শুধু নিতান্তই সরল না বরং মজারও। গবেষকদের জন্য এজন্য কোনো নীতিবাক্য, যেমন: খোলা স্থানে মলত্যাগ করলে এই ক্ষতি হবে, এটা করা যাবে না— এসব কিছুই বলার দরকার পড়েনি! পরবর্তীতে পয়নিষ্কাশন ও বিশুদ্ধ পানির প্রাপ্যতা নিয়ে আরো বিস্তর গবেষণা করা সম্ভব হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে।

এমন সব চমকপ্রদ গবেষণার গল্প নিয়ে ‘এটাই সায়েন্স: বাংলাদেশের অজানা কিছু গবেষণার গল্প’ বইটি সাজিয়েছেন তরুণ এ লেখক। জনস্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ এসব গবেষণার গল্প ভাবিয়ে তুলবে পাঠককে। পাঠকের হৃদয়ে দেশের গবেষক ও বিজ্ঞানীদের প্রতি তৈরি হবে আস্থা ও ভালোবাসার এক জায়গা।

প্রসঙ্গক্রমে করোনাভাইরাস সম্পর্কেও কিছু আলোচনা উঠে এসেছে বইতে। শুধুমাত্র এই ভাইরাস সম্পর্কে সঠিক সংবাদ জনগণের কাছে পৌঁছানোর জন্য কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বেঁচে গিয়েছিল হাজার হাজার মানুষের প্রাণ- সেই ঘটনাও উল্লেখ করেছেন লেখক। অথচ টিভির খবর শুনে সঠিক খবর না পাওয়ায় আরেকটি অঞ্চলেই বহু প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।

আমাদের দেশেও বিভিন্ন সময়ে দেখা যায় সংবাদমাধ্যমগুলো একটু প্রচার-প্রসারের জন্য বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে চটকদার নানা শিরোনামে খবর পরিবেশন করে। এমন সব বিষয়ে গবেষণাপত্রগুলো না পড়েই চটকদার কোনো সংবাদ পরিবেশন যে জনস্বাস্থ্যের জন্য মোটেও সুখকর কিছু নয়-  লেখক এ বিষয়টি উদাহরণ দিয়ে খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বইয়ে।

বইয়ের শেষাংশে লেখক বিজ্ঞান সম্পর্কে জানার জন্য সবচেয়ে বিশুদ্ধ মাধ্যম গবেষণাপত্র নিয়ে সংক্ষেপে সাবলীল ভাষায় আলোচনা করেছেন। গবেষণাপত্র কেমন হতে হয়, পিয়ার রিভিউ কী- এসব বিষয়েরও সরস উপস্থাপন করেছেন লেখক। সব মিলিয়ে বিজ্ঞান অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য আদর্শ একটি বই ‘এটাই সায়েন্স: বাংলাদেশের অজানা কিছু গবেষণার গল্প’।

সংক্ষিপ্ত বই-পরিচিতি

বই: এটাই সায়েন্স: বাংলাদেশের অজানা কিছু গবেষণার গল্প
লেখক: হাসান উজ-জামান শ্যামল
প্রকাশনী: অধ্যয়ন
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১৬০
মুদ্রিত মূল্য: ৩০০ টাকা

Language: Bangla

Topic: This article is a book review on 'Etai Science: Bangladesher Ojana Kichu Gobeshonar Golpo'.

Featured Image Source: tamralipi.com

Related Articles

Exit mobile version