একদিন-একরাত করেছি প্রেমের সাথে খেলা!
– জীবনানন্দ দাশ
একরাত- একদিন করেছি মৃত্যুর অবহেলা।
একদিন-একরাত ;- তারপর প্রেম গেছে চ’লে ,-
সবাই চলিয়া যায় ,- সকলের যেতে হয় ব’লে
তাহারো ফুরাল রাত !- তাড়াতাড়ি প’ড়ে গেল বেলা
জীবনানন্দ দাশের ‘প্রেম’ কবিতার এই লাইনগুলোই যেন মনে করিয়ে দেয় মার্কিন সিনেমা ‘বিফোর সানরাইজ’। একরাত প্রেমের সাথে খেলা, একরাত মৃত্যুরে অবহেলা করা কিংবা একটি রাত প্রেমের জন্য অর্পণ করা। তারপর সময় কিংবা নিয়তির প্রয়োজনে চলে যাওয়া। এসব যেন জীবনানন্দের এই কবিতার সাথেই মিলে যায়। পরিস্থিতির ডাকে সকলের যেতে হয় বলেই চলে যায় সবাই। কিন্তু মায়া? মায়া এক অদ্ভুত জিনিস। এক রাতের কথোপকথন, কিছু মুহূর্তের অনুভূতি কি কাউকে সারা জীবনের জন্য মায়ায় জড়াতে পারে? আসলে এক রাত বা কয়েক মুহূর্তই কিছু মানুষকে সারা জীবন মনে রাখার জন্য যথেষ্ট। এমন এক অন্যরকম এক রাতের গল্পই আমাদের বলে ‘বিফোর সানরাইজ’।
ভালোবাসা বা মায়া এই জগতের সবচেয়ে অদ্ভুত জিনিস। মানুষ কেন মানুষকে ভালোবাসে তার সুত্র আমাদের জানা নেই। মানুষ নিজেই জানে না কখন, কেন সে কারো মায়ায় জড়ালো। বিফোর সানরাইজ সিনেমার গল্পটা যেন একদমই আলাদা। সুর্যোদয় পর্যন্ত দুজন মানুষের কথোপকথন, নিজেদের চিন্তাভাবনা একে অপরকে বলা, সারারাত ধরে ভিয়েনা শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ানোর কাহিনীই এই সিনেমায় দেখানো হয়েছে।
সেদিন, ১৬ জুন ১৯৯৪। হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট থেকে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাগামী ট্রেনে ঘটনাচক্রে জেসে নামক এক মার্কিন তরুণের সাথে দেখা হয় সেলিন নামের এক ফরাসি তরুণীর। এরপর তাদের মধ্যে শুরু হয় কথা। সেই কথা থেকে জন্মাতে থাকে মোহ। ক্রমেই আকৃষ্ট হতে থাকে তারা একে অপরের প্রতি। কিন্তু তাদের হাতে সময় তো নেই। দুজন দুই দেশের, পরদিন সকালে দুজনের গন্তব্যও আলাদা। সেদিন রাতটাই শুধু আছে একে অপরকে চেনার জন্য, কেবল একটি রাত উপভোগ করার সময় আছে তাদের কাছে। এরপর নিজেদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলে যেতে হবে উভয়কে।
গল্পের নায়ক জেসের হাতে একরাত ভিয়েনা শহরে বাসা নিয়ে থাকার মতো পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ নেই। পরদিন সকালে জেসের ফ্লাইট এবং সেলিনও পরদিন সকালেই প্যারিসের ট্রেনে উঠবে। তখন জেসে সেলিনকে সেই রাতটা শহরে ঘুরে বেড়ানোর প্রস্তাব দেয়। সেই প্রস্তাবে সায় দেয় সেলিন। তারা সিদ্ধান্ত নেয় সেই রাতটা একসাথে কাটানোর। ট্রেন থেকে নেমে ভিয়েনা শহরের যেদিকে দু’চোখ যায় সেদিকেই চলতে শুরু করে তারা। একে অপরকে বলতে থাকে নিজেদের চিন্তা-ভাবনা, দর্শন, ভালোলাগা-মন্দলাগা। ভিয়েনার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে ঘুরতে তারা নিজেদের মধ্যে বেশ খোলামেলা আলোচনা করতে থাকে। তাদের মধ্যে কথোপকথন হয় ভালোবাসা নিয়ে, জীবন নিয়ে, দর্শন নিয়ে, এমনকি ধর্ম নিয়েও।
