একসময় এই মহাবিশ্বের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এক বিরাট কসমিক বিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় সকল প্রকার কণা, প্রতিকণা ও পদার্থ। সৃষ্টি হয় ছায়াপথ, গ্রহ, উপগ্রহ। মহাজগৎ সৃষ্টির এই তত্ত্বকে বলা হয় ‘দ্য বিগ ব্যাং থিওরি’। ১৯২৭ সালে বেলজিয়ান ক্যাথলিক যাজক জর্জ লিমেটার প্রথম এই তত্ত্বের অবতারণা করেন। পরবর্তীতে এই তত্ত্বটি বৈজ্ঞানিকভাবেও অনেক সমর্থিত ও সমাদৃত হয়।
এখন যদি আপনি গুগলের সার্চ বারে ‘The Big Bang Theory’ লিখে সার্চ করতে যান, তাহলে দেখবেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চিত্র। একটু আগে যে কথাগুলো বলা হলো তার কিছুই নেই। বরং দেখা যাবে একদল মধ্যবয়সী নারী-পুরুষের ছবি। গুগল আসলে আপনাকে যে তথ্য দেবে তা একটি আমেরিকান সিটকম টিভি সিরিজের। এই সিরিয়ালের নামও ‘দ্য বিগ ব্যাং থিওরি’।
সিটকম বা সিচুয়েশনাল কমেডি বলতে একটি বিশেষ জনরাকে বোঝায়। এই জনরার সিরিজগুলোতে অন্যান্য সিরিজগুলোর মতো অনেক বড়সড় প্ল্যাটফর্ম থাকে না। একটি সেটের মধ্যেই পুরো সিরিজের শুটিং করা হয়। থাকে কেবল হাতেগোনা কয়েকটি চরিত্র। প্রত্যেক এপিসোডের দৈর্ঘ্য ২০-৩০ মিনিটের মতো হয়। কয়েকজন মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে কেন্দ্র করে বানানো এই ধরনের সিরিজের বেশ বড় ফ্যানবেজ রয়েছে। ‘দ্য বিগ ব্যাং থিওরি’ এমনই একটি সিটকম সিরিজ। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে একটানা চলে এসেছে এই সিরিজটি। অবশেষে ২৭৯টি এপিসোড পরে ১২তম সিজনে এসে এর সমাপ্তি ঘটলো। একই সময়ে তুমুল জনপ্রিয় টিভি সিরিজ গেম অফ থ্রোনসও তার ইতি টানে। এই ফ্যান্টাসি সিরিজের জনপ্রিয়তায় চাপা পড়ে যায় ‘দ্য বিগ ব্যাং থিওরি’। কমেডি সিরিজটির সমাপ্তি নিয়ে আলোচনা একেবারে নেই বললেই চলে। সেই ২০০৭ সাল থেকে সিরিজটি এর নিয়মিত দর্শকদের হাসিয়ে আসছে।
কাহিনী সংক্ষেপ
লিওনার্ড হফস্ট্যাডার ও শেলডন কুপার দুই রুমমেট। দুজনে একই রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পদার্থবিজ্ঞানী। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের প্যাসাডিনা শহরে তারা একটি অ্যাপার্টমেন্টে সাবলেট হিসেবে বসবাস করে। একদিন তাদের পাশের বাসায় নতুন প্রতিবেশী হিসেবে আগমন ঘটে সুন্দরী এক নারীর। তার নাম পেনি। পেনিকে প্রথম দেখাতেই লিওনার্ডের অনেক পছন্দ হয়ে যায়। সে সৌজন্য রক্ষা করার অজুহাত দিয়ে মেয়েটির সাথে আলাপ জমানোর জন্য এগিয়ে যায়। কিন্তু শেলডন তাকে মনে করিয়ে দেয় যে, তারা দুজনেই এরকম সামাজিক আচরণে খুবই অপারদর্শী। নিজেদের কর্মক্ষেত্রের বাইরে সাধারণ লোকজনের সাথে তারা একেবারেই ঠিকমতো কথা বলতে পারে না। কিন্তু মেয়েটিকে পছন্দ হয়ে যাওয়ায় লিওনার্ড তার সকল দুর্বলতা অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যায়। দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য সে পেনিকে নিজের বাসায় দাওয়াত দেয়।
