ইহুদী জাতির ইতিহাস: ইহুদীদের প্রাচীন কিংবদন্তী ও ইতিহাসের শেকড়ের সন্ধানে

শুরুর আগে

ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠী হিসেবে ইহুদী জাতি বেশ রহস্যময়। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে প্রমাণিত না হলেও, ধর্মীয়ভাবে তাদের ইতিহাসের শেকড় অনেক প্রাচীন। বর্তমানে, ইহুদী জাতি ও ইসরায়েল মোটামুটি সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্য মুসলিম সমাজে ইহুদীদের নিয়ে আছে ক্রোধ, ক্ষোভ এবং ক্ষেত্রবিশেষে ঘৃণা। কেন?

এই সবকিছুর জড় অনুসন্ধান করতে গেলে সময়ের হাত ধরে আমাদের ফিরে যেতে হবে ৩০০০ বছর আগের সেই প্রাচীন সময়ে। লেখক আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ সেটাই করেছেন। এ নিয়ে, ২০২০ সালের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয় তার লেখা ‘ইহুদী জাতির ইতিহাস‘।

ইহুদী জাতির ইতিহাস; Image Source: Chhayabithi Publication

লেখার শুরুটা অবশ্য হয়েছিল অন্যভাবে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ রোর বাংলার পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে ‘ইহুদী জাতির ইতিহাস’ নামে একটি সিরিজ লিখছিলেন। শুরু করেছিলেন ২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি। এই সিরিজের ১৭টি পর্ব রোরে প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তীতে, পাঠকদের অভূতপূর্ব সাড়া পেয়ে লেখক সম্পূর্ণ একটি বই লেখা শুরু করেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেই বইটিই প্রকাশিত হয় ‘ইহুদী জাতির ইতিহাস’ নামে।

কী আছে এতে?

মোট ৩৮টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এই বইয়ের শুরুটা হয়েছে ইহুদী জাতির একদম শুরু থেকে। নবী হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর আরেক নাম ইসরাইল। তার ছিল ১২ পুত্র। এই ১২ পুত্রের বংশধরদেরকেই বলা হয় বনী ইসরাইল বা ইসরাইলের বংশধর। যদিও ইহুদী শব্দটা এসেছে ইয়াকুব (আঃ) এর চতুর্থ পুত্র ‘এহুদা’র নাম থেকে। তবু বর্তমানে ইহুদী বলতে বনী ইসরাইলকেই বোঝায়।

এই বইটা মূলত ইহুদী জাতির খ্রিস্টপূর্ব ইতিহাস। বইটা ঠিক ইসলামি বই না। নিরপেক্ষ একটা বই, যদিও ইহুদীদের মন্দ দিকটা এখানে স্পষ্ট। বিশেষ করে ফিলিস্তিনীদের সঙ্গে তাদের নির্মম আচরণ ও এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে সেটা ভালভাবে বোঝা যায়।

বইটিতে ইতিহাসের পাশাপাশি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ ব্যাখ্যা করার জন্য ‘প্রমাণিত ইতিহাস’, অর্থাৎ প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের বাইরে গিয়ে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের বিভিন্ন কিংবদন্তী, ওল্ড-টোস্টামেন্ট এবং এর মধ্যকার তাওরাত (ইংরেজিতে বলে ত্বোরাহ) এর বিভিন্ন উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে। পাশাপাশি এসেছে কোরআনের উদ্ধৃতি এবং ইবনে কাসীরের বিভিন্ন বর্ণনা। এতে করে ইহুদী ও মুসলিমদের দৃষ্টিভঙ্গি ও এর মিল-অমিল স্পষ্ট বোঝা যায়।

টেন কমান্ডমেন্ডস; Image Source: flickr

ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠন ও ফিলিস্তিন বনাম ইসরায়েলের সমস্যা নিয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনা নেই (যেহেতু এটি খ্রিষ্টপূর্ব ইতিহাস)। কিন্তু একটি অধ্যায়ে সংক্ষিপ্ত কিন্তু তথ্যবহুল আলোচনা আছে এ নিয়ে।

