বই! হ্যাঁ, বই-ই মানুষের সত্যিকারের বন্ধু। বলা হয়ে থাকে- চলার পথে আপনার বন্ধু হারিয়ে যেতে পারে, আপনাকে বর্জন করতে পারে। কিন্তু বই কখনো আপনাকে পর করবে না। গল্প, কবিতা, উপন্যাস কিংবা সাহিত্যের কোনো বই, তা সে যে বই-ই হোক না কেন, বই পড়ে অর্জিত জ্ঞান জীবন চলার পথে পাথেয় হিসেবে কাজ করে সারাটা জীবন। মানুষের জীবনে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই।
কাগজ আবিষ্কারের পর থেকেই আজ অবধি প্রকাশিত হয়েছে কোটি কোটি বই। পৃথিবীর অসংখ্য পাঠককে উদ্দেশ্য করে প্রকাশিত হয় এসব বই। অনেক বই সময়ের সাথে সাথে কালের গর্ভে হারিয়ে যায়, আবার অনেক বই দেশ, জাতি, কাল ছাড়িয়ে জায়গা করে নেয় অসংখ্য পাঠকের হৃদয়ে। এভাবেই লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হওয়া বেস্টসেলিং বইগুলো জায়গা করে নিয়েছে অসংখ্য বইয়ের দোকানে, পাঠাগারে। আসুন, জেনে নেই এরকম আটটি বই সম্পর্কে, যেগুলো সারা পৃথিবী জুড়ে সর্বাধিক বিক্রি হওয়ার তকমা পেয়েছে।
৮. দ্য হবিট
অক্সফোর্ড প্রফেসর ও বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী জে. আর. আর. টলকিনের লেখা জগদ্বিখ্যাত কিশোর ফ্যান্টাসি উপন্যাস ‘দ্য হবিট’। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি তিনি নিজের সন্তানদের জন্য লিখলেও সারা পৃথিবীর কোটি কোটি শিশু-কিশোরের কাছে প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা পায় বইটি। ৫০টির বেশি ভাষায় অনুবাদ হওয়া এই উপন্যাসটি জিতে নেয় অসংখ্য পুরস্কার। তখন থেকে সময়ের কাছে হার না মানা এই শিশুতোষ উপন্যাসটিকে এখন পর্যন্ত বিবেচনা করা হয় এক জনপ্রিয় ‘কিশোর ক্লাসিক’ হিসেবে। সারা পৃথিবীতে ১০০ মিলিয়ন কপির বেশি বিক্রি হয় উপন্যাসটি। শিশু-কিশোরদের কাছে টলকিনের বই মানে এক পাগলামি, এক উন্মাদনা। এই উপন্যাসের মাধ্যমে টলকিন চিরকাল জায়গা নিয়ে থাকবেন পৃথিবী জুড়ে তার অসংখ্য ভক্তের হৃদয়ে।
৭. দ্য ড্রিম অব দ্য রেড চেম্বার
কাও শয়েচিনের লেখা ‘দ্য ড্রিম অব দ্য রেড চেম্বার’ চীনা সাহিত্য জগতের ইতিহাসে এমন এক ফিকশন, যাকে চীনের সবচেয়ে জনপ্রিয় চার ক্লাসিক উপন্যাসের একটি হিসেবে ধরা হয়। ১৮ শতকের মধ্যভাগে রচিত এই উপন্যাসটিকে ‘দ্য স্টোরি অব দ্য স্টোন’ নামেও বলা হয়ে থাকে। প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসা ঘরানার কাহিনী নিয়ে গড়ে ওঠা এই উপন্যাসে চীনের মহান সভ্যতার জয়গান গাওয়া হয়েছে। চি চেন ওয়াং– এর ইংরেজি অনুবাদের আগে পাশ্চাত্য জগতের তেমন কেউই চিনতো না এই মহান সাহিত্যকর্মটিকে। উপন্যাসটি এ পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে ১০০ মিলিয়ন কপির বেশি।
৬. অ্যান্ড দেয়ার ওয়্যার নান
ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক আগাথা ক্রিস্টির লেখা ‘অ্যান্ড দেয়ার ওয়্যার নান’ রহস্য উপন্যাসের জগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক নাম। কলিন্স ক্রাইম ক্লাব প্রকাশনীর এই উপন্যাসটি লন্ডনের বাজারে আসে ৬ নভেম্বর, ১৯৩৯ সালে; ‘টেন লিটল নিগারস’ নামে। প্রকাশের পর সাড়া ফেলে দেওয়া এই উপন্যাসটি পরবর্তীতে আমেরিকায় প্রকাশিত হয় একই বছরের ডিসেম্বরে, পরিবর্তিত নামে এক নামে, ‘অ্যান্ড দেয়ার ওয়্যার ন্যন’। রহস্য উপন্যাসের জগতে সবথেকে বেশি বিক্রি হওয়া এই উপন্যাসটি মোটের উপর বিক্রি হয়েছে ১০০ মিলিয়ন কপির বেশি।
৫. হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য সরসারার’স স্টোন
ফ্যান্টাসি উপন্যাসের জগতে এক অবিস্মরণীয় নাম জে কে রাওলিং । তার ৭ পর্বের ‘হ্যারি পটার’ সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য সরসারার’স স্টোন’ প্রথমে ব্রিটেনের বাজারে আসে ১৯৯৭ সালে, ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসোফার স্টোন’ নামে। পরবর্তীতে বইটির শিরোনাম একটু পালটে আমেরিকায় ১৯৯৮ সালে বইটি প্রকাশিত হয় ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য সরসারার’স স্টোন’ নামে। এই উপন্যাস সিরিজের কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘হ্যারি’ এক অদ্ভুত ক্ষমতাসম্পন্ন কিশোর জাদুকর। প্রথম প্রকাশের পর থেকেই রাওলিংকে আর কখনোই পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১০৭ মিলিয়ন কপির উপরে বিক্রি হওয়া এই বইটিই তাকে নিয়ে যায় কিশোর ফ্যান্টাসি জগতের সেই অনন্য উচ্চতায়, যেখানে আজ তার কোটি কোটি পাঠক।
