বিশাল ভরদ্বাজের শেক্সপিয়র ট্রিলজির তৃতীয় সিনেমা ‘হায়দার’ (২০১৪) সমালোচক মহলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল, এবং দেশব্যাপী বিতর্কেরও সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। বিতর্ক হবে না-ই বা কেন? সিনেমার গল্পের প্রেক্ষাপট এমন এক অঞ্চল, যাকে ঘিরে প্রতিবেশী পারমানবিক শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে ভয়ংকর সংঘর্ষ এবং দুটি যুদ্ধ পর্যন্ত হয়ে গেল।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সেনাবাহিনী নিয়োজিত অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি হলো কাশ্মীর। সীমান্তের পাশেই আছে শত্রুদেশ পাকিস্তান। তাদের বিরুদ্ধে ভারতের অভিযোগ, তারা সীমান্তের ওইপাশ থেকে কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের সাহয্য করে। এই শত্রুদের হাত থেকে দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার খাতিরে লক্ষাধিক সেনা মোতায়েন করা হয়েছে এই ভূস্বর্গে।
বলিউডের সিনেমাগুলোতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে কাশ্মীরকে তুলে ধরা হয়েছে। এসবের মধ্যে কাশ্মীরের দুইটি দিক বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। এক, কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। দুই, কাশ্মীরের কথিত বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী আন্দোলন। বাইরে থেকে গণমাধ্যম এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদী চোখ দিয়ে কাশ্মীরকে দেখা ছাড়াও আরেকভাবে কাশ্মীরকে দেখা যায়।
পরিচালক বিশাল ভরদ্বাজ দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন:
“কাশ্মীরের পঁচিশ বছরের রাজনৈতিক নৈরাজ্য আর তার ট্র্যাজেডি আমাকে এই সিনেমা নির্মাণ করতে বাধ্য করেছে। কাশ্মীরকে আমরা সব সময় দেখে এসেছি সাজসজ্জার উপকরণ যেমন শুধু সিনেমার গানের শুটিং স্পট হিসেবে; অথবা মুখস্থ বুলি হিসেবে- যেমন আমরা দেখিয়েছি- ফিরান (কাশ্মীরী পোশাক) পরে কোনো এক লোক কালাশনিকভ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ‘হায়দার’ হলো প্রথম সিনেমা যেখানে কাশ্মীরকে আমরা দেখি ভেতর থেকে। আমার মনে হয় না এই ইস্যু নিয়ে আমরা মূলধারার কোনো সিনেমা নির্মাণ করেছি।”
উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ষোড়শ শতাব্দীর বিখ্যাত ট্র্যাজেডি ‘হ্যামলেট’কে কাশ্মীরের প্রেক্ষাপটে নির্মাণ করেছেন পরিচালক বিশাল ভরদ্বাজ। সাথে রয়েছে কাশ্মীরি সাংবাদিক বাশারত পীরের স্মৃতিকথা ‘কারফিউড নাইটে’র সহযোগিতা। এর আগে ‘ম্যাকবেথ’ থেকে ‘মকবুল’ (২০০৩), ‘ওথেলো’ থেকে ‘ওমকারাতে’ (২০০৬) এই ধ্রুপদী নাট্যকারের বিখ্যাত সৃষ্টিকর্মগুলোকে আধুনিক ভারতীয় প্রেক্ষাপটে নতুনভাবে সিনেমায় নির্মাণ করার সাহস দেখিয়েছেন। তবে ‘হায়দার’ তার আগের কাজগুলোকে ছাপিয়ে গেছে বলে সমালোচকদের ধারনা।