কোরআন শরিফ ও ইসলামিক ইতিহাস থেকে এই বইয়ের ঘটনাগুলোর ব্যাপারে অনেকেই হয়তো কিছুটা জানেন। কিন্তু প্রতিটা ঘটনারই ভিন্ন বর্ণনা আছে ইতিহাসে, কিংবদন্তীতে। সেগুলোর অনেক কিছুই হয়তো পাঠক নতুনভাবে জানবেন।

যেমন, কোরআন ও ইসলামি ইতিহাসে বর্ণিত দাউদ (আঃ) ও জালুতের লড়াই যে ইতিহাসে ডেভিড ভার্সেস গোলিয়াথের লড়াই বলে খ্যাত, এটা হয়তো অনেকেই জানেন না। জানেন না, মসজিদুল আকসা ও বাইতুল মুকাদ্দাস বলতে দুটো ভিন্ন জিনিসকে বোঝানো হয়। এরকম জিনিসগুলো বিভিন্ন কিংবদন্তী, ওল্ড টোস্টামেন্ট, নিউ টোস্টামেন্ট এবং বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

১৯৮২ সালে মসজিদুল আকসা; Source: Wikimedia Commons

ইয়াকুব (আঃ) এর পুত্রদের মাধ্যমে বনী ইসরাইলের শুরু। তার ছেলে হযরত ইউসুফ (আঃ) ছিলেন মিশরের ফারাওর উজির। সেই সূত্র ধরেই বনী ইসরাইল মিশরে বসবাস শুরু করে। সম্ভ্রান্ত জীবন ছিল তাদের। তাহলে তাদের জীবনে বিপর্যয় নেমে এল কীভাবে? কীভাবে হযরত মুসা (আঃ) এর অনুসারী হয়ে উঠল তারা?

মুসা (আঃ) এর সঙ্গেই লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে বনী ইসরাইল এসে পৌঁছায় জেরুজালেমের দ্বারপ্রান্তে। এখান থেকে পাওয়া যাবে বইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর। ইহুদীরা জেরুজালেমকে বলে ‘প্রমিজ ল্যান্ড’। কেন? তাহলে, ফিলিস্তিনিরা কি এ দেশের অধিবাসী না? যে প্রশ্নের মাধ্যমে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের দ্বন্ধ ও এত বছর ধরে চলে আসা লড়াইয়ের সূচনা, যে উদ্দেশ্যে বইটা লেখা- সেটা বেশ ভালভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এতে।

পর্যালোচনা

বইটার সবচেয়ে ভাল দিক হচ্ছে, যথাসম্ভব নিরপেক্ষভাবে পুরো ইতিহাসটা বর্ণনা করা হয়েছে। ইহুদী বর্ণনা কিংবা কিংবদন্তীর পাশাপাশি একইসঙ্গে এসেছে ইসলামি বর্ণনা। লেখক কোথাও নিজের মতামত দিতে চাইলে এর আগে যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য বা ফ্যাক্ট উল্লেখ করেছেন। তারপরেই কেবল এক-দুই বাক্যে দিয়েছেন নিজের মতামত।

প্রতিটা ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে যথেষ্ট বিস্তারিতভাবে। সেজন্য অনেক খুঁটিনাটি নতুনভাবে জানতে পারবেন পাঠক। ইহুদীদের মনস্তত্ব বুঝতে সেগুলো সাহায্য করবে।  

আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, সবাই জানেন, ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে। আরবরা ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে আছেন দীর্ঘদিন। কথা হলো, ইহুদীরা তাহলে কেন এই ভূখণ্ডকে নিজেদের বলে দাবি করে? এই দাবীর সূত্রপাতের পেছনে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও কারণ এখানে পরিষ্কার করা হয়েছে।

