“তোমাকে আমি পছন্দ করতাম। কিন্তু যা করেছ, তার ফলাফল কী তা তুমি খুব ভালো করেই জানো।”
যাকে উদ্দেশ্য করে টনি এই কথাগুলো বলে, সে জবাবে কিছুই বলে না। কেবল দুঃখ ভারাক্রান্ত চোখে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। এই দৃশ্যে তাদের দুজনের আচরণ আমাদেরকে অপরাধ জগতের সেই অলিখিত নিয়মের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়; যা সেলুলয়েডের কল্যাণে মহিমান্বিত রূপ লাভ করেছে।
ফরাসি শব্দ Rififi-এর ইংরেজি তর্জমা Brawling বা Fisticuffs. শুরুতে এটির নাম ছিল Du Rififi Chez Lez Hommes, যার অর্থ দাঁড়ায় A Fight Between Men. ১৯৫৫ সালে রিফিফির মুক্তির আগেও হেইস্ট জনরার সিনেমা নির্মিত হচ্ছিল। যেমন জন হিউস্টনের ‘দ্য অ্যাশফল্ট জাঙ্গল’ (১৯৫০)। তবে মডার্ন হেইস্ট জনরার ভিত্তি স্থাপন করে দেন জুলস ড্যাসিন তার রিফিফি সিনেমার মাধ্যমে। জনরার বিকাশে ফরাসি ফিল্মমেকার জ্যাঁ পিয়ের মেলভিলের বব লঁ ফ্যামব্লো (১৯৫৬) সিনেমার ভূমিকাও অনস্বীকার্য। উভয় চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপট প্যারিস। তাই ‘আধুনিক হেইস্ট ফিল্মের সূতিকাগার প্যারিস’- এ কথা বলাই যায়।
শুরুতে আমরা দেখতে পাই ধোঁয়াচ্ছন্ন একটি কক্ষ, যেখানে বসেছে জুয়ার আসর। সদ্য জেল থেকে ছাড়া পাওয়া টনি (জ্যাঁ সার্ভে) ইতোমধ্যেই তাসের আসরে নিজের কপর্দক খুইয়েছে। তারপরও সে খেলা চালিয়ে যেতে চায়। কিন্তু টাকা না থাকায় কেউ তার সাথে খেলা চালিয়ে যেতে রাজি হয় না। এমতাবস্থায় টনি কল করে তার বন্ধু জোকে (কার্ল মোহনার)। তৎক্ষণাৎ টাকা নিয়ে হাজির হয় সে।
সহসা আমরা জানতে পারি জো এমন সদয় আচরণ কেন করে। তার কারণ কয়েক বছর আগে উভয়ে মিলে একটি ডাকাতি করেছিল। যাতে ধরা পড়ে একাই সকল দায় মাথা পেতে নেয় টনি, টানে জেলের ঘানি। যার ফলশ্রুতিতে নিজের প্রেমিকাকেও হারাতে হয় তাকে। নগদ অর্থের পাশাপাশি দুটো তথ্যও নিয়ে আসে প্রাক্তন সহযোগী: ১. টনির প্রেমিকা ম্যাডো (ম্যারি স্যাবোরে) এখন শহরেই আছে। (টনি জেলে যাওয়ার পর সে ভাব জমায় লোকাল গ্যাংস্টার গ্রাটার (মার্সেল লুপোভিচি)-এর সাথে।) এবং ২. একটি অলংকারের দোকান লুটের চমৎকার প্ল্যান আছে তার কাছে। যদি চায় তাহলে টনি তার সাথে যোগ দিতে পারে।
টনি অপরাধের পথে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। জো’র দেওয়া অপর তথ্যানুযায়ী সে ম্যাডোর সাথে দেখা করবে বলে ঠিক করে। তবে তাদের সাক্ষাৎ যেরকম হবে বলে টনি আশা করেছিল, সেরকম হয় না। এই পরিস্থিতি তাকে ক্রোধান্বিত করে এবং আমরা তার প্রতিহিংসাপরায়ণতার পরিচয় লাভ করি। সিনেমার পরবর্তী অংশে চরিত্র হিসেবে তার উত্তরণ ঘটে। ম্যাডোর সাথে বচসার পর সেও ডাকাতিতে শামিল হবে বলে ঠিক করে। কিন্তু এ ধরনের ছোটখাটো ডাকাতিতে তার পোষাবে না, তাই জো’র নির্ধারিত দোকানেই ফুল স্কেল হেইস্টের প্ল্যান করে সে। যা সফল হলে তারা হাতিয়ে নেবে ঐ দোকানের সিন্দুকে থাকা সকল অলংকার; হাতে আসবে মিলিয়ন ফ্রাঁ অর্থমূল্যের দ্রব্যাদি।
