সিনেমা দেখতে কে না ভালোবাসে! আর সেই সিনেমা যদি হয় সমালোচক, দর্শক, পরিচালকদের বিবেচনাতেই কালোত্তীর্ণ; হয় শ্রেষ্ঠ তাহলে তো আর কথায় নেই। সেই সিনেমা দেখার জন্য পপকর্ণের বাক্স নিয়ে বসে যাওয়াই যায়। তাই আপনাদের সামনে চলে এলাম পৃথিবীর বিখ্যাত এবং সমালোচকদের মতে কালোত্তীর্ণ শ্রেষ্ঠ ৭ টি সিনেমা এবং তার রিভিউ নিয়ে। চলুন ঘুরে আসি ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত পত্রিকা সাইট এন্ড সাউন্ডের সমালোচক জরিপের শ্রেষ্ঠ ৭ সিনেমার দুনিয়ায়।
সিটিজেন কেইন
সিটিজেন কেইন মূলত একটি সিরিয়াস ঘরানার ক্লাসিক সিনেমা। সিনেমার পরিচালক ওরসন ওয়েলস। ১৯৪১ সালে তৈরি এ সিনেমাকে অনেক সময়েই ইতিহাসের সেরা সিনেমা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সিনেমাটি শুরুই হয় একজন মানুষের জীবনের শেষ দিয়ে। সিনেমাটিতে দেখা যায় চার্লস ফোস্টার কেইন (ওরসন ওয়েলস) যখন মারা যায় তখন তার শেষ কথাটি ছিল “Rosebud”.
জেরি থম্পসন নামে এক সাংবাদিক এটা খুঁজে বের করার চেষ্টায় নামেন যে কেইন আসলে কে ছিল এবং রোজবাড কথাটি তিনি কেন বলেছিলেন? সে ৫ জন ভিন্ন ভিন্ন মানুষের সাথে পরিচিত হয় যারা কেইনের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এদের কেউ হয়তোবা কেইনকে বড় করে তুলেছিলেন আবার কেউ ছিলেন কেইনের ২য় স্ত্রী। তাদের সাথে কথা বলে কেইনের শেষ কথাগুলোর রহস্য খুঁজে বের করার চেষ্টার মাধ্যমেই কেইনের বিশাল ব্যবসা, আমেরিকান প্রেসিডেন্টের ভাতিজিকে বিয়ে করা, নিউইয়র্কের গভর্নর পদের লড়াই, প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স দেয়া, ২য় বিয়ে করা এবং তাকেও ডিভোর্স দেয়া এ বিষয়গুলো দর্শকদের সামনে চলে আসে আর সিনেমার কাহিনী এগিয়ে চলে।
ভার্টিগো
ভার্টিগোকে বলা হয় সর্বকালের সেরা পরিচালক হিসেবে বিবেচিত আলফ্রেড হিচককের সেরা সিনেমা। ১৯৫৮ সালে তৈরি করা এ মুভিটি আসলে একটি সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার। সিনেমার অন্যতম মূল চরিত্র হলো গোয়েন্দা জন স্কটি ফার্গুসন। সে আর্কোফোবিয়া নামের এক রোগে আক্রান্ত। এ রোগের রোগীদের চরম মাত্রার উচ্চতাভীতি থাকে যা একজন গোয়ান্দার জন্য অত্যন্ত খারাপ একটি দিক।
সে ভার্টিগো নামক রোগেও আক্রান্ত যা তার চারপাশের সব কিছু ঘুরছে এমন এক মিথ্যা অনুভূতি তৈরি করে। গ্যাভিন এলস্টার নামে এক পুরাতন বন্ধু তাকে ব্যক্তিগত গোয়েন্দা হিসেবে নিয়োগ দেয় তার নিজের সুন্দরি স্ত্রী ম্যাডেলিনকে অনুসরণ করার জন্য যার আচার আচরণ এলস্টারের কাছে অস্বাভাবিক লাগছিল। এলস্টার ধারণা করছিলেন যে, তার স্ত্রীর দেহে মৃত কোনো আত্মা ভর করেছে। গোয়েন্দা স্কোটি নিজে এসব বিষয়ে অবিশ্বাসি ছিলেন, কিন্তু এলস্টারের সুন্দরি স্ত্রীকে দেখে তিনি এ কাজটি করতে রাজি হয়ে যান। এরপর থেকেই টান টান উত্তেজনার মধ্য দিয়ে সিনেমার কাহিনী এগিয়ে চলে।
