আঠারো শতকের শেষভাগের গল্প। আমেরিকার পশ্চিমে তখন দুই নামওয়ালা আউটল্য হলো বুচ ক্যাসিডি আর সানড্যান্স কিড। ব্যাংক আর ট্রেন ডাকাতিতে বুচ আর তার গ্যাং কুখ্যাত। প্রায় ১ যুগেরও বেশি সময় আউটল্য হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে তারা। বুচের গ্যাংয়ের মাঝে আলাদা জুঁটিটা গড়ে উঠেছে সানড্যান্স কিডের সাথে। বুচের আছে ক্ষুরধার মাথা আর সানড্যান্সের আছে তেজি বন্দুকবাজ হাত। জুঁটিটা জমেছে খাপে খাপে।
সিনেমার ওপেনিং ক্রেডিটে দর্শকের সামনে দুটো জিনিস তুলে ধরা হয়। টাইটেল সিকুয়েন্সটা সিনেমা হলের প্রজেক্টরে দেখানোর মতো করে দেখানো হয়। পর্দার একপাশে দেখা যায়, সিনেমার বুচ ক্যাসিডি ওরফে পল নিউম্যান আর সানড্যান্স কিড ওরফে রবার্ট রেডফোর্ড এবং পুরো ‘হোল ইন দ্য ওয়াল গ্যাং’য়ের ডাকাতির উদ্দেশ্যে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ছুটে চলার ফুটেজ। অনেকটা নিউজরীলের মতো, যা মনে করিয়ে দেয় সেইসময়ের বন্য পশ্চিমকে এবং পরিচয় করিয়ে দেয় গোটা গ্যাংটার সাথে। আর আরেকটা দিক যেটা এই ওপেনিং ক্রেডিট তুলে ধরেছে, তা হলো ওই নিউজরীল নিজে।
এই সিনেমা তার গল্প বলা শুরু করেছে উনিশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকে। ‘চলচ্চিত্র’ তখন একটি মাধ্যম হিসেবে সবে আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করেছে। সিপিয়া কালার টোন, সেই সময়কার ক্যামেরার লেন্স, প্রজেক্টরের শব্দ; সবকিছু এই মাধ্যমটির সূচনালগ্নের কথা মনে করায়। প্রজেক্টরের শব্দকে ছাপিয়ে ভেসে আসা পিয়ানোর বিষণ্ণ সুর একটা মাদকতা তৈরি করে। জাগায় স্মৃতিকাতরতা।
এই অনবদ্য টাইটেল সিকুয়েন্সের পরপরই সিনেমার প্রারম্ভিক দৃশ্যটা এই সিনেমার অনন্যতা নিশ্চিত করে। ব্যাংকের প্রবেশদ্বার থেকে পল নিউম্যানের মুখ- পুরোপুরি ডিসলভ না করে দুটোকেই এক ফ্রেমে আনা, তারপর ব্যাংকে ঢোকার পর লো-কী লাইটিং আর শব্দের খেলা- ঘড়ির কাটার টিকটিক শব্দ; ব্যাংকের লকার বন্ধ করার শব্দ; কাউন্টারে ক্লোজড সাইন বসিয়ে দেওয়ার শব্দ; এই প্রত্যেকটা আলাদা কাটকে র্যাপিড মন্তাজের মতো করে জুড়ে দেওয়া হয়। আর এইসবের শব্দকে চড়িয়ে দিয়ে দর্শকের মাঝে একটা অনিশ্চিত ভীতি তৈরি করা হয়। সিনেমার পরবর্তীর টোন অনুযায়ী এই দৃশ্যটাকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন মনে হয়। কিন্তু গল্প আর চরিত্রদের ভবিতব্যই এই দৃশ্যের কিছু উপাদানে রূপক হয়ে লুকিয়ে থাকে।
