দ্য লাঞ্চবক্স: রিতেশ বাত্রার ব্যতিক্রমধর্মী সিনেমা

মানুষের জীবন বড়ই অদ্ভুত। কেউই জানে না তার জীবনের শেষে কোথায় গিয়ে ভিড়বে জীবনতরী, কিংবা অন্যভাবে বললে- মানুষ যেভাবে ভাবে, কখনোই ভবিষ্যৎ সেভাবে ধরা দেয় না। কিন্তু তবুও জীবন থেমে থাকে না। তাকে ছুটে চলতে হয়, ভাল থাকতে হয়। পূর্ণ করতে হয় জীবনের চাওয়া-পাওয়াগুলো। বলা হয়,

“কখনও কখনও ভুল ট্রেনও আপনাকে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে।”

এই কথাটি নেওয়া হয়েছে মানুষের জীবন নিয়ে করা রিতেশ বাত্রার ব্যতিক্রমধর্মী সিনেমা ‘দ্য লাঞ্চবক্স’ থেকে। অনেক সিনেমাই তো জীবন নিয়ে করা হয়, কিন্তু এই সিনেমার ব্যতিক্রমধর্মীতা কোথায় কিংবা কেন সমালোচকদের কাছেও বাহবা কুড়ানো সিনেমাটি বক্স অফিসেও করেছে রেকর্ডভাঙা সাফল্য? চলুন, সেই গল্প শুনে আসা যাক।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের নেতৃস্থানীয় কলামিস্ট শুভ্রা গুপ্ত একবার বলেছিলেন,

বাত্রার চরিত্রগুলো আনন্দদায়ক। তারা মুম্বাইয়ের হতে পারে, তীব্র দেশি স্বাদে মিশ্রিত, কিংবা বিশ্বের যেকোনো প্রান্তেই জীবনের সাথে তাদের মেলানো সম্ভব।”

মুম্বাইয়ের মানুষের সাধারণ জীবনযাপনের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে মুভিটির অসাধারণ গল্পটি। যে গল্পে আছে ভালবাসা, দুঃখ, বন্ধুত্ব, একাকিত্ব কিংবা স্বপ্নবাজ মানুষ। সবাইকেই যেন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অসাধারণ এক ছন্দে। সিনেমার প্রতিটি দৃশ্যই যেন দর্শককে ভাবিয়ে তুলবে আর নিজেকেও মনে হবে এই সাধারণ জীবনেও কত অসাধারণ ঘটনা ঘটতে পারে। সিনেমার গল্পও কিন্তু মানুষের সাধারণ জীবন থেকেই পরিচালকের মাথায় এসেছিল। মুম্বাইয়ের ডাব্বাওয়ালাদের নিয়ে একটি তথ্যচিত্রে কাজ করছিলেন রিতেশ বাত্রা। এ সময় তিনি ডাব্বাওয়ালাদের সাথে গবেষণা ও সাক্ষাৎ শুরু করেন। এক সপ্তাহ পর তিনি এই চলচ্চিত্রের ধারণা পেয়ে যান এবং তথ্যচিত্রের পরিবর্তে একটি সিনেমা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন।

ডাব্বাওয়ালারা তার বন্ধু হয়ে ওঠে, এবং তারা তাকে তাদের দেখা গৃহিণীদের গল্প বলতে শুরু করে। সেখান থেকে তিনি গল্পের বিকাশ ঘটিয়ে এই চমত্কার চলচ্চিত্র তৈরি করেন। কত বিচিত্র জায়গা থেকে উঠে আসলো অসাধারণ এক কাহিনী!

