প্রারম্ভিক দৃশ্যেই এই সিনেমা তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুটি বক্তব্য; মুদ্রাস্ফীতি এবং প্রচলিত সমাজব্যবস্থার নিপীড়িত প্রকৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় দর্শককে। শুরুতেই এমন গুরুগম্ভীর বিষয়ের দিকে তর্জনী তাক করা এই সিনেমা সম্পর্কে অতি স্বল্প কথায় ধারণা দিতে গেলে কিছু বিশেষণের আশ্রয় নিতে হয়- কমনীয়, মর্মস্পর্শী এবং একইসাথে বিধ্বংসী, আমূল এবং প্রগাঢ়ভাবে রাজনৈতিক। কোনো সিনেমায় এই দ্বান্দ্বিক মিলন সাধারণত খুব কমই নজরে পড়ে।
পৃষ্ঠতল দেখে গীতিময়ী ভাবের সিনেমা মনে হলেও, ভেতরের বক্তব্য যথেষ্ট গুরুগম্ভীর এই সিনেমার। পলিটিকাল ড্রামায় রোমান্সের মিষ্ট স্বাদের পাশাপাশি সূক্ষ্ম আঁচে ডিস্টোপিয়ান ভাইব সম্পন্ন, সুইজারল্যান্ডিয়ান সিনেমা, ‘জোনাহ্ হু উইল বি ২৫ ইন দ্য ইয়ার ২০০০’।
সুইজারল্যান্ডে বসবাসরত আটটি চরিত্রের গল্প বলে এই সিনেমা। আপাতদৃষ্টিতে শ্রেণিভেদে তাদের বুর্জোয়া শ্রেণিভুক্ত করা গেলেও দেখা যায়, এই আট চরিত্র সামাজিক আর প্রাতিষ্ঠানিক সকল শৃঙ্খল ছেড়ে নিজেদের মুক্ত করতে চায়। গল্পের চরিত্রদের প্রধান দুটি চরিত্র, ম্যাথিউ এবং মাতিলদা। টাইপরাইটার হিসেবে কর্মরত ম্যাথিউ সদ্যই তার চাকরি হারিয়েছে, অন্যদিকে মাতিলদা কাজ করছে ফ্যাক্টরিতে। সন্তান নেবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই দুই দম্পতি, যার নামেই সিনেমার নামকরণ। চাকরিচ্যুত ম্যাথিউ চাকরির খোঁজ করতে গিয়েই মার্গারিটা আর মার্সেলের সান্নিধ্যে আসে। সাক্ষাৎ হয় তাদের। মার্গারিটা-মার্সেল দুজনেরই পেশা বাগান তৈরি করা। বাগানের প্রয়োজনীয় সার সংগ্রহে তারা নিয়োগ দেয় ম্যাথিউকে।
পরিবেশ বিষয়ে অগাধ জ্ঞান রাখে বাকপটু স্বভাবের এই মার্সেল। প্রাণীজগৎ আর বাস্তুসংস্থানে আসন্ন বিপর্যয় নিয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা রাখতে পারে সে। অন্যদিকে মার্গারিটার পাগলামো জৈব চাষ নিয়ে। বাকি চার চরিত্রের মাঝে আছে ম্যাক্স, যে কিনা একসময় মার্ক্সবাদী বিপ্লবী লিওন ত্রোৎস্কি’র ভাবাদর্শে নিমগ্ন থাকলেও, এখন রাজনীতির ময়দান ছেড়ে পরাজিত সৈনিকের ন্যায় প্রুফরিডারের চাকরি নিয়ে অর্থহীন দিন কাটাচ্ছে। ম্যাক্সের পরিচয় হয় ব্যাংকার ম্যাডেলিনের সাথে। ম্যাক্সের ধারণামতে, ম্যাডেলিনের ব্যাংকই সাধারণ মানুষদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলার তোড়জোড় করছে। অবশ্য ম্যাডেলিন এসবে নেই, সে ব্যস্ত বরং তন্ত্রসাধনায়।
