মার্চ ২৭, ১৯৭৩। লস অ্যাঞ্জেলসের ডরোথি শ্যান্ডলার (Dorothy Chandler) প্যাভিলিয়নে চলছে অস্কারের ৪৫তম আসর।
সেরা অভিনেতার পুরষ্কার ঘোষণা করতে মঞ্চে এসেছেন জেমস বন্ডখ্যাত রজার মুর এবং নরওয়েজিয়ান অভিনেত্রী লিভ উলম্যান। চারদিকে তখন দ্য গডফাদারের উন্মাদনা। অনুমিতভাবেই মনোনীত হয়েছেন ডন ভিটো কর্লিওনির চরিত্রে অভিনয় করা মার্লোন ব্র্যান্ডো। পুরষ্কারে তার নাম ঘোষিত হতেই করতালিতে ফেটে পড়ল অডিটোরিয়াম।
কিন্তু ব্র্যান্ডোকে তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না! অতিথিরা সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন ২৬-২৭ বছরের এক তরুণী। আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের মতো বাকস্কিনের পোশাক তার পরনে। ত্বকের রঙও শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত অস্কার অনুষ্ঠানের সাথে বেমানান। মুর ও উলম্যান তার হাতে ব্র্যান্ডোর পুরষ্কার তুলে দিতে চাইলে সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেন তিনি। এরপর সবাইকে অবাক করে জানালেন- হলিউডের চলচ্চিত্রে ইন্ডিয়ানদের যে ভুলভাল উপস্থাপন করা হয়, তার প্রতিবাদস্বরূপ ব্র্যান্ডো এই পুরষ্কার গ্রহণে রাজি নন। উপস্থিত অনেক রথী-মহারথী চিৎকার করে অপমান করতে লাগলেন তরুণীকে।
সাচিন লিটলফিদার
অস্কার-মঞ্চে ব্র্যান্ডোর পক্ষ থেকে দাঁড়ানো এই নারীর নাম সাচিন লিটলফিদার (Sacheen Littlefeather)। জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির এক বছর পর, নভেম্বরের ১৪ তারিখে। তার দেয়া তথ্যমতে, বাবা ছিলেন অ্যাপাচি আর ইয়াকুই গোত্রের অন্তর্গত, মা শ্বেতাঙ্গ। লিটলফেদারের চার বছর বয়সে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, এরপর থেকে নানির কাছে বড় হন তিনি। পরবর্তীতে বাবা-মায়ের দেয়া নাম মেরি ক্রুজ ছেড়ে দিয়ে হয়ে যান সাচিন লিটলফিদার। মাথায় পালক পরতেন দেখে ফিদার, আর সাচিন নাকি বাবার দেয়া ডাকনাম।
লিটলফিদার দাবি করেছেন- গায়ের রঙের কারণে স্কুলে তাকে নিয়মিতই অপমান করা হতো। এজন্য আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন তিনি। গার্ডিয়ান পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে বাবার হাতে নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেন তিনি। একবার বাবা মাকে পেটাতে গেলে তাকে ঝাড়ু দিয়ে নাকি আঘাতও করেছিলেন সাচিন। এরপর তো বাড়ি থেকে পালিয়ে থাকতে হয়েছিল বেশ কয়েকদিন!