কিন্তু এই প্ল্যান ফলপ্রসূ করতে হলে দরকার বিশেষজ্ঞের। তাই ডাক পড়ে জো’র বন্ধু মারিওর (রোপবার্ট ম্যানুয়েল)। প্রথম ডাকাতির আইডিয়া মূলত তার মাথাতে এসেছিল। আরো যোগ দেয় সিন্দুক বা সেফ ভাঙ্গার ওস্তাদ সেজার। যার সম্পর্কে বলা হয়, ‘এমন কোনো সিন্দুক নেই যেটি সেজার ভাঙ্গতে পারে না। আবার এমন কোনো নারী নেই, সেজার যার দ্বারা আকৃষ্ট হয় না।’ সেজার চরিত্রে অভিনয় করেছেন পরিচালক জুলস ড্যাসিন নিজে, পের্লো ভিটা ছদ্মনামে।
১২২ মিনিট দৈর্ঘ্যের রিফিফি আঁটসাঁট, প্লট বেইজড মুভি। এতক্ষণ পর্যন্ত যে কাহিনী সংক্ষেপ বলা হলো, সেটি প্রথম অংকের ঘটনাবলী। কিন্তু কেবল প্ল্যানিং আর ডাকাতির পরই চলচ্চিত্রটি শেষ হয়ে যায় না। বরং তখন সিনেমা আরো জটিল হয়। পরিচালক নিখুঁত প্ল্যানিং আর মনুষ্য ভুলকে দাঁড় করিয়ে দেন মুখোমুখি। আবহ আর চরিত্রদের আচরণ সমসাময়িক অন্যান্য গ্রেট নোয়ার বা ক্রাইম সিনেমার কাতারে স্থান লাভ করতে সহায়তা করে এটিকে।
সিনেমাটির মূল আকর্ষণ অবশ্যই ৩২ মিনিট দৈর্ঘ্যের সেই অনবদ্য হেইস্ট সিকোয়েন্স। না দেখলে বোঝা যাবে না এটি ধারণ করতে কতটা পরিশ্রম করতে বা মাথা খাটাতে হয়েছে ড্যাসিন আর তার সঙ্গীদের। সিনেমাটোগ্রাফার ফিলিপ্পে অ্যাগোস্টিনি আর এডিটর রজার ডয়াইরের সহায়তায় ড্যাসিন এমন আবহ সৃষ্টি করেছেন, যাতে মনে হয়েছে দর্শকও গল্পের অংশ। ডাকাতেরা নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী জুয়েলারি দোকান লুটতে পারবে কিনা, এই চিন্তায় দর্শকের কপালেও ভাঁজের উদয় হয়েছে। যেমন, একটি ওয়াইড শটে আমরা দেখি ডাকাত দল একটি গর্তের দিকে তাকিয়ে আছে। পরের দৃশ্যে আমরা আবার সেই একই গর্ত দেখতে পাই। তবে এবার ক্যামেরা চলে গেছে গর্তের অপর পাশে। এতে করে আলো-আঁধারির আবহ সৃষ্টি হয়, যা মুভির ঘটনাবলীকে দর্শক মনে আরো গ্রগাঢ় করে তোলে।
যন্ত্রপাতির টুকটাক আওয়াজ ছাড়া এমনিতে চার সদস্যের গ্যাং বেশিরভাগ সময়ই শান্ত এবং ধীরস্থির থাকে। তারা নিজেদের ভেতর কোনো কথা বলে না, যা বলার তা বলে দেয় তাদের অভিব্যক্তি। তবে তাদের মুভমেন্ট আমরা দেখতে পাই সামনে, পেছনে, উপর-নীচ সকল দিক থেকে। যাতে করে সাসপেন্সের আবহ সৃষ্টি হয়। এ ধরনের সিকোয়েন্স এরপর আরো অনেক সিনেমায় দেখা গেছে। তবে রিফিফির মতো অমোঘ কোনোটি হতে পারেনি। যা পরিচালক হিসেবে ড্যাসিনের সৃজনশীলতার পরিচায়ক, এই একটি সিকোয়েন্সই তাকে স্থান করে দিলো চলচ্চিত্রের স্বর্ণালী ইতিহাসে। বাস্তব জীবনেও এটি নিয়ে চর্চা হয়েছে। কেউ কেউ সিনেমায় দেখানো পন্থা অবলম্বন করে ডাকাতি করতে চেয়েছে। এসব কারণে কোথাও কোথাও রিফিফিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে বর্তমানের উন্নত প্রযুক্তির যুগে এই পন্থা অবলম্বন করে কোথাও লুট করা সম্ভব না।
