কিছু কিছু ছবি থাকে, যেগুলো শেষ হওয়ার পরও লম্বা সময় ধরে দর্শকের মনের কোণে রয়ে যায়। দর্শক বারবার ভাবে, এরপর কী হলো চরিত্রদের ভাগ্যে? কোনো সিক্যুয়েল কি আসবে? ২০১৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তামিল ছবি ‘৯৬’-ও যেন ঠিক তেমনই। দর্শক আজও সমানভাবে সম্মোহিত রাম-জানুর প্রেমকাহিনীতে, ইতোমধ্যেই অনেকের কাছে যেটি পেয়ে গেছে অমরত্বের সম্মান।
আশার কথা হলো, ‘৯৬’-এর সমাপ্তিতে দর্শকের মনে যে অতৃপ্তি রয়েছে, জন্ম নিয়েছে হাজারো প্রশ্ন, সেগুলো দূর করার চেষ্টা করেছেন স্বয়ং ছবিটির লেখক-পরিচালক প্রেম কুমার। ২০১৯ সালের অক্টোবরে ফিল্ম কম্প্যানিয়নের বিশাল মেননের নানা প্রশ্নের জবাবে তিনি তুলে ধরেছেন রাম-জানুর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিজের ভাবনার কথা। ‘৯৬’ ছবিটি যারা দেখেছেন, তাদের জন্য এই সাক্ষাৎকারকে বলা যায় অমূল্য। কারণ এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তারা আরো ভালোভাবে জানতে, এবং নতুন করে আবিষ্কার করতে পারবেন, তাদের প্রিয় চরিত্র রাম ও জানুকে।
তাহলে চলুন পাঠক, বিশাল মেনন ও প্রেম কুমারের কথোপকথনের মাধ্যমে আমরা আরো একবার হারিয়ে যাই রাম ও জানুর অপূর্ণ অথচ অনন্য ভালোবাসার জগতে।
আমি ‘৯৬’-কে দেখি এমন একটি ট্র্যাজেডি হিসেবে, যেটি শেষে কিছুটা হলেও আশা জাগিয়ে যায়। আপনিও কি এভাবেই দেখেন?
আমি একে ট্র্যাজেডি বলব না। শেষে ওদের বিচ্ছেদটা তো অনিবার্য ছিল, এবং দর্শকরাও সেটি ভালো করেই জানে। এক অর্থে বিষয়টি মৃত্যুর সাথে তুলনা করা চলে। আমরা জানি কী ঘটতে চলেছে, কিন্তু তারপরও আমরা সবসময় ভীতসন্ত্রস্ত থাকছি। অথচ আমরা (মৃত্যুর) পরে কিছুই অনুভব করব না। এই ভয়টা মূলত আসে ‘কীভাবে’ থেকে। কীভাবে সবকিছু শেষ হবে, সেটা নিয়েই আমাদের যত চিন্তা। ‘৯৬’ দেখার সময় দর্শকের মনে একধরনের দ্বৈততা খেলা করে। একদিকে তারা সত্যিই চায় রাম আর জানুর মধ্যে কিছু হোক। কিন্তু, তারা এটি নিয়েও ভীত যে রাম আর জানু যদি শেষ পর্যন্ত একসাথে হয়, তাহলে কী ঘটবে। যদিও দর্শক ছবির শেষে কেঁদেছে, তবু তারা জানে যে যা ঘটেছে তা আসলে নিজের মতো করে সঠিকই ঘটেছে।
আপনি কেন এভাবে ভাবছেন? দর্শক কি আরো বেশি খুশি হতো না, যদি রাম আর জানু আজ একসাথে থাকত?
