ভালো মানের ইন্টারনেট কিংবা খানিকটা বাড়তি পয়সা পকেটে থাকলেই এখন নিজ ইচ্ছেমতো যেমন খুশি চলচ্চিত্র চোখের সামনে চলে আসছে আপনার। কিন্তু একটা সময় এমন কিছু দেখা কেন, কল্পনাতেও আনা ছিল অনেক বেশি অসম্ভব কোনো ব্যাপার। ভাবুন তো একবার, আপনি এডওয়ার্ডিয়ান আমলের একজন মানুষ। রাজা ষষ্ঠ এডওয়ার্ডের সময়কাল, অর্থাৎ ১৯০১-১০ সালের মধ্যকার কোনো একটা সময়। কী মনে হচ্ছে? চোখের সামনে পর্দায় নড়তে থাকা মানুষগুলোই যখন মাত্র গা সওয়া হয়ে উঠেছে, ঠিক তখন কেউ একজন আবিষ্কার করে ফেললেন রঙিন চলচ্চিত্র- ব্যাপারটা কি ঠিক সত্যি বলে মনে হওয়ার কথা? ঠিক পড়েছেন, রঙিব চলচ্চিত্র! ১৯০২ সালের কথা। সেসময় নিজের সন্তান, ম্যাকাও পাখী এবং লন্ডনের রাস্তার রঙিন গতিময় স্মৃতিগুলোকে আটকে রেখেছিলেন অ্যাডওয়ার্ড রেমন্ড টার্নার। তবে ১৯০৩ সালে কারো সামনে সেভাবে নিজের কাজকে আনার আগেই মৃত্যু হয় এই মানুষটির। এছাড়া তার এই চেষ্টা পুরোপুরি সফল হয়েছিল এমনটাও বলা যায় না। অনেক বেশি অস্পষ্ট ছিল চিত্রগুলো। ফলে মানুষ যা-ও একটু আঁচ পেয়েছিল পুরো ঘটনাটির, সেটা ভুলে যেতে খুব বেশি সময় লাগেনি কারো।
কিনেমাকালার, দুই রঙকে মিশিয়ে তৈরি করা গতিশীল চিত্র- এর পেছনেও প্রধান প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিলেন টার্নার। তার কাজের পর থেকেই এমন কিছু করার এবং সফলভাবে করার প্রচেষ্টা চলছিল। সেটার সফল সমাপ্তি হয় ১৯০৬ সালে কিনেমাকালারের পেটেন্টের মাধ্যমে। সবার সামনে একে আনা হয় এর তিন বছর পর। কিনেমাকালারের পর মানুষ উদ্ভাবন করে টেকনিকালার। টেকনিকালারে রঙ কেবল দুটোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলো না আর। সেটা ছড়িয়ে পড়ে নানা রকম রঙয়ে। অবশ্য এটি সফলভাবে চালু করতে পেরিয়ে যায় অনেকগুলো বছর। ১৯১৬ সালে প্রথম টেকনিকালার সফলতা পায়। টার্নারের অসমাপ্ত এবং অল্প সফল কাজগুলোকে সফলতা দিতে যে মানুষটি আপ্রাণ চেষ্টা চালান তার হাত ধরেই টার্নারের স্মৃতি ও কর্ম মানুষের কাছে এসে পৌঁছোয়। মানুষটির নাম চার্লস আরবান। চলচ্চিত্রের অগ্রপথিক হয়ে কাজ করেছিলেন এই মানুষটি। তার কাছেই পাওয়া যায় টার্নারের চিত্রায়িত অংশটুকু। বিজ্ঞান জাদুঘরের কাছে চলে আসে সেটি। তবে সেখানে খুব বেশিদিন ছিল না জিনিসটি। এবং খুব স্বাভাবিকভাবে তখনো পর্যন্ত কেউ টার্নারের চিত্রায়িত অংশটির ব্যাপারে কিছু জানতো না। কিছুদিন বাদে চার্লস আরবানের সমস্ত জিনিসপাতি নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় গণমাধ্যম জাদুঘরে। আর সেসময় টার্নারের টেপটি সবার চোখে পড়ে। সেটিকে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আরো পরিষ্কার, আরো বেশি সুসংহত করার চেষ্টা করে সবাই। যেটা কিনা টার্নার করতে চেয়েও করতে সক্ষম হননি সেটাই করার চেষ্টা করা হয় আর এই চেষ্টা সফল হয়।
জাদুঘরের চলচ্চিত্রবিজ্ঞানের তত্ত্বাবধায়ক মাইকেল হার্ভে জানান, বিষয়টি সবার জন্য খুব বেশি অবাক করা ছিল যখন বর্তমানের সুসজ্জিত একটি সম্পাদনা কক্ষে বসে আবিষ্কার করা হয় যে, সামনে যে চিত্রটি চালু আছে সেটি আজ থেকে প্রায় ১১০ বছর আগে চিত্রায়িত হয়েছিল। “চলচ্চিত্র ইতিহাসবিদেরা এই প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে আগেই জানতেন এবং সবসময় ভেবে এসেছিলেন যে এটি কোনো ব্যর্থ প্রচেষ্টা ছিল। আমরা প্রমাণ করে দিয়েছি যে, সেটা সফল হয়েছিল। তবে এখনো অব্দি টার্নারের সেই গতিশীল চিত্রগুলো হাতে গোনা কয়েকজন মানুষই দেখেছে কেবল। টার্নার যেভাবে পুরো বিষয়টিকে সবার সামনে আনতে চেয়েছিলেন ঠিক সেভাবেই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সবার সামনে পুরো জিনিস্টিকে আনতে চাই আমরা”, বলেন হার্ভে। হ্যাঁ, ব্রিটিশ জাদুঘর এই আবিষ্কারটি করতে দেরি করে ফেলেছে, মানুষ অতীতের সফল চেষ্টাটি সম্পর্কে জানতে দেরী করে ফেলেছে; তবু, এতদিন পরে এসেও আজ টার্নারের তোলা চিত্রগুলো আমাদের সামনে। আর কিছুদিনের অপেক্ষা কেবল। এখন সেটা মানুষ দেখেছে, কয়েকজন মানুষ কেবল। কিছুদিন পর সবাই দেখতে পাবে ১১০ বছর আগের সময় আরেকজন মানুষের অসম্ভবকে সম্ভব করার চেষ্টাকে।
