ইতিহাস নিয়ে কখনোই মানুষের আগ্রহের কমতি ছিল না। ইতিহাসকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে অসংখ্য বই, তৈরি হয়েছে অসংখ্য চলচ্চিত্র। প্রচার হয়েছে অনেক টিভি সিরিজ। সম্প্রতি এই দিকটি বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে। দেখে নেওয়া যাক সেরা ১০টি ইতিহাসভিত্তিক টিভি সিরিজের কাহিনী আর তাদের ঐতিহাসিক সত্যের পরিমাণ।
রোম (২০০৫-২০০৭)
সিজার, ক্লিওপেট্রা, অক্টাভিয়াস কিংবা মার্ক অ্যান্টনির মতো বিখ্যাত ও প্রভাবশালী চরিত্রের উপস্থিতি থাকলেও Rome সিরিজে মূলত উঠে এসেছে লুসিয়াস ভোরেনিয়াস এবং টাইটাস পুল্লো নামক দুই রোমান সৈন্যের অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী। এর একজন নির্মাতার মতে, “সিরিজটি শুধু আমাদের বইয়ের ইতিহাসের প্রতিফলন নয়, বরং এই চরিত্রগুলো কীভাবে ইতিহাসকে পরিবর্তন করতে সাহায্য করেছে তার মনস্তত্ত্বও তুলে ধরা হয়েছে।” প্রাচীন রোমের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে তৎকালীন রোমের সাধারণ মানুষের পারিবারিক কিংবা সামাজিক জীবনের প্রতিফলনও উঠে এসেছে এখানে।
এটি তৈরি করতে বেশ খরচ গুনতে হয়েছে। তবে খরচের প্রতিদানও পেয়েছে নির্মাতারা। লেখা, পরিচালনা, সম্পাদনা এমনকি ভিজুয়াল ইফেক্টসের জন্য এটি পুরস্কৃত হয়েছে। অনেকের মতে রোম সিরিজের এমন সফলতাই পরবর্তীতে ইতিহাসভিত্তিক টিভি সিরিজ নির্মাণের জন্য অনুপ্রাণিত করেছে।
স্পার্টাকাস (২০১০-২০১৩)
প্রথমে দাস, সেখান থেকে থ্রাসিয়ান যোদ্ধা, তারপর রোমান গ্ল্যাডিয়েটর, এবং শেষমেশ রোমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসা স্পার্টাকাসের জীবন নিয়েই আবর্তিত হয়েছে এর ঘটনা। খ্রিস্টপূর্ব ৭৩ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৭১ অব্দ পর্যন্ত চলা তৃতীয় সের্ভিল যুদ্ধে স্পার্টাকাসের বীরত্বই সিরিজের মূল ক্লাইম্যাক্স। যুদ্ধের চরমতম মুহূর্তের দৃশ্যায়নসহ নাটকীয়তা আর দ্রুতগতির স্টোরিলাইন একে অনন্য মাত্রা এনে দিয়েছে।
প্রযোজকরা একে ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে দাবি করলেও এর বেশিরভাগ দৃশ্যই অতি নাটকীয় করে দেখানো হয়েছে। ডকুমেন্টারি নয়, বরং এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বিনোদনই। তবে এতে দেখানো ভায়োলেন্স, যৌনতা আর দাসদের প্রতি নির্মম ব্যবহার প্রাচীন রোমকেই প্রতিনিধিত্ব করে।
ভাইকিংস (২০১৩-২০১৯)
র্যাগনার লোথব্রক, নর্স উপকথার নায়ককে নিয়েই আবর্তিত হয়েছে ভাইকিংসের কাহিনী। সামান্য কৃষক থেকে র্যাগনারের যাত্রা শুরু, তারপর সেখান থেকে ভাইকিংসদের খাতায় নাম লেখানো এবং শেষমেশ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার রাজা হিসেবে আবির্ভূত হওয়া, এই হলো ভাইকিংসের সারমর্ম। সিরিজের পরের সিজনগুলোতে উঠে এসেছে র্যাগনারের ছেলেদের ইংল্যান্ড, স্ক্যান্ডিনেভিয়া আর ভূমধ্যসাগরে তাদের অ্যাডভেঞ্চারের গল্প।
যদিও ঐতিহাসিকভাবে ততটা সত্য নয়, তবে সিরিজের অভিনয় থেকে শুরু করে সেট নির্মাণ কিংবা গল্পের গাঁথুনি, সবকিছুতেই ভাইকিংসদের ফ্লেভার যুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে পরিমিত পরিমাণে। অভিযান, লুটপাট, আর তার সাথে নর্সদের ধর্ম আর পারিবারিক জীবন নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এতে।
