মার্টিন ম্যাকডোনাহর জন্ম ও বেড়ে ওঠা লন্ডনে, এক আইরিশ দম্পতির ঘরে। লন্ডনের আলো-বাতাসে বড় হলেও নিজের আইরিশ জিনকে তিনি কখনো ভোলেননি। সহজাত ব্ল্যাক কমেডির সাথে আইরিশ নানা বিষয় তার কাজে উপস্থিত হয়েছে নানাভাবে। ব্রিটিশ থিয়েটার জগতে নাট্যকার হিসেবে খ্যাতি অর্জনের পর তাকে দেখা যায় ক্যামেরার পেছনে। ২০০৮ সালে বানান ইন ব্রুজেস। ব্র্যান্ডন গ্লিসনের সাথে ম্যাকডোনাহর আগেই পরিচয় ছিল। ইন ব্রুজেসে কাজ করতে গিয়ে বন্ধুত্ব হয় কলিন ফ্যারেলের সাথে। এই বন্ধুত্ব দিনে দিনে আরও গাঢ় হয়েছে। এই আইরিশ ত্রয়ী মিলে আবার ভক্তদের নতুন কিছু উপহার দেবেন, এমন আশা সবসময় ছিল। তাদেরও ইচ্ছে ছিল আবার একসাথে কাজ করার। কিন্তু ব্যাটে-বলে মিলছিল না। অবশেষে দ্য ব্যানশীজ অফ ইনিশেরিন (২০২২)-এর মাধ্যমে সকলের মনের আকাঙ্ক্ষা যেন পূর্ণ হলো।
সিনেমার গল্পের সময় ১৯২৩ সাল, আইরিশ গৃহযুদ্ধ শেষের দিকে এসে পৌঁছেছে। প্রেক্ষাপট কল্পিত দ্বীপ ইনিশেরিন, যার অবস্থান মূল আইরিশ ভূখণ্ড থেকে খানিকটা দূরে।
দ্বীপের বাসিন্দা সহজ-সরল, ভোলাভালা পাড্রিক সুলিভান (কলিন ফ্যারেল)। সে দেখা করতে যায় প্রাণের বন্ধু ক্লম ডোহার্টির (ব্র্যান্ডন গ্লিসন) সাথে। কিন্তু বন্ধুর ঘরে গিয়ে তার সাথে সে কথা বলতে পারে না। ফলে সে চলে যায় দ্বীপের পাবে। সেখানেও তার দেখা মেলে না।
কিন্তু বন্ধুর সাথে যে তার দেখা করতেই হবে! এভাবে যখন তার সাথে দেখা হয়, তখনও সে দেখে যে তার বন্ধু তার সাথে কথা বলছে না। বরং তার উপস্থিতি বন্ধুকে বিরক্ত করছে। তাকে সে অগ্রাহ্য করছে। এ ঘটনায় পাড্রিকের দুনিয়া নড়ে যায়। সে জানতে চেষ্টা করে তার বন্ধু কেন এমন আচরণ করছে।
অন্যদিকে, পাড্রিক আর ক্লমের বন্ধুত্বের খ্যাতি রয়েছে পুরো দ্বীপে। দ্বীপে করার মতো তেমন কিছু নেই। তবে নিজেদের প্রাত্যহিক কার্যগুলো তারা একসাথেই সারে। হঠাৎ করে তাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরবে- এটা দ্বীপের বাসিন্দাদের পক্ষেও বিশ্বাস করা কঠিন। ক্লমের দেখা মেলা ভার। দেখা মিললেও এ বিষয়ে সে মুখে কুলুপ এঁটেছে। তাই সবাই বার বার পাড্রিককে প্রশ্ন করে। তাদের মাঝে কি ঝগড়া হয়েছে? হলে তার কারণটাই বা কী?
