গডজিলা, কিংকং, অ্যানাকন্ডা ইত্যাদি দানবভিত্তিক সিনেমাগুলো বরাবরই দর্শকদেরকে ভিন্নধর্মী বিনোদন দিয়ে এসেছে। ভয়, অ্যাডভেঞ্চার, রহস্য, কল্প-বিজ্ঞান ও অ্যাকশনের সমন্বয়ে নির্মিত সেই সিনেমাগুলোর দলে ২০১৩ সালে যুক্ত হয়েছিল নতুন একটি নাম “প্যাসিফিক রিম।” নিজ দেশ আমেরিকার বক্স অফিসে খুব একটা বড় সাফল্য না দেখাতে পারলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দর্শকদেরকে ঠিকই মাতিয়ে দিয়েছিল সিনেমাটি। ১৯০ মিলিয়ন ডলার বাজেটে নির্মিত “প্যাসিফিক রিম” আয় করেছিল ৪১১ মিলিয়ন ডলার। স্বাভাবিকভাবেই একটি সিক্যুয়েল নির্মাণের পরিকল্পনা তখন হয়তো নির্মাতাদের মাথায় চলে এসেছিল। যার ফলশ্রুতিতে ২০১৮ সালের মার্চের ২৩ তারিখে মুক্তি পায় সিরিজের দ্বিতীয় সিনেমা “প্যাসিফিক রিম: আপরাইজিং।”
কাহিনী
‘প্যাসিফিক রিম’ যেখানে শেষ হয়েছিল, সেখান থেকে ১০ বছর শুরু হয় “প্যাসিফিক রিম : আপরাইজিং” এর গল্প। সাবেক জেইগার পাইলট জ্যাক পেনটেকস্ট এখন বিভিন্ন জেইগার রোবটের যন্ত্রাংশ চুরি করে কালোবাজারে বেচে জীবন ধারণ করছে। এই জ্যাক হলো কাইজু যুদ্ধে শহীদ স্ট্যাকার পেনটেকস্টের ছেলে। স্ট্যাকার পেনটেকস্ট ছিলেন প্যাসিফিক রিম (২০১৩)-এর একটি মূখ্য চরিত্র।
নিষ্ক্রিয় এক জেইগার রোবটের পাওয়ার কোরের খোঁজ করতে গিয়ে জ্যাক একটি গোপন ওয়ার্কশপে হানা দেয়। ওয়ার্কশপটা ছিল আমারা নামানি নামের একজন কিশোরীর গোপন আস্তানা। আমারা জেইগার প্রযুক্তি নিয়ে খুবই উৎসাহী। স্ক্রাপার নামে এক পাইলটবিশিষ্ট জেইগারও আছে তার। যদিও সেটা আইনের চোখে অবৈধ। জ্যাক আর আমারা যখন পরস্পরের মুখোমুখি ঠিক তখনই দৃশ্যপটে হাজির হয় প্যান-প্যাসিফিক ডিফেন্স কর্পোস। বেশ কিছুক্ষণ ধাওয়া করার পর জ্যাক ও আমারাকে তারা আইনভঙ্গের কারণে গ্রেফতার করে।
অতঃপর জ্যাককে জানানো হয়, সে চাইলে আবার ডিফেন্সে যোগ দিতে পারে কিংবা নিজের অবৈধ কর্মকাণ্ডের জন্য জেল খাটতে পারে। ডিফেন্সে যোগ দিতে হলে তাকে আমারার প্রশিক্ষক হতে হবে। একজন দক্ষ জেইগার পাইলট হিসেবে গড়ে তুলতে হবে আমারাকে। কারণ, আমারা নিজে নিজে স্ক্রাপারের মতো জেইগার একাই বেশ দক্ষতার সাথে পরিচালনা করতে পেরেছিল। তাই তাকে এখন বড় জেইগারের যৌথ পাইলট হিসেবে তৈরি করে ডিফেন্সের সম্পদ হিসেবে কাজে লাগাতে হবে।
জ্যাক জেলের ঘানি টানার চেয়ে প্রশিক্ষক হওয়াটাকেই লাভজনক মনে করে এবং যোগ দেয় প্যান-প্যাসিফিক ডিফেন্সে। আমারাসহ আরও কয়েকজন কমবয়সী প্রশিক্ষণার্থীকে ট্রেইনিং দিতে শুরু করে জ্যাক। কিন্তু শাও কর্পোরেশন-এর ড্রোন প্রোগ্রামের কারণে ওদের জেইগার প্রজেক্ট হুমকির মুখে পড়ে যায়।