এটি আসলে আমাদের সংস্কৃতিতেই রয়েছে। শারীরিক অন্তরঙ্গতাকে, আমাদের প্রেক্ষাপটে, ‘অপবিত্র’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমি জানি এটি একটি খুবই ভারতীয় মানসিকতা, বিশেষ করে আগের প্রজন্মের মানুষের জন্য। কিন্তু এভাবেই আসলে ক্লাইম্যাক্সটা সবচেয়ে ভালো মানায়। যদিও ওরা শেষ অবধি একে অন্যের হয়নি, তারপরও দর্শক এতেই খুশি যে রাম আর জানু নিজেদের মধ্যে কিছুটা সময় তো অন্তত কাটাতে পেরেছে। আমার বয়স ৪১ (বর্তমানে ৪৩), এবং আমার প্রজন্মের অনেক মানুষের কাছে, ঐ একটি সাক্ষাতই হলো যা আমরা চাই। আমরা কখনোই চাইব না আমাদের নিজেদের স্বার্থে জানুর বিয়েটা ভেঙে যাক, ওর মেয়ের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হোক।
কিন্তু আপনার কি মনে হয় না ওই একটি সাক্ষাতের ফলেই গোটা বিষয়টি ওদের দুজনের জন্য আরো বেশি বেদনাদায়ক হয়ে উঠবে?
প্রেমের নামই তো বেদনা, তাই না? শেষমেশ, ভালোবাসা একটি রাস্তা ঠিকই খুঁজে নেয় কিছু বেদনা পিছে ফেলে যাওয়ার জন্য। যতক্ষণ ভালোবাসা থাকে, ততক্ষণই এটি আনন্দদায়ক। কিন্তু তারপর রাম আর জানু দুজনের জন্যই এখন যা অবশিষ্ট রয়েছে, তা হলো স্মৃতি। তাই হয়তো এই একটি সাক্ষাৎ ওদের জীবনকে আরো কঠিন করে তুলবে না। কারণ যে মুহূর্তগুলোর ক্ষমতা রয়েছে আপনার স্মৃতির অংশ হওয়ার, সেগুলো দিনশেষে আনন্দময় আবেশেই পরিণত হয়।
জানুর স্বামী কেমন মানুষ হতে পারে বলে আপনি মনে করেন? আমার মাথায় তো তার যে ছবিটি রয়েছে, সেটি অনেকটা ‘মৌন রাগম’-এর মোহনের মতো।
এই ছবিতে, রামের অ্যাপার্টমেন্টের একটি দৃশ্য রয়েছে যেখানে জানু বলছে ওর স্বামী খুবই ভালো মানুষ এবং ভালো বাবা। আমিও তাকে একজন আদর্শ স্বামী হিসেবেই চিন্তা করি। কিন্তু তার মানেই এই নয় যে দুজন খুব ভালো মানুষ একত্রে থাকলেই তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক অসাধারণ কিছু হবে। ভালোবাসা জিনিসটি একেবারেই ভিন্ন কিছু।
আপনার কি মনে হয় জানু ওর স্বামী সারাভানানকে বলেছে রামের সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে?
আমি মনে করি সারাভানান জানে। সে জানে তার স্ত্রীর হৃদয়ে অন্য কেউ বাস করে। সে জানত জানু একদিন রামের সাথে দেখা করতে যাবে, নতুন করে প্রেমে পড়বে, নিজের হৃদয়ের সব অনুভূতি ব্যক্ত করবে। কিন্তু সে এও জানত, জানু আবার ঠিকই ফিরে আসবে ওর স্বামীর কাছে, মেয়ের কাছে। সেজন্যই সারাভানান অবশ্যই স্বস্তিতে ছিল জানুর রিইউনিয়নে যাওয়ার ব্যাপারে। এমন অনেক স্বামীই হয়তো রয়েছে, যারা এ ধরনের কোনো সম্ভাবনার বিরোধিতা করবে। তবে এমন অনেক স্বামীরও অস্তিত্ব নিঃসন্দেহে রয়েছে, যারা চাইবে তাদের স্ত্রীর এ ধরনের অভিজ্ঞতা হোক। কারণ, অনেক মানুষকেই তো শেষ পর্যন্ত সারাজীবন কাটাতে হয় এমন কারো সাথে, যাদেরকে তারা সত্যিকারের ভালোবাসে না। একজনের স্বপ্ন আর চূড়ান্ত বাস্তবতার মাঝে অনেক ফারাক থাকতে পারে।
বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে এটি খুবই সত্য। আমাদের প্রজন্মের অনেক পুরুষের কথাই আমি মনে করতে পারি, যারা প্রেমে পড়ার পর বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে সেটি স্বীকার করতে পারত, প্রেমিকাকে বিয়ের চেষ্টা অন্তত করতে পারত। কিন্তু একজন নারীর জন্য এটি ছিল খুবই কঠিন একটি বিষয়। পুরুষদেরকেই প্রথমে নিজেদের ভালোবাসার কথা মুখ ফুটে বলতে হতো, এবং সেই বুকের পাটাও থাকতে হতো বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার জন্য। বর্ণ ও সম্প্রদায়ও বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
জানুর মতো অনেক নারীকেই তাই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হতো এমন কোনো পুরুষের সাথে, যাদেরকে তারা বলতে গেলে একেবারেই চেনে না। এমনকি আমার নিজের পরিবারেও, নারীরা তাদের ভালোবাসার পুরুষদের বিয়ে করতে পারেনি। এ কারণেই, এ ধরনের রিইউনিয়ন বা বহুদিন পর প্রেমিকের সাথে সাক্ষাৎ হতে পারে অনেক নারীর আজন্মলালিত স্বপ্ন, এবং আমার মনে হয় সারাভানান ব্যাপারটি বোঝে। সে মোটেই ভিলেন নয়। বরং, সে একজন হিরো। সে রামের মতোই একজন ভালো মানুষ… কিংবা, হয়তো রামের চেয়েও ভালো।
কিন্তু তারপরও জানু নিশ্চয়ই স্বীকারোক্তি দিতে চাইবে, তাই না? অন্তত, যদি ওর মনে কোনো অপরাধবোধ থাকে।
ওর তো এসবের কোনো দরকার নেই! আপনি কেবল তখনই স্বীকারোক্তি দেবেন, যখন আপনার দ্বারা একটি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু ওদের দেখা হওয়াটা তো কোন ভুল ছিল না। এটি ছিল জানুর জার্নির একটি অংশ। জানু বিশ্বাস করত রামের সাথে দেখা হওয়াটা তাকে স্বস্তি দেবে। অবশ্য ওর সেই বিশ্বাস ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে সেই মুহূর্তে, যখন ও বুঝতে পেরেছে রাম এখনো অবিবাহিত, এবং এখনো ওকেই ভালোবাসে। কিন্তু আবারও, এটি সেই প্রজন্মের সমস্যা। যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমরা এখনো অতটা ভালো নই, যতটা আপনারা বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। কিন্তু, জানু যেই মুহূর্তে রিউনিয়ন থেকে বাসায় ফিরবে, ওর স্বামী তখনই সব বুঝে ফেলবে।
আমার মনে হয় এরপর জানু বিষণ্নতায় চলে যাবে। ও হয়তো এখন ওর জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর পর্যায় পার করছে। কারণ ও এখন জানে, ও যে মানুষটিকে ভালোবাসে, সেই মানুষটিও এখনও ওকেই ভালোবাসে, অথচ ওর এ ব্যাপারে কিছুই করার নেই। ফলে ওর ব্যক্তিত্বে এখন নিশ্চিতভাবেই কিছু পরিবর্তন আসতে চলেছে।
তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, জানুর জীবনটা এখন তছনছ হয়ে গেছে?
