কান (Cannes) চলচ্চিত্র উৎসবের ৬৪ তম আসরকে ঘিরে চলছে অন্তিম মুহূর্তের প্রস্তুতি। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই উৎসব আয়োজকদের হাতে পৌঁছালো বহু প্রতীক্ষিত এক জন্মদিনের কেক। অবশ্য কেকটিকে অন্য সব সাধারণ কেকের মতো ভেবে খোদ আয়োজকদেরও কেউ কেউ ভুল করেছিল। কেকটি এসেছে সুদূর ইরান থেকে। আর এ লেখার আলোচনা এই কেক নিয়েই! কারণ, এবারের আসরে কেকটির বিশেষ প্রদর্শনী হতে চলেছে সিনেমার বিশ্বমঞ্চে! চমকে গেলেন কি? দুঃখিত! বলতে বলতে কিঞ্চিৎ বাড়িয়েই বলে ফেললাম। আসলে কেক নয়, বরং কেকের ক্রিমের ভেতর লুকিয়ে ইউএসবি পেনড্রাইভে লুকিয়ে যে ফিল্ম পাঠানো হয়েছে, তার বিশেষ প্রদর্শনী হবে কান চলচ্চিত্র উৎসব ২০১১-তে।
এবার একটু প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে একজন নির্মাতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া যাক, যার নাম জাফর পানাহি (Jafar Panahi)। ক্যারিয়ারের শুরু বিখ্যাত কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানিয়ে হলেও পরে ইরানের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা আব্বাস কিয়ারোস্তামির (Abbas Kiarostami) সহকারী হিসেবে ফিচার ফিল্মে কাজ শুরু করেন তিনি। জানিয়ে রাখা ভাল, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুরস্কার, খ্যাতি আর সম্মাননা অর্জনের দিক থেকে ইরানের খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালক মাজিদ মাজিদি (Majid Majidi), আব্বাস কিয়ারোস্তামি, আসগার ফারাদি (Asghar Farhadi), মহসেন মাখমালবাফ (Mohsen Makhmalbaf), সামিরা মাখমালবাফ (Samira Makhmalbaf) কিংবা বাহমান গবাদির (Bahman Ghobadi) মতো নির্মাতাদের আলোকচ্ছটায় আপাতদৃষ্টিতে জাফর পানাহিকে কিছুটা ম্রিয়মাণ বলে খানিকটা ভ্রম হতে পারে। যেখানে মাজিদি ও ফারাদির তো অস্কার জয়ের রেকর্ডই আছে। সেখানে পানাহি অস্কার তো দূরে থাক, নমিনেশনও পাননি আজ অব্দি!
এতদসত্ত্বেও পানাহি অনন্য, ব্যতিক্রম। পানাহিতে গ্লামার থাকে না। থাকে না আধুনিক সব প্রযুক্তির আহামরি ব্যবহার। তবুও বিশ্বসিনেমার অন্যতম আলোচিত নির্মাতাদের একজন তিনি। এতটাই আলোচিত যে, তার দৈনন্দিন জীবনের কর্মকাণ্ড মোবাইল ফোনে ফ্রেমবন্দি করেও সেটিকে মাস্টারপিস ফিল্মে রূপ দিলেন। ঐ ফিল্ম আবার বিশ্বসিনেমায় তোলপাড়। এমনকি কানের (Cannes) মতো ফিল্ম ফেস্টিভাল চূড়ান্ত আয়োজনের ঠিক ১০ দিন আগে ‘সারপ্রাইজ এন্ট্রি’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে প্রদর্শন করতে আগ্রহ প্রকাশ করে তার অদ্ভুতুড়ে ফিল্ম। এবং বিস্ময়কর যে, নির্মাতা ছবিটিতে তার সৃজনশীলতা ও অভিনবত্ত্বের জন্য carrosse d’or স্বীকৃতিও অর্জন করে! এখানেই শেষ নয়। ফিল্মটি পরের বছর, অর্থাৎ ২০১২ সালে ৮৫ তম অস্কার আসরেও ডকুমেন্টারি ফিচার ক্যাটাগরিতে শীর্ষ ১৫-তে জায়গা পায়। দুবাই, পুসান ও টরন্টো ফিল্ম ফেস্টিভালে, এবং পরবর্তীতে ‘নিউ ইয়র্ক ফিল্ম ফেস্টিভাল’ আর ‘ওয়ার্সো ফিল্ম ফেস্টিভালের’ মতো বিশ্বখ্যাত প্ল্যাটফর্মে ব্যাপক সমাদৃত হয় মুভিটি।