তবে মনযোগী পাঠকের কাছে কিছু ত্রুটিও চোখে পড়বে। কিছু জায়গায় আরো ভালো এডিটিং করা দরকার ছিল। এক-দুটো জায়গা খাপছাড়া লেগেছে বর্ণনায়।

যেমন, মূসার পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা যে অধ্যায়ে আছে, সেখানে খাপছাড়া অংশ আছে কিছু। কিছু অধ্যায়ে আবার আগের কোনো অধ্যায়ের ঘটনা আসলে, টেনে কপি করে পেস্ট করে দেয়া হয়েছে। এসব জায়গায়ও এডিটিংয়ের দুর্বলতা রয়ে গেছে খানিকটা। আগের অধ্যায়ের টোন, এই অধ্যায়ের টোনের সঙ্গে পুরোপুরি মেলেনি।

আবার কিছু অধ্যায়ে প্রত্যাশা যেভাবে বিল্ড করা হয়েছে, অধ্যায়ের শেষ সেটা পূর্ণ করতে পারেনি। সমস্যাটা বর্ণনার না, সমস্যাটা হচ্ছে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত আশা দেওয়া হয়েছে কিছু অধ্যায়ের শুরুতে। যিশু বা ঈসা (আঃ)-কে নিয়ে বর্ণনা অতটা নেই, আবার পাঠককে আগ্রহী করার জন্য অযথা শেষের ২-৩ অধ্যায় আছে রাসুল (সাঃ) এর জীবনী নিয়ে। দরকার ছিল না এটা করার। ক্লিফ হ্যাঙ্গার রাখার কারণ পাঠকমাত্রই বুঝবেন, তবু এটা করার দরকার ছিল না। তবে এর ফলে অনেকেই সীরাত বা রাসুল (সাঃ) এর জীবনী নিয়ে আরো জানতে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। নতুনভাবে জানার এই আগ্রহ উস্কে দেয়ার জন্য একই সঙ্গে লেখক ধন্যবাদও পাবেন।

লেখক আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ

বইটা পড়ার পরে একটু আফসোস থাকবে, এর পরে কী হলো, সেটা জানার জন্য। পরবর্তী পর্ব আসবে, এর ইঙ্গিত বইতেই দেয়া হয়েছে। সেজন্য অবশ্য অপেক্ষা করতে হবে।

তবে এই বছরই আরেকটি বই প্রকাশিত হয়েছে, ‘দ্য কিংডম অব আউটসাইডারস‘। লেখক, সোহেল রানা। এতে ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইহুদীদের সম্পূর্ণ ইতিহাসটা সংক্ষেপে জানা যাবে। যদিও এই বইয়ের ফ্লেভার পাওয়া যাবে না। সেটা আশা করে লাভও নেই অবশ্য। দুজন লেখকের লেখার ধাঁচ, টোন এক হবে না- সেটাই স্বাভাবিক।

যদি প্রাচীন ও ধর্মীয় ইতিহাস জানার আগ্রহ থাকে, ভাল লাগে কিংবদন্তী, আগ্রহ থাকে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের দ্বন্ধে ইহুদীদের দাবির পেছনের শেকড় বোঝার ব্যাপারে, কীভাবে ইসরায়েল ফিলিস্তিন দখল করে নিল- তাহলে এই বই হাতে তুলে নিতে পারেন। পড়তে পড়তে ঘুরে আসতে পারেন তিন হাজার বছর আগের প্রাচীন পৃথিবীতে। যেখানে ইতিহাস এবং কিংবদন্তী মিলে-মিশে এক হয়ে গেছে।

বইমেলার টপ টেনে থাকা বইটি কিনতে ঘুরে আসুন এই লিংক থেকে।

This article is in Bangla language. It is a review of Ihudi Jatir Itihash (History of Jews) by Abdullah Ibn Mahmud.

Feature Image: The author of the book

Related Articles

Exit mobile version