ড্রোন প্রোগ্রামের ফলে অত্যাধুনিক রোবটগুলো কোনো পাইলট ছাড়াই যেকোনো মুহূর্তে মিশনে নামার সামর্থ্য রাখে। এতে জেইগারের চেয়ে ঝুঁকি কম। পাইলটদের জীবনহানিরও শঙ্কা নেই। অফিসিয়ালি ড্রোনগুলোকে অবমুক্ত করার জন্য প্যান-প্যাসিফিক ডিফেন্সের কাছে অনুমতি চায় শাও কর্পোরেশন। সিডনিতে ডিফেন্সের কাউন্সিল মিটিঙে এই অনুমতির বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় যোগ দিতে যান ডিফেন্স সেক্রেটারি জেনারেল মাকো মোরি। আচমকা সেখানে একটি দুবৃর্ত্ত জেইগার এসে হামলা চালায়। জেইগারের তুমুল তাণ্ডব ও ভাঙচুরের কবলে পড়ে মারা যায় মাকো মোরি। জেইগারটিতে পাইলট হিসেবে কারা রয়েছে সেটা কেউ জানতে পারে না।
এই দুর্ঘটনার ফলে ড্রোন প্রোগ্রামকে দ্রুত অনুমতি দেয়া হয় যেন ভবিষ্যতে এধরনের হামলা থেকে ড্রোন রোবটগুলো মানুষদেরকে রক্ষা করতে পারে। কিন্তু রক্ষক ড্রোনগুলো পরিণত হয় ভক্ষকে! সেইসাথে সমুদ্রের তলদেশে প্রবেশপথ করে দেয় যেন কাইজুরা পৃথিবী হাজির হতে পারে!
একদিকে কাইজু দানবদের আক্রমণ, অন্যদিকে অত্যাধুনিক ড্রোনের বিশ্বাসঘাতকতা! পৃথিবীর এই সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায় ত্রাণকর্তার ভূমিকায় নামে পাইলটচালিত জেইগারগুলো। শুরু হয় ধুন্ধুমার লড়াই!
রিভিউ
১ ঘণ্টা ৫১ মিনিট ব্যপ্তির এই চলচ্চিত্রটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বেশ দ্রুতগতিতে এগিয়েছে। সিনেমা শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে অ্যাকশন সিকোয়েন্স দর্শকদেরকে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করে। জ্যাক প্যান্টাকস্ট চরিত্রে ছিল স্টার ও্যর্রস খ্যাত পরিচিতমুখ জন বোয়েগা। আমারা নামানি নামের কিশোরী চরিত্রে অভিনয় করেছে মিষ্টি মেয়ে ক্যালি স্প্যানি। জ্যাক আর আমারার খুনসুঁটি দর্শকদের আনন্দ দিয়েছে। বাকিরাও যে যার চরিত্রের প্রতি সুবিচার করেছেন।
সিনেমার কাহিনী ভূয়সী প্রশংসা পাওয়ার মতো না হলেও মন্দ ছিল না। ছোট-খাটো ট্যুইস্টের সমন্বয়ে বেশ উপভোগ্য ছিল। সিরিজের আগের পার্টের মতো এই পার্টেও রয়েছে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, বিস্ফোরণ ও ভাঙচুর। ২০১৩ সালের প্রিকুয়েলটিতে জেইগার বনাম কাইজুদের লড়াই থাকলেও এবার বাড়তি হিসেবে দেখা গেল জেইগার বনাম জেইগারের লড়াই! সাথে জেইগার বনাম কাইজুদের লড়াই তো থাকছেই।
