বর্তমান এই প্রযুক্তির যুগে চলচ্চিত্র বাণিজ্য একটি বড় মাপের ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। মিলিয়ন থেকে শুরু করে বিলিয়নের ঘরে অর্থলগ্নি হয়ে থাকে। কখনো সফলতা আসে, কখনো বা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় অর্থলগ্নিকারীদের। তবে একটি চলচ্চিত্র ভালোভাবে নির্মাণের জন্য প্রয়োজন ভালো একজন পরিচালক, দক্ষ কলা-কুশলী। আর প্রয়োজন পর্দার আড়ালের মানুষজনদের পর্যাপ্ত শ্রম। এ সবকিছুর ব্যয়ভার বহন করার জন্য অর্থলগ্নি করে থাকেন প্রডিউসার। আর পরিচালকের উপরে থাকে চাপ। ভালোমানের চলচ্চিত্র যদি ব্যবসাসফল হয়ে উঠতে না পারে সেই দায়ভার প্রডিউসারদের ঘাড়ে গিয়েই বর্তায়, তবে ক্ষেত্রবিশেষে বিলিবন্টনকারী অর্থাৎ ডিস্ট্রিবিউটরদের ঘাড়েও বর্তাতে পারে।
একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ হলেই এর সাথে সম্পৃক্ত মানুষের রাতের ঘুম নষ্ট হয়ে যায়। নির্মাতাদের মাথার উপর থাকে হাজারো চাপ, সেই সাথে থাকে ভয়, চলচ্চিত্রটি ব্যবসাসফল হবে কিনা এ নিয়ে মনে মনে চলে হিসাব-নিকাশ। তাই একটি চলচ্চিত্রকে সফল করে তুলতে কোনোরূপ ত্রুটি রাখতে চান না কেউই, চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে কেউ ঝুঁকিও নিতে চান না।
যত বড় কুশীলবই হোন না কেন একজন মানুষ, তাকে দিয়ে সর্বঘরানার চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব হবে এমনটি ভেবে নেয়া বোকামী। উঁচুশ্রেণির নির্মাতারা বরাবরই যোগ্য কুশীলবদের সুযোগ দিয়ে এসেছেন, এক্ষেত্রে খ্যাতির দরকষাকষি করেন না কেউ। চলচ্চিত্রকে পরিপূর্ণ করে তুলতে নির্মাতাগণ যোগ্যদের যেমন খুঁজে বের করেছেন, তেমনি মাঝপথে কোনো একজন কুশীলবকে পরিবর্তন করতেও দ্বিধা করেননি।
যারা নিয়মিত সিনেমা দেখেন কিংবা চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের নিকট একটি প্রশ্ন- কেমন হতো যদি টাইটানিক চলচ্চিত্রে লিওনার্দো না থেকে অন্য কেউ থাকতো? কখনো কি এভাবে কল্পনা করেছেন? কিংবা লিওনার্দোর পরিবর্তে ধরা যাক বেন হুইশকে দেখা যেত তবে?
