“মুহূর্তের ভেতর ব্যস্ত হয়ে পড়ে দু’জন। নিঃশব্দে একের পর এক লাশগুলো টেনে এনে তারা জড়ো করতে থাকে। সময় অতি দ্রুত অতিক্রান্ত হতে থাকে। চাঁদ সরে আসে। আকাশে মেঘ নেই। চত্বরের ওপর বীভৎস শ্বেতীর মতো ছেঁড়া আলো পড়ে থাকে।”
বইয়ের এই অংশটুকুন উপলব্ধি করতে পারলে গোটা উপন্যাস সহজ হয়ে যাবে পাঠকের জন্য। তাই এটি দিয়ে শুরু।
উনিশশো একাত্তর। ষড়যন্ত্রে মত্ত পাকিস্তান। পাখির ডাকে ঘুম ভাঙার বদলে গুলির শব্দে ভাঙে। মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আসে বুলেট। সেই বুলেট কবিতা হয়ে বেঁধে সাহসীর বুকে। রক্তের কালিতে লেখা হয় বীরত্বের শব্দমালা। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহ নির্মমতা নিয়ে কম বই নেই। প্রতিটি বইয়ে ফুটে ওঠে পাক হানাদারদের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড, আমাদের হাহাকার, ত্যাগ, সাধনার গৌরব, অদম্য সাহসিকতার বিষাদময় বিজয়ের সারাংশ। সৈয়দ শামসুল হকের লেখা নিষিদ্ধ লোবান এখানে ব্যতিক্রম।
চূড়ান্ত বিজয়ের রচনা করেননি তিনি। তিনি তুলে ধরেছেন চলমান ভয়াবহতা। তা আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে, যখন পাঠক বুঝবে, যার সঙ্গে যাত্রা করতে চলেছেন, তিনি একজন নারী। যে নারী নিজের অস্তিত্ব সংকটে ভুগছেন। জানেন না, তিনি সধবা না বিধবা। গন্তব্য জানা থাকলেও পথে কতখানি বিপদ অপেক্ষমান, তার হদিস নেই।
বিলকিসের স্বামী আলতাফ পত্রিকা অফিসের চাকুরে। ২৫শে মার্চ কালরাতের গুরুত্বপূর্ণ কলাম তৈরির দায়িত্ব তার উপর ছিল। রাতে বাড়ি থেকে বের হলেও ঘরে ফেরা হয় না। দিন যায়, মাস গড়ায়। আলতাফের হদিস মেলে না। কোনো চিঠি নেই, কারো মাধ্যমে পাঠানো বার্তা নেই। বিলকিস আশায় থাকে। সহকর্মীরা বলছে, আলতাফ ভারতে গেছে। সেখানে মুক্তি ট্রেনিং নিচ্ছে। একদিন ঠিকই ফিরবে। সে আশায় থাকতে থাকতে বাড়ির কথা মনে পড়ে বিলকিসের।
গ্রামের নাম জলেশ্বরী। শান্ত, সুন্দর, ছবির মতো। সেখানেই মা থাকে, ভাই থাকে, দুটো সন্তান নিয়ে বিধবা বড় বোন থাকে। শহরে যাবার সুযোগ থাকলেও বাবার মৃত্যুর পর মাকে রেখে কোথাও যায় না সে। কতদিন হয়ে গেছে, বিলকিস কাউকে দেখে না।
পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ের নির্দিষ্ট কোচে চেপে বসে বিলকিস। গন্তব্য জলেশ্বরী। নবগ্রামে আসতেই ট্রেন থামে। এ স্টেশনে দু’ মিনিটের বেশি কখনও না দাঁড়ালেও আজ আর চলে না ট্রেন। যাত্রীরা নেমে পড়ে একে একে। ট্রেনে ওঠার পর থেকেই যাত্রীদের মাঝে উৎকণ্ঠা ধরতে পারে বিলকিস। ফিসফাস স্বরে কীসের যেন বিপদের সম্ভাবনা ফুটে ওঠে জবানিতে। হয়তো চারিদিকের অরাজকতা নিয়ে আলাপ পাড়ছে। দেশে তো একটাই আলোচনা, পাক হানাদারদের নির্মমতা আর মুক্তিবাহিনীর সাহসিকতা। নবগ্রামে এসে বিলকিসও নেমে পড়ে ট্রেন থেকে। ট্রেন আর এগোবে না। সামনের ব্রিজ মুক্তিবাহিনী উড়িয়ে দিয়েছে। স্টেশন মাস্টারের আদেশে গার্ড চালককে ট্রেন ঘুরিয়ে ঢাকায় রওনা দেওয়ার তাগিদ দেন।
বিলকিস একা স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকে। মানুষগুলো দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। যারা বসে আছে, তাদের গন্তব্য জলেশ্বরী। নিঃশব্দে ভাবছে ভবিতব্য সম্বন্ধে। বিলকিসের মনে হলো, কে যেন তাকে ঝোপের আড়াল থেকে দেখছে। শহুরে সুন্দরী নারী, তাকানোতে অভ্যস্ত সে। খানিক আগে স্টেশন মাস্টারও দেখছিলেন। কোনো উপায় না পেয়ে হাঁটার সিদ্ধান্ত নেয় সে। নবগ্রাম থেকে জলেশ্বরী পাঁচ মাইল পথ। তার চেয়েও বড় ব্যাপার, একা একজন মেয়ে এতটা পথ পাড়ি দেবে। যদি পৌঁছাতে পারে শেষ অবধি, আকাশে ততক্ষণে সন্ধ্যাবাতি জ্বলে উঠবে।
পাকিস্তানিদের রোষের হাত হতে কে বাঁচাবে তাকে! বিলকিস অত ভাবে না। ভাবার আসলে সময় নেই। সে রওনা দেয়। পিছু নেয় একটি ছেলে। সতেরো কী আঠারো হবে বয়স। ঝোপের আড়াল থেকে সে-ই দেখছিল বিলকিসকে। নাম তার সিরাজ। সিরাজ যত এগিয়ে আসে, বিলকিস ত্রস্ত হয়। একা রেললাইনে অচেনা একজন মেয়ের পিছু নিচ্ছে তাগড়া তরুণ, খটকা খটমট করে। কথাবার্তা বলে বোঝা যায়, এ শত্রু নয়, বরং মিত্র। তাকে নিয়ে শুরু হয় বিলকিসের যাত্রা। কণ্টকাকীর্ণ অনিশ্চিত যাত্রা।
যে বিলকিস কখনও চিতা দেখেনি, লাশের গন্ধ শোঁকেনি, সেই নারীর কাঁধে পড়ে গুরুদায়িত্ব। সিরাজ সঙ্গ দেওয়ায় সাহস আসে। রাত কাটে। ভোর আসে। আবার রাত হয়। সারাদিন দুলে ওঠা বিশ্ব স্থির হয়। ওদের অস্থিরতা বাড়ে। অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে। একটু কাঁদবারও উপায় নেই। তবু চোখ মানতে চায় না। ভিজে আসে ওরা। সমস্ত চাওয়া পাওয়া সরে যায়। তাতে পতাকাবিহীন দণ্ডের ছায়া পড়ে যেন। গাঢ় হয় স্তব্ধতা, স্থিরতা, প্রত্যাবর্তনের অক্ষমতা।
বিলকিস লক্ষ করে, সিরাজ তাকে কিছু জানাতে চায়। সিরাজ চেয়েও পারে না। অনাকাঙ্ক্ষিত ভয় চেপে ধরে। বলে ফেলে ইচ্ছার বিরুদ্ধে। বিলকিসকে সত্য গ্রাস করে নীরবে। সে সত্য জানত। খুব বেশি প্রভাব পড়েনি তাই। সিরাজ স্বস্তি পায়। বিলকিস অভয় দেয়। নাতিধীর গতিতে কাজ এগিয়ে নেবার পরিকল্পনা করে দু’জন।