তছনছ হয়ে গেছে, এমন নয় বিষয়টা। জীবন যেমন বয়ে চলে, মানুষও সময়ের সাথে সাথে বদলায়। স্কুল-কলেজে আমাদের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল, আপনাদেরও এখন বেস্ট ফ্রেন্ড আছে। কিন্তু তারা আগে যেমন ছিল, এখনও ঠিক তেমনটাই নেই। তাদের মধ্যে বদল ঘটতে থাকে, কারণ একেকজন ব্যক্তি তার জীবনের একেক পর্যায়ে একেক রকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়, যেগুলো মানুষ হিসেবে তার মাঝে অনেক পরিবর্তনের জন্ম দেয়। আমরা যেমন কিছু আবেগের সম্মুখীন হই, আমাদের আশেপাশের মানুষরাও সেসব সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়।
জানুর বেদনাগুলো এখন সারাভানানের জীবনেরও অংশ, এবং তার এখন দায়িত্ব জানুর বেদনাগুলোকে নিজের করে নেয়ার। এখানে কোনো ভুল নেই। আজ যদি আমার স্ত্রী জানুর মতো কোনো অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়, আমি পিছিয়ে আসব না কিংবা বলব না, ‘এটা তোমার জীবন, এবং এগুলো তোমারই সমস্যা।’ সারাভানানের মানসিকতাও এমনই হবে। কেননা দিনশেষে জানু কিন্তু রামের সাথে থাকার জন্য নিজের পরিবারকে ছেড়ে যায়নি। এবার সারাভানানের প্রতিদানের পালা।
আচ্ছা এবার একটু অন্যভাবে ভাবা যাক। চলুন মনে করি, জানু বর্তমান তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি। এবং চলুন আরো ধরে নিই, জানু রামের জন্য ওর পরিবারকে ছেড়ে চলে এসেছে। আপনার কি মনে হয়, এক্ষেত্রেও ও অসুখীই রয়ে যাবে?
যদি জানু আপনাদের প্রজন্মের হয়, তাহলে হয়তো ও সুখ খুঁজে পাবে। আমি সত্যিই আপনাদের প্রজন্ম পছন্দ করি। আপনারা অন্যের কথা ভেবে নিজেদের জীবনকে নষ্ট করেন না। আজ হয়তো বয়স ত্রিশের কোঠায়ও পড়েনি এমন কোনো বিবাহিত দম্পতি একটি কফিশপে বসে বলতে পারে, ‘দেখো, এভাবে সম্পর্কটাকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।’ জানুর বয়স যদি আরো কম হতো, তাহলে হয়তো জানুও ওর স্বামীকে বলতে পারত যে ও যে মানুষটিকে ভালোবাসে, সেই মানুষটি আজও ওর জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। ওরা দুজন হয়তো একসাথে বসে কোনো সমাধানের পথ খুঁজে বের করত, এবং সেটি গোটা পরিস্থিতিকে খারাপ হতে না দিয়েই। আমার তো এমন এক বন্ধুও আছে, যে এক বিবাহিত নারীকে বিয়ে করেছে, যার আগের বিয়ে থেকে হওয়া একটি কন্যাসন্তানও রয়েছে। এবং তারা দুজনই এখন খুব সুখী।
তাহলে, আপনি যদি ‘৯৬’ লিখতেন আমার প্রজন্মকে কল্পনা করে, তাহলে কী কী বিষয়ে পরিবর্তন থাকত?
আমার মনে হয় না তেমন কোনো ছবি হতো। কারণ, এটি একেবারে নিশ্চিত যে আজকের প্রজন্মের রাম আর জানু একসাথেই থাকবে। তাদের মাঝে কোনো কনফ্লিক্ট আসবে না। ‘৯৬’-এ কনফ্লিক্ট এসেছিল এই ব্যাপারটি থেকে যে, ওদের দুজনের একসাথে হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। এই ছবিটি হলো এমন দুজন মানুষকে নিয়ে, যারা পরস্পরকে ভালোবাসে, এবং তারা একটি রাত একে-অন্যের সান্নিধ্যে কাটাবার সুযোগ পাচ্ছে, যখন কেউ নেই তাদেরকে বিরক্ত করার জন্য। এবার তারা কী করবে? এখান থেকেই আসলে টেনশনের উৎপত্তি।
আপনার কি মনে হয় রাম আর জানুর মধ্যে যোগাযোগটা নিদেনপক্ষে রয়েছে? স্রেফ বন্ধু হিসেবে?