ভারতের প্রচলিত এই সাধনা, তাকে আকৃষ্ট করেছে বেজায়রকম। আরেকদিকে আছে, মার্কো। হাইস্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক। সসেজ দিয়ে সময়ের অসীম ভাঁজ সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের বোঝাতে গিয়ে সে চলে যায় রুসো, ভলতেয়ারদের দর্শনে; আবার ফিরে আসে পুঁজিবাদ গুঁড়িয়ে দেওয়ার তীব্র বাসনা নিয়ে। সেই তীব্র বাসনা থেকেই হয়তো ম্যারির স্বভাব তাকে আকৃষ্ট করে। সুপারমার্কেটের ক্যাশিয়ার এই ম্যারি। গল্পে তার আগমন যেন ‘রবিন হুড’ হয়ে।
‘জোনাহ্’ গাছের শাখা-প্রশাখা’র মতো এই আট চরিত্র ও চরিত্রদের ভিন্ন গল্পকে মূল গল্পে সংযুক্ত করে। এবং সেই মূল গল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত ১৯৬৮ সালের মে মাসে ফ্রান্সের রাজনৈতিক অস্থিরতার দিনগুলোতে। পুঁজিবাদী ও ভোগবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ৬৮-এর মে মাসে ফ্রান্সে জেগে উঠেছিল বেসামরিক অস্থিরতা। ফ্রান্সের রাজনীতিবিদগণ তো ভেবেছিলেন, গৃহযুদ্ধ বুঝি লেগে গেল এবার। তবে শেষ অব্দি গৃহযুদ্ধের রূপ না দেখলেও ফ্রান্সের মে-জুন, দুমাসের সেই সময়টা নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা ইউরোপকে। সুইজারল্যান্ডের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে-ও পরিবর্তন এনেছে সেই সময়টা।
সেই পরিবর্তিত রূপটার আলাদা আলাদা ছাঁচে গড়ে ওঠা চরিত্র এরা। যেন সেই বিপ্লবে মৌন অংশগ্রহণকারী। শ্রেণিভেদে এদের বুর্জোয়া শ্রেণিভুক্ত করা গেলেও দেখা যায়, এরা তথাকথিত বুর্জোয়াসুলভ আচরণের বিপরীতপন্থি। সাধারণ জীবনযাপনেই সাচ্ছন্দ্য খুঁজে পায় তারা। এই চরিত্রেরা শুধুমাত্র তাদের কাজের খাতিরেই পুঁজিবাদী সমাজভুক্ত হয়, কিন্তু কাজ বাদে বাকি সময়ে তাদের বাস এই সমাজের বাইরে, নিজেদের এক দুনিয়ায় রুটিরুজি তাদের এই পুঁজিবাদী সমাজে হলেও তাদের চোখে এঁটে আছে শ্রেণিবিভেদহীন এক ভবিষ্যৎ দুনিয়ার স্বপ্ন, কানে বিপ্লবের সেই সুর। এবং তারা তাদের এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চায় জোনাহ্’কে দিয়ে। ম্যাথিউ এবং মাতিলদার সেই সন্তান, জোনাহ্। জোনাহ্’র জন্ম তাদেরকে নতুন এক সূচনা দেয়, নতুন এক আশা দেয়। এক সুন্দর ভবিষ্যৎ দুনিয়ার আশা। ২০০০ সালের সেই দুনিয়া। এবং ঠিক এখানটায় এসে ‘জোনাহ্’ সিনেমায় যোগ হয় ডিস্টোপিয়ান আবহ।
সিনেমার নারী চরিত্রগুলোর গঠনরূপ খানিকটা ভিন্ন। ডিস্টোপিয়ান আবহকে জোরদার করতে নারী চরিত্রগুলোর এই গঠনরূপ। মাতিলদার চরিত্রটি এখানে উপস্থাপিত হয় ‘ধরিত্রী’ রূপে। অন্যদিকে মার্গারিটা যেন ধারণ করছে প্রকৃতির রহস্যময়তা। শুধু এই চরিত্রগুলোই নয়, সিনেমার আটটি চরিত্রই কোনো না কোনো রূপকের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। নারী চরিত্রগুলো যখন পৃথিবী ও প্রকৃতির রহস্যকে ধারণ করছে এবং সিনেমার ডিস্টোপিয়ান আবহর প্রগাঢ়তা তুলে আনছে, পুরুষ চরিত্রগুলোর মুখে তখন সিনেমার মূল বিষয়ের রাজনৈতিক বক্তব্য আরো শাণিত হচ্ছে। বিপ্লব আনতে বদ্ধপরিকর তারা।
