বাংলা সাহিত্যে শক্তিশালী ছোট গল্পকারের সংখ্যা হাতে গুণে বলে দেয়া যায় এমন অবস্থানে আছে। এখানে নতুন বা পুরাতনদের কম-বেশি সবাই-ই বেশ ভালো উপন্যাস লিখে নিজেদের লেখায় মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন, কিন্তু শক্তিশালী ছোট গল্পকার হিসেবে খুব কম লেখকই নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন শাহাদুজ্জামান; যার প্রথম গল্পগ্রন্থ কয়েকটি বিহবল গল্প ১৯৯৬ সালে মাওলা ব্রাদার্স আয়োজিত কথাসাহিত্যের পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার জিতে নেয়।
আদতে শাহাদুজ্জামান একজন কথাসাহিত্যিক। তেমন ঘটা করে তার নাম প্রচার হয়নি বলে হয়তো অনেকেই তাঁকে চেনে না কিংবা তার নাম জানা থাকলেও তার লেখা পড়া হয়নি। মূলত তার লেখা প্রথম উপন্যাস ক্রাচের কর্নেল দিয়েই তিনিই আলোচনা এবং সমালোচনায় আসেন। এরপর জীবনানন্দ দাশের জীবনী অবলম্বনে একজন কমলালেবু নামক উপন্যাস লিখে নিজের জায়গাটা আরো পাকাপোক্ত করে ফেলেন। এবার অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে শাহাদুজ্জামানের প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত মিলিয়ে মোট এগারোটি গল্প নিয়ে মামলার সাক্ষী ময়না পাখি নামক একটি গল্পগ্রন্থ। আজকের আলোচনা এই বইটিকে কেন্দ্র করেই। তবে কিছু পূর্বাপর বিষয়ে আগে জেনে নেয়া ভালো।
সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যেয়ো না। উত্তরের চাইতে প্রশ্নগুলোকে ভালোবাসতে শেখো। প্রশ্নগুলোকে মনের সিন্দুকে তালাবদ্ধ করে রাখো। কোনো এক দূর ভবিষ্যতে তোমার অজান্তেই উত্তরগুলো তোমার কাছে এসে হাজির হবে।
– শাহাদুজ্জামান
পূর্বাপর প্রসঙ্গ
মানুষ সামাজিক জীব। আজীবন চিরন্তন সত্য একটি বাক্য। প্রকৃতির রাজ্যে সমাজের শৃঙ্খলিত পথে মানুষ টিকে থাকে নিজের অস্তিত্বকে আঁকড়ে ধরে। আবার বলা হয়ে থাকে, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। কিন্তু তবুও, পরিচিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত মানুষগুলো কখনোই অপরিচিত কোনো কিছুর আশা করতে পারে না। স্বচ্ছ আর স্পষ্ট ধারণা নিয়েও চূড়ান্ত সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। অন্যের মুক্তিতে নিজেকে মুক্ত মনে করে বোকা মানুষ। সমাজের প্রথাগত রীতি মেনে বড়দের অন্যায়গুলো দিনের পর দিন ছোটদের অভ্যাসে পরিণত করে তোলে। নিজের বিপদ থেকে নিজেকে বাঁচাতে অন্যকে ব্যবহার করে। গ্রামের সহজ সরল লোকটাকেও শহুরে কর্পোরেট কালচার অতিশয় চালাক বানিয়ে তোলে। কিন্তু তা-ও মানুষ জ্ঞানের চর্চা করে, শিল্পের চর্চা করে, জীবনবোধের চর্চা করে; কেননা মানুষ নিজের জীবনটাকে ভালোবাসে।
