ধরুন, একটি রাষ্ট্রে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালায় এমন একটি দলের প্রভাব ও সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রটির গোয়েন্দা সংস্থা এই দলটিকে দমন করার জন্য তৎপর হয়ে উঠবে। এক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থাটি কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে? হয়তো তারা উক্ত দলটির সদস্যদের ওপর নজরদারি বৃদ্ধি করবে, নয়তো দলটিতে নিজেদের চর ঢুকিয়ে দেবে, কিংবা এরকম কোনো উদ্যোগ নেবে।
কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থাটি যদি এরকম করে– প্রথমে তারা উক্ত দলটির একজন নেতার কিশোর ছেলেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে একটি ফ্ল্যাটে নিয়ে গেল, সেখানে ছেলেটিকে ধর্ষণ করা হলো, এরপর সেই কৃতকর্মের ছবি তুলে ছেলেটিকে হুমকি দেয়া হলো– যদি সে তাদের কথামতো কাজ না করে তাহলে এই ছবি ছেলেটির বাবাকে দেখানো হবে।
ছেলেটির বাবা কট্টর ধার্মিক, ছেলে সমকামিতায় লিপ্ত হয়েছে এটা জানতে পারলে ছেলেকে মেরে পর্যন্ত ফেলতে পারেন, কারণ ইসলামি আইনে সমকামিতা নিষিদ্ধ। ছেলেটি নিরুপায় হয়ে গোয়েন্দা সংস্থাটির সব কথা শুনতে বাধ্য হলো। ছেলেটিকে দিয়ে তার নিজের বাড়িতেই লুকানো মাইক্রোফোন বসানো হলো, এরপর তাকে দিয়েই ঐ দলটির নেতাদের খুন করানোর চেষ্টা করা হলো!
কী ভাবছেন? এরকমটা অসম্ভব? যারা এসপিওনাজ জগৎ সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা বুঝবেন, এটি অসম্ভব কোনো ঘটনা নয়। বাস্তবে ঠিক এরকমটাই ঘটেছিল ১৯৯৫ সালে, মিসরে। মিসরীয় গোয়েন্দা সংস্থা, যেটি সংক্ষেপে ‘এল মুখাবারাত’ নামে পরিচিত, এই ‘দানবীয়’ পন্থা বেছে নিয়েছিল মিসরের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ‘আল–জিহাদ’ এর মোকাবেলা করার জন্য, যে আল–জিহাদের নেতা ছিলেন আইমান আল–জাওয়াহিরি, বর্তমান ‘আল–কায়েদা’ এর আমির!
শুধু এই একটি ঘটনাই নয়, রাজনৈতিক ইসলামকে দমন করতে মিসরীয় সরকার (এবং সরকারি নিরাপত্তা রক্ষীবাহিনীগুলো) বহু অমানবিক পদক্ষেপ নিয়েছিল। অনেক বিশ্লেষকের মতে, আজকে আমরা ইসলাম ধর্মের নামে বিশ্বব্যাপী যে সন্ত্রাসবাদ দেখছি, তার সূচনা হয়েছিল মিসরের কারাগারগুলো থেকে। মিসরীয় কারাগারে অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করে বহু মূলধারার রাজনৈতিক ইসলামপন্থী নেতা–কর্মীই হয়ে উঠেছিল প্রতিশোধপরায়ণ, যা তাদের অনেককেই সন্ত্রাসবাদের দিকে ঝুঁকে পড়তে প্ররোচিত করেছিল।
ইসলামের নাম ব্যবহার করে বর্তমান বিশ্বে যে সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম প্রচলিত, সেই সন্ত্রাসবাদের উত্থানের জন্য এই কারণটির মতো আরো বহু সংখ্যক কারণ দায়ী। এর পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস, যে ইতিহাস যতটা না ধর্মের সঙ্গে জড়িত, তার চেয়ে বেশি জড়িত রাজনীতির সঙ্গে- ক্ষমতার রাজনীতি। আর বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আল–কায়েদার উত্থানের ইতিহাসটিই নিপুণভাবে উপস্থাপন করেছেন মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক লরেন্স রাইট তার ‘The Looming Tower: Al-Qaeda and the Road to 9/11‘ বইটিতে।