পরের দৃশ্যেই দর্শক পরিচিত হয় সানড্যান্স কিডের সাথে। কার্ড খেলায় চিটিং করার দায় এনে সরাইখানার প্রধান এসে মানেমানে কেটে পড়তে বললো তাকে। কাউবয় হ্যাট পরা সেই ব্যক্তি বসার ভঙ্গীতে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন না এনে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো চিটিংয়ের দায় আনা লোকটার দিকে। দৃষ্টির শীতলতা এতই প্রকট যে চোখ সরিয়ে নিতে হয় অস্বস্তিতে পড়ে। বুচ পাশে এসে বললো, “কিড কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা বাঁধাস না।” কিড তখনো তাকিয়ে। ওই লোককে বললো, একবার ছোট্ট করে ক্ষমা চেয়ে ফেলেন। চাচ্ছি না কোনো ঝামেলা হোক। এ যে সানড্যান্স কিড, যার বুলির আগে গুলি ছোটে।
সানড্যান্স কিড?! লোকটার কন্ঠে তখন পরিষ্কার বিস্ময়। উঠে দাঁড়ালো সানড্যান্স কিড, চেয়ারটা একটু ঠেলে। লোকটা পেছালো দু-কদম মারাত্মক ভয় পেয়ে। কিড নিজের গুলিবাজ হাতের দক্ষতাও দেখিয়ে দিলো একটু পর ডাইভ দিয়ে বসে। তারপর পরিচিতি পর্বের পর আরো কিছু ঘটনার ডালপালা মেলে প্রধান হয়ে আসে বুচ আর তার গ্যাংয়ের কয়েকটি ট্রেন ডাকাতি। বুচ আর সানড্যান্স এমন হেসেখেলে ডাকাতিগুলো করে, যেন ওগুলো নিতান্তই বাচ্চার হাতে দেওয়া বেলুন।
কিন্তু ভুল হয়ে যায় একবার। লক্ষ্য করেনি, তাদের এই ডাকাতির খবর দিনকে দিন বাতাস কেটে ভারী হয়ে বসেছে। তাইতো সেবার ডাকাতি করতে গিয়ে বুঝতে পারেনি, আরেকটি শক্তিশালী সৈন্য দল পেছনে তাদের ধরতে অপেক্ষা করছে। কোনোরকমে পালিয়ে এলো তারা দুজনে। উপায় কী? বুচের কথাই রইলো। সানড্যান্সের প্রেয়সীসহ তিনজনে রওনা দিলো বলিভিয়া। কেউ নাগাল পাবে না। নিজেরাও বদলে যাবে, আউটল্যগিরি ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে।
কিন্তু তা আর হলো কই? চাষবাস, গতর খাটা কোনটাই তাদের দুজনের কম্ম নয়। আবার ফিরলো ডাকাতিতে। এবার সানড্যান্সের প্রেয়সীকে সাথে নিয়ে তিনজনে বলিভিয়ায় ব্যাংক লুটতে শুরু করলো। তবে খুব বেশিদিন থিতু হলো না। ভেতর থেকে বদলে যাওয়ার তাগিদ সত্যিসত্যিই অনুভব করলো। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! তবে কি ওটাই অবধারিত যে, ‘কপালের লিখন না যায় খন্ডন’?
অর্ধশতকেরও বেশি সময় আগে নির্মিত হওয়া এই ওয়েস্টার্ন সিনেমা কালের পরিক্রমায় আজ ‘ক্লাসিক’ তো বৈ, এমনকি এই জঁনরার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিনেমা হিসেবে সমাদৃত হয়ে আসছে। পরিচালক জর্জ রয় হিলের ক্যারিয়ারের সর্বোত্তম দুইটি কাজের একটি এই ‘বুচ ক্যাসিডি এন্ড দ্য সানড্যান্স কিড’। আরেকটি হলো নিউম্যান এবং রেডফোর্ডকে নিয়েই বছর ৪ ব্যবধানে বানানো ‘দ্য স্টিং’। তার এই গ্রেট দুইটি সিনেমাকে পাশাপাশি রাখলেই সর্বাপেক্ষা বড় যেই সাদৃশ্য চোখে পড়ে তা হলো, নস্টালজিয়া। এটা দ্বারাই চালিত হন জর্জ রয় হিল। এবং কেন বুচ ক্যাসিডি এন্ড দ্য সানড্যান্স কিড গ্রেট সিনেমা, কীভাবে ওয়েস্টার্ন জঁনরায় একটা স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ালো- সেসব প্রশ্নের উত্তরে ওই নস্টালজিয়া বা