প্রখ্যাত ফরাসি ফিল্মমেকার ফ্রাঁসোয়া ট্রুফো রিফিফি সম্পর্কে বলেন, এটি তার দেখা সবচেয়ে সেরা ফিল্ম নোয়ার; যেটি নির্মিত হয়েছে তার পড়া সবচেয়ে বাজে নোয়ার নভেলের উপর ভিত্তি করে। সিনেফাইল মাত্রই জানবেন ট্রুফোর উক্তির মাহাত্ম্য কতটুকু। মূল নভেলকে বাজে বলার কারণও আছে। অগাস্টে লঁ ব্রেটন রচিত একই নামের ১৯৫৩ সালের উপন্যাসে লেখকের জাতিবিদ্বেষী মনোভাবের প্রকাশ পেয়েছে। একটি নির্দিষ্ট জাতিসত্তার লোকদের তিনি সেখানে ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। ব্রেটনের সাথে মিলে চিত্রনাট্য লিখতে গিয়ে এসব ছেঁটে ফেলেন ড্যাসিন। রচনা করেন একটি ক্লাসিক নোয়ার স্ক্রিনপ্লে। যার সাথে তার ভিজ্যুয়ালাইজেশন আর গল্প বলার ধরন মিলে জন্ম নেয় কালজয়ী এক চলচ্চিত্র। যাতে প্রাণ সঞ্চার করেছে জর্জেস অরিকের সংগীতায়োজন।
নাম শুনে ফ্রেঞ্চ মনে হলেও জুলস ড্যাসিন মূলত একজন আমেরিকান। রিফিফি তার প্রথম ফ্রেঞ্চ চলচ্চিত্র। চল্লিশের দশকে তিনি থ্রিলারে নতুন প্রাণবন্ত এক স্টাইলের প্রবর্তন করেন। তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ এবং ডকুমেন্টারি থেকে অনুপ্রাণিত রিয়ালিজমের দেখা মেলে এসব সিনেমায়। এ ধরনের সিনেমার মধ্যে একটির প্রেক্ষাপট নিউ ইয়র্ক (দ্য নেকেড সিটি, ১৯৪৮); এবং অপরটির প্রেক্ষাপট স্যান ফ্রান্সিসকো (থিভস’ হাইওয়ে, ১৯৪৯)। মেট্রো শহরের মীন স্ট্রিটের অপরাধপ্রবণতাই ছিল এসব সিনেমার মূল উপজীব্য।
সবকিছু যখন ঠিকঠাক চলছিল, তখনই তার ওপর নেমে আসে ম্যাককার্থিইজমের খড়গ। কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিপ্রবণতার দায়ে তাকে করে দেওয়া হয় কালো তালিকাভুক্ত। শুরু হয় নির্বাসিত জীবন। প্রথমে যান ইংল্যান্ডে। এবং তার চোখে লন্ডন ধরা দেয় করাল রূপে। যা আমরা দেখি ১৯৫০ সালের নাইট অ্যান্ড দ্য সিটিতে। এরপর তিনি চলে আসেন ব্রিটিশ চ্যানেলের অপর পাশে, প্যারিসে। নির্মাণ করেন রিফিফি, যা বেশিরভাগ সমালোচকের মতে তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সেরা কাজ। তবে রিফিফি নির্মাণ কালে ড্যাসিনের মাথায় কালজয়ী কোনো কাজ করবেন, এমন ভাবনা ছিল না। তিনি কেবল খুঁজছিলেন অর্থ উপার্জনের পথ। নিজের ভিশন, সহযোগী এবং কম পরিচিত কুশীলবদের অনবদ্যতা তাকে স্থান করে দেয় সিনে জগতের ইতিহাসে।
যেকোনো গ্রেট ফিল্মের মতো রিফিফিও প্রভাবিত করেছে পরবর্তীকালের পরিচালকদের। এটি নির্মিত না হলে হয়তো আমরা ওশেন’স ইলাভেন (২০০১), মিশন: ইম্পসিবল টু (২০০০), দ্য স্কোর (২০০১) বা রেজারভোয়্যার ডগস (১৯৯২)-এর মত চলচ্চিত্র দেখতাম না। তাই সময় করে পাঠক দেখে নিতে পারেন সিনেমার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা টাইমলেস ফ্রেঞ্চ ক্লাসিকটি।