ইংরেজীতে খুব সুন্দর একটি শব্দ আছে, ‘Melancholy’; যার বাংলা আভিধানিক প্রতিশব্দ হলো ‘বিষণ্ণতা’। কিন্তু, বিষণ্ণতা শব্দটা যেন এর সঠিক বিচার করতে পারে না। কোনো কারণ ছাড়াই অযথা মন খারাপ, শূন্যতার মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করার অনুভূতিই হচ্ছে ‘মেলানকোলি’। বেশিরভাগ মানুষই কমবেশি এমন অনুভূতির সাথে পরিচিত। হারুকি মুরাকামির ‘নরওয়েজিয়ান উড’ তেমনই এক বিষাদময়, মেলানকোলিক একটি বই। এটি লেখকের প্রকাশিত পঞ্চম বই, যার নামটি নেয়া হয়েছে বিখ্যাত ব্যান্ড বিটলসের একই শিরোনামের একটি গান থেকে।
বইটি ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় ও প্রকাশের সাথে সাথে এটি জাপানে তুমুল জনপ্রিয়তা পায় ও বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়। মুরাকামি সাধারণত পরাবাস্তব লেখা লিখতে পছন্দ করেন। তার চরিত্ররা বাস্তব, অবাস্তব দুই জগতেই অবাধে বিচরণ করে। কিন্তু ‘নরওয়েজিয়ান উড’ উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। এই বইয়ের চরিত্ররা ও গল্প সবই অতিমাত্রায় বাস্তব। মুরাকামি নিজে বলেন, কাজটা তিনি ইচ্ছা করেই করেছেন। তিনি শুধু পরাবাস্তব লেখাই লিখতে পারেন, এমন মিথ ভুল প্রমাণ করার জন্যই নাকি উপন্যাসটি লেখা। বলাই বাহুল্য, তিনি এই মিথ খুব ভালোভাবে ভেঙে সমালোচকদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছেন।
বাতিঘর থেকে প্রকাশিত হয়েছে এই বইয়ের একটি বঙ্গানুবাদ। সে বই হাতে নিলে প্রথমেই মনে হয়, বাহ, বইটা অনেক সুন্দর তো! সব্যসাচী মিস্ত্রির করা প্রচ্ছদ বইটির ভাবার্থের সাথে মিশে গেছে। আর, বাতিঘরের গুণমান নিয়ে তো সন্দেহের অবকাশ নেই। বরাবরের মতো বইয়ের বাঁধাই, ছাপা ও কাগজের মান সবই একদম উৎকৃষ্ট।
আলভী আহমেদের অনুবাদ অত্যন্ত মসৃণ। পড়ার সময় মনেই হয় না, এটা অন্য কোনো অনুবাদ। মনে হয়, লেখকের নিজের বইই বুঝি এটা। বিশেষ করে অনুবাদকের শব্দচয়ন অনেক ভালো ছিল। শুধুমাত্র শব্দচয়নের জন্যই অনেক অনুবাদ কাঠখোট্টা মনে হয় পড়ার গতি শ্লথ হয়ে যায়; আবার অনেকসময় দেখা যায়, অনুবাদকেরা ইংরেজী শব্দ একেবারে বর্জন করে ফেলেন। এর ফলে স্বাভাবিক অনেক বাক্যও কেমন উদ্ভট শোনায়। আলভী আহমেদ এদিকেও খেয়াল রেখেছেন, ক্ষেত্রবিশেষে তিনি শব্দগুলোর বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার না করে ইংরেজিই রেখে দিয়েছেন, যার ফলে অনুবাদ কোথাও আড়ষ্ট মনে হয়নি, বা ঝুলেও যায়নি।
বইয়ের মূল চরিত্র তরু ওয়াতানাবের জবানিতেই আমরা তার গল্প শুনি। পুরো বইটিই উত্তম পুরুষে বর্ণিত হওয়ায় মাঝে মাঝে মনে হবে যেন ডায়েরি পড়ছেন। বইয়ের প্রেক্ষাপট হচ্ছে সত্তরের দশকে এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণের জীবন। বইয়ের বাকি মূল দুই চরিত্র- নাওকো ও মিদোরি। এই দু’জনের চরিত্র প্রায় বিপরীত। আমরা গল্পের যত ভেতরে প্রবেশ করি, তত গভীরভাবে ওয়াতানাবের টানাপোড়েনের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি।
যারা একটু অন্তর্মুখী, তারা খুব ভালোভাবেই ওয়াতানাবের সাথে নিজেকে মেলাতে পারবেন। কৈশোর জীবনে ওয়াতানাবির একমাত্র বন্ধু ছিল কিজুকি। কিজুকির প্রণয়িনী ছিল নাওকো, আর সে সূত্রেই ওয়াতানাবের সাথে নাওকোর পরিচয়। তবে সেই পরিচয়ে কোনো ঘনিষ্ঠতা ছিল না। ওয়াতানাবে, কিজুকি ও নাওকোর শহর কোবেতে যা হয়নি, তারা দু’জনেই টোকিওতে পড়তে যাবার পর তা হলো ওয়াতানাবে ও নাওকোর মধ্যে ঘনিষ্ঠতার সৃষ্টি হলো; হয়তো তার জন্য কিজুকির মৃত্যুই দায়ী। ওয়াতানাবে বা নাওকো কেউই কিজুকির মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি।