বইটিতে এমন অনেক চমকপ্রদ তথ্য উঠে এসেছে, যা সাধারণ মানুষের জানার কথা নয়। যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে আগ্রহী, তাদের জন্য তথ্যগুলো কৌতূহলোদ্দীপক হবে।
১৯৭৯–৮৯ সালে আফগান যুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধক্ষেত্রে সোভিয়েত ও আফগান সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধে যতজন মিলিট্যান্ট কমান্ডার নিহত হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি সংখ্যক আফগান মিলিট্যান্ট কমান্ডার নিহত হয়েছিল পাকিস্তানের পেশোয়ারে, যে জায়গাটি ছিল আফগান বিদ্রোহীদের নিরাপদ ঘাঁটি। এর পেছনে সোভিয়েত ও আফগান গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতা যতটা দায়ী ছিল, ঠিক ততটাই দায়ী ছিল আফগান মিলিট্যান্ট নেতাদের মধ্যে ব্যক্তিগত রেষারেষি ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। নিঃস্বার্থ, গৌরবান্বিত, আদর্শবান ‘আফগান মুজাহিদিন’ সম্পর্কে যে মিথ পশ্চিমা গণমাধ্যম সেসময় প্রচার করেছিল, এটি সেই মিথকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
১৯৯০ সালে ইরাকি একনায়ক সাদ্দাম হোসেন যখন আরব বিশ্বে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, তখন ওসামা বিন লাদেন সৌদিদেরকে আরব বিশ্বে সাদ্দামের সম্ভাব্য আগ্রাসন সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে ইসরায়েলের অর্ধেক এলাকা পুড়িয়ে দেয়ার হুমকি প্রদানকারী সাদ্দামকে সৌদিরা তখন বীর হিসেবে দেখত, লাদেনের সতর্কবাণী তারা কানে তোলেনি। সেই বছরই সাদ্দাম কুয়েত দখল করে নেন, এবং সেই সুযোগে মার্কিনীরা সৌদি আরবে স্থায়ী ঘাঁটি গেড়ে বসে।
আরেকটি মজার ব্যাপার হচ্ছে, কট্টর সুন্নি সংগঠন আল–কায়েদা ১৯৯০–এর দশকে লেবাননভিত্তিক শিয়া সংগঠন হিজবুল্লাহর সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল এবং লেবাননে হিজবুল্লাহর শিবিরে আল–কায়েদা সদস্যদের প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছিল!
যেটি সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার, সেটি হচ্ছে ১৯৯৬ সালে আল–কায়েদার বর্তমান আমির আইমান আল–জাওয়াহিরি রাশিয়ায় গিয়েছিলেন এবং রুশ নিরাপত্তা রক্ষীদের হাতে ধরাও পড়েছিলেন। কিন্তু রুশরা তার প্রকৃত পরিচয় উদঘাটন করতে না পেরে তাকে ছেড়ে দিয়েছিল!
এটা যেহেতু বইটার একটা সারসংক্ষেপ মাত্র, এই লেখায় এজন্য আর কোনো তথ্য থাকছে না। তবে কৌতূহলীদের জন্য কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়!
• সাইয়্যিদ কুতুব — প্রখ্যাত মিসরীয় ইসলামি তাত্ত্বিক, লেখক, শিক্ষাবিদ এবং ‘ইখওয়ান আল–মুসলিমিনে’র নেতা, যাকে বিশ্বের বহু মূলধারার ইসলামপন্থী আদর্শ হিসেবে মানেন, যাকে আরব জাতীয়তাবাদের অগ্রদূত গামাল আব্দেল নাসের দণ্ডিত করেছিলেন মৃত্যুদণ্ডে— সেই সাইয়্যিদ কুতুব একসময় পুঁজিবাদ এবং বস্তুবাদের স্বর্গ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়ন করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে কুতুবের কী এমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল, যার ফলে রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে ইসলামকে তিনি দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন?