এটাও আমার মতো কারো জন্য তুলনামূলকভাবে নতুন একটি কনসেপ্ট। আজকাল আমি এমন অনেক প্রাক্তন প্রেমিক-প্রেমিকাকেই দেখি, বিচ্ছেদের পর যারা এখন বন্ধু হয়ে রয়েছে। আমি কোনো মন্তব্য করছি না কিংবা তাদের বিচার করছি না। কিন্তু আমাদের (প্রজন্মের) জন্য, নিজেদের জীবনের ভালোবাসাকে অন্য কারো সাথে কাটাতে দেখা সম্ভব না। এটি হয়তো কোনো ব্যক্তির জন্য সম্ভাব্য সর্বোচ্চ বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা। সেজন্যই তো জানু আর সারাভানানের বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার আগেই রাম সেখান থেকে পালিয়ে যায়। এর আগ পর্যন্ত, জানু ছিল ‘ওর’ জানু। কিন্তু তারপর থেকে আর নয়। আমরা এমনই।
এই ছবিতে আমরা রামের দৈনন্দিন জীবন দেখতে পাই, এবং আরো দেখতে পাই জানু কীভাবে সেই জীবনের একটি অংশ। কিন্তু রাম কীভাবে জানুর জীবনের অংশ ছিল, অন্তত ওদের পুনরায় সাক্ষাতের আগ পর্যন্ত?
জানুর জন্যও এটি একটি প্রাত্যহিক বিষয়। যখনই ও নিজেকে সান্ত্বনা দিতে চায়, রামের দশম শ্রেণির ছবি ওর সামনে ভেসে ওঠে। সেজন্যই দেখা হওয়ার পর ও রামকে নিয়ে সেলুনে যায়, দাঁড়ি কেটে ফেলতে বলে। যখনই ও আনন্দিত, দুঃখিত কিংবা কিছুই না… ও রামের কথা ভাবে। হয়তো যখন ও রান্না করছে, কিংবা যখন ও স্বামীর বাসায় ফেরার অপেক্ষা করছে, অথবা মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসছে।
তার মানে দাঁড়াচ্ছে, দেখা হওয়ার আগে জানুর জার্নিটাও রামের মতোই ছিল?
অবশ্যই। মানুষের একটি প্রবণতা আছে অতীতকে ভুলে জীবনে এগিয়ে যাওয়ার। বলা হয়ে থাকে, সময়ের রয়েছে অনেক কষ্ট ভুলিয়ে দেয়ার ক্ষমতা। কিন্তু কখনো কখনো সময়ও ব্যর্থ হয়। রাম আর জানুর কাহিনীটা সেই ব্যর্থতারই একটি ধ্রুপদী উদাহরণ।
আমি যখন রামের প্রাত্যহিক জীবন নিয়ে গানটি দেখেছিলাম, আমার মনে হয়েছিল হয়তো ও ডিপ্রেশনে রয়েছে।
আমার মনে হয় না ও ডিপ্রেসড। ডিপ্রেশনে রয়েছে এমন কোনো ব্যক্তি এত বেশি ঘুরে বেড়াত না, সবকিছু থেকে এত বেশি আনন্দ উপভোগ করত না। ও এখন জানুর ভালোবাসা অন্য কোথাও খোঁজার চেষ্টা করছে… এবং সেটি হলো প্রকৃতি থেকে। দেখুন, রামের জন্য ক্যাসানোভা (বিশ্বপ্রেমিক) হয়ে ওঠা খুব সহজ ব্যাপার হতো। ও চাইলেই একাধিক নারীর সাথে রাত কাটাতে পারত, শৈশবের ভালোবাসার কথা ভুলে যেতে পারত। কিন্তু ও তা করেনি। কারণ ও চেয়েছে ওই ভালোবাসাটা অটুট থাকুক। ও সেই শূন্যতা ও একাকিত্বটা অনুভব করছে। কিন্তু তাই বলে ও ডিপ্রেসড নয়।
