রেডিও স্টেশনের আবছা অন্ধকার রুম। অনুষ্ঠানে বয়স্ক এক প্রশ্নকর্তার বিপরীতে বসে আছেন সুঠামদেহের বলিষ্ঠ একজন পুরুষ। কণ্ঠে তার দীপ্ত তেজ। জীবনের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের নেপথ্য কাহিনীর খুঁটিনাটি বর্ণনা করে যাচ্ছেন লোকটি। নাম তার অপরাজিত রায়। সদ্য নির্মিত ‘পথের পদাবলী’ নির্মাণ করে তিনি দেশে-বিদেশে ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছেন। প্রশ্নকর্তা একের পর এক প্রশ্নবাণ ছুড়ে অনুভূতি জানতে চাইলে, পটাপট সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন অপরাজিত। মুখের কোণায় হাসিও লেগে আছে তার। বিজ্ঞাপনের অঙ্কনশিল্পী থেকে কীভাবে বিশ্বনন্দিত এক সিনেমা নির্মাণ করলেন, তারই সরল-জটিলের সমষ্টিকে ক্রমে ক্রমে স্মৃতিচারণ করে যাচ্ছিলেন তিনি।
এভাবেই প্রথিতযশা নির্মাতা সত্যজিৎ রায়কে সাদা-কালো শ্রদ্ধার্ঘ্য দিলেন পরিচালক অনীক দত্ত। ২০২২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অপরাজিত’ সিনেমার মাধ্যমে যেন তিনি সত্যজিৎ রায়কে জীবন্ত করে তুলেছেন। অপরাজিত সিনেমা নিয়ে আলোচনা করতে হলে প্রথমেই উঠে আসে অনীক দত্তের অসম সাহসের কথা। এর আগে ভূতের ভবিষ্যৎ, আশ্চর্য প্রদীপ বা মেঘনাদবধ রহস্যের মতো সিনেমা নির্মাণ করে নিজের প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। সিনেমার খুঁটিনাটি বিষয়কে অধিক গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা তার পুরনো স্বভাব। সবকিছু ছাপিয়ে এবার তিনি এমন একজনকে পরিবেশন করার কথা ভাবলেন, যার সাথে মিশে আছে বাঙালীর পরিপূর্ণ আবেগ ও অনুভূতি।
অনীক দত্ত তার প্রিয় ব্যক্তিত্ব সত্যজিৎ রায়কে গ্র্যান্ড ট্রিবিউট দিতে যাচ্ছেন, এমন খবর ছড়ানোর পরই শুরু হয়েছিল অপেক্ষার প্রহর। সাথে প্রস্থেটিক মেকআপে হাজির হওয়া জিতু কমল যেন সাক্ষাৎ সত্যজিৎ। ফার্স্ট লুক বের হবার পর রীতিমতো ঝড় বয়ে গেলো বাঙালীর সোশ্যাল মিডিয়ায়। টিজার, ট্রেলার মুক্তির অপেক্ষায় মুখিয়ে রইল সবাই। অনীক দত্ত কীভাবে সত্যজিৎ রায়কে সেলুলয়েডের ফিতায় পরিবেশন করবেন, সেটার পেছনেই ছিল সবচেয়ে বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
অনীক বড়সড় এক দাও মারলেন অভিনেতা জিতু কমলকে নিয়ে। সিনেপাড়ায় আগে থেকে তেমন কোনো নাম-ডাক ছিল না জিতুর। অভিনয় করেছেন কিছু টিভি সিরিয়ালে, ছোট চরিত্রে। তাই, সত্যজিৎ রায়ের মতো একজন কিংবদন্তির চরিত্রে জিতু কমলকে নির্বাচন করাটা শুরুতে ঝুঁকিরই নামান্তর। কারণ, পান থেকে চুন খসলেই শেষ। সমালোচকদের সমালোচনার অন্ত থাকবে না। ফুঁসলে উঠবে সিনেমা পাড়ার গলি। তবে, জিতু কতটা ঝানু অভিনেতা, এর