“There is man and beast at nature’s mercy. There is awe and love and reverence. And there is the man called…”
দারসু উজালার ট্যাগলাইনে এরকমটাই বলা। যে চলচ্চিত্রের পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া! রুশ চলচ্চিত্রের পরিচালকের জায়গায় কুরোসাওয়া নামটি দেখে কেউ হয়তো একটু অবাক হতে পারেন, ভুলক্রমে লেখা হয়েছে এমনটাও ভাবতে পারেন। তবে সচেতন পাঠক জেনে থাকবেন- এটি বিশ্বখ্যাত জাপানি মাস্টারমেকারের একমাত্র ভিনদেশি ভাষার চলচ্চিত্র। শুধু তা-ই না, এ চলচ্চিত্র তাকে প্রথমবারের মতো এনে দিয়েছে একাডেমি অ্যাওয়ার্ড, তথা অস্কার সম্মাননা। তা-ও আবার এমন এক সময়ে যখন জাপানিরা তাকে ফেলে দিয়েছিল বাতিলের খাতায়!
নিজ দেশের কোনো প্রযোজক অর্থলগ্নি করতে চাননি রশোমন, সেভেন সামুরাই-খ্যাত কিংবদন্তি এ নির্মাতার ফিল্মে। কারণ, ১৯৭০ সালে তিনি উপহার দিয়েছিলেন বাণিজ্যিকভাবে সুপারফ্লপ সিনেমা দদেস্কাদেন। ১৯৭১ সালে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে হতাশায় আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন কুরোসাওয়া। কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ তিনি! এরপর পাড়ি জমান সোভিয়েত ইউনিয়নে। আর তারপর? বাকিটা অবিশ্বাস্য এক চলচ্চিত্র নির্মাণের রূপকথা! যে রূপকথার মঞ্চে কুরোসাওয়ার রুশ ফিল্ম অস্কার জিতেছে তার স্বদেশী ভাষার চলচ্চিত্রকে শীর্ষ পাঁচে পরাজিত করে। খুব জানতে ইচ্ছে হয়- সেদিন জাপানি প্রযোজকদের মনে কতটা রক্তক্ষরণ হয়েছিল আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেয়া কুরোসাওয়ার অস্কারপ্রাপ্তি দেখে!
দারসু উজালা বন্ধুত্বের গল্প। আবেগ, অনুভূতি আর পারস্পরিক শ্রদ্ধার গল্প। আবার দারসু উজালা বন্যতার গল্প। অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় বুঁদ নির্ভীক শিকারির গল্প। এ গল্পের গতিপথে আমরা বার বার হারাই। সেই হারানো পথে কখনো দেখি শ্বাপদসংকুলতা আর টিকে থাকার নানা চ্যালেঞ্জ, কখনো প্রকৃতির সাথে লড়াই, আবার কখনো অজ্ঞাত প্রতিপক্ষের বিপক্ষে সার্বক্ষণিক সজাগ-সতর্ক দৃষ্টি রাখা। সাইবেরিয়া অঞ্চলের ক্যাপ্টেন ভ্লাদিমির আরসেনিয়েভের এই যাত্রা হয়তো পরিপূর্ণ হতো না, যদি দারসুর সাথে সেই রাতে পরিচয় না ঘটত।
সত্য ঘটনাবলম্বনে নির্মিত এই ছবির প্লট উসুরি উপত্যকা অঞ্চলের বরফাচ্ছন্ন বিস্তীর্ণ বনভূমি। একরাতে আকস্মিকভাবেই দারসু এসে ভেড়ে ক্যাপ্টেন আরসেনিয়েভের দলে। অভিজ্ঞ দারসুকে প্রস্তাব দেয়া হয় দলের গাইড হিসেবে সাথে থাকার জন্য। সেই রাতে দারসু সরাসরি ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ বলে না। সে সময় চেয়ে নিয়ে ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত জানাবার কথা বলে। কিন্তু পরদিন সকালে তাকে ঠিকই দলের সাথে পাওয়া যায়। দুর্গম অরণ্যের গাইড দারসু স্বীয়-প্রতিভায় মুগ্ধ করে সবাইকে। ওর রাইফেলের অব্যর্থ নিশানা দেখে সোভিয়েতের প্রশিক্ষিত সৈন্যদেরও অবাক হতে হয়! অরণ্যে দারসু কতটা কার্যকর তা অল্প কয়েকদিনেই বুঝে ফেলেন ক্যাপ্টেন। দারসু যে পদচিহ্ন দেখে মানুষের বয়স পর্যন্ত অনুমান করে ফেলতে পারেন!