১৯৯৫ সালের সহিংস বিদ্রোহে টালমাটাল কাশ্মীর। দিনে রাতে সেখানে কারফিউ লেগে থাকে। মাঝে মাঝেই সাধারণ কাশ্মীরিদের ওপর সেনা ক্র্যাকডাউন হয়। শত শত তরুণ যুবকদের বিশেষ ক্ষমতার আইনের (AFSPA) আওতায় সেনারা সন্ত্রাসী সন্দেহে তুলে নিয়ে যায়। দীর্ঘদিন তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। এরপর হঠাৎ কখনো কোথাও গণকবরে তাদের অস্তিত্বের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়।
দমবন্ধ করা এইসব স্নায়বিক উত্তেজনার সময়ে কাশ্মীরের শ্রীনগরের অনন্তনাগ এলাকার স্থানীয় ডাক্তার হিলাল মীর এক দুঃসাহসিক ঝুঁকি নেন। তিনি এক বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী নেতা ইখলাক লতিফের অ্যাপেন্ডিক্সের অপারেশন করেন তার নিজ বাসায়। ডাক্তার হওয়ায় পেশাগত কাজে তিনি ছিলেন সেনাদের বিশ্বাসভাজন এবং সম্মানিত ব্যক্তি। তার নিজের বাসাতেই তার এই রোগীর জন্যে সবচেয়ে নিরাপদ বোধ করেন। এই ধরনের ঝুঁকি নেয়া দেখে তার স্ত্রী গাজালার এবং সাথে সাথে দর্শকদেরও সন্দেহ হয়, তিনি কার পক্ষে? স্বাধীনতাকামীদের? নাকি ভারতপন্থীদের? তিনি উত্তর দেন- জীবনের!
কিন্তু জীবনের পক্ষে যারা থাকতে চায়, তাদের প্রায়ই দেখা যায় নিজেদের জীবনের ক্ষতি ডেকে আনতে। হঠাৎ সকালবেলা একটি অভিযান চালানো হয়। মসজিদের মুয়াজ্জিন মাইকে নির্দেশ দেন, এলাকার সকল পুরুষ আর যুবকদেরকে বাড়ির বাইরে বের হয়ে আসতে। মিলিটারিরা সকল পুরুষদের খতিয়ে দেখতে থাকে তাদের মধ্যে ‘সন্দেহজনক’ কিছু পাওয়া যায় কিনা। যাদেরকে সন্দেহজনক মনে হয় তাদের ওপর টর্চার চলে। এই ‘সন্দেহজনক’ মানুষ বাছাই করার প্রক্রিয়া খুবই চমকপ্রদ। সিনেমার (০০.০৯.৩৬) মিনিটে দেখা যায়, এলাকার সকল পুরুষদেরকে পর্যায়ক্রমে একে একে আর্মির এক জিপের সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। ড্রাইভারের আসনে কোনো এক সেনা অফিসার মুখমণ্ডল ঢাকা টুপি পরে বসে থাকেন। তিনি ‘সন্দেহজনক’ বলে কাউকে মনে হলেই হর্ন দেন। এরপর তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করা হয় তথ্য আদায়ের উদ্দেশ্যে।
আপাতভাবে মনে হয়, ডাক্তার চোখে মুখে আতঙ্কের ভাব লুকাতে না পেরে ধরা পড়ে যান। মিলিটারিরা অনন্তনাগে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা ইখলাক লতিফের অবস্থান সম্পর্কে খোঁজ নিয়েই আসে। ডাক্তার হিলাল মীরের বাসায় তল্লাশি চালাতে গিয়ে বাসায় অবস্থানরত আহত ইখলাকের সঙ্গী সাথীদের সাথে মিলিটারির সত্যিকারের বন্দুকযুদ্ধ হয়। ডাক্তার আর তার স্ত্রী গাজালার চোখের সামনে তাদের বাসা রকেট লঞ্চার দিয়ে বিস্ফোরিত করে দেওয়া হয়। ডাক্তারকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। আর পাঁচটা কাশ্মীরি পুরুষ যাদেরকে সন্ত্রাসী সন্দেহে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাদের ভাগ্য মেনে ডাক্তার হিলাল মীরও গুম হয়ে যান। পরবর্তীতে যাকে খুঁজে বের করার ভয়ংকর ট্রমাটিক ভ্রমণে বের হবেন তার আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় ফেরত একমাত্র সন্তান, সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র হায়দার।