৪. দ্য লিটল প্রিন্স
ফরাসি ভাষার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অনুবাদ হওয়া এই উপন্যাসিকা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ সালে। অঁতোয়ান দ্য স্যাঁৎ-একজ্যুপেরি রচিত ‘রুপকধর্মী এবং আধ্যাত্মিক আত্মজীবনীমূলক’ এই ক্লাসিক শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী পাঠকের কাছে সমানভাবে জনপ্রিয়। ইংরেজি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা এই বইটি বিক্রি হয়েছে ১৪২ মিলিয়ন কপির বেশি। বিপদগ্রস্থ এক পাইলটের সাথে এক ছোট রাজপুত্রের ভ্রমণকাহিনী নিয়ে রচিত এই উপন্যাসিকা। তিনশ’র মতো ভাষায় অনুবাদ হওয়াই বলে দেয় অত্যন্ত বিখ্যাত এই ছোট বইটির তুমুল জনপ্রিয়তা সম্পর্কে।
৩. দ্য লর্ড অব দ্য রিংস ট্রিলজি
জে. আর. আর. টলকিন তার লাখো ভক্তের কাছে আজীবন বেঁচে থাকবেন দ্য লর্ড অব দ্য রিংস ট্রিলজির জন্য। কল্পকাহিনী নির্ভর এই মহাকাব্যিক ট্রিলজি বিক্রি হয়েছে ১৫০ মিলিয়ন কপিরও বেশি। টলকিনের আরেক শিশুতোষ উপন্যাস ‘দ্য হবিট’ থেকে এই ট্রিলজির যাত্রা শুরু হলেও পরবর্তীতে তা বিস্তৃতি ছাড়িয়েছে বহুদূর। অধিকাংশ লেখা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে রচিত হলেও ১৯৫৪-৫৫ সালে তিন খণ্ডের এই বহুল আলোচিত উপন্যাস প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পর থেকেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্করণে বইটি অনুবাদ করা হয়েছে ৩৮টি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায়। এই ট্রিলজির তিনটি বই হচ্ছে–
- দ্য ফেলোশিপ অব দ্য রিং
- দ্য টু টাওয়ারস
- দ্য রিটার্ন অব দ্য কিং
২. এ টেল অব টু সিটিস
“স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব অথবা মৃত্যু। সহজতর হলো মৃত্যু। যেমন, গিলোটিনের নিচে মাথা পেতে দেওয়া”
– চার্লস ডিকেন্স
চার্লস ডিকেন্সের অসম্ভব জনপ্রিয় এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৮৫৯ সালে। প্রকাশের পর থেকেই সাড়া ফেলে দেওয়া এই উপন্যাসটি বিক্রি হয়েছে অন্তত ২০০ মিলিয়ন কপি। ঐতিহাসিক এই উপন্যাসের প্লট আবর্তিত হয়েছে ফরাসি বিপ্লবের আগের সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে। ঐ সময়ের লন্ডন কেন্দ্রিক সমাজের চিত্র ফুটে উঠেছে উপন্যাসটিতে। একই রকম দেখতে কিন্তু সম্পূর্ণ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন দুজন ব্যক্তি চার্লস ও সিডনির কাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে এই উপন্যাসটি।
১. ডন কিহোতে
স্প্যানিশ ভাষার উপন্যাস ডন কিহোতে উপন্যাসের জগতে এমন এক বিস্ময়, যা অন্ততপক্ষে বিক্রি হয়েছে ৫০০ মিলিয়ন কপি। মিগুয়েল দে সারভান্তেজের লেখা দুই খণ্ডের এই উপন্যাসের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৬০৫ সালে। প্রকাশের পরপরই সাড়া ফেলে দেয় এটি। পশ্চিমা সাহিত্যের ইতিহাসের অন্যতম সাড়া জাগানিয়া এই উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৬১৫ সালে। নাইট ডন কিহোতের সাহসী সব পরিভ্রমণ নিয়ে এই উপন্যাসের কাহিনী।
পরীক্ষাধর্মী বিন্যাস ও সাহিত্য রসের কারণে উপন্যাসটিকে প্রথম আধুনিক উপন্যাস হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। আধুনিক অনেক ঔপন্যাসিক যেমন- ফিল্ডিং, স্টারন, ডিকেন্স, মেলভিল, ফকনার সহ আরও অনেক লেখকের কাছে ‘সাহিত্যের বাইবেল’ স্বরূপ কাজ করে এই উপন্যাস। শুধুমাত্র সৃজনশীলতা বাড়াতে অনেক লেখকের কাছে এটি অবশ্য পাঠ্য।
ফিচার ইমেজ: History Things