Young always walk on toes
Old always walk on flat of heel.
আগুন, পানি এবং বাতাসকে তিনি বিশেষ গণ্যমান্যতা দেন। তার কথা শুনে সৈন্যরা তেমন কিছু ঠাহর করতে পারে না। তবে দারসুর Fire, Water, Wind: Three strong fellows এর সত্যতা কিছুসময় পরে ঠিকই উপলদ্ধি করা যায়। সত্যি বলতে কুরোসাওয়ার সিনেমাশৈলী নিয়ে কথা বলা ধৃষ্টতা। তারপরেও বোঝাপড়ার স্বার্থেই বলছি। মনোরম ফ্রোজেন লেকে নির্মাতা চমৎকার কিছু বার্ড ভিউ-র লংশট রেখেছেন। পাশাপাশি চরিত্রগুলোর উপর দর্শকদের নজর ধরে রাখতে মিডশট ও মিড ক্লোজ-আপ শটের চতুর ব্যবহারের জন্য নির্মাতা আকিরা কুরোসাওয়া বাহবা পেতেই পারেন। ফিল্মীয় শটের এহেন সুবিবেচনাপূর্ণ প্রয়োগের ফলশ্রুতিতে কাহিনীর বহমানতার সাথে দর্শকদের অন্তর্দৃষ্টির সংজ্ঞাপনে কোনো বিঘ্ন ঘটে না। বরং সেটি উপভোগ্য ওয়াইল্ড লাইফকে করে কাছ থেকে দৃশ্যমান। আরও ভয়ংকর ব্যাপার- ফিল্মে যে বাঘটি দেখতে পাওয়া যায় তা সত্যি সত্যিই বাঘ! ফিল্মের সিজিআই (CGI) প্রযুক্তির বাঘ না। দারসু একাধিকবার ক্যাপ্টেন আরসেনিয়েভের জীবন বাঁচায়। কৃতজ্ঞ ক্যাপ্টেনও গভীর স্রোতে তলিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে অকৃত্রিম বন্ধুকে।
চলচ্চিত্রটি মূলত দুজন মানুষের বোঝাপড়া আর নির্ভেজাল বন্ধুত্বের কাহিনী তুলে ধরেছে। তাদের প্রথমবার দেখা হয় ১৯০২ সালে। অতঃপর ১৯০৭-এ আবার দেখা। সিনেমার গল্প একদিকে যেমন ভীষণ অনুপ্রেরণা ও সাহসের, অপরদিকে তেমনি আক্ষেপ ভরা বাস্তবতার। বার্ধক্যের কাছে পরাস্ত দারসুর অসহায়ত্ব স্ক্রিনভেদ করে দর্শকমনকেও নিশ্চিতভাবে আহত করে। তদ্রুপ, শিকারী দারসুর পশুর প্রতি মমতা, এবং সাইবেরিয়ান বাঘকে গুলি করার পরে তার যে অনুশোচনা তা-ও বেশ হৃদয়স্পর্শীভাবে ফ্রেমে ধরা পড়ে। ঐ ঘটনার পর থেকে দারসু পুরোদস্তুর বদলে যায়। তার আচরণে ধৈর্যচ্যুতি ও রুক্ষতা প্রকাশ পেতে থাকে।
জীবনের শেষদিনগুলোতে দারসুকে আহবান করা হয় শহুরে বন্ধু ক্যাপ্টেন আরসেনিয়েভের সাথে তার বাসায় থাকতে। কিন্তু উন্মুক্ত প্রকৃতির এত কাছে যার সারাজীবন কেটেছে, প্রকৃতিকে যিনি এতটা ভালো জানেন ও বোঝেন তার কাছে শহরের বদ্ধ প্রকোষ্ঠের জীবন ক্রমেই দুর্বিষহ হয়ে উঠতে আরম্ভ করে। দারসু অবাক হয় রাস্তায় হুটহাট শিকারে বের হওয়া যায় না, কিংবা পার্কের গাছ চাইলেই কাটা যায় না বলে। তদ্ব্যতীত এখানে বিশুদ্ধ পানির জন্য পর্যন্ত অর্থ পরিশোধ করতে হয়। শহরের বন্দিত্বে