লোকগল্পের সারল্য আর আধুনিক গল্পবিশ্বের নিরীক্ষা মিলিয়ে শাহাদুজ্জামান তৈরি করেছেন এক স্বতন্ত্র গল্পভুবন। তাঁর গল্পে কখনো কখনো দেয়াল ভেঙে ঢুকে পড়ে কবিতা, প্রবন্ধ বা দর্শনের উপাদান। তাঁর গল্পভুবনে সাম্প্রতিক সংযোজন এই নতুন গল্পগ্রন্থ মামলার সাক্ষী ময়না পাখি। সমসাময়িক গভীর উৎকণ্ঠা বয়ে গেছে প্রতিটি গল্পের শরীরে। মামলার সাক্ষী ময়না পাখি শিরোনামটি মূলত আবদুল করিম খানের একটি পুঁথি থেকে ধার করা। গল্পগ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন সব্যসাচী হাজরা। হলদেটে, সাদা এবং কালোর সংমিশ্রণে আধুনিকতার সাথে আদিমতার মিশেল ঘটিয়ে এক অদ্ভুত সুন্দর প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী। গল্পগুলোর সাথে তাই প্রচ্ছদের একটা সম্পর্ক নিমেষেই টের পাওয়া যায়। বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। তাই এই প্রকাশনীর পেজ, বাইন্ডিং, বইয়ের গেটআপ বা আউটলুক নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই।
যে ব্যাপারগুলো আমরা সবার শেষে আবিষ্কার করি তারই নাম দিই সত্য। সত্যকে একটা নদী ভাবতে পারো, যা ভাগ হয়ে যায় শাখা প্রশাখায় তারপর আবার একত্রিত হয়। মাঝখানে তৈরি হয় চর। সেই চরের অধিবাসীরা চিরকাল তর্ক করে কোনটা আসল নদী তা নিয়ে। আর চরে দাঁড়িয়ে সারস দম্পতি সেই তর্ক শোনে।
– শাহাদুজ্জামান
গল্পপ্রসঙ্গ
মামলার সাক্ষী ময়না পাখি বইটিতে মোট এগারোটি গল্প আছে। সেগুলোর শিরোনাম হচ্ছে- জনৈক স্তন্যপায়ী প্রাণী যিনি গল্প লেখেন, মৃত্যু সম্পর্কে আমার অবস্থান খুব পরিষ্কার, টুকরো রোদের মতো খাম, চিন্তাশীল প্রবীণ বানর, পৃথিবীতে হয়তো বৃহস্পতিবার, উবার, অপস্রিয়মাণ তির, ওয়ানওয়ে টিকেট, লবঙ্গের বঙ্গ ফেলে, মামলার সাক্ষী ময়না পাখি এবং নাজুক মানুষের সংলাপ। এই গল্পগুলোর মধ্যে ইতিপূর্বে ‘জনৈক স্তন্যপায়ী প্রাণী, যিনি গল্প লেখেন,’ ‘মৃত্যু সম্পর্কে আমার অবস্থান খুব পরিষ্কার’ এবং ‘ওয়ানওয়ে টিকেট’ গল্পগুলো বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে আর বাদবাকি গল্পগুলো এই প্রথম প্রকাশিত হলো। বিস্তর আলোচনায় যাওয়ার আগে গল্পগুলো সম্পর্কেও খানিকটা জেনে নিব।
জনৈক স্তন্যপায়ী প্রাণী, যিনি গল্প লেখেন
মতিন কায়সার একজন স্তন্যপায়ী প্রাণী, যিনি গল্প লেখেন। কিন্তু একটা গল্প লিখলেই যে সেটা গল্প হয়ে যাবে, এই তত্ত্বে তিনি বিশ্বাসী নন। কেননা তিনি জানেন যে গল্পের এই নকল পৃথিবীর ভেতরও আসল আছে, আবার নকলের নকল আছে। তিনি আরো জানেন যে গল্পের পাঠক-পাঠিকাদের ভেতরও আসল আছে, নকল আছে। এমন অনেক পাঠক-পাঠিকাই আছে যারা শুধু চেনা ভূগোলের গল্প খোঁজে। চেনা পৃথিবীর সেই পথেই বিচরণ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কিন্তু মতিন কায়সার চান এমন পাঠক-পাঠিকাদের যারা অভিযাত্রীদের মতো নতুন মানচিত্রে পা দিতে ভয় পায় না। অচেনা ভূগোলে নতুন কিছু জয় করতে ছুটে চলা অভিযাত্রীর মতো পাঠক-পাঠিকা খোঁজেন মতিন কায়সার।
মৃত্যু সম্পর্কে আমার অবস্থান খুব পরিষ্কার