সিরিজের আরো দুই প্রধান চরিত্র হলো ভারতীয় অভিবাসী জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাজেশ কুথ্রাপালি এবং এমআইটি থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ করা ইঞ্জিনিয়ার হাওয়ার্ড ওয়ালোউইট্জ। রাজেশ, সংক্ষেপে রাজ, মেয়েদের সাথে একেবারে কথাই বলতে পারে না। তার সামনে কোনো মেয়ে আসলেই সে একেবারে চুপ হয়ে যায়। অপরদিকে হাওয়ার্ড একটু পারভার্টেড বা নারীপাগল চরিত্র। যেকোনো সুন্দরী নারী দেখলেই সে খুব বিদঘুটে উপায়ে তাদের পটানোর চেষ্টা করে।
শেলডন, লিওনার্ড, পেনি, রাজ ও হাওয়ার্ড- এই পাঁচজনের দৈনন্দিন জীবন নিয়েই সিরিজের কাহিনী, যেখানে পেনি বাদে সবাই বিজ্ঞানী। তিন সিজন পর্যন্ত একটিমাত্র প্রধান নারী চরিত্র থাকলেও চতুর্থ সিজনে বার্নাডেট ও এমি ফারাহ ফাওলার নামে আরো দুটি নারী চরিত্র সংযোজন করা হয়।
যেখানে ‘দ্য বিগ ব্যাং থিওরি’ অন্যান্য সিটকম থেকে আলাদা
উপরের বর্ণনা থেকে সিরিজটি অন্যান্য সিটকম সিরিজের মতো শোনালেও এটি অন্যগুলো থেকে বেশ ভিন্ন। সিরিজের চার পুরুষ চরিত্র অন্যান্য সিটকম সিরিজের চরিত্রের মতো সুদর্শন নয়, বরং ঠিক তার উল্টো। এরা প্রচুর অসামাজিক। নিজেদের ছাড়া আমজনতার সাথে ঠিকমত কথা চালিয়ে যেতে পারে না। উল্টোপাল্টা আচরণ করে। সামাজিক চালচলন প্রদর্শনে এরা একেবারে কাচা। চারজনের মধ্যে হাওয়ার্ড বাদে সবার ডক্টরেট ডিগ্রি রয়েছে। কাজেই বিজ্ঞানের মাঠে এরা যে খুব বুদ্ধিমান তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে এরা ঠিক ততটাই আনাড়ি। আধুনিক ভাষায় এদেরকে নার্ড বলে। আর এই নার্ড কালচারকে একরকম শ্রদ্ধা জানিয়েই সিরিজটি তৈরি হয়েছে।
সারা বিশ্বব্যাপী অন্যতম জনপ্রিয় সিটকম টিভি সিরিজ হলো ‘ফ্রেন্ডস’। এই ‘ফ্রেন্ডস’কে অনুসরণ করে ভবিষ্যতে তৈরি হয়েছে আরো অনেক সিরিজ। আসলে ‘ফ্রেন্ডস’ সিরিজটির চরিত্রগুলো যে শ্রেণীর মানুষদের নিয়ে হাসি তামাশা করতো, সেরকম কিছু চরিত্রকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছে ‘দ্য বিগ ব্যাং থিওরি। কাহিনী বন্ধুত্বকে ঘিরেই। শুধু বন্ধুদের প্রায় প্রত্যেকেই পিএইচডি ডিগ্রিধারী। আর সাধারণ মানুষজনের থেকে তাদের আচরণ ও জীবনধারা অনেক ভিন্ন। এই ভিন্নতার কারণেই এই সিরিজটি অন্যান্য সকল সিটকম থেকে ব্যতিক্রম। উদ্ভট চরিত্রের শেলডন কুপারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেতা জিম পারসন্স। তিনি প্রথমদিন অডিশনের সময় ভেবেছিলেন একটি গেম শোর জন্য অডিশন দিচ্ছেন। অত্যন্ত বুদ্ধিমান কিন্তু বেশ পাগলাটে স্বভাবের শেলডন চরিত্রটি দর্শকমহলে অনেক দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। চরিত্রটির এই বিপুল জনপ্রিয়তার কারণেই নির্মাতারা তাকে পুরো সিরিজের অঘোষিত প্রধান সদস্য হিসেবে চিত্রনাট্য তৈরি করে যায়। সকল কাহিনী এই চরিত্রের উপর ভিত্তি করেই এগিয়ে যেতে থাকে।