কিন্তু পাড্রিকও তো এ ব্যাপারে কিছু জানে না। বরং এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে সে নিজেই পেরেশান। একসময় সে ক্লমকে পাকড়াও করে। তার সাথে কথা না বলার কারণ জানতে চায়। ক্লম জানায়, কোনো বিশেষ কারণ নেই। সে পাড্রিককে আর পছন্দ করে না।
কিন্তু পাড্রিকের জন্য এ উত্তর যথেষ্ট হয় না। সে নিজের বন্ধুর সাথে পুনরায় হৃদ্যতার সম্পর্ক স্থাপনে ব্রতী হয়। পাড্রিকের বোন শিওভান (কেরি কন্ডন) ভাইকে পরামর্শ দেয় ক্লমকে না ঘাঁটাতে। বুদ্ধিতে খাটো, গ্রামের মানুষের হাসির পাত্র ডমিনিক কিয়ার্নিও (ব্যারি কিওঘান) তাকে একই পরামর্শ দেয়। এভাবে এই দুজনের সাথেও পাড্রিকের হৃদ্যতা বাড়ে। কিন্তু এদের কারো কথায় কর্ণপাত না করেই পাড্রিক ক্লমের সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চেষ্টা জারি রাখে। এক্ষেত্রে শিওভান আর ডমিনিকও তাকে সাহায্য করতে শুরু করে। ক্লমকেও তারা মানাতে চেষ্টা করে।
একপর্যায়ে আমাদের কাছে মনে হয় তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হলেও হতে পারে। ঠিক তখনই ক্লমের দিক থেকে আসে একটা হুমকি। সে বলে, পাড্রিক যদি তার সাথে আর কথা বলার চেষ্টা করে, তাহলে সে একে একে নিজের হাতের সবগুলো আঙুল কেটে ফেলবে!
এখন এই হুমকি শুনে কী করবে পাড্রিক? সে কি ভুলে যেতে চাইবে পুরনো বন্ধুকে? না কি চেষ্টা আরো বাড়িয়ে দেবে? আর ক্লম কি করবে? কেউ কি বন্ধুর উপর রাগ করে নিজের আঙুল কেটে ফেলে?
এছাড়া, দ্বীপের শৃঙ্খলারক্ষক পেদার কিয়ার্নি, ভীতিকর মিসেস ম্যাককরমিক, পাদ্রী, পোস্ট লেডি মিসেস ও’রিওরডান এবং বারটেন্ডার জঞ্জো ডিভাইন- এরাও উল্লেখযোগ্য চরিত্র।
আপাতদৃষ্টিতে দ্য ব্যানশীজ অফ ইনিশেরিনের চরিত্রদের যে দ্বন্দ্ব, সেটা মামুলি। আমার বা আপনার সাথে কেউ কথা বলতে না চাইলে আমরা হয়তো ২-১ বার চেষ্টা করবো সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে। এরপর তাকে তার মতো থাকতে দেবো। কিন্তু ইনিশেরিন দ্বীপের ব্যাপারটা তেমন না। এখানে সঙ্গীর অভাবে লোকজন অবিবাহিত জীবন কাটিয়ে দেয়। তরুণরা প্রণয়িনী খুঁজে পায় না। তাই এখানে সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে হারানোর মানে একাকীত্বে ভোগা। পাড্রিকের উপর তা কেমন প্রভাব ফেলে সেটা দেখতে পাই আমরা। এক্ষেত্রে তাদের সম্পর্কের প্রকৃতি অনেকটা প্লেটোনিক ভালোবাসার মতো।