এবার হয়তো একটু বেশিই হাবিজাবি মনে হচ্ছে, তা-ই কি? মনে হওয়া অস্বাভাবিক না হলেও এটাই সত্য। সাথে আরেকটি ধ্রুব সত্য যে— ছবিটির নির্মাতাও স্বয়ং জাফর পানাহি। তবে তিনি একা নন। ডিরেকশন, সিনেমাটোগ্রাফি আর কাস্টিংয়ে সাথে ছিলেন বন্ধু ডিরেক্টর মজতাবা মিরতাহমাব। একুশ শতকে এসে মুভি ক্যামেরায় যখন রেড ড্রাগনও আহামরি পাত্তা পায় না, ঠিক তখনই প্রযুক্তিকে নেহায়েত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের আইফোন আর একটি ক্যামকর্ডার দিয়ে তারা দুজনে ফিল্ম বানানোর কাজ সেরে ফেললেন একদম অনায়াসে। তা-ও আবার বিনা বাজেটে। ফিল্মের শুটিংয়ে একটিবারের জন্যও তারা ‘একশন’, ‘কাট’ শব্দগুলো উচ্চারণ করেননি। এমনকি এডিটিংয়ে পানাহি ধারণকৃত কোনো ফুটেজও ফেলে দেননি। তিনি ছবির শেষে বিশেষ কৃতজ্ঞতায় কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেছেন, কিন্তু নামগুলোকে এমনভাবে মুছে দিয়েছেন যেন পড়া না যায়। এতটুকু পড়ে নিশ্চয়ই আপনাদের মনে হতে পারে- এটা আবার কেমন ফিল্ম! অথবা আদৌ কি এটা কোনো ফিল্ম হতে পারে? হ্যাঁ। সকলের প্রশ্নের উত্তর পানাহি এই মুভির টাইটেলেই দিয়ে দিলেন। মুভির নামকরণ করলেন— THIS IS NOT A FILM! কী অদ্ভুত! নিজের ফিল্মকে স্বয়ং ডিরেক্টর বলছেন THIS IS NOT A FILM!
অবশ্য তা না বলে আর উপায়ই বা কী ছিল! পানাহি ২০ বছরের জন্য ফিল্মমেকিং এবং স্ক্রিপ্টরাইটিং সংশ্লিষ্ট কোনো কাজে যুক্ত থাকতে পারবেন না বলে তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আদালত। এই ২০ বছর তিনি দেশত্যাগও করতে পারবেন না। শুধু তা-ই নয়, ইরানের আদালতের রায়ে নিজ বাড়িতে ছয় বছরের জন্য গৃহবন্দি জীবনযাপনের নির্দেশপ্রাপ্ত আসামী হিসেবেও অভিহিত করা হয় তাকে। আর সেসময়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম কর্মীদের সাথে দেখা কিংবা যোগাযোগ করার তো প্রশ্নই আসে না। ফলে নিতান্ত বাধ্য হয়ে নিজের এপার্টমেন্টে মুভির সব কাজ শেষ করতে হয় তাকে। তার অপরাধ কী ছিল এখনই বলছি না। যা বলছিলাম— আইনের এই বিধিনিষেধ মেনে স্বাভাবিক জীবনযাপন করাই যেখানে দুঃসাধ্য, সেখানে জাফর পানাহি সাক্ষাৎ ব্যতিক্রম। তিনি জানতেন, যেকোনো সময় গ্রেফতার হতে পারেন তিনি। অথচ এমন পরিস্থিতিতে ভিন্ন কিছু ভেবেছেন মাস্টারমেকার পানাহি।
জাফর পানাহি জানেন— আইন যেমন আছে, তেমনি এর ফাঁকফোকরও আছে। আদালত তাকে ফিল্ম বানাতে নিষেধ করেছে, কিন্তু তাকে তো আর তার দৈনন্দিন জীবনের গল্প বলতে নিষেধ করেনি। ব্যস! সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আইডিয়া নিয়ে কাজে নেমে পড়লেন নিউরিয়ালিস্ট ঘরানার এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্ম ডিরেক্টর। অতীতের ধারাবাহিকতায় এবারও আগের সব এক্সপেরিমেন্টকে ছাপিয়ে গেলেন। নিজের আইফোনের ক্যামেরায় নিজেকেই ভিডিও করতে শুরু করলেন, সাথে যোগ দিলেন তার বন্ধু মজতাবা মিরতাহমাব।