চলচ্চিত্র দুনিয়া জুড়ে এমন অসংখ্য ঘটনা রয়েছে যেখানে দেখা যায়, চলচ্চিত্র সেটে মাঝপথে শিল্পী পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। আগেই বলা হয়েছে, একটি চলচ্চিত্র নির্মাণকে কেন্দ্র করে কোনো পরিচালক কিংবা প্রডিউসার ঝুঁকি নেবেন না। চলচ্চিত্রের খাতিরে যা যা সিদ্ধান্ত নিতে হয় কোনোকিছুতেই তারা কুণ্ঠাবোধ করবেন না। এমন অসংখ্য ঘটনার মধ্য থেকে বড় বাজেটের কয়েকটি চলচ্চিত্র ও তাদের কুশীলব পরিবর্তনের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সাজানো হয়েছে আজকের লেখাটি।
১. রবার্ট ডাউনি জুনিয়র; গ্র্যাভিটি
প্রথমেই বলা যাক ২০১৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র গ্র্যাভিটির কথা। যাদের নিয়মিত চলচ্চিত্র দেখা হয়, তারা নিশ্চয় গ্র্যাভিটি দেখেছেন। চলচ্চিত্রটিতে প্রধান দুই চরিত্র, জর্জ ক্লুনি আর সান্ড্রা বুলক মিলেই টান টান এক উত্তেজনা ধরে রেখেছেন পুরোটা সময়জুড়ে। একবার কল্পনা করুন তো, সান্ড্রা বুলকের পরিবর্তে অন্য কাউকে এই চরিত্র দেখতে চান কিনা। সান্ড্রা বুলককে কল্পনা করা যাক বা না যাক, জর্জ ক্লুনি কিন্তু শুরু থেকেই কুশীলবের তালিকায় ছিলেন না। ম্যাট চরিত্রের জন্য প্রথম ডাক পেয়েছিলেন রবার্ট ডাউনি জুনিয়র।
রবার্ট ডাউনিকে কে না চেনে! ভিন্নধর্মী হাস্যরসাত্মক সব অভিনয় যার মূল আকর্ষণ। আলফনসো ক্যুয়েরন নিজের লেখা ও পরিচালিত এই চলচ্চিত্রটির প্রধান চরিত্র ক্লুনিকে দেবার পূর্বে দিয়েছিলেন রবার্ট ডাউনি জুনিয়রকে। শ্যুটিং সেটে অভিনয়ের মাঝে নিজের অভিনয়ে সৃজনশীলতা ফুটিয়ে তোলার গুণসম্পন্ন রবার্টকেই ছিলো আলফনসোর প্রথম পছন্দ। কিন্তু অল্প কয়দিন শ্যুটিং এর মধ্য দিয়েই আলফনসো বুঝতে পারেন যে, রবার্ট এই চলচ্চিত্রটির জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত ছিলো না। এই ব্যাপারে পরবর্তীতে পরিচালক আলফনসো মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন যে, রবার্টের অভিনয়গুণের কোনোই তুলনা হয় না, কিন্তু গ্র্যাভিটি চলচ্চিত্রটিতে প্রযুক্তিগত যে ব্যবস্থাটি ছিল শ্যুটিং সেটে, সেটি রবার্টের অভিনয় ধাঁচে এক বিশাল প্রতিকূলতা তৈরি করে।
আলফনসোর এই মন্তব্যের হাত ধরেই গ্র্যাভিটি পরিবারে প্রবেশ ঘটে জর্জ ক্লুনির। গ্র্যাভিটি পরবর্তীতে তিনটি নমিনেশন ও সাতটি অ্যাকাডেমী অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয়। যারা এখনো দেখেননি গ্র্যাভিটি, দ্রুত দেখে ফেলুন।
২. অ্যানি হ্যাথওয়ে; নকড আপ
কমেডি আর রোমান্স ঘরানার চলচ্চিত্র নকড আপ-এ অভিনেত্রী ক্যাথারিন হাইগল এর পরিবর্তে প্রথমে চিত্রগ্রহণ করা হয় জনপ্রিয় অভিনেত্রী অ্যানি হ্যাথওয়েকে।
চিত্রধারণের কিছুদিন যেতে না যেতেই অ্যানি হ্যাথওয়েকে জানানো হয় যে, চলচ্চিত্রে তার অভিনীত অ্যালিসন স্কট চরিত্রটির একটি বাচ্চা জন্ম দেবার লেবার পেইনের দৃশ্যও ধারণ করা হবে। অ্যানি হ্যাথওয়ে এমন একটি দৃশ্যের জন্যে মূলত প্রস্তুত ছিলেন না, এটা নিয়ে পরিচালকের সাথেও তার কথা কাটাকাটি হয়।