ক্রমেই তাদের মধ্যে এক রোমান্টিক সম্পর্কের অবতারণা হতে থাকে। একে অপরের প্রতি শারীরিক ও মানসিকভাবে আকৃষ্ট হতে শুরু করে তারা। কিন্ত আর মাত্র কয়েক ঘন্টা। এরপর একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে হবে তাদের। সে যা-ই হোক। আর দেখা হোক বা না হোক, তাই বলে যে সময়টা আছে তার সর্বোত্তম ব্যাবহার করবে না কেন! তাই তারা জীবনের অনুপাতে এই ক্ষণিক সময়কে উপভোগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। যে মানুষকে জেসে এর আগে কোনোদিন দেখেনি, সে এক বিদেশিনী। সেই বিদেশিনী তাকে দিয়েছে ভালোবাসা, দিয়েছে অনুভূতি, সময় দিয়েছে, শান্তি দিয়েছে। সেসব অনুভূতি, স্মৃতি সেই বিদেশিনীকে সারা জীবনের জন্য রেখে দেয় হৃদয়ের গভীরে।
প্যারিসের সেলিন যেন নাটোরের বনলতা সেনেরই প্রতিরুপ যে এক অন্যরকম অনুভূতি দিয়েছিল জেসেকে কিংবা দিয়েছিল দু-দণ্ড শান্তি। ক্লান্ত এক প্রাণ জেসে, তাকে ঘিরে রেখেছে জীবনের সমুদ্র সফেন। অতঃপর ভিয়েনায় তাকে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল প্যারিসের সেলিন।
সেসব রঙিন সময় ফুরালো। সময় হয়েছে এবার চলে যাওয়ার। সেলিনকে প্যারিসের ট্রেনে তুলে দেওয়ার জন্য স্টেশনে যায় জেসে। শেষবার যখন রেল স্টেশনে তাদের দেখা তখন তারা আবারো দেখা করবে বলে কথা দেয়। কিন্তু কতদিন পর? শেষপর্যন্ত তারা ছয়মাস পর দেখা করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের সেই কথোপকথন যেন জীবনানন্দের ‘পঁচিশ বছর পরে’ কবিতারই সমার্থক। যেখানে জীবনানন্দ বলেছিলেন,
শেষবার তার সাথে যখন হয়েছে দেখা মাঠের উপরে-
বলিলামঃ ‘একদিন এমন সময়
আবার আসিও তুমি- আসিবার ইচ্ছা যদি হয়;
পঁচিশ বছর পরে।
জীবনানন্দ পঁচিশ বছর পরের কথা বললেও জেসে আর সেলিন ঠিক ছয় মাস পর ভিয়েনাতেই দেখা করবে বলে একে অপরকে কথা দেয়। কিন্তু সেই ছয় মাস পার হতে কতো বছর লাগে তা সময়ের চেয়ে বেশি কেউ জানে না। সময় আর পরিস্থিতি আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। কথামতো ছয়মাস পর কি তাদের দেখা হয়েছিল? সেই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে দেখতে হবে বিফোর ট্রিলজির পরবর্তী সিনেমা ‘বিফোর সানসেট’।
রিচার্ড লিংকলেটার ও কিম ক্রাইজান দুজনে মিলে লিখেছেন এই সিনেমার কাহিনী। লিংকলেটার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে এই সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন। ১৯৮৯ সালে ফিলাডেলফিয়ায় রিচার্ড লিংকলেটারের সাথে সাক্ষাত হয়েছিল এক নারীর। তখন তারা দুজনে শহরের বিভিন্ন দিকে ঘুরে বেড়ান, তাদের মধ্যে গভীর কথোপকথন হয়। সেই বাস্তব জীবনের স্মৃতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই তিনি লিখেছেন এই সিনেমার গল্প। লিংকলেটারের পরিচালনায় এই কাহিনী যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। বিফোর ট্রিলজির প্রথম সিনেমা ‘বিফোর সানরাইজ’। সিনেমায় জেসে চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইথান হক, এবং সেলিন চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন জুলি ডেলপি। সিনেমাটি ১৯৯৫ সালে থিয়েটারে মুক্তি পায়। এর পরবর্তী দুটি সিকুয়েল ‘বিফোর সানসেট’ এবং ‘বিফোর মিডনাইট’ মুক্তি পায় যথাক্রমে ২০০৪ এবং ২০১৩ সালে।