নর্স উপকথার অনেক চরিত্র একসাথে মিশিয়ে সিরিজটি তৈরি করা হয়েছে, যদিও বাস্তবে অনেকের অস্তিত্বই ছিল না; এবং কারো কারো অস্তিত্ব থাকলেও তাদের পরস্পরের সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। ভাইকিংদের বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন চরিত্রকে জোড়াতালি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই সিরিজ।
রিসারেকশন: এরতুগ্রুল (২০১৪-২০১৯)
অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান প্রথম ওসমানের বাবা এরতুগ্রুল গাজীর জীবনকে নিয়ে আবর্তিত হয়েছে এই তুর্কী টিভি সিরিজ। সিরিজটি মূলত পরিচিত ‘দিরিলিস: এরতুগ্রুল’ নামে। সিরিজটির মূল গল্প এরতুগ্রুল গাজীর কায়ি গোত্রকে খুঁজে বের করাকে কেন্দ্র করে। আর তা করতে গিয়ে এরতুগ্রুলকে মুখোমুখি হতে হয়েছে নাইটস টেম্পলার, সেলজুক এবং মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে। এতে টেম্পলার, মঙ্গোল কিংবা সেলজুকদেরকে ভিন্নভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যা পশ্চিমা সিরিজগুলোতে সাধারণত দেখানো হয় না ।
যদিও এরতুগ্রুল বাস্তবেই ছিলেন, তবুও মৌখিক উপকথা ছাড়া তার সম্পর্কে নিখুঁত ঐতিহাসিক তথ্য খুব কমই পাওয়া যায়। আর সেগুলোই এই সিরিজে দেখানো হয়েছে। এরতুগ্রুল সুলায়মান শাহের ছেলে ছিলেন, কিন্তু আসলেই তিনি কায়ি গোত্রের কেউ ছিলেন কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
নাইটফল (২০১৭-২০১৯)
অ্যাকারের পতনের পর পবিত্র ভূমিতে নিজেদের শেষ জায়গাটুকুও হারিয়ে ফেললো ক্রুসেডাররা। কিন্তু নাইটস টেম্পলারদের কাজ শেষ হয়নি, যখন জানা গেল হলি গ্রেইল মুসলমানদের হাতে নয়, ফিরে এসেছে ইউরোপেই। এই হলি গ্রেইল আর ক্ষমতা নিয়েই শুরু হলো নাইটস টেম্পলার, ফরাসি রাজা ফিলিপ, পোপ বোনিফাস, মঙ্গোল গুপ্তচর আর আরব বেদুইনদের এক গুপ্তসংগঠনের বহুমুখী দ্বন্দ্ব। সিরিজটির পদে পদে দেখা মিলবে ভালোবাসা, বিশ্বাসঘাতকতা, বন্ধুত্ব, ষড়যন্ত্রসহ মানবচরিত্রের সবগুলো দিকই।
যুদ্ধের অসাধারণ দৃশ্যায়ন, ক্ষমতার লড়াই, নাটকীয় দৃশ্যের সাথে টেম্পলারদের নিয়ে তৈরি কল্পনা আর বাস্তব ইতিহাস মিলেমিশে এক অসাধারণ সিরিজে রূপান্তর করেছে নাইটফলকে। কাহিনীর মূল চরিত্র ল্যান্ড্রি দ্য লুজন কাল্পনিক হলেও টেম্পলার গ্র্যান্ডমাস্টার দ্যু মোলেঁ, চতুর্থ ফিলিপ, পোপ অষ্টম বোনিফাস কিংবা রানী জোয়ান- ইতিহাসের বাস্তব চরিত্র।
মার্কো পোলো (২০১৪-২০১৬)
মঙ্গোল সাম্রাজ্যে মার্কো পোলো, সিরিজটির শুরুই হয় মঙ্গোল সম্রাট কুবলাই খানের বন্দী হিসেবে মার্কো পোলোর যাত্রা দিয়ে। তারপর একে একে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, ক্ষমতার লড়াই, গুপ্তহত্যার চেষ্টা, ভালোবাসা-বিশ্বাসঘাতকতাসহ নানা বিষয় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মাত্র দুই সিজন বানানোর পরই সিরিজটি বন্ধ করে দেওয়া হয়, তবে তার মধ্যেই প্রাচ্য-পশ্চিমের সংস্কৃতিকে একসূত্রে গেঁথে দেওয়া এই সিরিজ সিনেমাটোগ্রাফি আর মিউজিকের জন্য বেশ পরিচিতি পেয়েছে। এর চরিত্রগুলো আসল হলেও এর বেশিরভাগ ঘটনা মোটেই আসল নয়।
দ্য লাস্ট কিংডম (২০১৫-২০১৯)