সাংস্কৃতিক বা প্রজন্মগত বাধাগুলোকে ছাপিয়ে, রাম আর জানুর কাহিনীকে আমি দেখি এমন এক আখ্যান হিসেবে, যেখানে নিয়তি একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। ছবির শুরুতে দেখা যায় একটি রোডব্লকের কারণে রামের ছাত্রী ওর ছোটবেলার শহর থানজাভুরের পথ ধরতে বাধ্য হয়। ঠিক একইভাবে, যদি জানুর কলেজের সেই মেয়েটি রামের নামটা ঠিকভাবে মনে করতে পারত, তাহলে আজ হয়তো ওরা একসাথে থাকত।
হ্যাঁ, আমি এভাবেই বিষয়গুলোকে লিখেছি। কলেজের ওই দৃশ্যে, রাম এত বছর পর এতদূর থেকে আসে জানুর সাথে দেখা করতে। ও এমনকি একজনের সাহায্যও নেয় জানুকে ডাকার জন্য। কিন্তু, নিয়তির পরিহাসে ওদের মাঝের দূরত্বটা বজায় থাকে। অথচ ২০ বছর বাদে নিয়তি আবারো তার ভূমিকা পালন করে ওই নির্দিষ্ট রাস্তাটা ব্লক করে দিয়ে। বর্ষা নামের চরিত্রটি যখন ওই ভিন্নপথ বেছে নেয়, ঠিক তখনই রাম আর জানুর জীবনের পথেও ঘটে এক বিশাল দিক পরিবর্তন। যদি ওই রোডব্লক না থাকত, তাহলে হয়তো আরো এক বা দুই দশক লেগে যেত ওদের দেখা হতে।
যখন জানু কফিশপে বসে রামের ফটোগ্রাফির ছাত্রীদের কাছে ওদের ভালোবাসার কাহিনী বলে, ওই দৃশ্যটিকে আপনি কীভাবে দেখেন? যদিও জানুর বলা কাহিনীটি মিথ্যা ছিল, ওদের দুজনের দম্পতি হিসেবে চিত্রটি কি সত্যি বলে মনে হয়? আসলেই কি ওদের সাথে এমন কিছুই ঘটত, যদি ভাগ্য আরেকটু সহায় হতো?
একদম।
তখনও কি রাম একজন ফটোগ্রাফারই হতো?
হ্যাঁ, তখন ও যেখানেই যেত, জানুকে সঙ্গে করে নিয়ে যেত। সেটি হতে পারত ওদের আদর্শ ভবিষ্যৎ। সত্যি বলতে কী, আমি এখন আসলেই একজন বিশ্বখ্যাত ফটোগ্রাফারকে চিনি যার নাম রামচন্দ্রন, এবং তিনি অ্যাসাইনমেন্টের কাজে তার স্ত্রীকে সঙ্গে করেই ঘুরে বেড়ান। রাম আর জানুও অমনই হতো।
এই নাম থেকে আমার পরবর্তী প্রশ্নটা আসছে। আপনি কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন ওদের নাম রাখার রামচন্দ্রন ও জানকী, যেটি সীতার আরেক নাম?
এর পেছনে বেশ শক্তিশালী একটি কারণ আছে। আমি যখন প্রথম স্ক্রিপ্টটি লিখেছিলাম, ওদের নাম দিয়েছিলাম বিনোথ আর জননী। বিনোথ, কেননা তামিল ভাষায় বিনোদাম মানে ব্যতিক্রম বা অনন্য। আর জননী, কারণ আমার ভাইঝির নাম এটি, এবং আমরা ওকে জানু ডাকি। কিন্তু স্ক্রিপ্ট লিখে শেষ করার পর, পরিচালক বালাজি থারানীধরনের মনে হয় এই গল্পটি অনেকটাই যেম রাম আর সীতার মতো। তাদেরও তো একটি অপূর্ণ প্রেম কাহিনী। তারা কখনো একসাথে থাকতে পারেনি। তখনই আমি নামগুলো পরিবর্তন করলাম। ওদের নাম দিলাম রামচন্দ্রন ও জানকী। তাছাড়া জানুর মা-বাবাও ছিল এস জানকীর ভক্ত।
জানুর বেলায়, ওর বিয়ে হয়ে যায় কলেজে থাকতেই। কিন্তু রাম অনেক সময় পেয়েছে। তো, আপনার কি মনে হয় রাম এই সময়ের মধ্যে কোনো মেয়ের প্রতি অন্তত আকৃষ্ট হয়েছে?