একসময় মিদোরির সাথেও ওয়াতানাবের পরিচয় হয়, যে আপাতদৃষ্টিতে নাওকোর একদম বিপরীত। নাওকোর নিস্প্রভ, দ্যুতিহীন উপস্থিতির পাশে মিদোরি যেন এক বর্ণিল আলোকচ্ছ্বটা। তবে সেই উজ্জ্বল খোলসের ভেতরেও অন্য এক মিদোরি ছিল, যা শুধু ওয়াতানাবেই স্পর্শ করতে পেরেছে।
তবে এটি কিন্তু কোনো ত্রিভুজ প্রেমের আখ্যান নয়। নিজের অবস্থান ও নিজের জীবনে থাকা ব্যক্তিদের উপস্থিতি সম্পর্কে ওয়াতানাবে বরাবরই স্পষ্ট ছিল। এভাবেই বইটি এগিয়ে যেতে থাকে। আমরা ওয়াতানাবের দর্শন বুঝতে থাকি, তার ভালোবাসা অনুভব করতে থাকি। ওয়াতানাবের এই টানাপোড়েনের মধ্যে বইয়ে এক রকম স্থিতি এনে দিয়েছে রেইকো নামের চরিত্রটি। তার জীবনবোধ ও কিছু সংলাপ মনে রাখার মতো।
বইয়ের মূল উপজীব্য ওয়াতানাবের ভালোবাসা হলেও এটি রোমান্টিক কোনো লেখা নয়। পাওয়ার চেয়ে না পাওয়াকেই মুরাকামি বইতে বেশি তুলে ধরেছেন। ওয়াতানাবে, নাওকো, মিদোরির নিঃসঙ্গতা, সবার মধ্যে থাকার পরেও একা মনে হওয়া পাঠককে অব্যশই নাড়া দেবে। ওয়াতানাবের ভেতরের দ্বন্দ্ব, সংশয় খুব ভালোভাবে ফুটে উঠেছে।
সম্পূর্ণ আলাদা তিনটি প্রধান চরিত্রকে মুরাকামি যে একই সুতোয় বেঁধেছেন, তা হচ্ছে দ্বিধা। আমরা বইয়ের প্রধান তিন চরিত্রকেই চরম দ্বিধাগ্রস্ত হতে দেখি। নাওকো কিজুকির মৃত্যু কখনোই মেনে নিতে পারে না, আবার সে ওয়াতানাবের কাছেও আসতে চায়। মিদোরি নিজের দায়িত্ব ও উচ্ছ্বলতার মধ্যে একটু ফাঁক খোজে। আর ওয়াতানাবে ভঙ্গুর নাওকোর খুঁটি হতে চাইলেও মিদোরিকে সে ছাড়তে পারে না। এইযে চরিত্রগুলোর মধ্যের অন্তর্নিহিত সংশয়, তার বর্ণনা মুরাকামি খুবই দক্ষতার সাথে করেছেন। যে ব্যক্তি জীবনে সুখের সন্ধানে শুধু অবসাদই পেয়েছে, সে বইয়ের প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে নিজের কোনো এক সত্ত্বাকে খুঁজে পাবে।
এত বিষাদময়তার মধ্যেও মুরাকামির সূক্ষ্ম হিউমার ছড়িয়ে রয়েছে পুরো বই জুড়েই। চরিত্রগুলোর সাথে তাদের আশেপাশের পরিবেশও মুরাকামির বর্ণনায় যেন জীবন লাভ করে। প্রাণবন্ত উপস্থাপনার কারণে আমরা ৬০ দশকের জাপানের ডানপন্থী পরিবর্তনের পরিষ্কার চিত্র দেখতে পাই। একইসাথে টোকিওর শরৎ ও শীতেরও খুব মোহনীয় বর্ণনা পাওয়া যায়। কখনো ওয়াতানাবে, বা কখনো মিদোরির মাধ্যমে মুরাকামির রাজনৈতিক দর্শনের কিছু আভাসও আমরা পাই।
তরুণ মুরাকামি নিজেও সেসময় টোকিওতে ডর্মে থাকতেন। হয়তো উপন্যাসের ওয়াতানাবে তরুণ মুরাকামির অবয়বে আঁকা, তবে এ নিয়ে লেখক কিছু বলেননি। ওয়াতানাবে, মিদোরি, নাওকো বা রেইকো সব চরিত্রকেই মুরাকামি এমনভাবে চিত্রিত করেছেন যে, বই শেষ হবার অনেক পরেও মাথায় চরিত্রগুলো ঘুরতে থাকে। তাদের বিষণ্ণতা, অপ্রাপ্তিগুলো মন খারাপ করিয়ে দেয় পাঠকেরও। এখানেই মুরাকামির সার্থকতা। তিনি তার চরিত্রগুলোকে জীবনদান করতে সক্ষম হয়েছেন, পাঠকের একদম হৃদয়ে পৌঁছে দিতে পেরেছেন।
প্রথম প্রকাশের পর প্রায় ৩৫ বছর পরেও বইটি এখনো সমান জনপ্রিয়, পঞ্চাশেরও বেশি ভাষায় অনূদিত হওয়া বইটি লাখো পাঠকের মন জয় করেছে আর মুরাকামিকে পরিণত করেছে একজন সুপারস্টারে। বিটলসের গানটির পাখি উড়ে যাবার মতোই বইটি পড়া একসময় শেষ হয়ে গেলেও এর রেশ রয়ে যাবে অনেকদিন।