মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস কিংবা গল্প পড়তে ভীষণ ভালোবাসি আমি। মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস পড়লে অদ্ভুত এক তৃপ্তি পাই, যা পুরো দেহ-মনকে দীর্ঘ সময় ধরে মোহিত করে রাখে। গল্পের কিছু কিছু অংশ এত মূর্ছনা জাগায়, যা মনকে আবেশে অভিভূত করে রাখে।
মানুষের জীবনের টানাপোড়েন, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, আর ভাবনার লাগামহীনতা মিশিয়েই হয়তো তৈরি হয় একেকটা চরিত্র, যার সমষ্টিগত একটা রূপ হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিক জনরা। আরো সহজ কথায় বলতে গেলে, জগতের সবচেয়ে কঠিন কাজ বোধহয় মানুষের মন পড়া। যার অন্য প্রান্ত পাঠ করার সাধ্য নেই, তাকেই তো মানুষ বেশি মান্য করে। মোটকথা, অপরের মনকে বন্দনা করা, আত্মীয়তা, দুঃসময়ে বন্ধু হয়ে যাওয়া। কী আশ্চর্য এক চেষ্টা! যার কোনো রূপই নেই, তাকে ছোঁয়ার জন্য এত আয়োজন? এই আয়োজনের নামই হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিকতা।
মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস পড়তে শুরু করেছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরে। তারপর অনেক গল্প পড়েছি এই জনরার। শিহানুল ইসলামের এই ধরনের মনস্তাত্ত্বিকগুলো আমাকে খুব আলোড়িত করে। ‘সন্ধে নামার আগে’ বইটির প্রতিটি উক্তিতেই মন নিয়ে খেলা করেছেন লেখক। চলুন দেখে আসি, ঠিক কোন গল্পটা বলতে চেয়েছেন লেখক।
কাহিনী সংক্ষেপ
একটা অসমাপ্ত গল্পকে বয়ে বেড়াচ্ছে অংশুক। তার লেখক সত্ত্বা সেই গল্পটা আজ পর্যন্ত লিখতে পারেনি। একসময়ের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা অপরাজিতারও ঠিক একই গল্প। কীভাবে দুই সময়ের দুজন মানুষের গল্পটা মিলে গেল?
এককালের বিখ্যাত নায়িকা অপরাজিতা, যে নিজের সৌন্দর্যে পুরো দেশের মানুষকেই নেশায় বুঁদ করে রেখেছিল। লেখকের ভাষায়, অপরাজিতা মানেই এক বিশুদ্ধতার প্রতিচ্ছবি। জীবনের এক অমোঘ ধারাপাত। এ যেন একজন জাত শিল্পীর দায়বদ্ধতা, যার বিনিময় কেবল পয়সায় হয় না।
অপরাজিতা গুহ, যে নিজেকে আড়াল করে রেখে ভেবেছিল তার অতীতের সমস্ত গল্প একদম গায়েব হয়ে গেছে। সত্যিই কি তা-ই? তাহলে সেদিনের পুচকে অংশুক সেই গল্পটা বুকে নিয়ে বেড়াচ্ছে কেন? স্বপ্ন থেকে পাওয়া সেই গল্পটার মাধ্যমে অংশুক যেন অপরাজিতার আড়াল ভেঙে গভীরে প্রবেশ করে ফেলেছে। এমনকি নিজের বাংলোয় বসে অপরাজিতা যা ভাববে তার সবটাই যেন অংশুক জেনে ফেলবে! নিজেকে সে কই আর লুকিয়ে রাখতে পারলো?
ঠিক এই গল্পটাই সুধীরের। যে সুধীরকে অপরাজিতা গুহ পড়তে পারেনি। অথচ তার ভেতরকার শুদ্ধতা কেড়ে নিয়েছিল সে। তার দুঃখগুলো ছুঁয়ে দেখতে পারেনি অপরাজিতা।
অথচ সেই দুঃখগুলো নিংড়ে নিচ্ছে অংশুককে। যে অংশুকের বেঁচে থাকার প্রকৃত উপলব্ধি হলো ভাবনায়, চিত্তে আর অনুভবের মাধ্যমে নিজেকে অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র করে রেখেছে। আর এজন্যই সুস্মিতা তাকে ভালোবাসতে চেয়েছিল। আবার এই স্বতন্ত্রতার ফাঁদে পড়েই সুস্মিতা তার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চাইলো। অংশুককে নিয়ে একটা নিজস্ব ঘরের স্বপ্ন দেখেও তা ভুলে যেতে চাইছে সুস্মিতা। সে কি কোনো অমোঘ সত্য জেনে ফেলেছিল? কেন সেই সত্যের দায় নিতে চায়নি সুস্মিতা?