বাবাকে খুঁজতে গিয়ে অস্থিতিশীল কাশ্মীরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছাপিয়ে হায়দার ঢুকে যাবে শেক্সপিয়রীয়ান ফ্যামিলি ড্রামায়। সেই ড্রামার মধ্যেও কাশ্মীরের মেটাফোর চাইলে খুঁজে পাবে দর্শক।
সিনেমায় পরিচালক বিশাল ভরদ্বাজের দুইটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। একদিকে ছিল গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে কাশ্মীরিদের জীবনের ভয়াবহ রাজনৈতিক ও সামরিক বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরার চ্যালেঞ্জ। যা ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আবেগের জন্য বেশ অস্বস্তিকর বলা যায়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় সিনেমা মুক্তি পরবর্তী টুইট যুদ্ধে। ভারতীয় সেনাদেরকে ‘বর্বর’ হিসেবে সিনেমায় উপস্থাপন এবং কাশ্মীরের সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের অভিযোগ এনে প্রতিবাদ করেন এর বিরোধীরা। হ্যাশট্যাগ ‘BoycottHaider’ টুইট হয় প্রায় ৭০,০০০ হাজার বার। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে হ্যাশট্যাগ ‘HaidertrueCinema’ এর মাধ্যমে ‘হায়দার’কে সোশ্যাল মিডিয়ায় সমর্থন জানায় হায়দারের ভক্তকুল।
এই বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে নির্মাতা বিশাল ভরদ্বাজ দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন বলেন:
“ আমি নিজেও একজন ভারতীয়। আমি নিজেও একজন দেশপ্রেমিক। আমিও আমার জাতিকে ভালবাসি। তাই আমি অবশ্যই এমন কিছু তৈরি করব না যা আমার জাতির বিরুদ্ধে যায়। কিন্তু যা কিছু মানবতা বিরোধী সে বিষয়ে অবশ্যই আমার মন্তব্য থাকবে।”
পরিচালকের দ্বিতীয় কঠিনতম কাজ ছিল শেক্সপিয়ারের জটিলতম ট্র্যাজেডির আধুনিক ভারতীয় রূপায়ণ। নিজ দেশে বা দেশের বাইরে তার এই কাজের সফলতা নিয়ে বেশ খুঁটিনাটি আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু কেউই তার এই ‘দুই পাগলা ঘোড়ায় চড়ে বসা’ সাহসী উদ্যোগের প্রশংসা না করে পারেননি।
হায়দার চরিত্রে ক্যারিয়ার সেরা অভিনয় করেছেন বলিউডের পরিচিত মুখ শহীদ কাপুর। হায়দারের মা গাজালার চরিত্রে পাল্লা দিয়ে সমান গুরুত্বপূর্ণ অভিনয় করে গেছেন টাবু। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতে, টাবুর বরাতে শেক্সপিয়ারের এই ট্র্যাজেডি এক নতুন ‘জারট্রুডে’-কে পেয়েছে। হায়দারের পিতা হিলাল মীর চরিত্রে আছেন নরেন্দ্র ঝা। তার ভাই, হায়দারের কুচক্রী চাচজান খুররাম চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছেন কে কে মেনন। হায়দারের ছোটবেলার প্রেয়সী আরশিয়া চরিত্রে শ্রদ্ধা কাপুর খারাপ অভিনয় করেন নি। তার পিতা পারভেজ চরিত্রে ছিলেন ললিত পারিমো।