সিনেমাটোগ্রাফি ছিল গড়পড়তা মানের। উল্লেখযোগ্য কিংবা আলাদা করে চোখে পড়ার মতো তেমন কিছু ছিল না। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও বাড়তি কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি, যেটা আগের পার্টটি ঠিকই পেরেছিল। জেইগার আর কাইজুদের সিজিআইগুলো ছিল আগের কিস্তির তুলনায় দুর্বল। তবে চোখ ধাঁধানো কিছু অ্যাকশন সিকোয়েন্স রয়েছে। যা দর্শকদের বিশেষ করে ছোটদের দারুণ আনন্দ দেবে। কিছু মজার সংলাপ দিয়ে দর্শকদের হাসানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর অধিকাংশই কাজ করেনি।
এবছর অস্কার জেতা পরিচালক গিয়ের্মো দেল তরো ২০১৩ সালের “প্যাসিফিক রিম” পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু “দ্য শেইপ অফ ওয়াটার” সহ অন্যান্য প্রজেক্টের কারণে এবারের কিস্তিতে পরিচালকের আসনে তাঁর বসা হয়নি। সিনেমা জুড়ে তাঁর দক্ষ পরিচালনার অনুপস্থিতিটা বেশ ভালভাবে অনুভব করা গেছে।
বক্স অফিস পর্যালোচনা
২০১৩ সালের প্যাসিফিক রিম বক্স অফিসে কেমন করেছিল সেটা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এবারের কিস্তিটি ১৫০ মিলিয়ন ডলার বাজেটে নির্মিত ছিল। যা কিনা ৫ বছর আগে নির্মিত প্রিকুয়েলটির চেয়েও ৪০ মিলিয়ন ডলার কম! কিন্তু তারপরও রক্ষা হয়নি। খোদ আমেরিকা থেকে মাত্র ৫৯ মিলিয়ন ডলারসহ বিশ্বব্যপী প্যাসিফিক রিম: আপরাইজিঙের মোট বক্স অফিস কালেকশন ২৮৮ মিলিয়ন ডলার।
আগের কিস্তিটি অকল্পনীয়ভাবে চীনের বক্স অফিসে আমেরিকান বক্স অফিসের চেয়েও ভাল করায়, এবারের কিস্তিটি চীনের দর্শকদের বিষয়টি মাথায় রেখে নির্মাণ করা হয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ ও পার্শ্বচরিত্রগুলোতে চীনা শিল্পীদের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যনীয়। কিন্তু এবার চীনের দর্শকরা হতাশ করেছে। ফলে বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছে “প্যাসিফিক রিম: আপরাইজিং”। পরিচালক জানিয়েছিলেন, এই সিনেমাটি দর্শকরা গ্রহণ করলে তৃতীয় কিস্তি তৈরি করবেন। সিনেমার শেষে সেরকম ইঙ্গিতও রেখেছেন। এখন দেখার বিষয়, বক্স অফিসে ভাল না করার পরও প্যাসিফিক রিমের তৃতীয় কিস্তি দর্শকদের সামনে আসে কিনা।
প্যাসিফিক রিম: আপরাইজিং চলচ্চিত্রটি মূলত ৮-১৫ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের নির্মল বিনোদনের জন্য নির্মিত হয়েছে। তাই বলে প্রাপ্তবয়স্কদের কাছে বিরক্ত লাগবে, তেমনটাও নয়। তবে কাহিনীতে বিশেষ কোনো গভীরতা নেই, নেই কোনো ১৮+ দৃশ্যও। সবমিলিয়ে এটি একটি পারিবারিক সিনেমা, যা পপকর্ন আর কোল্ড ড্রিঙ্কস সহযোগে ফুরফুরে মেজাজে আয়েশ করে উপভোগ করা যেতে পারে।
Featured image: Universal Pictures