পরিচালক জুড অ্যাপাটো এর হাতে অ্যানি হ্যাথওয়ের পরিবর্তে ভিন্ন কোনো অভিনেত্রীকে চিত্রধারণ করা ছাড়া আর কোনো উপায়ই ছিলো না। এরই জের ধরে চলচ্চিত্রে অ্যালিসন স্কট চরিত্রে আসেন ক্যাথারিন হাইগল।
৩. এডওয়ার্ড নরটন; দ্য অ্যাভেঞ্জার্স
এডওয়ার্ড নরটন; এই নাম আর মানুষটির চেহারা দর্শকদের কাছে বেশ সুপরিচিত, নরটনের অনেক ভালো ভালো চলচ্চিত্র আমরা পেয়েছি। শৈশবে দেখা হাল্ক চলচ্চিত্রে হাল্কের চরিত্রেও নরটনকেই পেয়েছি আমরা। তাই এই মানুষটিই আমাদের কাছে হাল্ক হিসেবে পরিচিত।
অ্যাভেঞ্জার্স ফ্র্যাঞ্চাইজে নরটনেরও অভিনয় করবার কথা ছিলো, ব্যাপারটি এমন না যে চিত্রধারণ শুরু হবার পর সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয়। ২০১২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত দ্য অ্যাভেঞ্জার্সের জন্য পরিচালক চেয়েছিলেন সুপারহিরোদের চরিত্রে পৃথকভাবে চলচ্চিত্রগুলো নির্মাণের সময় যারা এই চরিত্রগুলোয় অভিনয় করেছেন তাদেরকেই চিত্রধারণ করবেন। এই হিসেবেই আয়রন ম্যান, থর, ক্যাপ্টেন আমেরিকা, ব্ল্যাক উইডো, হকআই, লোকি চরিত্রে পূর্বে যারা অভিনয় করেছেন তারা অ্যাভেঞ্জার্সে অভিনয়ের প্রস্তাব পান। সেই সাথে একটি প্রস্তাব এডওয়ার্ড নরটনের কাছেও পৌঁছায়। এডওয়ার্ড নরটনও চাচ্ছিলেন নতুন করে আবার এই হাল্ক চরিত্র ভিন্ন আঙ্গিকে অভিনয় করতে।
কিন্তু পরিচালক জস হুইডন নরটনকে নিয়ে খানিকটা পর্যালোচনা করেন, তিনি দেখেন যে, সেই মুহূর্তে নরটনের চেয়ে মার্ক রাফালোকে হাল্ক চরিত্রে চিত্রধারণ তার জন্য সুবিধার হবে। এভাবেই আমরা হাল্ক চরিত্রের নরটনকে ভুলতে শুরু করি আর মার্ক রাফালো হয়ে যায় আমাদের হাল্ক।
৪. রাইয়ান গসলিং; দ্য লাভলি বোনস
২০০৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র দ্য লাভলি বোনস এ প্রধান চরিত্র জ্যাক স্যালমনে অভিনয় করেন মার্ক ওয়ালবার্গ। এই চরিত্রে চিত্রধারণের জন্য প্রথম চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন রাইয়ান গসলিং।
রাইয়ান গসলিং কিংবা মার্ক ওয়ালবার্গ, দুজনই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল অভিনয়শিল্পী। দ্য লাভলি বোনস চলচ্চিত্রের পরিচালক পিটার জ্যাকসনের রাইয়ানের অভিনয় দক্ষতায় কোনো সন্দেহ ছিলো না। চলচ্চিত্রটির শ্যুটিং শুরু হবার কয়েক সপ্তাহ আগে হঠাৎ করে রাইয়ানকে তালিকা থেকে বাদ দেয়ার সংবাদটি খানিকটা বিস্ময়করই ছিলো। তবে রাইয়ানকে চরিত্র থেকে বাদ দেবার যৌক্তিক ঘটনাও ছিলো পরিচালক জ্যাকসন সাহেবের কাছে।
রাইয়ান পরিচালক পিটার জ্যাকসনকে ‘জ্যাক স্যালমন’ চরিত্রটির চিত্রগ্রহণের ব্যাপারে সামান্য পরিবর্তনের পরামর্শ দেন। রাইয়ান প্রস্তাব রাখেন যে, জ্যাক চরিত্রটিকে যদি আরো ৬০ পাউন্ডের মতো বেশি ওজনে চিত্রগ্রহণ করা যায়, তবে পুরো চলচ্চিত্রে ভালো দেখা যাবে চরিত্র। কিন্তু এই প্রস্তাব পরিচালকের পছন্দ হয়নি, অগত্যা প্রয়োজনের তুলনায় ওজন বেশি হওয়াতে রাইয়ানকে চরিত্র থেকে বাদ দিতেই হয়।
৫. জেমস পিউরফয়; ভি ফর ভেন্ডেটা