টোকিও স্টোরি
টোকিও স্টোরি একটি জাপানিজ ড্রামা ফিল্ম। ইয়াসুজিরো ওযুর সেরা সিনেমা বলা হয় এটিকে। সিনেমার সময়কাল ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জাপানের পুনরুত্থানের সময়ের। সিনেমাটি তৈরি করা হয় ১৯৫৩ সালে। এক বৃদ্ধ স্বামী স্ত্রীর তাদের সন্তানদের টোকিও শহরে দেখতে আসাকে কেন্দ্র করে সিনেমার গল্প গড়ে উঠেছে। কিন্তু তাদের সন্তানরা যেন খুব ব্যস্ত, কারণ হয়টো তারা স্বার্থপর, বা তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই বা গোটা পৃথিবীই হয়তো তাদের বাবা-মায়ের সাথে এমন আচরণ করে বলেই।
দ্য রুলস অভ দ্য গেম
এটি ১৯৩৯ সালে তৈরি একটি ফ্রেঞ্চ ফিল্ম। জিন রিনোয়ের পরিচালনায় তৈরি এ মুভিটি কমেডি ড্রামা ঘরানার। সিনেমার কাহিনী গড়ে উঠেছে ফ্রান্সের উচ্চ বিত্ত শ্রেণীর ধনীদের এবং তাদের কর্মচারীদের নিয়ে। সিনেমার সময়কাল ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর একদম প্রাক্কালে। সিনেমায় ধ্বংসলীলার প্রতি চরিত্রগুলোর উদাসিনতা ফুটে উঠেছে।
এ সিনেমা মুক্তির ১ বছরের মধ্যেই ফ্রেঞ্চ সরকার সিনেমাটিকে নিষিদ্ধ করে। শুধু তাই নয়, যুদ্ধের সময়ে সিনেমাটির আসল নেগেটিভ পুড়িয়ে ফেলা হয়। এরই সাথে পরিচালকের আসল সিনেমাটি পুরোপরিভাবে হারিয়ে যায়। আজ আমরা রুলস অব দ্য গেমের যে ভার্সনটি দেখি তা বিভিন্ন উৎস থেকে পুনরায় সংগ্রহ করে জোড়া তালি দিয়ে তৈরি করা। এটি পরিপূর্ণভাবে জিন রিনোয়ের আসল মুক্তি দেয়া সিনেমাটি নয়। তারপরও আজও এ সিনেমার আবেদন আগের মতোই আছে। আর সিনেমার মূল বক্তব্যটিও আজও ততটাই জীবনসঙ্গত রয়েছে যা প্রায় ৮০ বছর পূর্বে সিনেমাটি মুক্তি দেয়ার সময় ছিল।
সানরাইজঃ আ সং অব টু হিউম্যানস
সানরাইজ: আ সং অব টু হিউম্যানস ১৯২৭ সালে মুক্তি পাওয়া একটি আমেরিকান মুভি। এই মুভিকে নির্বাক সিনেমাগুলোর মাঝে শ্রেষ্ঠ বললেও অত্যুক্তি করা হয় না। এটি রোমান্টিক ড্রামা ঘরানার একটি সিনেমা। আমেরিকান সিনেমা হলেও সিনেমার পরিচালক ছিলেন জার্মান পরিচালক এফ ডাব্লিউ মুরনাউ।
সিনেমার কাহিনী নেয়া হয়েছে কার্ল মেয়ারের ছোট গল্প “দ্য এক্সকারশান টু টিলসিট” থেকে। ১৯২৯ সালে ইউনিক অ্যান্ড আর্টিস্টিক পিকচার ক্যাটেগরিতে ১ম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড বা, অস্কারে পুরস্কার জিতে নেয় এ সিনেমাটি। সিনেমার নায়িকাও এ সিনেমার জন্য অস্কার জিতে নেন। ছবির কাহিনী গড়ে উঠেছে একজন কৃষকের জীবনকে কেন্দ্র করে। শহরের এক কুটিল মহিলার ফাঁদে পরে কৃষকটি নিজের স্ত্রীকে হত্যা করতে সচেষ্ট হয়। কৃষকটি তাকে ডুবিয়ে মারার পরিকল্পনা করে। তারপর? জানতে হলে দেখতে হবে পুরো মুভিটি।