• আইমান আল–জাওয়াহিরি— যার জন্ম মিসরের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে, পেশায় যিনি ছিলেন একজন চিকিৎসক, মানুষের জীবন রক্ষা করা যার জীবনের মূল লক্ষ্য হওয়ার কথা, সেই জাওয়াহিরি কেন সন্ত্রাসবাদের পথকে বেছে নিয়েছিলেন? কেন সুনিশ্চিত বিত্ত–বৈভবের জীবন ছেড়ে প্রথমে আল–জিহাদ এবং পরবর্তীতে আল–কায়েদার মতো সংগঠনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হয়েছিলেন?
• আব্দুল্লাহ আজ্জাম — ফিলিস্তিনি ধর্মীয় নেতা, যিনি আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্য প্রবেশের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ বা ‘ধর্মযুদ্ধে’র আহ্বান জানিয়েছিলেন, যিনি ছিলেন ওসামা বিন লাদেনের মতো আফগানিস্তানে আগত আরব যোদ্ধাদের আদর্শিক গুরু, তাকে কেন পেশোয়ারে খুন করা হয়েছিল? সেই খুনের রহস্য এখনও অমীমাংসিত রয়েছে কেন?
• ওসামা বিন লাদেন — সৌদি রাজপরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মুহাম্মদ বিন লাদেনের ছেলে, যিনি সৌদি বিন লাদিন গ্রুপের বিশাল বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের একজন উত্তরাধিকারী, যাকে সকলেই চিনতো ‘নম্র, ভদ্র, বিনয়ী, লাজুক’ একজন মানুষ হিসেবে, কেন তিনি প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইকে নিজের জীবনের মূলমন্ত্র করে নিয়েছিলেন? যে সৌদি সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থনে লাদেনকে উৎসাহিত করেছিল আফগান ‘জিহাদে’ অংশ নিতে, তারা কীভাবে লাদেনের শত্রুতে পরিণত হলো?
• ১৯৮৯ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর সুদানে যে ইসলামপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তারা ১৯৯০–এর দশকের প্রথমদিকে লাদেনকে সাদরে তাদের দেশে গ্রহণ করে নিয়েছিল। পরবর্তীতে কেন তারা লাদেনকে সুদান থেকে বহিষ্কার করে? কেনই বা লাদেনের সমস্ত সম্পত্তি তারা বাজেয়াপ্ত করে নেয়?
• লাদেন আফগানিস্তানে আশ্রয় নেয়ার পর তালিবান নেতা মোল্লা মুহাম্মদ ওমর তাকে সৌদি আরবের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। কেন তিনি সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন? কেনই বা তিনি লাদেনের পক্ষ নিয়ে সৌদি আরবের রোষানলে পড়ার ঝুঁকি নেন?
• ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ার ধ্বংসের আগেই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ জানতো যে, কিছু আল–কায়েদা সদস্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছে। কেন তারা সেই তথ্য এফবিআইকে জানালো না? কেনই বা তারা চিহ্নিত আল–কায়েদা সদস্যদের গ্রেপ্তার করার কোনো চেষ্টা করেনি? আর আল–কায়েদার রহস্য উদঘাটনে যে মুসলিম এফবিআই এজেন্ট অংশ নিয়েছিলেন, তার পরিচিতিই বা কী?
হাতেম তাইয়ের সাত সওয়ালের মতো এই সাতটি সওয়ালের জওয়াব যদি পেতে চান, বইটি পড়ুন।
বইটি সম্পর্কে:
নাম: The Looming Tower: Al-Qaeda and the Road to 9/11 || লেখক: লরেন্স রাইট
প্রকাশনী: আলফ্রেড এ. ক্নপ্ফ, নিউ ইয়র্ক || প্রকাশকাল: ২০০৬
বাংলাদেশে প্রাপ্তিস্থান: রকমারি (ভিজিট করুন এখানে)