সিরিজের অন্যান্য চরিত্রগুলোও একে অপরের থেকে পিছিয়ে নেই। বিশেষ করে পেনি চরিত্রটি। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন কেলি কোউকো। গ্রুপের মধ্যে সে-ই একমাত্র সাধারণ মানুষ যে কোনো ডিগ্রিধারী বিজ্ঞানী বা ইঞ্জিনিয়ার না। সুন্দরি ও সাদামাটা চরিত্রের পেনির জায়গায় দর্শক নিজেদের স্থাপন করে বাকি চরিত্রদের বিচার করতে পারেন।
এই সিরিজের আরেকটি অন্যতম সেরা দিক হলো কমিক বুক, চলচ্চিত্র ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর রেফারেন্স ব্যবহার করা। সিরিজের ছেলে চরিত্রগুলো প্রচুর কমিক বই পড়ে ও সিনেমা দেখে। ‘স্টার ওয়ারস’ ফ্রাঞ্চাইজি, ‘স্টার ট্রেক’ ফ্রাঞ্চাইজিগুলোর রীতিমতো উন্মাদ সমর্থক হিসেবে তাদের উপস্থাপন করা হয়েছে। পপ কালচারের জগতের সাথে যাদের বেশ সখ্য রয়েছে, তারা তাই এই সিরিজটি দেখে অনেক আনন্দ পাবেন। সিরিজের অনেক কাহিনীই তাদের এই উন্মাদনাকে কেন্দ্র করে এগিয়ে গিয়েছে। এ কারণে এই সিরিজের একটি আলাদা ফ্যান বেজ তৈরি হবে সেটাই স্বাভাবিক।
যে কারণে এই সিরিজটি নিজেদের মান ধরে রাখতে পারেনি
যেকোনো সিরিজের শুরু ভালো হলেই যে তা তার সেই সাফল্য ধরে রাখতে পারবে এমন কোনো কথা নেই। গেম অফ থ্রোন্সের কথাই ধরুন। প্রচুর উত্তেজনা সৃষ্টিকারী এই টিভি সিরিজের শেষ সিজন নিয়ে বেশিরভাগ দর্শকই অসন্তুষ্ট। ‘দ্য বিগ ব্যাং থিওরির” ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। তবে এই সিরিজটির অবনতি শুরু হয়েছে আরো আগে থেকে। পঞ্চম সিজন থেকে ধীরে ধীরে এই সিরিজের পতন শুরু হয়। আর এর জন্য দায়ী এর নির্মাতাদের নানা সিদ্ধান্ত।
প্রথমেই তুলে আনতে হবে একেবারে বিপরীতমুখী ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্টের বিষয়টি। যে সিরিজের মূল আকর্ষণ ছিল নার্ড কালচার উপস্থাপন করা, সেখানে এটি পরিণত হয় রোমান্টিক কমেডিতে। শেলডন কুপারের বান্ধবী আনা এই সিরিজের অন্যতম বড় ভুল। যদিও শুরুর দিকে ব্যাপারটি ভালোই কৌতূহলোদ্দীপক ছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে চরিত্রটি তার মূল বৈশিষ্ট্য থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে। হাওয়ার্ড আর রাজের ব্রোম্যান্স ছিল সিরিজের অন্যতম মজার এক দিক। সেটিও ধীরে ধীরে মূল কাহিনী থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। যে হাওয়ার্ড তার সাধ্যের বাইরে থাকা মেয়েদের পটানোর জন্য অদ্ভুত সব কাজ করতো, সে বিয়ে করে দুই সন্তানের বাবা হয়ে যায়। রাজ নামক চরিত্রটি মেয়েদের দেখলেই চুপ হয়ে যেত। মদ পান করা ছাড়া সে স্বাভাবিক অবস্থায় মেয়েদের সাথে কথা বলতে পারতো না। কিন্তু একসময় তার জড়তা কেটে যায়। এই সিরিজের প্রথম ছয় সিজন ও পরবর্তী ছয় সিজনে চরিত্রগুলোর আচরণে আকাশ-পাতাল পার্থক্য দেখা যায়। এমন ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট এই সিরিজের পুরনো স্বাদ নষ্ট করে ফেলে।