পলাশ এখন কোনো এক হাসপাতালের আইসিইউ এর বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে টিউব লতাগুল্মের মতো জড়িয়ে শুয়ে আছে পলাশের বাবা। পলাশ তাকিয়ে দেখে ওর বাবার হাতের চামড়াগুলো কেমন বেগুন পোড়ার মতো দেখাচ্ছে। বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে তার গ্রিক দেবী ইয়োসের গল্প মনে পড়ে। যে গল্পে ইয়োসের সঙ্গী টিথোনাস নিথর দেহে অমরত্ব নিয়ে বেঁচে ছিল। যে গল্পে অমরত্বকে এক অভিশাপ মনে হয়েছিল। পলাশ ডাক্তারের কাছে জানতে চায় এসব নল আর টিউব দিয়ে কী লাভ? ডাক্তার জানায়, ওর বাবার বেঁচে থাকার জন্য দরকার। পলাশ আবারো জানতে চায়, এসব খুলে ফেললে কি বাবাকে হারিয়ে ফেলবে? ডাক্তার জানায়, সেটা হতেও পারে, আবার না-ও হতে পারে। কিন্তু পলাশ জানে, মৃত্যু সম্পর্কে ওর অবস্থান খুব পরিষ্কার, এই কথার ঘোর বিরোধী ও নিজেই।
টুকরো রোদের মতো খাম
পোস্ট অফিসের মেঝেতে পড়ে থাকা বেওয়ারিশ কিছু চিঠির মাঝ থেকে হলুদ খামের চিঠিটা তুলে নেয় আন্দালীব। নীল বল পয়েন্টে লেখা সরু সরু অক্ষর দিয়ে সাজানো হয়েছে চিঠিটাকে। নিশাচর সমুদ্রের মতো চিঠিটা আন্দালীবকে কাছে টেনে নেয় আর আন্দালীবও পড়তে শুরু করে চিঠিটা। এক ফাঁসির আসামির জীবনের শেষ চিঠি এটা। অনেক কথার ভিড়ে একটা কথা আন্দালীবকে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দেয়। লোকটা মৃত্যুর আগে কারো কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করেছিল; অনেকটা শেষ ইচ্ছের মতো। আন্দালীবের মনে হয় লোকটার লেখা ‘আপনে শাহীনরে মাপ কইরা দিয়েন’ কথাটার মাঝেই যেন আছে সত্যিকারের মুক্তি।
চিন্তাশীল প্রবীণ বানর
অনন্য লেখক শহীদুল জহির পুরান ঢাকার এক যুবকের গল্প শুনিয়েছিলেন একবার; যে শৈশবে বানরের দুধ খেয়ে বড় হয় এবং প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি চুরির সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য হয়ে উঠে। এই এলাকার মানুষদের নিত্যদিনের জীবনে তাই লম্বা লেজওয়ালা খয়েরি রঙের বানরদের ঘোর তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। পুরান ঢাকার নারিন্দার পঞ্চাশ কামরার বিশাল বাড়ি পাঠান মঞ্জিল এ একদিকে যেমন আবদুল মোমেন, তার স্ত্রী নিলুফার আর মেয়ের টুম্পার বসবার ঠিক তেমনি অন্যদিকে ছাদের কার্নিশে কতিপয় বানর পরিবারের ঠিকানা। এদের মধ্যে খয়েরি রঙের প্রবীণ বানরটা তাদের নিত্যদিন জীবনের গতিধারাকে পর্যবেক্ষণ করে। একদিন আবদুল মোমেন অফিসের কাজে বিলেত যায়। নির্দিষ্ট তারিখ পেরিয়ে মাস যায়, বছর যায় কিন্তু আবদুল মোমেন ফেরে না। ঐদিকে চিন্তাশীল প্রবীণ বানর আরো চিন্তিত হয়ে প্রবীণ হতে থাকে তাদের নিত্যদিনের জীবনে।
পৃথিবীতে হয়তো বৃহস্পতিবার