ইন্ডিয়ান আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্টতা
১৯৬৩ সালে বন্ধ করে দেয়া হয় আলকাটরাজ (Alcatraz) দ্বীপের কারাগার। এখানকার আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের আশা ছিল- এবার দ্বীপ তাদের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হবে। স্বাভাবিকভাবেই সরকারের সেরকম কোনো ইচ্ছে ছিল না। ১৯৬৯ সালে রিচার্ড ওকসের( Richard Oakes) নেতৃত্বে বহু লোক দ্বীপ ইন্ডিয়ানদের ফিরিয়ে দেবার দাবিতে সেখানে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করে। তাদের সাথে যোগ দেয় আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্ট (American Indian Movement)। লিটলফিদার তখন শিক্ষার্থী, তবে নিয়মিত দ্বীপে উপস্থিত হয়ে ধর্মঘটের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতেন তিনি।
১৯৭৩ সালে অস্কারের আগে দিয়ে আরম্ভ হয় উন্ডেড নি-র (Wounded Knee) সংঘর্ষ। লিটলফিদার তখন স্যান ফ্রান্সিস্কোর এক রেডিও স্টেশনে কাজ করেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ ডাকোটার উন্ডেড নি শহরে নানা দাবিদাওয়া নিয়ে আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্টের সদস্যরা অবস্থান নেন। শহর দখল হয়ে যায় আন্দোলনকারীদের হাতে। তাদের হটাতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ইউএস মার্শাল সার্ভিস। প্রায় ৭১ দিনের অচলাবস্থা শেষ হয় ৮ মে, মুভমেন্টের সদস্যদের অস্ত্র সমর্পণের মধ্য দিয়ে। সাচিন মুভমেন্টের প্রতি তার সমর্থন জ্ঞাপন করেন।
ব্র্যান্ডোর সাথে পরিচয়
স্যান ফ্রান্সিস্কোতেই সাচিন ছোটখাট অভিনয় করতে শুরু করেন। তখন ১৯৭০ এর দশক। মার্লোন ব্র্যান্ডো ছিলেন তার প্রতিবেশী। তবে আনুষ্ঠানিক পরিচয় হয় পরিচালক ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলার মাধ্যমে, ১৯৭২ সালে। এক বছর পর অস্কারের ঠিক আগের রাতে ব্র্যান্ডো তাকে ফোন করে বাসায় ডাকেন।
পরবর্তীতে অ্যাকাডেমি অব মোশন পিকচার্স অ্যান্ড আর্টসের সাথে এক সাক্ষাৎকারে লিটলফিদার জানিয়েছেন, ব্র্যান্ডো ডাকার আগপর্যন্ত টেলিভিশনে অস্কার অনুষ্ঠান দেখার পরিকল্পনা ছিল তার। কিন্তু ব্র্যান্ডো তাকে বড় এক দায়িত্ব ধরিয়ে দেন, যদি তিনি পুরস্কার জেতেন। তারপরেও দ্বিধা কাটছিল না তার। অবশেষে মাত্র ১৫ মিনিট বাকি থাকতে অনুষ্ঠানস্থলে এসে পৌঁছান তিনি।
অস্কারের রাত
লিটলফিদার তার বংশপরিচয় এবং বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরেন বাকস্কিনের জামা, পায়ে দেন মোকাসিন। অস্কারে মঞ্চে ওঠা প্রথম আদিবাসী নারী হয়ে যান তিনি। মুর যখন ব্র্যান্ডোর নাম ঘোষণা করেন, তখন লিটলফিদার এগিয়ে যান। তার হাতে ছিল একতাড়া কাগজ, যেখানে ব্র্যান্ডোর সম্পূর্ণ বক্তব্য লেখা ছিল। বলা হয়, অনুষ্ঠানের পরিচালক হাওয়ার্ড কচ (Howard Koch) হুমকি দিয়েছিলেন লিটলফিদার এক মিনিটের বেশি সময় নিলে পুলিশে দেবেন তাকে। ফলে সংক্ষিপ্ততম সময়ের মধ্যে কথা শেষ করেন তিনি। জানিয়ে দেন- চলচ্চিত্রে ইন্ডিয়ানদের সঠিকভাবে না দেখানোর প্রতিবাদে এবং উন্ডেড নির আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে অস্কার প্রত্যাখ্যান করছেন ব্র্যান্ডো।