জবাব তিনি দিয়েছেন অভিনয় প্রদর্শনীতে। সত্যজিতের চিরাচরিত সিগনেচার বা দেহ-ভঙ্গিমা, যেটা আমরা সচরাচর দেখে এসেছি, জিতু কমল সেরকম কিছু ব্যবহারিক প্যাটার্ন রপ্ত করেছেন একেবারে নিখুঁত শৈল্পিকসত্তায়। চাহনির ধরন, স্টাইল, হাতে ধরা সিগারেট, সবকিছু এতটাই ত্রুটিহীন যে, এতে জিতু কমলের প্রচণ্ড খাটুনি, এবং চরিত্রের প্রতি তার ভালোবাসা এবং নিবেদনকেই প্রতিফলিত করে। জিতুকে সত্যজিতের চরিত্রে মেনে নিতে দর্শকের কোনো অসুবিধাই হয়নি।
বিমলা রায়ের চরিত্রে সায়নী ঘোষ ছিলেন বেশ সাবলীল। আপাদমস্তক এক আদর্শ বাঙালি অর্ধাঙ্গিনীর প্রতিরূপ। স্নিগ্ধতা ছড়িয়েছেন প্রতিটি ফ্রেমে। কখনো অপরাজিতের সাথে খুনশুটি, কখনো হালকা করে মেজাজ দেখানো, যা চরিত্রের সাথে মিশে গিয়েছে পুরোপুরি। উমার চরিত্রে অনুষা, বরুনা চরিত্রে অঞ্জনা বিশ্বাস, বিমান রায়ের চরিত্রে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়- সকলেই নিজ জায়গা থেকে সেরাটা উপহার দিয়েছেন। ছোট চরিত্রে সুমিত সমদ্দার, মানসী সিনহাও ছিলেন মানানসই।
তবে, ক্যামেরার পেছনে থেকে সিনেমাকে সফলতায় রূপ দেয়ায় সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন প্রস্থেটিক ম্যাজিশিয়ান, মেকআপ আর্টিস্ট সোমনাথ কুণ্ডু। বায়োগ্রাফি সিনেমায় যার জীবনী নিয়ে সিনেমা নির্মিত হচ্ছে, তাকে কতটুকু জীবন্তভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তোলা গেছে, সেটাই বায়োগ্রাফি সিনেমার মূল আকর্ষণ। কথায় আছে, আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী। তাই প্রথমেই দর্শক চেহারা এবং ভঙ্গিমার সাথে মিল খুঁজে বেড়াবে। সোমনাথ কুণ্ডুর হস্ত জাদুতে জিতুর মধ্যে যেন সাক্ষাৎ সত্যজিৎ রায় ফিরে এসেছেন। এত নিখুঁত প্রস্থেটিক মেকআপ বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে খুবই কম দেখা গেছে। মুক্তির আগে দর্শকদের হলমুখী করার কৃতিত্ব সিংহভাগই সোমনাথ কুণ্ডুর।
সিনেমাকে পঞ্চাশ দশকের চিরাচরিত বাংলার ভিন্টেজ লুক দেওয়াও ছিল চ্যালেঞ্জিং। সেখানে ক্যামেরা হাতে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন সুপ্রতীম ভোল। তাকে সাথে নিয়ে অনীক দত্ত একটু একটু করে সামঞ্জস্যপূর্ণ স্বচ্ছতার সাথে কাহিনি ফুটিয়ে তুলেছেন সেলুলয়েড ফিতায়। পুরো সিনেমায় পঞ্চাশ-ষাট দশকের বাংলার আবহাওয়া বজায় ছিল, যা ওই সিনেমার মূল উপজীব্য। কিছু কিছু ক্লোজ শট এবং লং শট এত দুর্দান্ত ছিল যা চিত্রনাট্যকে নিয়ে গেছে অনন্য মাত্রায়। কখনো শহুরে দালানকোঠা কখনো বা গ্রাম বাংলার শ্যামল প্রকৃতি- সবকিছুতে যেন নিখুঁত শৈলী ও মননশীলতার স্পষ্ট ছাপ। সাদা-কালো এবং সত্যজিৎ রসায়নের দুরূহ লুকোচুরি খেলা দর্শক মনোযোগ হরণ করতে বাধ্য।