কায়সার হক একটা কোম্পানির কমিউনিকেশন ডিভিশনের দায়িত্বে আছেন এবং তাঁরই অধীনে কাজ করে মাসুদ। অফিসে মার্কেটিং ডিভিশনের হেড হিসেবে আকরাম আলী যোগ দেয়ার পর থেকেই কায়সার হকের চাকরি জীবন দোদুল্যমান অবস্থায় আছে। মাসুদ বয়সে ছোট হলেও কায়সার হকের সাথে ওর ভালোই সম্পর্ক। এক ঝুম বৃষ্টির দিনে মাসুদ আর কায়সার হক আড্ডা দিচ্ছিল। কমিউনিকেশন সংক্রান্ত একটা দারুণ আইডিয়া মাসুদ শেয়ার করে কায়সার হকের সাথে। বৃষ্টি শেষে যে যার বাসায় চলে যায়। পরের দিন সকালে অফিসে জরুরী মিটিং ডাকা হয়। মিটিং এ মাসুদের আইডিয়া নিজের বলেই চালিয়ে দেয় বিশ্বস্ত কায়সার হক। মাসুদ নিজেও জানে এই শহরে টিকে থাকার মূলমন্ত্রই হচ্ছে প্রতারণা, কিন্তু তা-ও মাসুদের দুনিয়াটা নড়ে ওঠে।
উবার
উবার হচ্ছে আধুনিক যুগের ট্যাক্সি ক্যাব সার্ভিস। এরকম একটা উবারেই বসে আছে বিহবল এক নারী। তার চোখ সানগ্লাসে ঢাকা। তার স্লিভলেস তাগা পরা বাহুতে বসন্ত টিকার দাগ আর অদৃশ্য রোম দৃশ্যমান হয়ে উঠে। এক অভিজাত হোটেলের উল্টো দিকের রাস্তায় থামে উবারটা। ভেতরে বসা নারী মুহুর্তেই নেকাব যুক্ত এক বোরকায় নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলে। তারপর বেশ দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে রাস্তা পার হয়ে চলে যায় হোটেলের ভেতরে। নারীটা হোটেলের লবিতে বসে থাকে কারো ফোনকলের অপেক্ষায়। হোটেলের লোকগুলোর কেমন সন্দেহ হয়, তাই তারা পুলিশকে ফোন করে। নারীটা বসে আছে কারো ফোনকলের অপেক্ষায়, হোটেলের কর্মচারীরা আছে পুলিশের অপেক্ষায় আর অন্যদিকে উবার ড্রাইভার বসে আছেন এই নারীর অপেক্ষায়।
অপস্রিয়মাণ তির
নীনা আর সাব্বির বসে আছে প্রধান সড়কের জ্যামে নিজেদের গাড়িতে। থানা থেকে ফোন আসামাত্রই গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গিয়েছে ওরা। বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। গাড়ির ওয়াইপার কোনোভাবেই বৃষ্টির ছাটের সাথে পাল্লা দিয়ে পেড়ে উঠতে পারছে না। নীনা আর সাব্বিরের একমাত্র সন্তান শাহাব। অনেক আদর আর যত্নে তিলে তিলে বড় করেছে ছেলেটাকে। কিন্তু দিন দিন ছেলেটা যেন ওদের আওতার বাইরে চলে যাচ্ছিল। কোনোভাবেই ওর সাথে কথা বলা যেত না। যেকোনো কথাতেই খুব রুক্ষ আর বাজে ব্যবহার করতো বাবা-মায়ের সাথে। একদিন কথা কাটাকাটিতে সাব্বির একটা চড় মেরে বসে শাহাবকে। শাহাব চড়টাকে হজম করতে না পেরে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। সময় যায় কিন্তু শাহাব ফিরে আসে না।
ওয়ানওয়ে টিকেট
রফিকুল আলম আর রফিকুল ইসলাম ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের একই বছরের ছাত্র ছিলেন। দুজনের মধ্যে খুব ভালো বন্ধুত্ব। ফিজিকসের বিষয়গুলো নিয়ে আড্ডা দিতে দুজনেই বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। রফিকুল আলমের শ্যালিকা নায়লার সাথে রফিকুল ইসলামের বিয়ে হয়। রফিকুল ইসলাম ভাবেন বন্ধুত্বটা সম্পর্কে আরো বেশি জমে উঠবে। কিন্তু বিয়ের পরপরই রফিকুল ইসলাম রফিকুল আলমের সাথে ফিজিক্সের গডস পার্টিকেল নিয়ে আলাপ করা বন্ধ করে শ্বশুরের সাথে শেয়ার