সুপারহিরোদের কমিক বই, সিনেমা, টিভি সিরিজ নিয়ে তাদের উন্মাদনার অংশটুকু সিরিজের নির্মাতারা কমিয়ে দেয়। এসব জায়গায় এসে যুক্ত হয় ফ্যামিলি ড্রামা। এভাবে সিজনের পর সিজন সিরিজটি যে উপাদানগুলোর জন্য অন্যতম ভালো লাগার কারণ ছিল, ঠিক সেগুলোই হারাতে থাকে। শেষের দিকে এসে আগের মতো হাসির উপাদান তেমন নেই বললেই চলে। দর্শকের মনে হবে, অনেকটা জোর করেই সিরিজটি প্রত্যেক বছর সম্প্রচারিত হচ্ছে। তবে যে যা-ই বলুক, সিরিজটির প্রথম পাঁচটি সিজন আসলেই অনেক মানসম্মত ছিল এবং ’ফ্রেন্ডস’ সিরিজটির মতো সেই সিজনগুলোও চাইলে বার বার দেখা যায়।
বহুমুখী অতিথি চরিত্র এই সিরিজের অন্যতম আকর্ষণ
একটি দিক দিয়ে ‘দ্য বিগ ব্যাং থিওরি’কে কোনো সিরিজ হারাতে পারবে না। আর তা হলো এর অতিথি চরিত্রের তালিকা। বড় বড় অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে শুরু করে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীরাও এই সিরিজে অতিথি চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এর বেশিরভাগই নিজেদের বাস্তব চরিত্র হিসেবেই পর্দায় আগমন করেছেন। এই বিশাল তালিকার মধ্যে রয়েছেন বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং, বিল গেটস, এলন মাস্ক, স্ট্যান লি প্রমুখ। এই তালিকার মধ্যে আরো রয়েছেন নানা বিখ্যাত চলচ্চিত্র ও টিভি ব্যক্তিত্ব, যাদের সচরাচর এমন জায়গায় কল্পনা করা যায় না। এই বড় বড় চরিত্রগুলোকে কেন্দ্র করেই অনেক এপিসোডের চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে, যা সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না।
শেষ ভালো যার সব ভালো তার
একটা সময়ে এসে এই সিরিজ আর আগের মতো জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেনি। তবুও একে একেবারে অখাদ্য বলা যায় না। সেই পুরনো হাসির খোরাক না জাগাতে পারলেও আধঘণ্টা এর পেছনে ব্যয় করাই যায়। যারা একেবারে প্রথম থেকে সিরিজটি দেখেছেন তারা শেষ এপিসোডে এসে কিছুটা আবেগাপ্লুত ঠিকই হবেন। চরিত্রগুলোর প্রতি ভালোবাসার জন্যই অনেকে সিরিজটি এর অবনতি উপেক্ষা করে শেষপর্যন্ত দেখে গেছেন। শেলডন কুপারের চরিত্রের প্রবল জনপ্রিয়তার কারণে নির্মাতারা শেলডনের ছোটবেলাকে কেন্দ্র করে একটি প্রিকুয়েল টিভি সিরিজ নির্মাণ করেন। ‘ইয়াং শেলডন’ নামের এই সিরিজটি চাইলে অনেকে দেখতে পারেন। এটি দেখার জন্য ‘দ্য বিগ ব্যাং থিওরি’ অবশ্যই দেখা লাগবে এমন কোনো ঝামেলা নেই।
প্রচুর পরিমাণে আমেরিকান সিটকম কমেডি প্রতিদিন সম্প্রচারিত হয়। এই বিশাল তালিকার মধ্যে ‘দ্য বিগ ব্যাং থিওরি অনেক উপরের সারিতে থাকবে- এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।