চলচ্চিত্রদর্শক দু’ধরনের; একদল যারা ভি ফর ভেন্ডেটা চলচ্চিত্রটি ইতোমধ্যেই কয়েক হাজারবার দেখে ফেলেছেন, অন্যদল যারা চলচ্চিত্রটি দেখেননি। এক-দু’বার দেখেছেন তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। যাদের নিয়মিত চলচ্চিত্র দেখা হয়, তারা যদি একবার এই চলচ্চিত্রটি দেখেন, তাহলে বার বার দেখতে ইচ্ছে হবে, বছরে অন্তত একবার দেখা হবেই- এমনই চলচ্চিত্র এটি। এতগুলো স্তুতিবাক্য বলা হলো চলচ্চিত্রটির ব্যাপারে, বুঝতেই পারছেন নিশ্চয় এটি সাধারণ কোনো ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র নয়। ২০০৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র এই ভি ফর ভেন্ডেটাই হলো চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের টাইটানিক।
গল্প, চিত্রনাট্য, অভিনয়, শব্দগ্রহণ কোনোদিক থেকেই এর তুলনা চলে না। বর্তমানে আমাদের অসুস্থ সমাজ আর এর নোংরা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে এত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে, এই চলচ্চিত্র না দেখা মানে অনেকটুকুই অপূর্ণ থেকে যাওয়া। চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র ‘ভি’, মুক্তিকামী এক যোদ্ধা। সে একাই রুখে দাঁড়ায় অসুস্থ এক সরকারব্যবস্থার বিপরীতে। এ নিয়েই পুরো গল্প।
চলচ্চিত্রটির পেছনে রয়েছে বহু পুরনো ইতিহাস, পুরনো এক ইতিহাসকে নতুন আঙ্গিকে বলা হয়েছে এতে। চলচ্চিত্রটির পটভূমি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ে নিতে পারেন ‘নভেম্বর দ্য ফিফথ’ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?” শীর্ষক আর্টিকেলটি।
ভি ফর ভেন্ডেটা চলচ্চিত্রের শীর্ষ চরিত্র ভি-এ অভিনয় করবার কথা ছিলো জেমস পিউরফয়ের। কিন্তু শেষপর্যন্ত আর সেটি সম্ভব হয়নি। পুরো চলচ্চিত্রজুড়ে ভি চরিত্রটিকে গাই ফক্স নাম্নী এক বিশেষ মুখোশ পরিধান করতে হতো, মুখোশের অন্তরালের চেহারাটি চলচ্চিত্রে উন্মোচন করা হয়নি। পুরো চলচ্চিত্র কোনো একজন মানুষকে নিয়ে নয়, এ ছিলো পুরো বিদ্রোহী জাতির একটি প্রতীকী রূপ। গাই ফক্স মুখোশ পরিহিত অবস্থায় অভিনয় করতে জেমস পিউরফয় নানাবিধ অসুবিধার সম্মুখীন হতে শুরু করলেন।
ছয় সপ্তাহের মতো শ্যুটিং চলবার পর জেমস পরিচালকের নিকট মুখোশ পরিধানের ব্যাপারে অভিযোগ করতে শুরু করলেন। জেমস পিউরফয় জানালেন যে, তার পক্ষে আর এই মুখোশ পরিধান করে অভিনয় সম্ভব নয়। অগত্যা পরিচালক জেমস ম্যাকটিগ আর কী করবেন। ‘ভি’ চরিত্রে অভিনয়ের জন্যে হিউগো উইভিং এর আবির্ভাব ঘটে।
ম্যাট্রিক্স ট্রিলজির এজেন্ট স্মিথের কথা মনে আছে? এই এজেন্ট স্মিথই হলেন হিউগো উইভিং। এজেন্ট স্মিথ যত খারাপ মানুষই হোক না কেন, এই চরিত্রের অভিনেতা হিউগোর অভিনয়গুণের প্রশংসা না করে কিন্তু পারা যায় না। কয়দিন শ্যুটিং যেতে না যেতেই ব্যাপারটি বুঝতে পারেন ম্যাকটিগ, মাঝপথে অভিনেতা পরিবর্তন তার জন্যে শাপে বর হয়ে এসেছে। হিউগোর সাথে বেশ খুশি মনেই চলচ্চিত্রের বাকি কাজটুকু সম্পন্ন করেন ম্যাকটিগ।
ফিচার ইমেজ: gablescinema.com