বাজার আর জায়গা জমি নিয়ে আলাপ করা শুরু করে দেন। আর পারতপক্ষে রফিকুল আলমকে শুধুমাত্র এড়িয়েই চলেন না, বরং দুটো কথা সবার সামনেই শুনিয়ে দেন। রফিকুল আলমের স্ত্রী আর সন্তান আমেরিকায় থাকেন। রফিকুল আলম মাঝে মাঝে যান সেখানে। একদিন ভোর রাতে পুলিশ আসে রফিকুল আলমের বাসায়। শ্যালিকার ঘরের গৃহকর্মীকে রেপ করার কারণ জানিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। সময় বয়ে যায়, কিন্তু রফিকুল আলমকে ছাড়িয়ে নিতে তার বন্ধু রফিকুল ইসলাম কিংবা অন্য কেউই আসে না।
লবঙ্গের বঙ্গ ফেলে
মোজাম্মেল আলী কাঁঠাল ভালোবাসেন। বংশপরম্পরায় সত্রাসিয়ার সবচেয়ে বড় কাঁঠালবাগানের মালিক তিনি। তাঁর এই কাঁঠালময় জীবন বর্তমানে শোকের চাদর দিয়ে ঢাকা। কেননা, তাঁর স্ত্রী সুফিয়া খাতুন মারা গেছেন। সুফিয়া খাতুন ভালো মাশকলাইয়ের ডাল রান্না করতেন। মোজাম্মেল আলীর মেয়ের বিয়ে হয়েছে কাছেই মহিমাগঞ্জ গ্রামের অঙ্কের স্কুল শিক্ষকের সাথে। বাবার এই দুর্দিনে তাই রেহানা স্বামী-সন্তান নিয়ে ছুটে আসে, কিন্তু কিছুদিন থেকেই চলে যান। মোজাম্মেল আলীর বন্ধু সমতুল্য হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার মোহাম্মদ বরকত একদিন কথার প্রসঙ্গে নতুন করে বিবাহের কথা বলেন তাঁকে। মোজাম্মেল আলীও ভাবেন, সন্তানাদির দরকার না হলেও একজন সঙ্গিনীর দরকার, সেবা-যত্নের দরকার আর কাঁঠালের ব্যবসা সামলানো দরকার। মোজাম্মেল আলীর বিয়ে হয়ে যায় গ্রামের নার্গিস পারভীনের সাথে। এই খবর শুনে মেয়ে রেহানা আমৃত্যু নিজের বাবার চেহারা না দেখার প্রতিজ্ঞা করে।
মামলার সাক্ষী ময়না পাখি
মোহাম্মদ বজলু নিশানদিয়া গ্রামের একজন গাছি, যার কাজ নারকেল পাড়া, ডাব পাড়া, নারকেলগাছের চূড়ার মরা পাতা পরিষ্কার করা, খেজুরগাছে রসের হাঁড়ি বসানো ইত্যাদি। গাছে চড়ার নেশা বজলু আশৈশব; আর ও খুব ভালোভাবেই জানে এবং বোঝে যে, এই গাছির কাজ ছাড়া আদতে সে আর অন্য কোনো কাজ পারে না। কিন্তু স্ত্রী মোমেনা আর দশ বছরের কন্যা শিল্পীকে নিয়ে তার যে সংসার তা শুধু নারকেল-ডাব পেড়ে চলে না।
একদিন সকালে গ্রামের মেম্বার আলতাফ আলীর নারকেলগাছ পরিষ্কারের কাজ করতে গিয়ে একেবারে উঁচু মগডাল থেকে পা ফসকে পড়ে যায় বজলু। ভালো চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসে মোমেনা আর বজলু। ঢাকায় একটা ভবন ধ্বসের কারণেই হাসপাতাল জুড়ে রোগীদের ছড়াছড়ি। এক সাংবাদিক বজলুর কাছে কিছু জানতে চাইলে বজলু নিজেকে রিক্সাওয়ালা পরিচয় দেয়, যে কিনা ৭/৮ জনের জীবন বাঁচিয়েছে সেই ভবন ধ্বসের সময়। রাতারাতিই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় বজলু। কিন্তু বজলুর এই কাল্পনিক জগত এলো কোথা থেকে? বজলুর গোপন নেশাটা হচ্ছে কবি আবদুল করিমের পুঁথি, যে পুঁথির গল্পে মামলার সাক্ষী দেয় কথা বলা এক ময়নাপাখি।
নাজুক মানুষের সংলাপ