২০০১: আ স্পেস ওডিসি
স্ট্যানলি কুব্রিকের এক অমর সৃষ্টি। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত এ মুভিটিকে যুগের থেকে কয়েক দাফ এগিয়ে থাকা মুভি হিসেবে স্মরণ করা হয়। সিনেমাটির স্ক্রিনপ্লে লিখেছেন স্ট্যানলি কুব্রিক নিজে এবং সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সায়েন্স ফিকশান লেখক আর্থার সি ক্লার্ক। সিনেমটি মুক্তি পাওয়ার কিছুদিন পরেই ক্লার্ক এই একই নামে একটি উপন্যাস প্রকাশ করেন। সিনেমটিতে জুপিটার বা বৃহস্পতি গ্রহে অভিযানের কাহিনী ফুটে উঠেছে। ব্ল্যাক মনোলিথ নামের রহস্যজনক,কৃত্তিম (কালো পাথর বা, স্তম্ভ) খোঁজে এ অভিযান যা মানুষের বিবর্তনের উপড় প্রভাব বিস্তার করছে। H.A.L. 9000 (হাল ৯০০০) নামে এক সেন্টিয়েন্ট বা, অনুভূতিসম্পন্ন কম্পিউটারের সাথে মানুষের এ ব্ল্যাক মনোলিথ পাওয়ার জন্য যুদ্ধ দেখানো হয়েছে। এ যুদ্ধের বিজয়ীই বিবর্তনের পরের ধাপে পা রাখবে।
মানুষের বিবর্তন, কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা, মহাজাগতিক প্রাণী বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক বিষয় এ সিনেমাতে উঠে এসেছে। ভিজুয়াল ইফেক্টসের জন্য এ সিনেমাটি অস্কার পায়। এছাড়াও ৪ টি ক্যাটেগরিতে এ সিনেমা অস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল।
দ্য সার্চার্স
দ্য সার্চার্স ১৯৫৬ সালে মুক্তি পাওয়া ওয়েস্টার্ণ ঘরানার আমেরিকান সিনেমা। জন ফর্ড সিনেমাটি পরিচালনা করেন। সিনেমাটি ব্যবসায়িকভাবে সফল হলেও কোনো অস্কার নমিনেশান পায়নি। এর মুক্তির পর থেকে এটিকে মাস্টারপিস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটিকে সর্বকালের অন্যতম সেরা সিনেমা এবং সবচেয়ে প্রভাববিস্তারকারী সিনেমাগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ইথান এডওয়ার্ডস নামে এক ব্যক্তি সিভিল ওয়্যার শেষে টেক্সাসে ফিরে আসে নতুন করে ঘর বাঁধার স্বপ্নে। সে তার গোপন কিন্তু সত্যিকারের ভালোবাসার মেয়েটির কাছাকাছি থাকার আশায় বুক বাঁধে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাকে তার ভাইপো মার্টিনকে নিয়ে এক দীর্ঘ ভ্রমণে বের হতে হয় তার নিজের ভাগ্নীকে খুঁজতে যাকে ইন্ডিয়ান উপজাতিরা অপহরণ করেছে। ধীরে ধীরে মার্টিন তার চাচা এডওয়ার্ডের চরিত্রে কিছু পরিবর্তন দেখতে পায়। সে বুঝতে পারে ইন্ডিয়ানদের প্রতি তার চাচার ঘৃণা ধীরে ধীরে তার বোনের উপরে চলে যাচ্ছে। মার্টিন আশা নিরাশার মাঝে পরে যায়, তার চাচা কি তার বোনকে রক্ষা করবেন নাকি হত্যা করবেন?
আজ তো শুনলেন পৃথিবী বিখ্যাত ৭ টি সিনেমার কথা। এমন আরো সিনেমার গল্প শুনতে অপেক্ষায় থাকুন। আর সিনেমাগুলো দেখে নিতে ভুলবেন না যেনো, না হলে জীবনটা হয়তো অসম্পূর্ণই থেকে যাবে আপনার।