হাঁপিয়ে ওঠা দারসু আর্জি জানায় পুনরায় প্রকৃতির কাছে ফেরার। বহুবার আপত্তি জানানো আরসেনিয়েভ আর নিষেধ করতে পারেন না। তবে বিদায়বেলায় বন্ধুকে নিজের সবচেয়ে কার্যকর রাইফেলটি উপহারসমেত দেয়, যেন বৃদ্ধ বন্ধুর নিশানা ঠিক রাখতে অসুবিধা না হয়। দারসু খুশিমনে রাইফেল নিয়ে প্রস্থান করে বন্ধুর বাসা থেকে। অথচ তখন কে-বা জানত, রাইফেলের জন্যই একদিন তার জীবন হারাতে হবে!
It’s sweeping visual poetry
is shaped by a sense of awe
and inspiration… Kurosawa has fashioned
a great and universal film.
দারসু উজালা নিয়ে লেখা সানফ্রান্সিস্কো ক্রনিয়েলের সম্ভাষণ ছিল এমনটাই। এ ফিল্মের বাস্তবমুখীতা অত্যন্ত জরুরি এবং শিক্ষণীয়। প্রতিটি এলিমেন্টকে নির্মাতা কোনো না কোনো প্রসঙ্গক্রমে ব্যবহার করেছেন। তবে চলচ্চিত্রের এক দৃশ্যে একই সময়ে আকাশে চাঁদ এবং সূর্য সিঙ্গেল ফ্রেমে দেখা যায়। এছাড়া সম্পাদনার সামান্য ত্রুটি বাদ দিয়ে শট কন্টিনিউটিতেও দুয়েক জায়গায় অসামঞ্জস্যতা দেখা গেছে। তবে তাতে মূল গল্পে বিশেষ সমস্যা ঘটেনি।
দারসু উজালার মেকআপ এবং কস্টিউম বিশেষ নজর কাড়ে। যথাযথ, পরিশীলিত, এবং সময় ধারণে সক্ষম। তদ্রূপ, শব্দ এবং সঙ্গীতায়োজন শ্রুতিমধুর। কুরোসাওয়া তার নির্মাতাজীবনের সবচেয়ে ক্রান্তিকালে নির্মাণ করেছিলেন দারসু উজালা। এবং এ থেকেই পেয়েছেন চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় খ্যাতি। মজার তথ্য হলো, তিনি দারসুর গল্পটি নিয়ে নাকি আরো অনেক আগেই জাপানি সেটআপে নির্মাণ পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন, যা অর্থাভাবে এতদিন করতে পারছিলেন না।
এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক আরেকটি তথ্য উল্লেখ করা যায়। রুশ ভাষায় দারসু উজালাকে নিয়ে নির্মিত এটি দ্বিতীয় চলচ্চিত্র। প্রথমবার ১৯৬১ সালে একই টাইটেলে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন পরিচালক আগাসি বাবাইয়ান। সবশেষ বক্তব্য— ক্যাপ্টেন আরসেনিয়েভ আর শিকারী দারসুর সাথে আপনিও যদি ২ ঘণ্টা ২২ মিনিট উসুরির শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে শামিল হতে চান, তাহলে নির্দ্বিধায় সময় করে দেখে নিতে পারেন ৭০ মিলিমিটারের যুগান্তকারী এ সিনেমা।
চলচ্চিত্র: Дерсу Узала (Dersu Uzala)
পরিচালক: আকিরা কুরোসাওয়া
জনরা: অ্যাডভেঞ্চার, বায়োগ্রাফিক্যাল ড্রামা
মুক্তির বছর: ১৯৭৫