সুরঘর সামলেছেন দেবজ্যোতি মিশ্র। আবহ সঙ্গীতে পুরোটা সময় পথের পাঁচালীর মোহে মাতিয়ে রেখেছেন তিনি। সাথে অর্ঘ্যকমল মিশ্রের সম্পাদনাও প্রশংসার দাবি রাখে। সত্যজিৎ রায়ের অবতার সৃষ্টিতে জিতু কমল, সোমনাথ কুণ্ডুর সাথে আরেকজন বহুল প্রশংসার দাবি রাখে। তিনি হলেন চন্দ্রাশিস রায়। অপরাজিত চরিত্রের বলিষ্ঠ, ব্যারিটোন ও পরিষ্কার কণ্ঠের পেছনে মূল কল-কাঠি নেড়েছেন তিনি। তার ডাবিংয়েই প্রাণ ফিরে পেয়েছেন সত্যজিৎ।
সিনেমাটি এগিয়েছে একগুচ্ছ নস্টালজিয়াকে পুঁজি করে। আশ্রয় নেওয়া হয়েছে প্যারালালিজমেরও। একদিকে যেমন সাদা-কালো রঙে সকল প্রতিবন্ধকতা টপকে সত্যজিতের সিনেমা বানানোর সংগ্রাম দেখানো হচ্ছে, তেমনি সমান্তরালভাবে দেখানো হচ্ছে অপু-দুর্গাকেও। পথের পাঁচালি এবং বিশ্ব সমাদৃত এক ফিল্ম নির্মাতার গল্প একসাথে এগোয়- সমান্তরাল এবং সহাবস্থানে।
ছকবাধা গণ্ডির খোলস ভেঙে থেকে বের হয়ে, তৎকালীন সিনেমা কালচার স্রোতের বিপরীতে গা ভাসিয়ে, সিনেমা তৈরির ব্যাকরণ পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন সত্যজিৎ রায়। প্রাচীনপন্থীদের তাচ্ছিল্য, অবহেলা ও অপমান উপেক্ষা করে, স্বপ্নদ্রষ্টা একগুচ্ছ তরুণকে সাথে সত্যজিৎ রায় যে ‘পথের পাঁচালী’ নামক কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়েছিলেন, অনীক দত্ত যেন অর্ধশত বছর পর সেটাই লাইভ ডকুমেন্টারি হিসেবে তুলে ধরলেন সকলের সামনে।
বিজ্ঞাপন সংস্থার সাধারণ একজন শিল্পী থেকে বিভূতিভূষণের ‘আম আঁটির ভেঁপু’ অলঙ্করণ ও প্রচ্ছদ- এই কাহিনিই বদলে দিয়েছিল সত্যজিতের গতিপথ। এরপর ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি, কোম্পানির কাজে সস্ত্রীক বিলেত ভ্রমণ, ‘বাইসাইকেল থিবস’ দেখে সিনেমার তৈরির কনসেপ্ট নিয়ে নতুন করে ভাবা, সিনেমার বাজেট নিয়ে অর্থসংকটে পড়া, লগ্নির জন্য প্রযোজনা সংস্থা এবং প্রযোজকদের দ্বারে দ্বারে ঘোরা, সত্যজিতের এসব জানা-অজানা কাহিনি নিয়ে তৈরি হয়েছে চিত্রনাট্য। কোথাও অতিরঞ্জিত কিছু নেই, নেই কোনো অতিরিক্ত সংযোজন। পুরো সিনেমাই সাদাসিধে, সত্যজিতের জীবনী শুনিয়ে যায়।
পরিচালক অনীক দত্ত ছবিতে বদলে দিয়েছেন প্রায় সকল জিনিসের নাম। সত্যজিতের পরিবর্তে অপরাজিত, সুব্রত মিত্র পরিবর্তিত হয়েছে সুবীর, বংশী চন্দ্রগুপ্ত হয়েছেন চন্দ্রগুপ্ত কিচলু। বোরাল গ্রাম হয়েছে সরাল। পথের পাঁচালি হয়েছে পথের পদাবলী। প্রায় সকল নামেই লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। তবে সেগুলো ধরতে দর্শকের বিন্দুমাত্র অসুবিধা হবার কথা নয়। কারণ, পরিচালক পথের পদাবলীর মাধ্যমেই রূপক অর্থে তুলে ধরতে চেয়েছেন পথের পাঁচালীকে।