স্মৃতিমেদুরতার কথা ও আসবে। জর্জ রয় হিল মূলত ওয়েস্টার্ন জঁনরার চিরচেনা অলংকারগুলোকে অনেকটা বাদ রেখেই এই সিনেমাটিকে গ্রেট করে তুলতে কাজ করেছেন। এবং তেমনটা করেছেন কারণ, সিনেমাটিকে তিনি এই জঁনরার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি স্বরূপ বা স্মৃতিমেদুরতায় ভরা একটি সিনেমা হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। তা পেরেছেনও।
নস্টালজিয়ার প্রসঙ্গে বলতে গেলে এই সিনেমার নির্মাণকাল বিবেচনায় রাখতে হবে। ৬০ দশকের একদম শেষভাগে এসেছে এটি। গোটা হলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে তখন বড়সড় পরিবর্তনের জোয়ার আসছিল। স্টুডিও সিস্টেম বিদায় নিচ্ছিল। ওয়েস্টার্নের সবচেয়ে ক্লাসিক সময়টাও দেখছিল অন্তিম সূর্য। তো সেই সময়ে জর্জ রয় হিল ‘বুচ ক্যাসিডি এন্ড দ্য সানড্যান্স কিড’কে পুরোদস্তুর ওয়েস্টার্ন না বানিয়ে স্মৃতিমেদুরতা, প্রেমময়তা আর বিদায়ী শোক নিবেদনকারী একটা চিঠি হিসেবে নির্মাণ করেছেন। তবে শুধু এই সময় নয়, গল্পের প্রেক্ষাপটের সময়কাল নিয়েও কথা বলতে হয়। নতুন একটা শতক তখন। উনিশ শতক। মানুষের জীবনযাত্রা, প্রযুক্তি সবকিছুই অগ্রসরমান হওয়ার শতক। আগের শতকের অনেককিছুরই চিরস্থায়ী বিদায় নেবার কাল তখন উপস্থিত। সেই পুরানো সময়ের প্রতি অনুরণন, নতুন সময়ে নতুন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারার দ্বন্দ্ব; সবকিছুই এই সিনেমার আবহে এবং চরিত্রায়নে প্রকাশ পেয়েছে।
ওয়েস্টার্নের চেনা অলংকারকে বাদ দিয়ে এই সিনেমার গ্রেট হয়ে উঠা নিয়ে বলা যাক। পরিচালক রয় হিল অলংকারগুলোকে আসলে ছুঁড়ে ফেলেননি। বরং পাল্টে ব্যবহার করেছেন। সেখানেই সিনেমাটির মাহাত্ম্য উঠে এসেছে। বন্দুকবাজি, রক্তারক্তি এখানেও আছে। কিন্তু তা যতটা না ক্যামেরার সামনে, দ্বিগুণ বেশি পেছনে। গোলাগুলি, মারপিটের শব্দ ভেসে আসছে, তবে ভায়োলেন্সটাকে রাখা হয়েছে ওই, পেছনেই। তাছাড়া এই জঁনরার সিনেমাগুলোর টোন থাকে সবসময় গম্ভীর। সারাক্ষণই একটা চিন্তা থাকে এই বুঝি আউটল্যর হাত চলে যাবে তার কোমরবন্ধনীতে অবস্থান গাঁড়া পিস্তলের দিকে। তারপর কোনোকিছু বুঝে উঠার আগেই পিস্তলের নল দিয়ে ধোঁয়া বেরুতে দেখা যাবে। মাঝের সময়েই, সেটা হাতে এনে অব্যর্থ নিশানায় প্রতিপক্ষের খুলি ফাঁপা বানানো শেষ। সেদিক থেকে এই সিনেমা সবসময় একটা হালকা মেজাজে ঘোড়া ছুটিয়েছে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। সিরিয়াস মুহূর্তেও বুচ কিংবা সানড্যান্স কারো বলা হাস্যকর কথা, তাদের স্বভাবসুলভ গুফিনেস গুমোট বাতাসটায় একটা প্রাণের উদ্দীপনা বইয়ে দেয়।