এই গল্পটা আদতে দুজন মানুষের কথোকপকথন। উত্তরসূরি আর পূর্বসূরি নামক দুজন মানুষ জীবনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্পে মেতে ওঠে। সেখানে থাকে জীবনবোধের কথা, বাস্তবতার কথা, সত্য-মিথ্যার ভেদাভেদের কথা, নৈতিকতার কথা, নান্দনিক সৃজনশীলতার কথা। পূর্বসূরি একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় উত্তরসূরির দিকে আর উত্তরসূরির সেই সব জটিল প্রশ্নের সহজ উত্তর দিতে থাকে। গল্প এগিয়ে চলে।
লেখকপ্রসঙ্গ
কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের জন্ম ঢাকায়, তবে পড়াশোনা করেছেন মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে। তারপর চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানে পিএইচডি করেন নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন।
লেখালেখির শুরুটা আশির দশকের শুরুর দিকে ম্যাগাজিনে বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রবন্ধ এবং ভিন্ন ভাষার গল্পের অনুবাদ দিয়ে। তবে নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকেই মূলত গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ কয়েকটি বিহবল গল্প মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশ পেয়েছিল। এখন অবধি তাঁর লেখা গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ সব মিলিয়ে তাঁর ২৫টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে, উপন্যাস- ক্রাচের কর্নেল এবং একজন কমলালেবু, গল্পগ্রন্থ- কয়েকটি বিহবল গল্প, অন্য এক গল্পকারের গল্প নিয়ে গল্প, পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ, সাক্ষাৎকারগ্রন্থ- কথাপরম্পরা, অনুবাদগ্রন্থ- ভাবনা ভাষান্তর, গবেষণাগ্রন্থ- একটি হাসপাতাল একজন নৃবিজ্ঞানী কয়েকটি ভাঙ্গা হাড় এবং ভ্রমণগ্রন্থ- আমস্টারডাম ডায়েরী এবং অন্যান্য। কথাসাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরষ্কার পান মননশীল এই লেখক।
তোমার সন্তানেরা তোমার নয়’
জীবনের ভেতর গুঁজে থাকা যে তৃষ্ণা, তারা বস্তুত তারই সন্তান। তারা তোমাদের মাধ্যমে সংসারে আসে শুধু কিন্তু তোমাদের থেকে নয়। বাবা-মা হিসেবে ধনুক থেকে অনন্তের দিকে ছুটে যাওয়া অপস্রিয়মাণ তিরের মতো সন্তানদের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু তো করবার নেই তোমাদের।– কবি জিবরান
পাঠ প্রতিক্রিয়া
শাহাদুজ্জামানের লেখা নিয়ে নতুন করে কিছুই বলার নেই- কথাটি এই বই পড়ার পর অন্তত প্রযোজ্য নয়। কেননা লেখকের আগের গল্পগুলোর তুলনায় এই গল্পগুলো আরো অনেক বেশি পরিণত। লেখার ধরন অনেকটাই বদলে গেছে। তবে তাড়িয়ে গল্প বলার বিশেষত্বটা একইরকম আছে। আর ছোটগল্পে যে তিনি শক্তিশালী মানের একজন লেখক সেটা আবারো প্রমাণ করেছেনে এই বইয়ের মাধ্যমে। এই বইতে শাহাদুজ্জামানের স্বকীয়তা এবং সৃজনশক্তির ভার ক্ষণে ক্ষণেই তাঁর নিজের লেখাই প্রকাশ করেছে। যদিও ইংরেজি শব্দের অধিক ব্যবহার লক্ষণীয়।