এখনো পর্যন্ত টার্নারকে খুব কম মানুষই চেনেন। যারা চেনেন তারাও খুব বেশিদিনের জন্য নয়। কিন্তু এটা তো সত্যি যে, টার্নার অনেক বেশি অবদান রেখে গিয়েছিলেন আমাদের বর্তমান চলচ্চিত্রের পেছনে। তার পরে আরো অনেকে এসেছেন, কাজ করেছেন, টার্নারের রেখে যাওয়া কাজগুলোকেই সম্প্রসারিত করেছেন। কিন্তু তাদের সামনে আলোকবর্তিকা ধরে এগিয়ে যাওয়া মানুষটিকে কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো সম্মান বা স্থান দেওয়া হয়নি কোথাও। কোথাও তাকে চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার কারণে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তার কাজকে স্বীকার করে নেওয়া হয়নি। মানুষ তেমন একটা জানেই না টার্নার নামে কোনো মানুষ সম্পর্কে। কে ছিলেন এই টার্নার? প্রথমেই বলেছি তার সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। তবে যতটুকু জানা যায় সেটুক বলতে গেলে, তার পুরো নাম এডওয়ার্ড রেমন্ড টার্নার। টার্নারের জন্ম হয়েছিল ১৮৭৩ সালে। লন্ডনের বেড়ে ওঠা, সেখানেই সমস্ত কাজের শুরু। ছবি তুলতে ভালোবাসতেন। আর সেই ছবি তোলার প্রতি ভালোবাসা থেকেই ধীরে ধীরে পেশা হিসেবে পুরো বিষয়টিকে নিয়ে নেওয়া। লন্ডনে একটি স্টুডিওতে কাজ করতেন টার্নার। রঙিন ছবি তোলার প্রথমভাগে কাজ করেন টার্নার। তবে টার্নার বিশ্বাস করতেন, কেবল স্থিরচিত্রেই নয়, গতিশীল চিত্রেও রঙ মেশানো সম্ভব। তবে তার কাছে এমন কোনো কাজ করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ ছিল না। তাই বলে ইচ্ছের কমতি হয়নি এতটুকু। দমে যাননি টার্নার।
ফ্রেডরিক লী ঘোড়া প্রজনন এবং ঘোড়সওয়ারী হিসেবে বেশ নাম করেছিলেন তখন। টাকাও ছিল অনেক। তার কাছ থেকেই টাকা নেওয়ার এবং রঙিন চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ শুরু করার পরিকল্পনা করেন টার্নার। ১৮৯৯ সালে লী এবং টার্নারের নামে দুটো প্যাটেন্ট নেওয়া হয়। আর তার ঠিক দুই বছর পর ঘটনাচিত্রে প্রবেশ করেন চার্লস আরবান। এই দুজনের পেছনে থেকেই কাজ করে যান তিনি। পরে অবশ্য সমস্ত আবিষ্কারের সম্পূর্ণতা এনে দিতে, সেগুলোকে মানুষের সামনে তুলে ধরতে কাজ করেন আরবান। ১৯০১-০৩ সালের মধ্যে টার্নার নিজের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্রের কাজ করেন।
সেগুলোকে নিজের ক্যামেরায় চিত্রায়িত করেন। সেসময় মোট ৩৩ মিলিমিটারের পরীক্ষামূলক চিত্র ধারণ করেন তিনি। তবে এর বেশি কিছু করা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। মাত্র ২৯ বছর বয়সে হঠাৎ করে মৃত্যু হয় টার্নারের। থেমে যায় সব কাজ। চার্লস আরবান দেরী করেননি। তিনি টার্নারের মৃত্যুর পর তার সমস্ত অসমাপ্ত কাজের ভার দেন সহকারী জর্জ এলবার্ট স্মিথের কাছে। তবে এই পুরো ব্যাপারটির সফলতার জন্যে দরকার ছিল প্রদর্শনের সময় প্রতি সেকেন্ডে ৪৪ ফ্রেম গতি। এছাড়া ছবিগুলোর সারিবদ্ধ হওয়াটাও ছিল জরুরী। যেটা তখন সম্ভব হয়নি এবং পুরো ব্যাপারটিতেই তাই একরকমের ব্যর্থতা। স্মিথ এই কাজ থেকে সরে গিয়ে কিনেমাকালারের দিকে মন দেন। ফলে, টার্নারের কথা ধামাচাপা পড়ে যায়। অবশ্য এখন আর সেটা হওয়ার নয়। গতিশীল চলচ্চিত্রের জনক হিসেবে টার্নারকেই উল্লেখ করেন জাদুঘর সংশ্লিষ্টরা।
ফিচার ইমেজ: Financial Times