ওদিকে আজাদ গুমরে মরছিল অপরাজিতাকে পেয়েও হারানোর যন্ত্রণায়। সেটা একটা বয়স পর্যন্ত। শুদ্ধ ভাবনা নিয়ে অপরাজিতাকে চেয়েছিল সে। ঘটনার পাকচক্রে মেয়েটাকে পাওয়া হয়নি তার। যৌবন প্রায় পেরিয়েই যাচ্ছে। একসময় বিশেষ উপলক্ষ ছাড়া অপরাজিতাকে মনেও পড়ে না আর। অপরাজিতাকে পেতে পেতেও পাওয়া হলো না আজাদের। সারাটা জীবন সেই আক্ষেপেই পুড়ল।
চুয়াল্লিশ বছর বয়সে তার মনে হলো, সে এখন সুকন্যাতে ডুবতে বসেছে। সুকন্যাকে আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে পুরুষ-বিদ্বেষী মেয়ে। তারপর হঠাৎই একদিন না চাওয়া সন্ধেতে এমন কিছু জেনে ফেলল আজাদ। খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মেয়ের গোপন কথা হুট করে জেনে ফেললে ভেতরে ভেতরে তার অহমিকা এভাবেই মরে যায়। সে সুকন্যাকে কাছে পেতে চাইলো। কিন্তু কতটুকু পাওয়া হলো তার? সুকন্যার কাছেও কি সে অবাঞ্ছিত নয়?
বেঁচে থাকার পথে এসব টানাপোড়ন, সম্পর্কের মধ্যকার সংঘাত আর মনের যত ওলটপালট ভাবনার উপাখ্যান হলো ‘সন্ধে নামার আগে’।
প্রতিক্রিয়া
যেকোনো ভালো গান শুনলে, ভালো মুভি দেখলে, ভালো বই পড়লে অন্যরকম এক ভালোলাগা কাজ করে। সেই সময়টাকে আচ্ছন্ন করে রাখে অদ্ভুত এক মায়াজালে। এই বইটি আমার কাছে সেই ধরনের একটি বই। জীবনধর্মী, মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস যারা ভালোবাসে তারা বইটি পছন্দ করবেই। বইয়ের পরতে পরতে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে নিজেকে।
উপমাময় লেখা পড়েছিলাম সমরেশ মজুমদারের লেখায়। উত্তরাধিকারে এত দারুণ উপমা দিয়েছিলেন তিনি! তার পরে উপমার দারুণ সব প্রয়োগ করতে দেখলাম শিহানুল ইসলামকে। তার ‘এপারে কেউ নেই’ বইয়েও চমৎকার কিছু উপমা পেয়েছি।
লেখক হয়তো গল্পের নায়কের নাম অজিত রেখেছিলেন শুরুতে। পরে নাম বদলে অংশুক রাখলেও একটা জায়গায় অজিত রয়ে গেছে। এই ব্যাপারে আরেকটু সতর্ক থাকা দরকার ছিল। এছাড়া বেশ কিছু টাইপো রয়ে গেছেে। আশা করি এসব ব্যাপারে আরও সতর্ক হবেন লেখক এবং প্রকাশনী।
লেখক পরিচিতি
লেখক শিহানুল ইসলাম বেড়ে উঠেছেন যমুনার কোলঘেষা এক গ্রামে। যমুনা পাড়ের নিগৃহীত মানুষগুলোর দুঃখই লেখকের জীবনের সামগ্রিক দুঃখবোধের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সেই মানুষদের কথা বলার জন্যই কলম ধরেছিলেন। মনস্তাত্ত্বিকতাকেই গল্পের মাধ্যমে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করছেন তিনি। এই জনরা নিয়েই কাটাছেঁড়া চলছে তার। এপর্যন্ত শিহানুল ইসলামের দুটি মৌলিক উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। উপন্যাস দুটি প্রকাশ করেছে ‘ভূমি প্রকাশ’।
একটি ‘এপারে কেউ নেই’- বইটি প্রকাশিত হয়েছে একুশে বইমেলা-২০১৮ তে। ‘এপারে কেউ নেই’ দেশভাগের প্রেক্ষাপটে লেখা একটি চমৎকার মনস্তাত্ত্বিক গল্প। সামগ্রিকতাকে ছাপিয়ে কতিপয় চরিত্রের ব্যক্তিগত এক হাহাকারের আখ্যান।
অন্যটি ‘সন্ধে নামার আগে’- এটি প্রকাশিত হয়েছে একুশে বইমেলা-২০২০ এ। ‘সন্ধে নামার আগে’ ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের টানাপোড়েনের গল্প। প্রত্যেকের জীবনেই একটা গোপন দুঃখ থাকে। সেটাই মানুষের বেঁচে থাকার অনুরণন। তার সংকটে মানুষ কেমন অনুভূতিশূন্য হয়ে যায়! সেই শূন্যতাই সবচেয়ে প্রকটভাবে ধরা দেয় সন্ধে নামার আগে।
অনলাইনে কিনুন- সন্ধে নামার আগে