দশ মিনিটের এক অসাধারণ ক্যামিও চরিত্রে এসেছিলেন ইরফান খান। তার চরিত্রের নাম রুহ্দার। শেক্সপিয়ারের হ্যামলেটে দেখা যায়, নিহত রাজা হ্যামলেটের ‘আত্মা’ তার সন্তান রাজকুমার হ্যামলেটকে এসে বলে যায়, তার পিতার হত্যাকারী কে! তাকে তার পিতার হত্যার প্রতিশোধ নিতে বলে। ‘হায়দার’ সিনেমায় নির্মাতার সুনিপুণ কৌশলে সেই ‘আত্মা’ হয়ে যায় এক রহস্যময় চরিত্র ‘রুহ্দার’। সিনেমার ফ্রেমে বিশেষ উপস্থিতি হিসেবে (০১:০৩:১৭) মিনিটে হাজির হন রুহ্দার। সিনেমার প্রথমার্ধের কিছুটা ধীরগতি কাটিয়ে উঠে দ্বিতীয়ার্ধে এক অসাধারণ সিনেমাটিক অভিজ্ঞতার ইঙ্গিত দিয়ে যান।
পুরো সিনেমা জুড়েই আছে এক ট্র্যাজিক বিষণ্ণতার সুর। এই ট্র্যাজেডি শুধু শেক্সপিয়রীয়ান ট্র্যাজেডিই নয়। নির্মাতা কিভাবে শেক্সপিয়রীয়ান ট্র্যাজেডির সাথে কাশ্মীরের মানুষের জীবনে কয়েক যুগ ধরে ঘটে চলা ট্র্যাজেডিকে মিলিয়ে দেখাতে চেয়েছেন, সেটা দেখার মতো বিষয়। বিভিন্ন সময়ে এটা ‘হ্যামলেট’-কে ছাপিয়ে গিয়ে কাশ্মীরের বয়ান হয়ে উঠেছে। কাশ্মীরের আজাদি নিয়ে কাশ্মীরের মধ্যেই যে দুই ধরনের অভিমত চালু আছে সেটা দেখতে পাওয়া যায়। একপক্ষ সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে আজাদি হাসিল করতে চায়। আরেক পক্ষ গান্ধীবাদী আদর্শে বিশ্বাসী। সিনেমায় ডাক্তার হিলাল মীরের প্রবীণ পিতা পরের দলের প্রতিনিধি। চরমপন্থি আদর্শবাদী এক নেতাকে তিনি উপদেশ দেন, “প্রতিশোধ শুধু প্রতিশোধই ডেকে আনে। এর থেকে আজাদি না মিললে আসল আজাদির দেখা পাওয়া যাবে না।”
তবে কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামীদের মধ্যে ভারত-বিরোধী মনোভাবের চিহ্ন হিসেবে সিনেমার (০০:৫২:৩৮) মিনিটের ফ্রেমে এক বাড়ির দেয়ালে লেখা থাকতে দেখা যায়: ‘Go India, Go Back’!
পুরো সিনেমা জুড়ে জম্মু এবং কাশ্মীর প্রদেশের সাধারণ মানুষের জীবনে মিলিটারি প্রভাবের চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সিনেমার (১:০৪:১৮) মিনিটে দেখা যায় এক যুবক তার নিজের বাড়ির দরজার সামনে মাথা নিচু করে কাঁচুমাচু হয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার মা জোরাজুরি করলেও সে বাসায় প্রবেশ করছে না। রুহ্দার এসে জিজ্ঞেস করলে তার মা বলেন, সে এভাবেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। বাসায় প্রবেশ করে না। রুহ্দার তার শরীরে মিলিটারি স্টাইলে তল্লাশি চালান। এরপরেই শুধু সে তার নিজ বাসায় প্রবেশ করে! কাশ্মীরের মানুষ যে সম্মিলিতভাবে একটা মিলিটারি ট্রমার মধ্যে দিয়ে যায় তার একটা উদাহরণ হিসেবে নেয়া যায় একে। সিনেমার (০০:৩৫:০৮) মিনিটে এক পিতা তার সেনাদের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে সেনা ক্যাম্পে বন্দী সন্তানের মুক্তির উপায় জানতে আসেন স্থানীয় আইনজীবী খুররামের কাছে। খুররাম তাকে বলেন, তার সন্তানকে সেনাদের কাছে থেকে ছুটিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে তাকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে পারেন তিনি। সেজন্য তার নামে মিথ্যা মামলা দিতে হবে। যাতে তাকে জেল-হাজতে অন্তত বাঁচিয়ে রাখা যায়। তাতেই