এবং সেটা অবশ্যই উইলিয়াম গোল্ডম্যানের ওই অসামান্য চিত্রনাট্য ছাড়া সম্ভব হতো না। ওয়েস্টার্নের ট্র্যাডিশনাল সংলাপের ধারাকে তিনি পুরোপুরি বর্জন করেছেন। লেখায় প্রফুল্লতা যুক্ত করেছেন। সেটাকে স্পষ্টমান করতে অ্যাকশন, কমেডি, রোমান্স, ভায়োলেন্স; সবকিছুর মিশেল ঘটিয়েছেন। তার লেখা সংলাপগুলো খুবই ব্যঙ্গাত্মক এবং মাঝেমাঝে অপ্রাসঙ্গিকও ঠেকে। সেই অপ্রাসঙ্গিকতাই বলে দেয় সিরিয়াস হওয়ার চেয়ে, সিরিয়াসনেসকে ব্যঙ্গ করাটাই তার উদ্দেশ্য। তার চিত্রনাট্যের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা আয়রনিই, চিত্রনাট্যটাকে বুদ্ধিদীপ্ত এবং স্বকীয় করে তুলেছে।
রয় হিল শুধু ভায়োলেন্স আর টোনেই বদল ঘটাননি, দুই আউটল্যর চরিত্রায়নে- তাদের গুফিনেসের দিকটা, সেটা দিয়েও অন্যান্য ওয়েস্টার্ন সিনেমার রুক্ষ মেজাজি, দৃঢ়চেতা আউটল্য থেকে তাদের পৃথক করেছেন। সিনেমার কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র, সানড্যান্স কিডের প্রেমিকা, সে শুধু শোভাবর্ধনকারী নয়। গোল্ডম্যানের লেখনীর সাহায্য নিয়ে তার মাঝেও রয় হিল দিয়েছেন জটিলতা। চরিত্রটার দৃঢ়তাই এটাকে ভিন্নতা দিয়েছে।
বুচ ক্যাসিডি এন্ড দ্য সানড্যান্স কিড, এর হাসিঠাট্টার রসদ নিয়েছে ফরাসি নব্য তরঙ্গের চলচ্চিত্র থেকে। এর আগে সফলভাবে এই অনুপ্রেরণা নিয়েছিল আর্থার পেনের ‘বনি এন্ড ক্লাইড’ (১৯৬৭)। প্লেফুল হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন জঁনরাকে সংমিশ্রিতকরণ, কখনোবা ‘সাভার্সিভ’ হয়ে উঠার সাহসটা এই সিনেমা পেয়েছে সেই ফরাসি নব্য তরঙ্গ থেকে। এই সাভার্সিভনেস’টাই চোখে পড়ে তিন অংক ধরে এগিয়ে চলার প্রচলিত রীতিকে পাল্টানোয়। তিনটা অংক নয়, বরং তিনটা আলাদা চ্যাপ্টারে বিভক্ত হয়েছে এই সিনেমা। প্রতিটা চ্যাপ্টারই সেটিং, গতি এবং ভাবে আলাদা। প্রথম চ্যাপ্টার পুরোটাই মূল দুই চরিত্রের চরিত্রবিন্যাস, তাদের জগত তৈরি, তাদের রসায়ন তৈরিতে ব্যয় হয়েছে। পরের চ্যাপ্টার পুরোটাই কেটেছে আমেরিকান সেনা থেকে ভাগদৌড়ে। এবং এখানেই রয় হিল আরেকটা অলংকারকে বদলে দিয়েছেন। ওয়েস্টার্ন সিনেমার হিরোরা বা আউটল্যরা কখনো ভীতু নয়। পিছু হটা তাদের ধাঁচেই নেই। সেই জায়গায় পুরোপুরি উল্টো কাজটাই করতে দেখা যায় এই দুই আউটল্য’কে। তৃতীয় চ্যাপ্টার গোটাটাই বলিভিয়ার অভিযান নিয়ে, যা রোমাঞ্চের অনুভূতি দেয়। মূলত, নিগূঢ় এবং নাটকীয় অংশ দ্বিতীয় চ্যাপ্টারটাই। একমাত্র সেখানেই ভাবের দিক থেকে ওয়েস্টার্নের রীতি মেনেছে এই সিনেমা।