মামলার সাক্ষী ময়না পাখি পরিপূর্ণ রূপের একটি মনস্তাত্ত্বিক গল্পগ্রন্থ। বই খুলে প্রথম গল্প পড়তে শুরু করলেই বুঝবেন লেখক আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছেন তাঁর নিজের রচিত দুনিয়ায়, যেখানে তাঁর মর্জিতে আপনাকে সুশৃঙ্খল পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে। কোনো কোনো বাক্য বুঝে উঠার জন্যই হোক কিংবা মনের গহিনে পুষে রাখার জন্যেই হোক- আপনাকে দ্বিতীয়বার পড়ার জন্য বাধ্য করবে।
আমরা সাধারণত একটি গল্পগ্রন্থে ভিন্নধর্মী বিষয়ে রচিত অনেকগুলো গল্প পড়ে থাকি আর এই বইটিও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে অন্যান্য গল্পগ্রন্থ আর এই গল্পগ্রন্থের মধ্যে একটাই তফাৎ, সেটা হচ্ছে এই বইয়ের সবগুলো গল্পই অদ্ভুত এক বিষণ্ণতায় বিচ্ছিন্নতাকে সঙ্গী করে বইয়ের প্রতিটি পাতায় লেপ্টে আছে। প্রতিটি গল্পেই অভিন্ন এক সুর লক্ষ্য করা যায়। বইয়ের যেকোনো গল্প পড়া শুরু করা মাত্রই লেখক আপনাকে বাধ্য করবে লেখকের চরিত্রের মতো নিরপেক্ষভাবে দুনিয়াকে দেখার এবং উপলব্ধি করার। সাহিত্যের প্রকৃত উদ্দেশ্য যে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির উন্নতি, দৃষ্টিশক্তির প্রসার বৃদ্ধি এবং দৃশ্যমান জীবনকে আরো গভীরভাবে দেখা এবং অবলোকন করা- এসবই এই বইয়ের প্রতিটা গল্পের ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছেন লেখক।
মামলার সাক্ষী ময়না পাখি বইতে শাহাদুজ্জামান একজন স্তন্যপায়ী প্রাণীর কথা শুনিয়েছেন, যিনি পরিচিত পাঠকদের ভীড় থেকে মুক্ত হয়ে সাহসী অপরিচিত পাঠকদের জন্য গল্প লিখতে চান; শুনিয়েছেন এমন একজনের কথা, যাঁর মৃত্যু সম্পর্কে অবস্থান খুব পরিষ্কার অথচ এই স্বচ্ছতা সত্ত্বেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে তিনি দ্বিধান্বিত; শুনিয়েছেন টুকরো রোদের মতো খাম হাতে একজন খেয়ালি মানুষের কথা, যিনি আটপৌরে এক শ্যামলা রমণীর চোখে খুঁজে পেয়েছেন চন্দ্র-সূর্যের মতো জ্বলজ্বলে আদিম এক প্রাকৃতিক জলবিন্দু; শুনিয়েছেন চিন্তাশীল এক প্রবীণ বানরের কথা, যে কি না শহীদুল জহিরের পুরান ঢাকার এক ছাদে বসে আবদুল মোমেন এবং তার পরিবারকে পর্যবেক্ষণ করে;
তিনি আরো জানিয়েছেন বোধিপ্রাপ্ত এক উবার চালকের কথা, যে কি না দুনিয়ার কোনো খোঁজ রাখে না, অথচ নিজের রাইড নিয়েই খুব বেশি চিন্তিত; অপস্রিয়মাণ তিরের দিকে তাকিয়ে থাকা এক যুগলের কথা জানিয়েছেন, যাঁদের বুকের ভেতর শরনার্থী কবি জিবরানের বাণী ঝড় তোলে; ওয়ানওয়ে টিকেট হাতে এক বেকুবের কথা জেনেছি আমরা, যার জীবনযাপন আমাদের বিষণ্ণ হাসির এক পরশ দেয়; আরো জেনেছি পৃথিবীর কোনো এক বৃহস্পতিবারের গল্প, যে গল্পে নায়িকা উজ্জ্বল হলুদ পায়ের শালিক পাখির মতো নায়কের ভারী হয়ে যাওয়া বুকটার উপর গিয়ে বসে; অথবা লবঙ্গের বঙ্গ ফেলে দেয়া গল্পটার কথাও বলতে পারি, যে গল্পে একাকীত্ব, বিষণ্নতা, বেদনা, প্রতারণা আর মৃত্যু মিলেমিশে একাকার হওয়া সত্ত্বেও কালো ছাগলটার পিঠের উপর কালো শালিকটা বসেই থাকে।
