প্রতিটা যুদ্ধই অনেক গল্প তৈরি করে, আবার সব গল্পের আড়ালেই থাকে ভিন্ন কিছু যুদ্ধ।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আতঙ্কের বারুদ ছড়িয়ে দিয়েছিল গোটা দেশজুড়ে। চাপা কান্নার শব্দে ঘুমাতে যাওয়া, ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে জেগে ওঠা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। নিভু নিভু প্রদীপের মতো ফুরিয়ে আসত একেকটি জীবনের বাতি। আঁকড়ে ধরার সম্বল ছিল না। মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না। অবশ্য সব খুঁইয়ে সর্বস্বান্ত বুকের ভেতর কিছু না থাকলেও ভিসুভিয়াসের ক্রোধ ছিল। সাহস, স্থিরতা, আত্মবিশ্বাসের সঞ্জীবনী শক্তির অমোঘ আধার ছিল। বুলেটের বিরুদ্ধে লাঠি? গ্রেনেডের বিরুদ্ধে বৃষ্টি? ভাবতে অবাক লাগে। বিস্ময়ের বিমূঢ়তায় চিত্তে স্তব্ধতা আসে। অথচ আগামীর সম্ভাবনাময় স্বাধীনতার অভিপ্রায়ে যুদ্ধের এই হাহাকার আমাদের খুব চেনা। কাব্যে-গীতিতে, গদ্যে-ছন্দে তার আলেখ্য নিদর্শন।
দীর্ঘ বিষাদের অবশেষে বিজয়ের গল্পগাঁথা অনেকাংশেই ম্লান হয়ে আসে। আত্মত্যাগ যেখানে পাহাড়প্রমাণ, সেখানে প্রাপ্তির আনন্দ বেশিক্ষণ টিকতে পারে না। আর এখানেই ভিন্নধারার আমেজ এনে দিয়েছে আলোচিত উপন্যাসিকা, ক্ষ্যাপা। হারানোর আক্ষেপ, শূন্যতার গ্লানির তুলনায় প্রাপ্তির গৌরব এখানে বরারবই বেশি।
ক্ষ্যাপা ঠিক সেই সময়ের গল্প, যখন আমরা নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করছিলাম। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে মাটি হয়ে উঠত লালচে। শত্রু ঠেকিয়ে রাখার তাগিদে চলত ঘরে ঘরে দুর্গের নির্মাণ। কিন্তু যুদ্ধকালীন বিভীষিকাময় অধ্যায় নিয়ে এই গল্পটা লেখা হয়নি, বরং গল্পটি প্রেরণার। অফুরন্ত সাহসের। যেখানে ক্রমে প্রকট হয়ে ওঠে এক মুক্তিকামী ক্ষ্যাপা কিশোরের ভিন্ন কিছু যুদ্ধ।
প্রেক্ষাপট মিঠাপুকুর গ্রাম। মিঠা আলুর ফলন ভালো হয় সেখানে। গ্রামবাসীরা যথেষ্ট সচ্ছল। কোনো কিছুর অভাব নেই। সুখী আবাসের প্রতিচ্ছবি স্বরূপ মিঠাপুকুর গ্রামকে বইয়ের পাতায় তুলে ধরেছেন লেখক বাপ্পী খান। বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলে গল্পের গতি। বর্গার পদ্ধতি, ঢেঁকির কাজ, সিঁধেল চোরের প্রবৃত্তি, অচ্ছুতের স্বরূপের সাথে পাঠকের জানাশোনা ঘটে। আর নির্ধারিত পাঠক যেহেতু ছোটরা, কাজেই বইটি তাদের জিজ্ঞাসু মনের খোরাকের যোগান দিতেও ভূমিকা রাখে।
মিঠাপুকুরের সবার স্বভাব কিন্তু মিঠা না। টক আছে। ঝাল আছে। জমিদার রামমোহন রায় দানশীল প্রকৃতির মানুষ। কলিম ব্যাপারী বদমেজাজী হলেও গ্রামের ভালো চান। শহীদুল মাস্টার, বাগানপ্রেমী কালিদাস, মুদি দোকানি হেকমত মিয়ার মতো মানুষদের সবাই শ্রদ্ধার চোখে দেখে। কিন্তু ভালোর বিপরীতেই আছে মন্দ। আর মিঠাপুকুরের মন্দ লোকেদের শীর্ষে আছে ওসি ফারুক, তরফদার চেয়ারম্যান।
ক্ষ্যাপা উপন্যাসিকায় জাহাঙ্গীরের মতো রহস্যময় কিছু চরিত্রের দেখা পাওয়া যায়। ছেলে, জহিরই যার একমাত্র সম্বল। বাপ-ছেলে মত্ত থাকে গুলতি খেলে, বালিহাঁস ধরে, কিংবা ডাহুক মেরে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস সত্যিই নির্মম। একদিকে নির্ভেজাল জাহাঙ্গীর আটকা পড়ে মিথ্যা মামলার কবলে। অন্যদিকে চোরের ছেলে চোর হিসেবে বিখ্যাত (কিংবা কুখ্যাত!) হয় জহির। তারপর?