রয় হিল তো প্রতিটা জঁনরা অলংকার নিয়েই খেলেছেন, বদলেছেন। সেটা বাদ দেননি আবহসঙ্গীত ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। পুরো সিনেমায় ৩টা দৃশ্যেই শুধুমাত্র আবহসঙ্গীতের ব্যবহার করেছেন। এবং বার্ট বাখারাখের সঙ্গীত বেশ অদ্ভুত, ওয়েস্টার্ন সিনেমা হিসেবে। তার করা পিয়ানোর সুর কানে প্রবেশিত হয়ে সোজা হৃদয়ে নেমে যায়। বিষণ্ণতা, মোহনিয়া ভাব দুটোই জাগায়। এবং হিল এমন ভাবের উদ্রেক ঘটাতে চেয়েছেন তার ওই নস্টালজিয়ার দিকটাকে গাঢ় করতে, সাসপেন্স তৈরিতে নয়। সাসপেন্সের ক্ষেত্রে কোনরকম মিউজিক ছাড়া বিভিন্ন অবজেক্টিভ সাউন্ড দিয়েই টেনশনের আবহ তৈরি করেছেন। যেই জায়গাগুলোতে আবহসঙ্গীত ব্যবহার করেছেন সেগুলো স্মরণীয় হওয়ার বড় কারণ ভিজ্যুয়ালে মন্তাজ ব্যবহার করা। বলিভিয়ায় যাওয়ার পর বুচ আর সানড্যান্সের আগের কাজে ফেরার সেই দৃশ্যটাই স্মরণ করা যাক।
মন্তাজের অনবদ্য ব্যবহার এই সিনেমায় অনেকবার চোখে পড়ে, যা ওয়েস্টার্নে অসচরাচর। একদম প্রারম্ভিক দৃশ্যের মতো র্যাপিড মন্তাজ, ধরা পড়তে যাওয়া সেই ট্রেইন ডাকাতির সময়েও দেখা যায়। জুম ইন, জুম আউটের ব্যবহারও যথাযথ। লাইটিংয়ে সফট লাইটিং এবং লো-কী লাইটিং দুই টেকনিকই ব্যবহার করা হয়েছে। ওয়াইড লেন্সে সফট লাইট দিয়ে পশ্চিমের বিস্তীর্ণ ভূমিকে ধরার পাশাপাশি সমৃদ্ধ প্রোডাকশন ডিজাইনকে আরো ঐশ্বর্যমন্ডিত করে তুলে ধরা হয়েছে। ওদিকে রাতের দৃশ্যগুলোতে লো-কী লাইটিং’য়ে কিয়ারস্কুরো ইফেক্ট দেওয়া হয়েছে মাঝেমাঝে, যার অসাধারণ ব্যবহারটা ধরা পড়ে বুচ চরিত্রে পল নিউম্যানের হতাশ এবং ভীত অভিব্যক্তির প্রকাশে।
অবশ্যই এই সিনেমার সবচেয়ে বড় শক্তি নিউম্যান এবং রেডফোর্ড নিজে। একজনের ক্যারিয়ার খানিকটা দোলাচলে তখন, আরেকজনের তো শ্রেষ্ঠত্বের পথে হাঁটা সবে শুরু। নিজেদের অভিনয়বলে দুজনের রসায়নটাকে অনন্য এক অবস্থান দিয়েছেন। ওয়েস্টার্ন হয়েও এই সিনেমা বাডি-কমেডি। সেই প্রকৃতিটাই তো এই সিনেমাকে পরবর্তীকালের ওয়েস্টার্ন সিনেমার জন্য একটা ‘মাইলফলক’ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। পল নিউম্যান এবং রবার্ট রেডফোর্ডের মতো কিংবদন্তী দুই অভিনেতা না থাকলে সেই অবস্থান এতটা জ্বলজ্বলে হতো না। নিউম্যান-রেডফোর্ডের সহজাত দক্ষতা এবং কমনীয়তায় তাদের রূপায়িত এই চরিত্র দুইটাকে অপছন্দ করা অসম্ভব। পরবর্তী দশকগুলোর বাডি-কমেডি সিনেমার জন্য তারা হয়ে উঠেছেন, এককথায় ‘স্ক্রিন লেজেন্ড’।
জর্জ রয় হিল তার এই সিনেমায় স্টাইল এবং বাস্তবতা তুলে ধরায় ষাটের আমেরিকারই প্রতিরূপ এঁকেছেন। তবে যেই গঠনরীতি দাঁড় করিয়েছেন তা তো ৭০-এর আমেরিকান নব্য তরঙ্গেরই একটা আগাম মডেল। জঁনরার উপাদান আর এপ্রোচে বৈচিত্র্যতা আনা এই সিনেমা, শেষ দৃশ্য অব্দি সেই কাজ জারি রেখেছে। শেষের সেই ফ্রিজ-ফ্রেম শুধু ওয়েস্টার্নেই নয়, চলচ্চিত্র ইতিহাসেরও অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফ্রিজ-ফ্রেমের উদাহরণ। জানান দিয়েছে- কেন ‘বুচ ক্যাসিডি এন্ড দ্য সানড্যান্স কিড’ ওয়েস্টার্ন জঁনরায় একটা আলাদা মাইলফলক, কেন এটা ভিন্ন এবং কেন এটা আগত সেই সময়ের মডেল হয়ে ছিল, আছে এবং থাকবে।