‘জোনাহ্ হু উইল বি ২৫ ইন দ্য ইয়ার ২০০০’ এই আট চরিত্র এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থা দ্বারা নিপীড়িত, সমাজবহির্ভূত একঘরে মানুষগুলোকে একই ছাদের নিচে আনতে চেষ্টা করে। ইউরোপে তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিকদের শোষণের বিষয়টিও উঠে এসেছে সিনেমায়। তবে সিনেমার বহুল বিষয়ের ভিড়ে এই গুরুগম্ভীর বিষয়টি অনেকটা ভাসাভাসা রয়ে গেছে। অথচ, সুইস পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এরাই সবচেয়ে বেশি শোষণের শিকার।
পরিচালক অ্যালাইন ট্যানার তার অন্য আরেকটি সিনেমা ‘দ্য সালামান্দার’ (১৯৭১)-এ সুইস লোকজনের জেনোফোবিয়া (ভিনদেশীয় লোকজনের প্রতি ভয়)-র দিকটি কড়া ব্যঙ্গাত্মক রূপে তুলে এনেছিলেন। সেই সিনেমার চিত্রনাট্যকার জন বার্গার, সুইস লোকজনের এই অবস্থার রূপটা যথেষ্ট অলঙ্কারপূর্ণ করে লিখেছিলেন।
কিন্তু এ সিনেমার চিত্রনাট্যে জন বার্গারের লিখনশৈলীতে সেই একই ট্রিটমেন্ট কিছুটা অগভীর। ট্যানারের বিদ্রূপের জায়গাটা দ্ব্যর্থবোধক। তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিকদের উপর নিপীড়নের চিত্র আরো ভারী এবং অনুনাদী করে তোলা যেত। পুঁজিবাদ সচল রাখতে যে বেকারত্ব দরকার এবং এই প্রক্রিয়ায় বাইরের দেশের শ্রমিকদের গুরুত্ব তুলে ধরার মুহূর্তটা হয়তো বেখেয়ালে এড়িয়ে গেছেন পরিচালক ট্যানার।
এই সীমাবদ্ধতা ছাড়া, ৬০ দশকের সংগ্রামী ব্যবস্থার ভিতে বর্তমানকে বহুকাল ধরে প্রচলিত রূপকথার মতো ‘আশাবাদ’ দিয়ে ঘিরে দারুণ এক বিশ্লেষণীয় রূপ উপস্থাপন করেছেন ট্যানার। এই আশাবাদ আর আকাঙ্ক্ষার প্রতীক ওই ছোট্ট শিশু, জোনাহ। তবে শুধুমাত্র চেতনা দিয়েই পুঁজিবাদ গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভব, এমন ধারণা সিনেমাটি তৈরি করে না কখনোই। ডকুমেন্টারির ন্যারেটিভের মতো সিনেমার মাঝের বিভিন্ন অংশে জুড়ে দেওয়া রিয়েল ফুটেজগুলোতে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পিঠে সুইস আর্মির অবরোধের চিত্র এই ধারণাটাই প্রতিষ্ঠিত করে; শান্তিপ্রিয় সুইসদেরও নিপীড়নের নিজস্ব ইতিহাস আছে।
সিনেমার আট চরিত্রের অন্তর্দ্বান্দ্বিক দিকটিও দেখাতে ভোলেননি পরিচালক। তাদের স্ব-স্ব দর্শনে আছে ভিন্নতা এবং সেই ভিন্নতাই এই দ্বন্দ্বের পাথেয়। পুঁজিবাদী নিপীড়নকে ‘সিস্টেমিক’ দেখানো অন্যতম বড় লক্ষ্য, এই সিনেমার। রাজনৈতিক কৌশল উত্থাপনের পথ নয়, বরং রাজনৈতিক নথি তৈরির পথটা দেখায় ‘জোনাহ’। এতসব বিষয় ও বক্তব্যকে লিনিয়ার ন্যারেটিভের ধাঁচে উপস্থাপন করে না এই সিনেমা।
