‘রঙিন চশমা’য় দেখা মুহম্মদ জাফর ইকবালের স্মৃতিগুলো

“তখন মাত্র দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমার বয়স কম, চোখে তখন একধরনের রঙিন চশমা। সেই রঙিন চশমার এমনই জাদু যে তুচ্ছ সাধারণ ঘটনাকেই অসাধারণ মনে হয়—আসলে আমার তো কিছু করার নেই!”

মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা পড়েনি, এমন পাঠক বোধহয় বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তার পরিচয় বহুমুখী বিজ্ঞানলেখক, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীকার, কথাসাহিত্যিক, কিশোরসাহিত্যিক, কলামিস্ট, শিক্ষাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। এ দেশের এক পুরো প্রজন্ম বলতে গেলে, তার রচিত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী এবং কিশোর উপন্যাস পড়ে বড় হয়েছে। কিশোর উপন্যাস, কলাম কিংবা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন ‘দেশের বাইরে দেশ’, ‘আধ ডজন স্কুল’, ‘আমেরিকা’র মতো স্মৃতিচারণমূলক ও আত্মজৈবনিক রচনা। ‘রঙিন চশমা’ তেমনই একটি আত্মজৈবনিক বই, যেখানে উঠে এসেছে লেখকের তরুণ জীবনের গল্প।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল; Image Source: Wikimedia Commons

মুহম্মদ জাফর ইকবালের জন্ম ভাষা আন্দোলনের বছর, অর্থাৎ ১৯৫২ সালে। তার পিতা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদ এবং মাতা আয়েশা ফয়েজ। ফয়জুর রহমান আহমেদ পুলিশের চাকরি করতেন এবং কর্মসূত্রে তাকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হতো। মুহম্মদ জাফর ইকবালের অগ্রজ নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘আমার ছেলেবেলা’ গ্রন্থে তাদের পরিবারের অনির্ধারিত জীবনের খণ্ডচিত্র এবং বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকালীন বিভিন্ন অম্লমধুর স্মৃতির কথা পাওয়া যায়। ‘রঙিন চশমা’ বইয়ের ঘটনাবলি স্বাধীনতা, অর্থাৎ ১৯৭১ সালের পরের। লেখকের সে সময়ের খণ্ড খণ্ড স্মৃতি গল্পের মাধ্যমে এখানে উঠে এসেছে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ফয়জুর রহমান আহমেদ পিরোজপুর মহকুমার এসডিপিও (সাব-ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পিরোজপুরে অসহযোগ আন্দোলন গড়ে উঠলে তিনি তাতে সম্পৃক্ত হন এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলেন। ২৫শে মার্চে কালরাতের পর যুদ্ধ শুরু হলে সে অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলতে এবং অস্ত্র দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দিতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। মে মাসে পাকবাহিনী পিরোজপুর দখল করে নিলে একসময় তিনি বন্দি হন।

তার পরিবার যখন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এখানে ওখানে ছুটে বেড়াচ্ছে, তেমনই এক দিনে বলেশ্বর নদের তীরে গুলি করে তাকে হত্যা করে মৃতদেহটি পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। স্থানীয় জনগণ নদীতীরেই তাকে সমাহিত করে। এ খবর পাওয়ার পরেও স্বামীর মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি আয়েশা ফয়েজ। তাই তিনি সন্তানকে অনুরোধ করতেন, কবর খুঁড়ে স্বামীর দেহাবশেষটুকু মিলিয়ে দেখতে। সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা লেখক বর্ণনা করেছেন বইয়ের প্রথম গল্প, ‘স্বাধীনতা’য়।

বইয়ের প্রচ্ছদ; Image Source: Amar Books

ঐ সময়টায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে পিতাকে হারিয়ে লেখকের গোটা পরিবারকে দারুণ অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়েছিল। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারটির জীবন সংগ্রামের গল্পের কথা পাওয়া যায় এ বইতে। এমন সময় গেছে, যখন বাড়িতে ছেলেদের সকলের ছিল একটা সাধারণ জামা এবং সাধারণ প্যান্ট। সেই জোড়াটি পরেই বাইরে যেতে হতো; যখন একজন বাইরে যেতেন, বাকিদের তখন থাকতে হতো ঘরে। অবস্থা কখনো এতটাই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠত যে পরের বেলা কী খাওয়া হবে, তা নিয়ে বাঁধতো দুশ্চিন্তা।