কৃতজ্ঞ হয়ে যান সেই পিতা। চরম যন্ত্রণাদায়ক অপেক্ষা এবং তারপর গণকবরে সন্তানের পঁচে যাওয়া লাশের চিহ্ন খোঁজার চেয়ে অন্তত তার সন্তান জেলে থাকলেও জীবিত থাক! উধাও না হয়ে যাক! সিনেমার (০০:৩৭:৩৪) মিনিটে হায়দার তার দুই বন্ধু এবং তাকে নজরদারিতে রাখা গোপন স্পাইদের সামনে তার পিতাকে খুঁজতে বের হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। তারা তাকে বলে, সে বাবাকে খুঁজবে কোথায়? ক্যাম্পে না কয়েখানায়? হায়দার বলে, পুরো কাশ্মীরই তো কয়েদখানা! সব জায়গাতেই সে বাবার খোঁজ নিবে।
বলিউডের সাম্প্রতিক সিনেমার ইতিহাসে ‘হায়দার’ একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এর বেশ কিছু সিনেমাটিক মুহূর্ত আছে যেগুলো কোনোভাবেই ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। এর মধ্যে আছে সিনেমার (০১:২৬:৪০) মিনিটে রাস্তার মোড়ে প্রচুর মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে করা হায়দারের এক বক্তৃতা। নিজের পিতার মৃত্যুর খবর জানতে পারে সে। পিতার মৃত লাশের ছবি ও কবর দেখে সে ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজওয়ার্ডারে’ ভুগতে থাকে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। নিজের মাথা কামিয়ে পাড়ার মোড়ে সে বক্তৃতা দেয়। পুরো সিনেমাতে তো বটেই, বিশেষ করে এই দৃশ্যে শহীদ কাপুর যে মানের অভিনয় করে দেখান সেটা তার এই পর্যন্ত সেরা অভিনয় বলা চলে।
পিতা ডা. হিলাল মীরের কবর খুঁজে পাওয়ার পর তার গায়েবানা জানাজা হয়। সেসময় হায়দারকে গোরস্থানে বাচ্চাদের সাথে ফুটবল খেলতে দেখা যায়। সিনেমার (০১:৪৪:৫৭) মিনিটে আরেক স্মরণীয় মনোলগ আছে তার। প্রায় সাড়ে ছয় মিনিট ধরে চলা ‘বিসমিল’ গানের মধ্যে দিয়ে এক কাহিনী মঞ্চস্থ হয়। ‘প্লে উইদিন অ্যা প্লে’র এই ধারণার মাধ্যমে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো কাহিনী উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যে দিয়ে কোনো এক বিশেষ দর্শকের মনোভাব বা প্রতিক্রিয়া বুঝতে চাওয়া হয়। এই গানে এবং কোরিওগ্রাফিতে কাশ্মীরের ঐতিহ্যবাহী ‘ধুমাল’ লোকসংগীতকে উপস্থাপন করা হয়েছে।
‘হ্যামলেট’ এ শেক্সপিয়ার রাজপুত্র হ্যামলেট ও তার মা রাণী জারট্রুডের মধ্যে ‘ইডিপাস কমপ্লেক্স’-কে ফুটিয়ে তুলেছেন। ইডিপাস কমপ্লেক্স হলো বিপরীত লিঙ্গ হিসেবে মায়ের প্রতি ছেলে সন্তানের বিশেষ আকর্ষণ। যা শিশু সন্তান স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার সাথে সাথে কাটিয়ে ওঠে। মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের এই তত্ত্বকে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে সাবধানী উপস্থাপন করতে হয়েছে বিশাল ভরদ্বাজকে। তার দেশের দর্শকের কথা ভাবতে হয়েছে।
বিভিন্ন জায়গায় নির্মাতা মূলের থেকে বেশ কিছু স্বাধীনতা নিয়েছেন। তিনি সিনেমার একটি ব্যতিক্রমী সমাপ্তি দিয়েছেন।