ইংল্যান্ডে ড্যানিশদের অভিযানকে কেন্দ্র করে প্রতিশোধ আর ক্ষমতার দ্বন্দ্বই এই সিরিজটির মূল উপজীব্য। এক স্যাক্সন অভিজাতের ছেলে কিন্তু ড্যানিশদের কাছে বেড়ে উঠা ইউট্রেড র্যাগনারসনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে এর কাহিনী। সে কোন পক্ষে যাবে? তার পূর্বপুরুষদের উত্তরসূরি নাকি তাকে যারা বড় করেছে তাদের দিকে? ডেনদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইংল্যান্ডের শেষ বড় ঘাঁটি ‘কিংডম অব ওয়েসেক্স’-কেই নির্দেশ করছে সিরিজের টাইটেলটি।
অভিনয়, যুদ্ধের দৃশ্যায়ন, মিউজিক, কস্টিউম থেকে শুরু করে প্লটও সমালোচকদের নজর কেড়েছে। তৎকালীন সমাজের পরিস্থিতিও ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে এতে। ঐতিহাসিক সত্য আর কাল্পনিক চরিত্র মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে এতে। প্রোটাগনিস্ট ইউট্রেড মূলত কোনো একটি চরিত্র নয়, বরং ইতিহাসের অনেকগুলো চরিত্র থেকে ধার নিয়ে তাকে তুলে ধরা হয়েছে। ইংলিশ রাজা আলফ্রেড দ্য গ্রেট বা অ্যাসার দ্য মংক এবং ড্যানিশ নেতা উব্বা আর গাথ্রাম বাস্তবেই ছিল।
এমপ্রেসেস ইন দ্য প্যালেস (২০১১)
চীনা সম্রাট ইয়ংঝেং-এর রক্ষিতা ঝেন হুয়ান সিরিজটির কেন্দ্রীয় চরিত্র। ইয়ংঝেং এর অগণিত স্ত্রী আর রক্ষিতাদের ভিড়ে কি ঝেন হুয়ান নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে? বিশ্বাসঘাতকে পরিপূর্ণ হারেমে ঝেন হুয়ানের একমাত্র ভরসা নিজের বুদ্ধি আর দক্ষতা।
মান্দারিন ভাষা হলেও চীনের এই অসাধারণ টিভি সিরিজটি এর অসাধারণ প্লট, আকর্ষণীয় স্টোরিলাইন আর অদ্ভুত কস্টিউমের কারণে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ইতিহাসভিত্তিক টিভি সিরিজ মানেই রক্তাক্ত দৃশ্য। তবে কেউ যদি কম ভায়োলেন্স আর বেশি ভালোবাসার ছোঁয়া পেতে আগ্রহী হয়, তবে এমপ্রেসেস ইন দ্য প্যালেস তার জন্যেই। এমনকি হারেম আর রক্ষিতাদের নিয়ে গল্প হলেও এতে যৌনতা নেই বললেই চলে। বরং এতে চীনা সম্রাটের হারেমের অভ্যন্তরের রাজনীতিই সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। চরিত্রগুলো বাস্তব হলেও এর পুরোটুকুই মস্তিষ্কপ্রসূত, এমনকি ঘটনাগুলোও কাল্পনিক।
একাটেরিনা (২০১৭-২০১৮)
রাজকন্যা সোফি ফ্রেডারিক অগাস্টার রানী হয়ে ওঠা, এবং তার স্বামী তৃতীয় পিটারের গুপ্তহত্যার পর সম্রাজ্ঞী হিসেবে দেশচালনা শুরুর মাধ্যমে ‘ক্যাথেরিন দ্য গ্রেট’ হওয়ার গল্প ফুটে উঠেছে এতে।
অসাধারণ প্লট, সেট, কস্টিউম আর মিউজিকের সাথে এর দুর্দান্ত স্টোরিলাইন দর্শককে সহজেই ধরে রাখতে পারে। তাছাড়া বিশ্বাসঘাতকতা, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ভরপুর এই সিরিজটির প্রতি মুহূর্তে পাওয়া যাবে সাসপেন্সের ছোঁয়া। অন্যান্য টিভি সিরিজের সাথে তুলনা করলে এর ঐতিহাসিক সত্যের পরিমাণ অনেক বেশি, এমনকি চরিত্রগুলোও গড়ে উঠেছে সত্য তথ্যের উপর ভিত্তি করেই।
ফ্রন্টিয়ার (২০১৬-২০১৯)
অষ্টাদশ শতাব্দীর কানাডায় ফার-ট্রেড কোম্পানিগুলোর রাজত্বকে নাটকীয়ভাবে তুলে ধরা হয়েছে এতে। হাডসন বে কোম্পানির সাবেক কর্মচারী অর্ধেক আইরিশ-অর্ধেক ক্রি নায়ককে কেন্দ্র করে সিরিজের কাহিনী গড়ে ওঠেছে। প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত নায়ক হাডসন বে কোম্পানির বারোটা বাজানোর জন্য মুখিয়ে আছে, তৈরি হয়ে আছে কোম্পানির লোকজনরাও। কী হবে তারপর?
অষ্টাদশ শতাব্দীর কানাডায় ফার-ট্রেড কোম্পানিগুলোর রাজত্ব আর দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার, এমনকি হাডসব বে কোম্পানিও ছিল বাস্তব। তবে ঐতিহাসিক সত্য বলতে এতটুকুই, এর চরিত্র থেকে শুরু করে ঘটনাগুলোর সবই কাল্পনিক।