টানাপোড়েনের সংসার চালাতে মুহম্মদ জাফর ইকবালকে কখনো টিউশনি করতে হয়েছে, কখনো আঁকতে হয়েছে কার্টুন। তিনি কার্টুন আঁকতেন জাসদের মুখপাত্র ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকায়। স্বল্প পারিশ্রমিকে কার্টুন আঁকা এবং সে-সংক্রান্ত দুঃস্মৃতির কথা পাওয়া যায় ‘কার্টুন’ গল্পে।

শহীদ পরিবার হিসেবে মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে সরকার প্রদত্ত একটি বাসায় তারা বাস করতেন। সে বাসায় রক্ষীবাহিনী একদিন হানা দেয় এবং তাদের উৎখাত করে। তৎকালীন রক্ষীবাহিনী নিয়ে জনসাধারণের ভীতি, টালমাটাল সামাজিক পরিস্থিতি, বিপর্যস্ত অর্থনীতি, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, চুরি-ছিনতাইয়ের বাড়বাড়ন্তের কথা পাওয়া যায় বইতে। চুরি প্রসঙ্গে মুহম্মদ জাফর ইকবাল লিখেছেন,

“আসলে সময়টি ছিল খুব দুঃসময়। দুঃখকষ্ট এবং অভাবের তাড়নায় কত মানুষ যে এ পথে আসতে বাধ্য হয়েছিল, তার তু‌লনা নেই। সবচেয়ে কষ্টের দৃশ্য ছিল ভাসমান পতিতারা। গ্রাম থেকে চলে আসা মেয়েগুলো শহরের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছ— এক মুঠো খাবারের জন্যে তারা তাদের জীবনকে কীভাবে তছনছ করে ফেলছে, সেই দৃশ্যগুলো এখনো আমরা ভুলতে পারি না।”

 

লেখকের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কেন্দ্র কার্জন হল; Image Source: Kaler Kantho

শুধু দুঃস্মৃতিই নয় অবশ্য, বহু মজার ঘটনাও রয়েছে বইটিতে। মুহম্মদ জাফর ইকবাল সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করতেন। তার বিশ্ববিদ্যালয়কালীন স্মৃতির কথা আছে কয়েকটি গল্পে। হলের জীবন, রোমাঞ্চকর প্ল্যানচেট, নাটক করা, প্রক্সি দেওয়া, শিক্ষাসফর, আন্তঃহল গালি প্রতিযোগিতার কথা পাওয়া যায় বইটিতে। হাত দেখা নিয়ে তার এবং তার তৎকালীন সহপাঠিনী, পরবর্তী সময়ে জীবনসঙ্গিনী ইয়াসমিন হকের ঘটনাটি বিশেষ মজার।

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখক হিসেবে মুহম্মদ জাফর ইকবালের প্রথম আবির্ভাব ঘটে ‘কপোট্রনিক সুখ দুঃখ’ রচনার মধ্য দিয়ে। সে বইটি রচনার কাহিনী পাওয়া যাবে এখানে। এছাড়া আছে বান্দরবান ভ্রমণ, বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিজ্ঞানভিত্তিক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, আর্থিক অনটনের মধ্যে গোটা মানিক রচনাসমগ্র কিনে ফেলা, আসবাব না কিনতে পেরে নিজেরাই আসবাব বানাতে লেগে যাওয়া প্রভৃতি আকর্ষণীয় গল্প। লেখকের কিছু ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ছবিও পাওয়া যাবে সেইসাথে।

স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমিন হকের সাথে ডক্টর মুহম্মদ জাফর ইকবাল; Image Source: Dhaka Tribune

যুবা বয়সের নানা রঙের বিচিত্র ঘটনাবলি স্বভাবসুলভ নির্মেদ স্বাদু গদ্যে বর্ণনা করেছেন লেখক। গল্পগুলোতে তার রসবোধ স্পষ্ট। তাছাড়া জীবনের বহু কঠিন অভিজ্ঞতাকে তিনি যেভাবে নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বর্ণনা করেছেন, তা তুলনারহিত‌। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালের বইমেলায়, প্রতীক প্রকাশনী থেকে‌। যে মানুষটি তার জাদুলেখনী দিয়ে আমাদের মোহিত করে রেখেছেন এতদিন যাবৎ, তার জীবনের ঘটনাঘটন একটু উঁকি দিয়ে দেখতে মাত্র ছিয়ানব্বই পাতার বইটি পড়ে ফেলা যেতেই পারে।

This article is in Bangla. It is about Muhammad Jafar Iqbal's Memoir of his youth— 'Rongin Choshma'.

Featured Image: Edited by author

Related Articles

Exit mobile version