নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকের কণ্ঠে ১৬ বছর পলাতক থাকা ভারতের কুখ্যাত ক্রাইমলর্ড গণেশ গাইতোন্ডের বলে ওঠা কথাটি ভেসে এলো। শ্রোতা? মুম্বাইয়ের এক চুনোপুঁটি পুলিশ অফিসার সারতাজ সিং। এই চরিত্রে আছেন সাইফ আলী খান। বলেছিলেন “ভগবানে বিশ্বাস করো?” এই কথার সাথে ২৫ দিনের মাথায় মুম্বাইয়ের বুকে হতে চলা ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার কী সম্পর্ক? কেন অপরাধ জগতে ফিরে আসা গডফাদার গাইতোন্ডে বলছে, সবাই মারা যাবে? বেঁচে থাকবে শুধু একজন। কে সেই একজন?
হলিউডের পর্দায় আর টিভি সিরিজে এমন কাহিনী অনেকবারই দেখেছেন। সন্ত্রাসী হামলা হতে চলেছে কোনো শহরে, নায়ক আর তার দলবল উঠে পড়ে লাগে সে হামলা ঠেকাতে আর নাটের গুরুদের ধরতে। সময়ের দৌড়ে ধরাও পড়ে খলনায়কেরা। তবে উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন চলচ্চিত্র বা সিরিজ খুব একটা দেখা যায় না। সে অভাব কিছুটা পুষিয়ে দিল নেটফ্লিক্সের ‘স্যাক্রেড গেমস’। তবে ভারতের অপরাধ জগতকে এর আগেও রূপালি পর্দায় দেখা গেছে, গ্যাংস অব ওয়াসিপুর তার অন্যতম উদাহরণ। কিন্তু কী এমন কাহিনী আছে স্যাক্রেড গেমস-এ যে মুক্তির সাথে সাথেই সাড়া পড়ে গেল?
গল্পের নায়ক সারতাজ সিং, তার বাবা ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার। বাবার আদর্শে ছেলেও এখন মুম্বাই পুলিশ ফোর্সের অফিসার। সততার কারণে সারতাজ মেনে নিতে পারেন না ভারতের আইনরক্ষক পুলিশ বাহিনীর দুর্নীতি। কিন্তু তারপরও তাকে জোর করে মাথানত করতে হয়। গল্পের শুরুতেই নির্দোষ এক কিশোরকে বিনা বিচারে হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দিতে তাকে জোর করা হয়। বিবেকের তাড়নার সঙ্গে সারতাজ জড়িয়ে পড়েন চার দশকের পুরনো এক অপরাধ জগতের কাহিনীর সাথে।
তার ফোনে কল আসে। কল করেছেন গণেশ গাইতোন্ডে নামের এক ব্যক্তি। গাইতোন্ডে তাকে সতর্ক করে দেয়- ২৫ দিনের মাথায় মুম্বাইয়ের সবাই মারা যাবে। গাইতোন্ডের পুরনো নথি খুঁজে বের করতে আর্কাইভে হানা দেন সারতাজ, এরপর বেরিয়ে আসে থলের বেড়াল আর একের পর এক কাহিনী। মুম্বাইয়ের কাহিনী দেখতে দেখতে দর্শক হারিয়ে যান এক সময়ের বোম্বের অপরাধ জগতে, যখন গাইতোন্ডে ছিল ছোট শিশু।
শিশু গাইতোন্ডে ছোটবেলায় নিজের ব্রাহ্মণ ভিক্ষুক বাবাকে নিয়ে প্রতিদিন বেরুতো ভিক্ষা আদায়ের জন্য। একদিন সে অসময়ে বাসায় ফিরে আবিষ্কার করে তার মা-কে পতিতাবৃত্তি করা অবস্থায়। ঘুমন্ত মা-কে ভারী পাথরের আঘাতে হত্যা করে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায় শিশু গণেশ।
গাইতোন্ডের বড় হবার সাথে সাথে তার তিন গড ফাদারের কথা জানতে পারি। এরা তাকে অসময়ে সাহস কিংবা অর্থ জোগায়। কিন্তু নানা ঘটনায় তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। কেন? আর যা-ই হোক সেটা স্বাভাবিক কারণে নয়।
কীভাবে এক সাধারণ শিশু থেকে বোম্বের অপরাধ জগতের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে গেল গাইতোন্ডে?
কীভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী গডফাদাররা একে একে সরে গেল? কী কারণে এত ক্ষমতাবান হয়েও সে পলাতক হয়ে গেল? কেন আজকের ভারতের মন্ত্রীমহোদয় গাইতোন্ডের নাম ফিরে আসায় এত ভীত? সারতাজ সিংয়ের ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারের অতীতের সাথে কী সম্পর্ক তার? ভারতের অধুনা রূপালি পর্দার জনপ্রিয় ও সুন্দরী মডেলরা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজন্মের হলেও কেন তার খবর শুনেই শিউরে উঠে নিজেকে গুটিয়ে নিল? তার আবাসের মেঝেতে পড়ে থাকা মেয়েটি কে? একের পর এক রহস্যের সাথে যখন সারতাজ জানতে পারে তার ছেলেবেলার ব্যাটখানাও আসলে গাইতোন্ডের উপহার, তখন নিজের সৎ জেনে আসা প্রয়াত বাবাকে নিয়ে সন্দেহে পড়ে যান তিনি। এ রহস্যগুলোর জট তাকে খুলতেই হবে। কিন্তু রহস্যের সমাধানটা কী?
ওদিকে গাইতোন্ডের নাম উঠে আসায় ভারতীয় ইন্টেলিজেন্স উইং ‘র’-এর এজেন্টরাও উঠে পড়ে লাগে। এর মাঝে অঞ্জলী মাথুর যেন সারতাজের প্রতি পদক্ষেপ ছায়ার মতো অনুসরণ করে যেতে থাকেন, তারই বা কী উদ্দেশ্য? মন্ত্রী কেন চান, র-এর এজেন্ট এ মামলা সমাধান না করুক?
এতগুলো প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে দর্শককে দেখতে হবে সিরিজটি। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলো নিয়ে সিরিজ হয়েছিল। সেগুলো নেটফ্লিক্সে থাকলেও আসলে নেটফ্লিক্সের মৌলিক সম্পত্তি নয়। নেটফ্লিক্স অরিজিনাল বলতে যা বোঝায় সে হিসেবে ভারতীয় প্রথম নেটফ্লিক্স সিরিজ হলো এটি। বিক্রম চন্দ্রের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনেই সিরিজটি নির্মিত হয়েছে। ফ্যান্টম ফিল্মস ছিল যৌথ প্রযোজনায়। আট পর্বের এ সিরিজটি অনুরাগ কশ্যপ আর বিক্রমাদিত্য মোত্বানি পরিচালনা করেন। অনুরাগ কশ্যপই কিন্তু সেই গ্যাংস অব ওয়াসিপুর-এর পরিচালক, তাই এই সিরিজটিও যে ভালো হবে তা স্বাভাবিকই ছিল। সাম্প্রতিক মুক্তি পাওয়া ‘লাস্ট স্টোরিজ’-ও তারই!
নেটফ্লিক্সের ‘নার্কোস’ (২০১৫-) সিরিজটি মুক্তি পাবার পর থেকে কোকেন ব্যবসা থেকে বিলিয়নিয়ার হওয়া ড্রাগলর্ড পাবলো এস্কোবারের এক নতুন ভক্তকুল সৃষ্টি হয়। দর্শক জানেন এবং বোঝেন যে এস্কোবার যা করেছিলেন, যত মানুষের রক্ত তার হাতে- সবই ঘৃণ্য এবং শাস্তিযোগ্য। কিন্তু তাও পাবলো এস্কোবার যেন এক আইকনের নাম। ঠিক যেন পাইরেটস অফ দ্য ক্যারিবিয়ানের মতো। জ্যাক স্প্যারো এক দস্যু জেনেও সবাই নিজের অজান্তেই পক্ষ নেয় দস্যুরই।
এস্কোবারের মতোই গণেশ গাইতোন্ডে যখন গড কমপ্লেক্সে ভোগে (নিজেকে ঈশ্বর ভাবতে থাকে) তখন রক্তবন্যা ভাসিয়ে দিলেও দর্শকমনে সে ঠাই করে নেয় অন্য মাত্রায়। গড কমপ্লেক্সে ভোগা মানুষেরা সাধারণত নিজেদের ত্রুটির ঊর্ধ্বে মনে করে থাকে, সমাজের নিয়ম কানুন কোনো কিছুই যেন তার জন্যে নয়।