রাজনৈতিক কথাবার্তা এখনকার অস্কারে পানিভাত হলেও সময় তখন ১৯৭৩। অস্কারের ধ্যানধারণার পরিপন্থী বলে মনে করা হতো এমন বক্তব্য। তাছাড়া, ভিন্ন বর্ণের এক তরুণীর কাছ থেকে সবক নিতে প্রস্তুত ছিল না শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত হলিউড। ফলে লিটলফিদারের কথা বলার মাঝেই শুরু হয় চিৎকার-চেঁচামেচি। দর্শকসারিতে বসা অনেকে অপমানসূচক অঙ্গভঙ্গিও করতে থাকেন তার প্রতি। লিটলফিদার ১৯৯০ সালে পিপল ম্যাগাজিনের কাছে বলেন, দর্শকেরা চেঁচিয়ে তাকে বলছিলেন, তুমি আমাদের সন্ধ্যাটা মাটি করেছ।
লোকমুখে শোনা যায়, বিখ্যাত অভিনেতা জন ওয়েইন নাকি লিটলফিদারকে তেড়ে মারতে উঠেছিলেন, ছয়জন নিরাপত্তারক্ষীর তাকে ধরে রাখতে হয়েছিল। তবে ফিল্ম হিস্টোরিয়ান ফারান স্মিথ (Farran Smith Nehme) এবং ওয়েইনের জীবনীলেখক স্কট আইম্যান পরে এই গল্প ভুয়া বলে উল্লেখ করেছেন। ওয়েইন তখন বেশ অসুস্থ, কাউকে মারতে যাবার অবস্থা ছিল না তার।
প্রতিক্রিয়া
লিটলফিদারের প্রতি সমালোচনায় মুখর হন তৎকালীন অধিকাংশ চলচ্চিত্রশিল্পী। সেরা অভিনেত্রীর পুরষ্কার দিতে এসে র্যাকুয়েল ওয়েলচ বলে ওঠেন, মনে হয় না আর কারো রাজনৈতিক বক্তব্য দেবার ইচ্ছে আছে। সেরা চলচ্চিত্রের নাম ঘোষণা করে ক্লিন্ট ইস্টউড বলে বসেন, কে জানে ওয়েস্টার্ন মুভিতে গুলি খাওয়া সমস্ত কাউবয়ের স্মরণে এই পুরষ্কার দেয়া যায় কিনা! অস্কারের পর পরই লিটলফিদারের কাজকে স্টান্টবাজি বলে উড়িয়ে দেয়া হয়, ব্র্যান্ডোকে তার সতীর্থরা তিরস্কার করেন অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকার জন্য।
টিভিতে ডিক ক্যাভেট শো-তে (The Dick Cavett Show) অতিথি হিসেবে এসে ব্র্যান্ডো লিটলফিদারের প্রশংসা করেন। তার কথা শোনার মতো সৌজন্য অন্তত দেখানো উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি। উপস্থাপককে তিনি জানান, লিটলফিদারের প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে, তাতে তিনি মর্মাহত, এবং বড় একটি সামাজিক ইস্যুতে অবদান রাখার সুযোগ হারিয়েছে অ্যাকাডেমি। উন্ডেন নি মুভমেন্টের এক নেতা, রাসেল মিনসের মতে, লিটলফিদার তাদের দাবির প্রতি জনগণের মনোযোগ টেনে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত চলচ্চিত্র নির্মাতা বার্ড রানিংওয়াটারও লিটলফিদারকে সমর্থন করেন।