আবার, মার্টিন ম্যাকডোনাহর আগের কাজের সাথে পরিচিত হলে, তার সিগনেচার ব্ল্যাক কমেডি, ট্র্যাজেডি এবং ম্যাকাব্রে উপাদানগুলোর ব্যাপারে জানবেন। এসবের জন্য অপেক্ষাও করবেন। কিন্তু দেখতে পাবেন সিনেমার প্রথম অংকে কেবল একটা কথা ঘোষণার মতো শোনা যাচ্ছে। একটা চরিত্র আরেকটা চরিত্রের সাথে বন্ধুত্ব রাখতে চাচ্ছে না। দ্বিতীয় অংকে এই কথা পরিণত হলো হুমকিতে। বলা হলো- কথা বলার প্রচেষ্টা করলে আঙুল কেটে ফেলা হবে। সাদা চোখে এমন নির্বিষ ‘লোয়ার স্টেকসমূহকে যেভাবে ‘হায়ার স্টেক’-এ রূপান্তরিত করেন ম্যাকডোনাহ, সেখানেই এই সিনেমার মাহাত্ম্য, যা একজন স্ক্রিপ্ট রাইটার এবং ডিরেক্টর হিসেবে ম্যাকডোনাহরও সাফল্য। হায়ার স্টেক তৈরিতে তিনি যেভাবে সমসাময়িক ভূরাজনীতি, মানুষের মনোভাব এবং রাজনৈতিক বিষয়াবলী স্ক্রিপ্টের থিমের সাথে একীভূত করেছেন, সেটা তার মেধা আর রাজনৈতিক সচেতনতার উজ্জ্বল প্রমাণ।
তিন বন্ধুর আইরিশ শিকড়ের কথা তো শুরুতে বলা হয়েছে। এদিক থেকে এবং সময় বিবেচনায় দ্য ব্যানশীজ অফ ইনিশেরিনকে আমরা আইরিশ গৃহযুদ্ধের রূপক উপস্থাপনা হিসেবেও দেখতে পারি। আয়ারল্যান্ডের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব, তারা সবসময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়েছে নিজেদের স্বাধীনতার জন্য। যখন ব্রিটেন আয়ারল্যান্ডকে ডমিনিয়নের মর্যাদা দিল, তখন স্বাধীনতাকামী জনতা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়লো। উভয়পক্ষই স্বাধীনতা চাইল। তবে পদ্ধতির ভিন্নতায় সৃষ্টি হলো প্রজন্মান্তরের বিভেদ।
পাড্রিক আর ক্লম যেন বিবাদমান দুই পক্ষেরই প্রতিনিধি। অতি উৎসুক ব্রিটিশদের প্রতিভূ চরিত্রও রয়েছে। গৃহযুদ্ধের ফলে মানুষ বা সমাজ যেভাবে তার সারল্য, নিষ্কলুষতা হারায়, যেভাবে এ দুটো উপকরণ যাদের বিরোধিতা করছে তাদের সমার্থকে পরিণত হয়, রূপকের আশ্রয়ে এসব বিষয় এখানে ফুটে উঠেছে চমৎকারভাবে। এমন পরিবর্তন এবং মনোভাবের অসাড়তার ব্যাপারও মূর্ত হয়েছে সিনেমায়। এদিক থেকে একে আমরা অ্যান্টি-ওয়ার ফিল্মও বলতে পারি।
আবার, সিনেমার নামে ব্যানশীর উল্লেখ আছে। এরা আইরিশ রূপকথার পরীসদৃশ সত্তা, যারা মৃত্যুর আগমনী বার্তা প্রচার করে। শেষ দৃশ্যে আমরা এমনই এক ব্যানশীকে উপস্থিত দেখি, যেটা সেই প্রেক্ষাপটে যুদ্ধের সমাপ্তিতেও আমাদেরকে অশুভ ইঙ্গিত দেয়। আইরিশ ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা সেই অশুভ ইঙ্গিতকেই সত্য হতে দেখি।
সিনেমার ট্র্যাজিক আবহের সাথে বিনা ক্লেশে মিশে গেছে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক এবং সিনেম্যাটোগ্রাফি। সকল অভিনেতার অভিনয়ও চমৎকার। এক্ষেত্রে কিওঘানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অন্য কারো হাতে পড়লে হয়তো তার চরিত্র কেবল কমিক রিলিফের বস্তু হতো।
তো, সময় করে দেখে নিতে পারেন ১১৪ মিনিটের সিনেমাটি, যেটি হয়তো এখন পর্যন্ত ম্যাকডোনাহর সেরা কাজ। এখানে তিনি গল্পের যতটুকু দেখিয়েছেন আর যতটুকুর ব্যাপারে আভাস দিয়েছেন, তা তার শৈল্পিক দক্ষতার পরিচায়ক।