সিনেমায় কিছু রেফারেন্স ব্যবহার করেছেন পরিচালক। রায় বাড়ির যে ভৃত্যকে দেখানো হয়েছিল, তার নাম ছিল প্রহ্লাদ। এই রেফারেন্স সরাসরি এসেছে ‘প্রফেসর শঙ্কু’ থেকে। চিত্রগ্রাহক সুবীর মিত্রকে একটি দৃশ্যে অপরাজিত বলছেন, ‘সাবাস মি. মিটার!’ এই রেফারেন্স নেওয়া হয়েছে ফেলুদা থেকে।
চলচ্চিত্রে সত্যজিতের পাশাপাশি খুঁটিনাটি অনেক জিনিসকেও অধিকতর ফোকাস করা হয়েছে। যেমন- সিনেমা নির্মাণে বাউন্সিং লাইটিং ব্যবহার, স্বাভাবিক আলোয় আউটডোর শুটিংসহ যেসকল যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিলেন সুব্রত মিত্র, বাদ যায়নি সেগুলোও। সাথে ঠাঁই পেয়েছে কুশীলবদের শৈল্পিক বোঝাপড়াও। এই সিনেমা দেখার পর দর্শকেরা নিও ‘নিও-রিয়ালিজম’ এর ব্যাকরণ কিছুটা ঠাহর করতে পারবেন।
অপরাজিত সিনেমায় কাশবনের মধ্যে দিয়ে প্রথম ট্রেন দেখার অনুভূতি, ইন্দির ঠাকরুনের মৃত্যু, বৃষ্টিতে অপু দুর্গার স্নান, পুকুরের পানিতে মিষ্টি ওয়ালার প্রতিচ্ছবি, হাউ-মাউ-কাউ বলে রাক্ষস-খোক্কসের কেচ্ছা, সবই যেন পথের পাঁচালির মাস্টার কপি। দৃশ্যগুলো যারপরনাই দর্শককে আবেগ-আপ্লুত করে দেয়।
চলচ্চিত্রকে প্রশংসার জোয়ারে ভাসিয়েছেন খোদ সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ রায়ও। তার ভাষায়,
ঝামেলার ছবি! খুব ডিফিকাল্ট। তবে সিনেমাটি খুবই ভালো লেগেছে। এই রিক্রিয়েশনটা দুর্দান্ত লেগেছে। আর শেষ পর্যন্ত ছবিটি ধরে রাখা খুব মুশকিলের কাজ ছিল। খুবই ভালো লেগেছে। সারাক্ষণ পিছনে কন্সটেন্ট একটা মিউজিক বাজছে। খুবই ভালো লাগা কাজ করেছে। বাবাকে সিনেমাস্কোপে দেখাটা অবিশ্বাস্য লাগছিল। কিছু জায়গা খুবই সুন্দর।
সত্যজিৎ রায়কে যে পরিচালক হৃদয়ে ধারণ করে, অপরাজিত এর জ্বলন্ত প্রমাণ। কিংবদন্তি সত্যজিতের প্রতিভা বিচ্ছুরিত হয়ে কীভাবে তা সিলভার স্ক্রিনে ঠাঁই পেয়েছিল, সেই গল্প বলার চেষ্টা করেছেন অনীক। পুনরায় নির্মাণ করতে চেয়েছেন ইতিহাস। আপামর বাঙালি যা গ্রহণ করে নিয়েছে সাদরে। শুধু বাংলায় নয়, ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে এক নবদিগন্তের সূচনা করেছিল ‘পথের পাঁচালী’। শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে, অভিজাত মোড়লদের সমালোচনা গোণায় না ধরে, যেভাবে বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্বের বুকে তুলে ধরেছেন সত্যজিৎ, সেই উপাখ্যান প্রদর্শন করা এই সিনেমার নাম ‘অপরাজিত’ রাখাই যথার্থ এবং যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়েছে। সবমিলিয়ে বলা যায়, বাংলা সিনেমার ইতিহাসে ‘অপরাজিত’ এক মাইলফলক হয়ে থাকবে।