আর জেনেছি এক ময়না পাখির গল্প, যে পাখি আদালতে সাক্ষী দেয়; আর সবশেষে মুখোমুখি করেছেন দুজন নাজুক মানুষকে, যাদের সংলাপে শিল্পের কঠিন পথের ধারণা পাওয়া গিয়েছে, শিল্পসৃষ্টির উদ্দেশ্যের কথা জানা গিয়েছে, জীবনবোধের অতলে ডুব দেয়া গিয়েছে সহজেই। ঠিক এভাবেই লেখক প্রচলিত গল্পের ধারাকে ভেঙে মিথ, দর্শন, কবিতা, পুঁথি, নৃবিজ্ঞানসহ অসংখ্য জ্ঞানখণ্ডকে একত্রিত করে একেকটা গল্পকে সাজিয়েছেন। পাঠক তাই বইটা শেষ অদ্ভুত এক আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে থাকবেন বেশ খানিকটা সময় জুড়ে।
যেসব বাণী পাঠককে আকৃষ্ট করবে
গল্প লিখলেই তাকে গল্প বলা যায় না। গল্পের এই নকল পৃথিবীর ভেতরও আসল আছে, আবার নকলের নকল আছে। কেউ গল্প বানিয়ে তোলে, কারও গল্প হয়ে ওঠে।
বেঁচে থাকা মানে তো মানুষকে ভালোবাসতে পারার একটা সুযোগ, হয়তো মানুষের ভালোবাসা পাওয়ারও একটা সুযোগ।
একটা খুব দমকা হাওয়া বয়। হাওয়ায় কে যেন বলে যায়, প্রতারণার দক্ষতাই এই শহরে টিকে থাকার মূলমন্ত্র।
পৃথিবীতে বিশ্বাসের আর কোনো জায়গা নেই। পৃথিবীটা একটা ডেঞ্জারাস জায়গা হয়ে গেছে।
প্রবাসজীবন হচ্ছে চোরাবালির মতো, ওটা শুধু আপনাকে নিচের দিকে টানবে।
সবকিছুই জয়-পরাজয়ের পাল্লায় মাপার কিছু নেই। অনেক নির্বোধও কঠিন বিপদের সময় পার করে দিতে পারে, কিন্তু প্রতিদিনের পৌনঃপুনিকতা মোকাবিলা করা প্রতিভার কাজ।
মানুষকে আমি যত জেনেছি, তার কাছ থেকে আমি তত কম প্রত্যাশা করতে শিখেছি। যত দিন গেছে মানুষকে আমি তত সহজ শর্তে গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়েছি।
মানুষ যখন স্বাভাবিক থাকে তখন সে সহজে নিজের কথা বলে না। তাকে একটা মুখোশ দিলে সে অনায়াসে নিজেকে খোলে। আলোতে না খুললেও অন্ধকারে খোলে।
মানুষের বর্তমানের ভেতর অতীত এবং ভবিষ্যৎ গ্রথিত থাকে। বর্তমান আসলে একটা সময়গ্রন্থি।
মানুষ অবিরাম সুতার ওপর দিয়ে হাঁটে- যার একদিকে থাকে সত্য, অন্যদিকে মিথ্যা। সে-ই জেনে গেছে, পরিস্থিতি মোতাবেক সত্য নির্মাণ করা প্রতিভাবানদেরই কাজ।
তুমি হারিয়ে গেলেই তোমার উপস্থিতি টের পাওয়া যাবে। হারিয়ে গেলে পাওয়ার ইচ্ছাটা যে হারিয়েছে তার কাছে এবং অন্যদের কাছে খোলাসা হয়।
আপাতত যাত্রা করো পরিব্রাজকের মতো, পর্যটকের মতো নয়। পর্যটক হচ্ছে সেই মানুষ, যার ঘরে ফেরার পরিকল্পনা আছে আর পরিব্রাজকের নেই। পরিব্রাজকের কাছে গন্তব্য প্রধান না, পথটাই প্রধান।
যৌনতার সঙ্গে যদি প্রেম যুক্ত হয়, তাহলে হয়তো খানিকটা অমরত্বের স্বাদ মিলতে পারে।
বইপ্রসঙ্গ
বই: মামলার সাক্ষী ময়না পাখি
লেখক: শাহাদুজ্জামান
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশনী: প্রথমা প্রকাশনী
পৃষ্ঠা: ১১২
মূল্য: ২৪০ টাকা