তারপর গল্পে জুড়ে যায় নতুন পালক। জহিরের জীবনেও দেখা দেয় ভিন্ন ভিন্ন মোড়। নদীর পানি তেষ্টা মেটালেও খাবার জুটবে কোথা থেকে? একা ছেলে রুক্ষ ভূমিতে টিকবে কী করে? বলাই বাহুল্য, চোরের ছেলেকে কেউ আপন করেনি। কাজেই জহিরের সংগ্রামী জীবনে অ্যাডভেঞ্চারের কোনো কমতি ছিল না। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে জঙ্গলে ধুঁকে ধুঁকে বাঁচতে শিখে গিয়েছিল ক্ষ্যাপা ছেলেটা।
শহীদুল মাস্টারের সংস্পর্শে এসে জহিরের শেখার যুদ্ধটা সহজ হয়ে গিয়েছিল। ক্ষুধার যুদ্ধটা সহজ ছিল না ঠিকই। অবশ্য খাবার জুটে যেত ঠিক। ক্ষ্যাপা, জহিরের জন্য প্রকৃতির পসরা সবসময় সাজানো গোছানো থাকত। এর মধ্যেই সম্পূর্ণ ভিন্নধারার এক যুদ্ধের উদ্ভব ঘটতে দেখা যায়। মুক্তির জন্য যুদ্ধ। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ।
কিন্তু জঙ্গলের বিভীষিকার তুলনায় হাজারগুণ বেশি ভয়াবহ পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। নারকীয় তাণ্ডবের প্রকোপে মিঠাপুকুরের কদর্য রূপটা যখন বেরিয়ে আসে, ক্ষ্যাপা জহিরও তখন ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ওঠে। যুদ্ধ শেষে অনিবার্য বিজয়ের গল্প তো আমাদের জানা, কিন্তু জহিরের উন্মত্ততার শেষটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে?
বস্তুত মিঠাপুকুর গ্রামবাসীর সুখ কিংবা দুঃখের গল্প ক্ষ্যাপা। শান্তিপূর্ণ গ্রামটার বুকে শত্রুপক্ষ যেদিন অস্ত্রবোঝাই হেলিকপ্টার নামিয়েছিল, গল্পটা সেই সময়ের। নিঃসন্দেহে ঐক্যবদ্ধতা এই গল্পের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক। বৃহত্তর স্বার্থের লক্ষ্যে বিরাগভাজন হাবুলের সাথে জহিরের একাত্মতা মূলত সেই বার্তাই প্রদান করে। তাছাড়া হায়েনার মুখোশধারী কিছু মানুষের গল্প বইয়ের পাতায় স্থান পেয়েছে।
এই গল্পের পরতে পরতে গুলতি হাতে ছুটে চলা এক ক্ষ্যাপা কিশোরের টিকে থাকার গল্প। দেশকে স্বাধীন করার সংকল্প যেখানে সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে। পিতার অপমান, নিজের চারিত্রিক কলঙ্ক যেখানে একেবারেই তুচ্ছ। অবধারিতভাবেই দেশের মর্যাদার কাছে সবই ঠুনকো। কারণ মৃত্তিকার চেয়ে বড় কিছু নেই।
লেখক বইয়ের পাতায় তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধের চিরপরিচিত সময়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সম্পূর্ণ ভিন্নধারার একটি গল্প। যুদ্ধ সম্পর্কে ভাবলে সবার আগে হানা দেয় ভয় আর আতঙ্ক। অথচ অ্যাডভেঞ্চারধর্মী উপন্যাসিকা, ক্ষ্যাপার ক্ষেত্রে যুদ্ধকালীন ভয়াবহতার তুলনায় বিজয়ের আনন্দ প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। দারুণ সাবলীলভাবে নির্মিত হয়েছে বইয়ের পুরো কাহিনি।
গল্পের প্রয়োজনে আসা প্রতিটি ঘটনার বর্ণনা ঠিকঠাক উঠে এসেছে। শব্দের কারুকাজ বইয়ের পাতায় কেটে কেটে বসানো হয়েছে ছবির মতো। পড়লেই সেই অদ্ভুত সুন্দর ছবিটা ভেসে ওঠে একদম চোখের সামনে। মুহূর্তেই ঘুরে আসা যায় মিঠাপুকুরের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত। মৌমাছির চাকের দৃশ্যটা খানিকটা অবাস্তব ঠেকতে পারে। তবে যুদ্ধকালটা তো এমনই— চমক, অস্বাভাবিক।
চরিত্রগুলোর নির্মাণ যথেষ্ট ভালো। বিশেষ করে জহির নামক ক্ষ্যাপা ছেলের কথা সহজে ভোলার মতো নয়। তার কঠোর জীবনের রোমাঞ্চকর আখ্যান কোনো যুদ্ধের চেয়ে কম না। নাম দেখেই বাংলা চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তী পরিচালক, জহির রায়হানের প্রতি লেখকের শ্রদ্ধা অনুমেয়। একই কথা শহীদুল মাস্টারের ক্ষেত্রেও খাটবে। গুণী ব্যক্তিত্ব জহির রায়হানের ভাই, প্রখ্যাত লেখক শহীদুল্লাহ কায়সারের কথাই যেন স্মরণ করিয়ে দেয় এই চরিত্র।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের মাঝে বরাবরই আলাদা আবেগ কাজ করে। একাত্তরের সময়টা কাছ থেকে জানার সুযোগ যাদের হয়নি, তাদের জন্য ক্ষ্যাপা হতে পারে চমকপ্রদ একটি উপায়। কিশোর বয়সী পাঠকদের জন্য সুপাঠ্য অবশ্যই। তাছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকদের স্মৃতির ট্রেনে ভ্রমণের সুবর্ণ সুযোগ এনে দিতে পারে এই বইটি। ছেলেবেলার দুষ্টুমি আর আনন্দে ভরা দিনগুলোতে পুনর্গমন করতে চাইলে ক্ষ্যাপার পাতায় চোখ বুলিয়ে দেখা যেতে পারে। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের আবহে অ্যাডভেঞ্চারধর্মী বই যাদের পছন্দ, পড়তে পারেন তারাও।
বই সংক্ষেপ
বই: ক্ষ্যাপা
লেখক: বাপ্পী খান
ধরন: মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অ্যাডভেঞ্চার
প্রকাশনী: বাতিঘর প্রকাশনী