মূল ন্যারেটিভের ভাঁজে ভাঁজে আপাতদর্শনে বিছিন্ন মনে হওয়া রিয়েল ফুটেজের ন্যায় দৃশ্যগুলো মার্ক্সবাদী ধারণার মূলে প্রবেশের পাশপাশি, পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকদের বিচ্ছিন্ন অবস্থাকে জোরালো করে তোলে। এবং সবকটি ধারণা; বক্তব্যকেই মেটাফিজিক্যাল কবিতা আকারে সাজিয়েছেন পরিচালক ট্যানার। গোটা সিনেমায় সময়, প্রকৃতি, শিক্ষা; এসব মূল সুর হিসেবে বারবার প্রতিধ্বনি তোলে।
এই সিনেমা উঁচুদরের শিল্প-নিচুদরের শিল্প’র তথাকথিত অদ্ভুত ফারাকে না জড়িয়ে শিল্পের অন্য এক সংজ্ঞাকে সামনে এনেছে। রোজকার সকল কাজের প্রক্রিয়াতে ‘জোনাহ’ শিল্পকে খুঁজেছে, মিশিয়েছে। প্রতিদিনকার আলাপে, গুনগুন করে গেয়ে ওঠা গানের ছোট্ট কলিতে, উদ্দেশ্যহীন শ্লেষে, ক্ষণিকের জেশ্চারে কিংবা কোনো বাক্যবাগীশ বিবৃতিতে ছড়িয়ে থাকা শিল্পরূপকে দৃষ্টিগোচর করে তোলে ‘জোনাহ’। এমনকি চরিত্রদের ভেতরকার শৈল্পিক সত্ত্বার ওই সুরিয়াল ভিশনেও। শুধু শিল্পের ক্ষেত্রেই নয়, ইতিহাসের ক্ষেত্রেও ‘জোনাহ’ একই পন্থা মেনেছে। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছোটবড় সবকিছুর মধ্য দিয়েই ইতিহাসবেত্তার ভূমিকা পালন করেছে এই সিনেমা।
শব্দে এবং দৃশ্যে, দুই জায়গাতেই এই সিনেমা গদারের ন্যারেটিভ স্টাইল অনুসরণ করেছে। ম্যাডেলিন এবং ম্যাক্সের আলাপচারিতার দৃশ্যের সেই ট্র্যাকিং শটগুলো গদারের ‘কনটেম্পট’ সিনেমার পল এবং ক্যামিলের কথা মনে করিয়ে দেয়। অপেশাদার গায়কদের গায়কী মনে করিয়ে দেয় ‘পিয়েরত- দ্য ম্যাডম্যান’-এর কথা।
গদারের শান্ত, ধীর রূপটার একটা কাছাকাছি প্রতিকৃতি যেন ট্যানার। ‘জোনাহ্’র কালার প্যালেটগুলো ধূসর। নিঃশব্দ, বোবা হয়ে রয়েছে যেন। সূক্ষ্মভাবে হলেও সম্পাদনা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। শটগুলো কখনো কখনো একটু দীর্ঘ হয়েছে, আবার কখনো অকস্মাৎ কাট হয়েছে। ক্যামেরা কখনো পেয়েছে পূর্ণ স্বাধীনতা, আবার কখনো সবিস্তারে সরে গিয়েছে সাবজেক্টের কাছ থেকে।
সিনক্রোনাস সাউন্ড আর লং টেকের শটে ট্যানার তার অভিনেতাদের সময় দিয়েছেন চরিত্রটা বুঝতে। চরিত্রদের আলাপচারিতার প্রতিটি দৃশ্যেই মুহূর্তে মুহূর্তে লাইটিং, ক্যামেরার সেটআপ বদলিয়েছেন ট্যানার। তার হাসিঠাট্টাপূর্ণ আমেজের আঁচটা বুঝতে পারবে যে কেউ। সিনেমায় বাস্তববাদিতা দেখানোর প্রচলিত পদ্ধতিকে ট্যানার ভিন্নতা দেন ‘ওভারটোনাল মন্তাজ’ ব্যবহার করে। গদারের স্টাইলকে ট্যানার তার নিজস্ব ভঙ্গিমায় আরো সম্প্রসারিত করেন এবং তা যথেষ্ট পরিমাণ নাটকীয় আবেগের সাথেসাথে উদ্ভাবনী উপায় রেখেই।
ইন্টেলেকচুয়াল হয়েও এই সিনেমার পরিষ্কার বক্তব্য, চটপটে স্বভাব আর নিপুণতা বিস্ময় জাগায়। আশাবাদ আর প্রেমভাবে পূর্ণ ধুয়াযুক্ত ছোট্ট এক গান যেন ‘জোনাহ হু উইল বি ২৫ ইন দ্য ইয়ার ২০০০’।