তামিল নাড়ুর কিছু জেলায়, আপনি এখনও অনেক মানুষকে খুঁজে পাবেন যারা এমজিআরের (তামিল লাড়ুর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং জনপ্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেতা) মতো পোশাক পরে; লং-কলারের শার্ট আর বেল বটম। তারা জানে তাদেরকে দেখতে হাস্যকর দেখাচ্ছে, তারপরও তারা একটি নির্দিষ্ট সময়েই আটকে আছে। অনাদি-অনন্তকালের জন্য। তারা যেমন, তেমনেই খুব খুশি। রামও ওরকম। রামের কখনোই মনে হয় না ওর কোনো মেয়ের সাথে প্রেম করা বা কাউকে বিয়ে করা দরকার। কারণ ও-ও আটকে পড়েছে। এমনকী এজন্য ওর যৌন আকাঙ্ক্ষাও হার মেনেছে। যখন আপনি রোজ সকালে কেবল একটি মানুষেরই মুখচ্ছবি মনে করে ঘুম থেকে উঠবেন, কিংবা একটি মানুষেরই কথা মনে করে ঘুমাতে যাবেন, সেটি এক প্রগাঢ় অনুভূতি। সেই অনুভূতিটি যেন আপনাকে তিলে তিলে মেরে ফেলবে। রামও সেরকম মৃত্যুযন্ত্রণাকে সঙ্গী করে বেঁচে আছে।
সেক্ষেত্রে, আপনার কি মনে হয় না ওর এই বিষয়ে কিছু করা জরুরি? কারো সাহায্য নেয়া?
আমি জানি না ওর আদৌ সাহায্য প্রয়োজন কি না। আমি বলছি না এটি ঠিক বা ভুল। কিন্তু রাম আসলে এভাবেই তৈরি। ও নিজের অবস্থানকে কখনো খারাপ বলে মনে করে না। ওর কখনো মনে হয় না ও কষ্টে ভুগছে। ও জানুর স্মৃতির মাঝে বেঁচে রয়েছে, শান্তি খুঁজছে প্রকৃতিতে। যদি ও এমন কারো দেখা পেত, যাকে দেখে ওর মনে হতো জানুর চেয়ে ‘শ্রেয়’, তাহলে হয়তো ও সেই মেয়ের প্রেমে পড়ত। কিন্তু, তেমনটি ঘটেনি।
আপনার কি মনে হয় না ও অন্ধ হয়ে থাকবে, যদিও বা তেমন কারো সাথে ওর সাক্ষাৎ হয়?
আপনি কখনোই সেটি জানবেন না। কারণ জীবনকে আপনি কখনো ওভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারবেন না। আমার কথাই ধরুন। আমি সারাজীবন সবাইকে বলে এসেছি, আমি কখনো কোনো ছবি বানাব না। আমি সবসময় কেবল একজন সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবেই নিজের উন্নতি ঘটাতে চেয়েছি। অথচ আজ, আমি একটি (বর্তমানে দুটি) ছবি পরিচালনা করে ফেলেছি। এমনটি ঘটেছে, কারণ আমার আদর্শে পরিবর্তন এসেছে। জীবন সবসময়ই আপনাকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়, যখন আপনি নিজের একগুঁয়ে নীতি ও আদর্শকে ছুড়ে ফেলতে বাধ্য হন, হার মানেন। রামের বেলায়ও সেরকম ঘটতে পারে। ও সারাজীবন ব্যাচেলরই থেকে যেতে পারে, আবার জানুর বিকল্প কারো সন্ধানও পেয়ে যেতে পারে।
আপনার কি মনে হয় রাম আর জানুর আবার কখনও দেখা হবে?
আমি খুব করে চাই ওদের দেখা হোক। আমি ওদের জন্য এমনটিই আশা করছি। কিন্তু আমি জানি, এটি কোনো পরিকল্পিত সাক্ষাৎ হবে না। আবারো মাঠে নামতে হবে নিয়তিকে।