মুম্বাইয়ের ডাব্বাওয়ালা; Image Source: occrp.org

মূল সিনেমায় দেখা যায়- এই ডাব্বাওয়ালাদের ভুলেই একবার ইলা (নিমরাত কোউর) নামের এক গৃহিনীর পাঠানো ডাব্বা (লাঞ্চবক্স) তার স্বামীর কাছে না গিয়ে পৌঁছে যায় সাজান ফার্নান্দেজ (ইরফান খান) এর কাছে। প্রথমদিনেই ইলা বিষয়টি বুঝতে পেরে পরদিন বক্সে একটি চিঠি লিখে পাঠায় সত্যিই খাবার তার স্বামীর কাছে যাচ্ছে কিনা বোঝার জন্য। এখান থেকেই শুরু হয় এক অপূর্ব গল্প। কখনো সামনাসামনি দেখা না হলেও তাদের মধ্যে শুরু হয় চিঠি লেনদেন। নিজের ঘরে স্বামীর থেকে আগে থেকেই অবজ্ঞায় ভরা ইলার জীবনে সাজান ভাল বন্ধু হয়ে ওঠে। সিনেমার একপর্যায়ে অসাধারণ এক বন্ধুত্ব আমরা দেখতে পাই, যেখানে অনেক আগেই পরিবারের সবাইকে হারিয়ে একাকী এক মানুষ সাজান আর অন্যপ্রান্তে ইলা একে অন্যকে চিঠি দেওয়ার মাধ্যমে যার যার দুঃখ দূর করার চেষ্টা করতে থাকে। এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দেখা যায়। মানুষ কখনওই একা থাকতে পারে না; তাকে বেঁচে থাকতে হলে একটি সত্যিকারের ভালবাসার অবলম্বন দরকার হয়। মানুষ তার অতীত স্মৃতি নিয়ে বাঁচতে চায়, আর এই অতীত মনে রাখতে হলে মানুষের অবশ্যই চাই কারো সাথে সেই স্মৃতি ভাগ করে নেওয়ার মতো একজন মানুষ। ইলার কাছে লেখা চিঠিতে একবার সাজান জানান,

“I think we forget things if we have no one to tell them to.”

সিনেমায় বরাবরের মতোই ইরফান খান তার অভিনয়-প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন অসাধারণভাবে। হলিউড কিংবা বলিউড- উভয় ইন্ডাস্ট্রিতেই ইরফান খান তার অভিনয় দ্বারা সব মানুষেরই মন জয় করতে পারতেন। লাঞ্চবক্স সিনেমাতেও একজন বিপত্নীক পুরুষের বেশে একদম চরিত্রের মাঝেই নিজেকে এক করে দিয়েছেন তিনি। সিনেমায় কাজ করার ব্যাপারে তিনি বলেন,

“আমাকে স্ক্রিপ্ট পাঠানো হয়; আসলে ধারণাটি পাঠানো হয়। আমার প্রযোজক আমাকে ধারণার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এবং আমি সিনেমা করার জন্য তৈরি ছিলাম। আমি একটি প্রেমের গল্প করতে চেয়েছিলাম এবং আমি সত্যিই গল্পটি পছন্দ করেছি। গল্পের সংবেদনশীলতা এবং নির্দোষিতা আমাকে প্রভাবিত করেছে। এটি যে কারো মধ্যে একধরনের রোমান্টিক অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে সক্ষম।”

সিনেমার এক দৃশ্যে ইরফান খান; Image Source: youtube.com

 

নির্দোষ এক প্রেমের গল্পের আরেক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল শেখ চরিত্রটি। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন আরেক বাঘা অভিনেতা নওয়াজুদ্দীন সিদ্দীকি। নওয়াজুদ্দীন বর্তমান প্রজন্মের কাছে অত্যন্ত পছন্দের একজন মানুষ। তার অভিনয় কিংবা প্রতিটি সিনেমায় নতুনভাবে নিজেকে ফুটিয়ে তোলা সকলের কাছেই সবসময় প্রশংসা কুড়িয়েছে। যারা ইরফান এবং নওয়াজুদ্দীনের ভক্ত তাদের জন্য সিনেমাটি এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা দেবে নিঃসন্দেহে। দ্য লাঞ্চবক্সে সাজান আর শেখের মধ্যে সম্পর্ক যেন গুরু শিষ্যের মতো। যেখানে সাজান নানাভাবে শেখকে শিখিয়ে দিচ্ছে জীবনের নানা দিক। আর একদম অনাথ জীবন থেকে বেড়ে ওঠা স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলা শেখও ধীরে ধীরে নিজেকে যোগ্য করে তোলে একজন ভাল মানুষ হিসেবে। এজন্যই শেখের বিয়েতে ছেলেপক্ষের একমাত্র অভিভাবক সাজান শেখকে বলেন,

“You will be a good husband, Sheikh.”