২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি শুটিং শেষ হবার পর গত ৬ জুলাই নেটফ্লিক্সে মুক্তি দেয়া হয় এ সিরিজটি। সারতাজ সিং রূপী সাইফ আলী খান ইতোমধ্যে কুড়িয়েছেন অকুণ্ঠ প্রশংসা। আর ওদিকে গডফাদার বা গ্যাংস্টার রূপে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি গ্যাংস অব ওয়াসিপুরকেও পেছনে ফেলে দিলেন কিনা সে নিয়ে উঠছে চায়ের কাপে ঝড়। সিদ্দিকি কিন্তু ইতোমধ্যে বলে দিয়েছেন যে এটি তার করা সবচেয়ে জটিল চরিত্র, এবং তিনি অনুভব করেন যে সিরিজে এ চরিত্রের বেড়ে ওঠার জন্য অনেক সময় পাওয়া গিয়েছে, যেটি হয়ত সিনেমাতে পাওয়া যেত না। রাধিকা আপ্তে যদিও তার অন্য কাজগুলোতে নিজেকে প্রমাণ করেছেন, কিন্তু এ সিরিজে তার উপস্থিতি কিছুটা মলিন।
সাতটি ভারতীয় অরিজিনাল নেটফ্লিক্স সিরিজ বানাবার ঘোষণা আসবার পর ২০১৪ সালে লস এঞ্জেলেসে বিক্রমাদিত্য মোত্বানি নেটফ্লিক্সের সাথে মিটিং-এ বসে ঠিক করেন যে বিক্রম চন্দ্রের বইটি থেকে সিরিজ বানাবেন। আর সেই চিন্তার ফসলই আজকের এ নেটফ্লিক্স সিরিজটি। সিরিজের আরেকটি চমৎকার দিক হলো এর অসাধারণ সাউন্ডট্র্যাক, ঠিক সময়ে ঠিক সুর দেয়াটাও যে একটি শিল্প, সেটি নিপুণভাবে করে দেখানো হয়েছে। তবে একটা বিষয় না বললেই নয়, ভারতীয় কাজ দেখেই যে সপরিবারে বসে উপভোগ করার মতো তা কিন্তু নয়; নেটফ্লিক্সের মোড়কে হওয়ায় ঠিক যেমনটি আপনি গ্যাংস অব ওয়াসিপুরে হয়তো দেখেননি, ঠিক সেটিই দেখতে পাবেন এ সিরিজে।
এই সিরিজে রাজীব গান্ধীকে ‘অপমান’ করবার কারণে মামলাও ঠুকে দেয়া হয়েছে ভারতের মাটিতে।
সত্যিকারের কিছু লোকেশনে সিরিজটির শুটিং করা হয়েছে, যেন দর্শক প্রকৃত অনুভূতিটা পেয়ে থাকেন। আশির দশক থেকে হয়ে যাওয়া ঘটনাগুলো ফ্ল্যাশব্যাকে একটু পর পর দেখানোর কারণে, সত্যিকারের ঐতিহাসিক পটভূমিতে সিরিজটি ফুটে ওঠে। ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ড, বাবরি মসজিদ ঘটনা, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা- একে একে সবই উঠে আসে পর্দায়। আর বর্তমানের প্রেক্ষাপটে উঠে আসে ২৬/১১-র ঘটনা বলে পরিচিত কুখ্যাত মুম্বাই সন্ত্রাসী আক্রমণ, আর সেই সাথে উঠে আসে অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর কথাও। মূলত পবিত্রজ্ঞান করা ধর্মগুলোকে ব্যবহার করে বা ঢাল বানিয়ে, ধর্মব্যবসাকে পুঁজি করে হানাহানি আর রক্তবন্যার যে খেলা চলে অন্ধকার জগতে, সেটিকেই ‘পবিত্র খেলা’ বা ‘স্যাক্রেড গেমস’ ডাকা হয়েছে। সিরিজটির ট্রেলার দেখতে পারেন এ ভিডিওতে-
ক্রাইম থ্রিলার ঘরানার সিরিজটি দেখতে ক্লিক করতে পারেন এখানে। সাইফ আলী খান জানিয়েছেন, সিরিজটির চারটি সিজন দেখা যাবে, প্রতিটির থাকবে আটটি করে পর্ব। ইতোমধ্যে সিরিজটির আইএমডিবি রেটিং ৯.৪/১০ আর রটেন টমেটোজের টমেটোমিটারে এখন পর্যন্ত ১০০% ফ্রেশ। তবে আর দেরি কেন? হারিয়ে যান রূপালি পর্দায় বোম্বে থেকে মুম্বাইয়ের আন্ডারওয়ার্ল্ডে।
ফিচার ইমেজ: The Quint