প্রতিশোধ-স্পৃহা হলো মানুষের একটি স্বাভাবিক এবং প্রাচীন প্রবণতা। ধ্রুপদী সাহিত্যেও একে এভাবেই উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এভাবেই কি কাশ্মীরের সমস্যার সমাধান হবে? প্রতিশোধের চক্রে পড়ে সেখানকার কয়েকটি প্রজন্ম স্রেফ উধাও হয়ে গিয়েছে। ‘হায়দারে’র নির্মাতা এই সমস্যার একরকম সমাধানের পথ দেখিয়েছেন শেষদিকে।
‘হায়দার’ বেস্ট স্ক্রিনপ্লে, বেস্ট কোরিওগ্রাফি, বেস্ট কস্টিউম ডিজাইন, বেস্ট মেল প্লেব্যাক সিঙ্গার, বেস্ট মিউজিক ডিরেকশন ক্যাটেগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার পায়। রোম ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রথম কোন ভারতীয় সিনেমা হিসেবে পিপলস চয়েস অ্যাওয়ার্ড পায়। এছাড়া আরো অসংখ্য পুরষ্কার ঘরে তোলে ‘হায়দার’। বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও সিনেমা মার্কেটে হিট হয়। নির্মাতা বিশাল ভরদ্বাজ বলিউড বাণিজ্যেকে জায়গা দেননি তার সিনেমায়। স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে সিনেমা বানিয়ে বিতর্কিত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েছেন। ‘দেশবিরোধী’ ট্যাগ লাগার ভয় তো সবসময় ছিলই। কিন্তু সফল হয়েছেন ৪১টি কাটের পরও ভারতীয় সেন্সর বোর্ডের (CBFC) হাত গলে সিনেমা মুক্তি দিতে। এই সিনেমা মুক্তি দেওয়াতে সেন্সর বোর্ডকেও কিছু কৃতিত্ব দিতে হবে।
সিনেমায় অসাধারণ কিছু গান আর ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের কথা আলাদা করে বলতেই হয়। মোট নয়টি গান আছে সিনেমায়। এর মধ্যে সাতটি গানের গীতিকার হলেন গুলজার। বাকি দুইটি গান লিখেছেন ফাইজ আহমেদ। কোন গানের চিত্রায়নই পরিস্থিতির সাথে বেমানান বা আরোপিত মনে হয় নি। মিউজিক কম্পোজ করেছেন পরিচালক নিজেই। সিনেমাটোগ্রাফি এবং সম্পাদনাও প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। অপরূপ কাশ্মীরের সৌন্দর্য নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। কাকচক্ষু জলের ঝিলাম নদী আছে সেখানে। সে নদী নিয়ে আবেগ আছে কাশ্মীরিদের।
সবচেয়ে চমকপ্রদ ছিল সিনেমার সংলাপ। একেকটা সংলাপ দর্শকের অন্তরে গেঁথে যাবে। সিনেমার কাব্যিক নির্মাণে ‘হায়দার’ ভারতীয় ক্ল্যাসিকের মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য।
সবমিলিয়ে যারা এই সিনেমা এখনো দেখেননি তাদের আধুনিক কালের একটি ক্ল্যাসিক দেখার প্রস্তুতি নিয়ে স্ক্রিনের সামনে বসতে হবে। নেটফ্লিক্সে পাওয়া যাবে।
পুনশ্চ: কাশ্মীর নিয়ে সাম্প্রতিককালে ভারতে বিভিন্ন ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। নতুন নতুন ট্র্যাজেডির জন্ম হচ্ছে। নতুন করে কাশ্মীরের সাদা বরফ রক্তে ভিজে না যাক, ঝিলামের টলটলে পানির রঙের পরিবর্তন না হোক, এই অবাস্তব কামনা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না আমাদের। ভূস্বর্গকে নতুনভাবে স্মরণ করার, সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক আনন্দময় জীবনের কামনায় ‘হায়দার’ কে মাধ্যম হিসেবে ধরে নিতে পারেন।