ইরফান খান আর নওয়াজুদ্দীনের অসাধারণ অভিনয় দেখা যাবে সিনেমাতে; Image Source: imdb.com

গুরুর প্রকৃত শিষ্যের মতো সিনেমাতে অভিনয় দিয়েও বাজিমাত করেছেন নওয়াজুদ্দীন সিদ্দীকি। শেখের কথা বলার স্টাইল, তাকানোর ভঙ্গী কিংবা বিভিন্ন আবেগের প্রকাশ- সবকিছুতেই ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষের প্রতিচ্ছবি। একবার এক সাক্ষাৎকারে নওয়াজ বলেছিলেন, তিনি তার আশেপাশের মানুষদের কথা বলা কিংবা আচার-আচরণ সবসময়ই খুব ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এবং বিভিন্ন চরিত্র করার সময় তার সাথে মিলে গেলে সেই মানুষের থেকে পাওয়া কোনো একটা বৈশিষ্ট্য তিনি নিয়ে আসেন চরিত্রের মাঝে। এভাবেই তার মতো বড় অভিনেতারা হয়ে ওঠেন আরো বড়, নিজেকেই ছাড়িয়ে যান একসময়। আর আমরা তাদের থেকে শিখতে পারি- জীবনের কোনো অংশই ফেলনা নয়, যদি আমরা নিজেদের নিয়ে একটু ভিন্নভাবে ভাবতে পারি।

চিঠি চালাচালির মধ্যেই এগিয়ে চলে সিনেমার গল্প; Image Source: indiatimes.com

কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল ইলা আর সাজানের মধ্যে? আসলে একসময় ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। ইলার স্বামীর বাইরে অন্য কারও সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া আর ইলা ও সাজান দুজনেরই নিজেদের মধ্যে সুখের সন্ধান পাওয়ায় তারা প্রেমে পড়ে যায়। সিনেমায় কেউ কাউকে কোনোদিন না দেখেও প্রেমে পড়ে যাওয়ার বিষয়টি দর্শককে মুগ্ধ করবে। কিন্তু বাধ সাধে সাজানের নিজের বয়স নিয়ে চিন্তিত হয়ে ওঠার বিষয়টি। সাজান একবার ইলাকে চিঠিতে লেখে,

“No one buys yesterday’s lottery ticket, Ila.”

তবুও শেষমেষ তাদের মাঝে দেখা হয় কিনা সেটা কিন্তু জানা যায় না। কারণ এটি একটি ওপেন এন্ডিং সিনেমা। প্রচন্ড আকর্ষণ তৈরি হওয়া সিনেমার শেষাংশ পরিচালক রিতেশ বাত্রা দর্শকের হাতেই তুলে দিয়েছেন। শেষ দৃশ্যে দুজনেই ছুটে চলে তাদের শান্তির জীবনের উদ্দেশ্যে, যার শেষটা সিনেমা দেখে আপনিই নাহয় কল্পনা করে নেবেন। ভারতে ২০১৩ সালে মুক্তি পাওয়া লাঞ্চবক্স বক্স অফিসে আয় করে প্রায় ১০০.৮৫ কোটি রুপি এবং বিএএফটিএ পুরস্কার (২০১৫), অ্যামাজোনাস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল (২০১৩), আপসারা ফিল্ম প্রোডিউসার্স গিল্ড অ্যাওয়ার্ডস (২০১৪), এশিয়া প্যাসিফিক স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ডস (২০১৩) ইত্যাদি নানা সম্মাননায় পূর্ণ হয়েছে ফিল্মটির অর্জনের খাতা।

This article is in Bangla. It is a review of a movie named 'The Lunchbox' an exceptional movie by Ritesh Batra about romance and human life. The movie was released in 2013.

Necessary references have been hyperlinked inside the article.

Featured Image: Pinterest

Related Articles

Exit mobile version