সকালের নাস্তা করা, টিভিতে খবর দেখা, মেয়ের পোষা গেছো গিরগিটিকে খাওয়ানো, নিজের শাস্তির ব্যাপারে প্রতিবেশীদের সাথে ফোনালাপ, তার পূর্বনির্মিত তিনটি চলচ্চিত্র The White Ballon (১৯৯5), The Circle (২০০১) এবং Crimpson Gold (২০০৩) [বিশেষভাবে বলে রাখা ভাল, এই তিনটি ছবিই ইরানে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ] এর বিভিন্ন দৃশ্য ক্যামেরায় দেখিয়ে এর ব্যাখ্যা ও আলোচনা কোনোকিছুই বাদ গেল না ফ্রেম থেকে। ৭৬ মিনিট দৈর্ঘ্যের ফিল্মের আনুষঙ্গিক সব কাজ শেষ করতে সময় লাগে সর্বমোট ১০ দিন, যার মধ্যে শ্যুট হয় চারদিন। শেষটা পানাহি একটু ড্রামাটিকভাবেই করলেন। পারস্য নওরোজ বা নতুন বছরকে বরণ করার রাত ছিল ঐদিন। স্বভাবতই তেহরানের রাস্তায় শত শত লোকের ভিড়। আতশবাজিতে মুখরিত চারপাশ। আতশবাজির সাথে পানাহি প্রচণ্ড গুলির আওয়াজও শুনতে পাচ্ছিলেন বলে সন্দেহ করলেন। পানাহির বাসায় আগত এক যুবক ময়লা ফেলতে বাইরে গেলে আগ্রহ নিয়ে তিনিও ঘটনা দেখতে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে আসেন, কিন্তু সদর দরজা খোলা মাত্রই ক্যামেরা হাতে পানাহিকে লোকে দেখে ফেলবে ভয়ে ছেলেটি তাকে সতর্ক করে দিয়ে রাস্তায় নেমে যায়। রাস্তায় রাস্তায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। অবস্থা আঁচ করতে পেরে ইতস্তত পানাহি ক্যামেরা বন্ধ করে দিয়ে ভিতরে চলে আসেন। আর এভাবেই ‘বাইরে যখন তেহরান জ্বলছে,পানাহি তখন গৃহবন্দি’ এমন এক ইঙ্গিতবাহী বার্তা দিয়ে সিনেমা শেষ হয়। উল্লেখ্য, ২০১০ সালে পানাহিকে তার স্ত্রী ও কন্যাসহ গ্রেফতার করা হয় আহমেদিনেজাদ সরকারের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর অভিযোগে। সেখানে ইরানের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক গাইডেন্স ২০০৯ সালে দেশটির পুনঃনির্বাচন নিয়ে আহমেদিনেজাদ সরকারের উপর বিনা অনুমতিতে ডকুমেন্টারি করার কথা উল্লেখ করে।
ইরানে জাফর পানাহি আর নিষিদ্ধ সিনেমা যেন একে অন্যের সমার্থক। নিজেকে বরারবই অরাজনৈতিক নির্মাতা দাবি করে আসা জাফর পানাহি এ ফিল্মেও যেন মনের অজান্তে একজন বিপ্লবী কমরেড। পানাহি সিনেমা বানাবেন আর ইরান সরকার তা নিষিদ্ধ করবে না— সেটি কী করে হয়! এর আগেও বিভিন্ন সময় এবং সর্বশেষ গ্রিন বিপ্লব চলাকালে পানাহির দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে সরকার কর্তৃক নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পানাহিকে সানন্ডেন্স ফিল্ম ফেস্টিভালে যোগ দিতে না দেয়া। সেই সময় তার ফিল্ম অফসাইড ও দ্য সার্কেলকে মুসলিম নারীদের জন্য অফেন্সিভ বলে ইরানি সরকার চিহ্নিত করে। ক্রিটিকদের কেউ কেউ দিজ ইজ নট অ্যা ফিল্ম-এর মেকিংকে ভিডিও ডায়েরি ফরম্যাট বলে উল্লেখ করেন। মুভিটি রিলিজের পর থেকেই স্বনামধন্য অনেক ফিল্ম ম্যাগাজিন ও জার্নালে মুভিটিকে বিশেষভাবে হাইলাইট করা হয়। ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ ম্যাগাজিন ছবিটিকে ২০১২ সালের সেরা চলচ্চিত্রের তালিকায় অষ্টম স্থানে রাখে।
হলিউড রিপোর্টার ওদের জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলে, “An unusual documentary’that finds a creative solution to Panahi’s ban on filmmaking.”
সিনেমাটি নিয়ে আদ্যোপান্ত অনেক কথা বলা হলো। কিন্তু যে কেক রহস্য দিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম সেই লুকিয়ে পাঠানো পেনড্রাইভে আসলে কী ফিল্ম ছিল তা উল্লেখ করা হলো না। তবে না বললেও সচেতন পাঠকের মনে এতক্ষণে একটি নামই উদিত হবার কথা। THIS IS NOT A FILM… হ্যাঁ সত্যিই তাই। এটি তো সিনেমার চাইতেও অনেক বেশি কিছু!