চরিত্র বিশ্লেষণে এলে সবার আগে আসবে বিলকিসের নাম। প্রথম পাতা থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত গল্পটা তাকে ঘিরে আবর্তিত। একজন শহুরে রমণী, যার স্বামী গণমাধ্যমকর্মী। পঁচিশে মার্চের ভয়াল কাল রাত্রে ঘর ছেড়ে বের হয়ে আর ফেরে না। একদিকে স্বামীর শোক, পক্ষান্তরে দূরের গ্রামে পরিবারের চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত নারী। যার হারানোর ভয় নেই, চাওয়া-পাওয়ার বালাই নেই। বিধ্বস্ত দেশে নির্বিকার পথচলা পাঠকের মনে মায়ার জন্ম দেবে।
মুক্তিযুদ্ধে এমন হাজারো বিলকিস লড়াই করেছে। লড়াই মানে কেবল অস্ত্র হাতে সশস্ত্র যুদ্ধে যাওয়া নয়। শেষ দেখার আগে হাল না ছাড়ার যে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ বিলকিস চালিয়ে গেছে পুরো সময়, স্বাধীনতা অর্জনে কম ভূমিকা রাখেনি সেসব। সিরাজ প্রতিনিধিত্ব করেছে সেসব মানুষের, যারা ধর্ম-বর্ণ-জাতের ঊর্ধ্বে গিয়ে মুক্তিকামী মানুষের পাশে ছায়া হয়ে অবিচল থেকেছে শেষ নিঃশ্বাস ফেলার মূহুর্তেও। বয়সের তুলনায় সিরাজের বিচক্ষণতা এবং একইসঙ্গে চাঞ্চল্য উপন্যাসে আলাদা মাত্রা যোগ করে। এই দু’জনের বাইরে ছোট ছোট চরিত্র আছে, যারা গল্পের পোক্ত গাঁথুনি হিসেবে সর্বস্ব ঢেলে দিয়েছে।
বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ শামসুল হক সব্যসাচী লেখক হিসেবে সমাদৃত। কেন তাকে সব্যসাচী বলা হয়, সাহিত্যের প্রতিটি বিভাগে নিজের লেখনশক্তি দিয়ে তা বুঝিয়েছেন। নিষিদ্ধ লোবানেও একেবারে সহজ ভাষায় গভীর বোধ জাগ্রত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের স্রেফ শরীরের মৃত্যু ঘটেছে। ওরা প্রত্যেকে ফিরে আসে বিলকিস, সিরাজ হয়ে। তাদের অন্তরাত্মা ফিরিয়ে আনে দেশপ্রেম। দেশপ্রেমের সান্নিধ্যে এলে, পরিবারও তুচ্ছ মনে হয়। মাটির চেয়ে খাঁটি কিছু হতে পারে না। চিতার আগুন অথবা কবরের মাটি, বেলাশেষে নিঃশব্দের যে প্রবল ঘণ্টাধ্বনি স্তব্ধতা ভাঙে, তা তো মাটির কাছে ফিরে যাবার আহ্লাদের প্রকাশ।
নিষিদ্ধ লোবানে লেখক বুঝিয়েছেন, যে মৃতদেহে দেশের মাটি লেগে রয়, তার ঘ্রাণ মাদকের চেয়ে ধ্রুপদী, নৈসর্গিক। আঘাত ছাড়া প্রতিরোধ অসম্ভব। নিশ্চল মূর্তি অভিমান করতে পারে, রুখে দাঁড়াবার শক্তি থাকে না। সে কেবলই স্মৃতি রোমন্থন করতে পারে। আঘাতপ্রাপ্ত সত্ত্বা জাতিস্মরে পরিণত হয়। প্রজ্বলিত হয় মশালের মতো। যার দ্যুতি ঝলসে দেয় সমস্ত অপশক্তির অপপ্রয়াসকে।