তবে লিটলফিদার সমস্যার সম্মুখীন হন কর্মক্ষেত্রে। তার অতীত কর্মকান্ড ঘেঁটে তাকে নানা সমালোচনায় বিদ্ধ করা হয়। এক বছর আগে প্লেবয় ম্যাগাজিনে মডেল হন তিনি, সেদিকে ইঙ্গিত করে নোংরা অনেক কিছু বলা হয়। তবে লিটলফিদার দাবি করেন- এ কাজ তিনি করেছিলেন কেবল এটা বোঝানোর জন্য যে তার মতো চামড়ার কেউও সুন্দর হতে পারে। তবে চলচ্চিত্রে ক্যারিয়ারের সমস্ত ইচ্ছে জলাঞ্জলী দিতে হয় তাকে। ইন্ডিয়ানদের মার্কিনীরা লাল চামড়া বলতো, সেদিকে ইঙ্গিত করে তিনি অভিযোগ করেছিলেন- তাকে রেড-লিস্টেড করেছে হলিউড। ফলে খুব অল্প কাজের সুযোগ পেতেন তিনি। ধীরে ধীরে অভিনয় ছেড়ে ইন্ডিয়ান মুভমেন্টের সাথে পুরোপুরি জড়িয়ে যান তিনি।
আনুষ্ঠানিক ক্ষমাপ্রার্থনা
২০২২ সালের ২রা অক্টোবর স্তন ক্যান্সারে ভুগে মারা যান সাচিন লিটলফিদার। মৃত্যুর কয়েকমাস আগে এক বক্তব্যে তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালে অস্কারে তিনি প্রতিনিধিত্ব করছিলেন পুরো একটি জাতিগোষ্ঠীর, যাদের কথা এর আগে এভাবে কেউ বলেনি।
অ্যাকাডেমি অব মোশন পিকচার্স এ সময় তার সাথে যোগাযোগ করে। তৎকালীন অ্যাকাডেমি প্রেসিডেন্ট ডেভিড রুবিন জুনে তার হাতে তুলে দেন তার সাথে করা দুর্ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়ে চিঠি। চিঠি গ্রহণ করে হাসতে হাসতে লিটলফিদার বলেন, আমরা ইন্ডিয়ানরা খুব ধৈর্যশীল, মাত্র তো পঞ্চাশ বছর হয়েছে!
বিতর্ক
লিটলফিদার মারা যাবার কিছুদিন পর তার বংশপরিচয় নিয়ে বিতর্ক আরম্ভ হয়। এর সূচনা করেন নাভাহো ইন্ডিয়ান এবং নামকরা লেখিকা জ্যাকুলিন কেলার (Jacqueline Keeler)। তিনি লিটলফিদারের দুই বোন এবং ইন্ডিয়ান গোত্রনেতাদের সাথে কথা বলেন, যাচাই করেন লিটলফিদারের বংশপরিচয়ের চার্ট। এরপর স্যান ফ্রান্সিস্কো ক্রনিকল (San Francisco Chronicle ) পত্রিকায় লেখা প্রবন্ধে তিনি লিটলফিদারকে প্রতারক বলে দাবি করেন এই অর্থে যে, তিনি কোনোকালেই ইন্ডিয়ান ছিলেন না। কেলার স্বীকার করেন- লিটলফিদারের কোনো এক পূর্বপুরুষ ইন্ডিয়ান হতে পারেন, তবে নিজেকে অ্যাপাচে আর ইয়াকুইদের অন্তর্গত বলে তিনি যে দাবি করেছেন তার স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। এমনকি তার পরিবারও এই দাবিকে মিথ্যে বলেছে। এতদিন তারা এগিয়ে আসেনি এই ভেবে যে এতে তো কারো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না।
কেলারের মতে, লিটলফিদার ইন্ডিয়ানের অভিনয় করছিলেন মাত্র (Pretending), সত্যিকারের ইন্ডিয়ান নন তিনি। মিথ্যে পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে নামযশ কামিছেন বলে তার তীব্র সমালোচনা করেন লেখিকা। তবে লিটলফিদারের সমর্থকেরা কেলারের গবেষণা প্রশ্নবিদ্ধ বলে বাতিল করে দিয়েছেন। তারা পাল্টা সমালোচনা করে বলেছেন- কে ইন্ডিয়ান আর কে না সেটা ঠিক করার অধিকার কেলারকে দিয়েছে কে!
লিটলফিদার সত্যি ইন্ডিয়ান হন আর না হন, এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে প্রায় অর্ধশত বছর আগে অস্কারের মঞ্চে দাঁড়িয়ে ইতিহাস রচনা করেছিলেন তিনি। আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের ইস্যু লাইমলাইটে আনতে তার ভূমিকার ব্যাপারে কোনো বিতর্ক নেই। তার এই অবদান মুছে যাবার নয়।