যান্ত্রিকতার এই জীবনে আমাদের অনেকেরই দৈনন্দিন কাজ ছকে আঁকা থাকে। নয়টা-পাঁচটা অফিস অথবা সারাদিনের ক্লান্তিকর ক্লাস। মাঝে মাঝে অনেকেরই হয়তো মনে হয়, ব্যাগ নিয়ে একা বেরিয়ে পড়ি কোথাও। অজানা কোনো এক পাহাড়ে ভোরবেলা শিশিরভেজা ঘাসে হাত বুলাই। কিন্তু এত ব্যস্ততার মাঝে ঘুরে আসার ফুরসত মেলেই বা ক’জনের!
ছকে আঁকা চাকরি হয়তো আপনাকে মাইনে দেয়, কিন্তু একটি ভালো ভ্রমণ আপনার অন্তর্নিহিত শক্তি যোগাবে। কিছুদিনের জন্য সব ব্যস্ততা ভুলে কয়েকদিনের জন্য কোথাও বেড়িয়ে আসলে শরীর ও মন দুটোই ফুরফুরে থাকে। আমাদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন, যারা নতুন কোনো জায়গা ঘুরতে চেয়েছেন কোনো সিনেমা বা টিভি সিরিজ দেখে। চলুন, এমন কিছু সিনেমার কথা জেনে আসি যা আপনাকে ভ্রমণ করতে অনুপ্রেরণা দেবে।
১. দ্য সিক্রেট লাইফ অফ ওয়াল্টার মিটি (২০১৩)
ওয়াল্টার মিটি (বেন স্টিলার) লাইফ নামে একটি মাসিক পত্রিকায় কাজ করে। তার ঘটনাহীন জীবন দুঃসাহসিক কাজ আর বীরত্বের দিবাস্বপ্ন দিয়ে ভর্তি। একদিন বিখ্যাত এক ফটোগ্রাফার কিছু ছবির রিল পাঠায় ওয়াল্টারের পত্রিকায়, যেখানে বলা থাকে, ২৫ নাম্বার ছবিটি অবশ্যই লাগবে পত্রিকার কভারের জন্য। ওয়াল্টার সেই ছবিটি অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে না পাওয়ায়, শেষমেশ সেই ফটোগ্রাফারের সন্ধানে বের হয়ে পড়ে। তার নিস্তেজ জীবনধারার বাইরে বেরিয়ে এসে, এক এক করে বিভিন্ন দুর্গম ঘুরতে থাকে সেই ফটোগ্রাফারের খোঁজে। গ্রিনল্যান্ড থেকে আইসল্যান্ডের পাহাড়ের পাশঘেষা রাস্তায় স্কেট করা থেকে শুরু করে আফগানিস্তানের বরফে ঢাকা পর্বতমালা পার হতে থাকে ওয়াল্টার। তার সাদামাটা জীবন যেন নিমেষে বদলে যায়।
বেন স্টিলারেরই পরিচালনা করা এই সিনেমাটি অনুপ্রেরণাদায়ক সুন্দর একটি গল্প! অসাধারণ আলোকচিত্রের সাথে মনোমুগ্ধকর আবহসঙ্গীত সিনেমা শেষ হবার পরও আপনার মন ভরিয়ে রাখবে।
সিনেমাটির IMDB রেটিং: ৭.৩/১০
ট্রেইলার:
২. ইট, প্রে, লাভ (২০১০)
If you are brave enough to leave behind everything familiar and comforting then the truth will not be withheld from you.
এলিজাবেথ গিলবার্টের লিখা একই নামের বেস্ট সেলার বই থেকে নির্মাণ করা হয়েছে সিনেমাটি। তিনি বইটি লিখেছেন নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে। কিছু দুর্দাশাজনক সম্পর্ক এবং একটি ব্যর্থ বিয়ের পর লিজ গিলবার্টের (জুলিয়া রবার্টস) মনে হতে থাকে তার একটি বিরতি প্রয়োজন। অফিস থেকে এক বছরের ছুটি নিয়ে ভ্রমণে বের হয় লিজ। ভ্রমণের উদ্দেশ্য নিজেকে খুঁজে পাওয়া। এই যাত্রা তাকে নিয়ে যায় ইতালি, ইন্দোনেশিয়ার বালি থেকে ভারত পর্যন্ত। মুভির নামের যথেষ্ট প্রয়োগ করে এই এক বছরের ভ্রমণে লিজ!
রায়ান মারফির পরিচালনায় এই সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন জুলিয়া রবার্টস, হাভিয়ের বারদেম এবং জেমস ফ্র্যাঙ্কো। সিনেমাটির দেখানো বালি, ইতালি এবং ভারতের কিছু জায়গা এতটাই মনোমুগ্ধকর যে জীবনে একবার জায়গাগুলো ঘুরে আসার চিন্তা মাথায় উঁকি দিবে নিশ্চিত!
সিনেমাটির IMDB রেটিং: ৫.৮/১০
ট্রেইলার:
৩. ইনটু দ্য ওয়াইল্ড (২০০৭)
এই সিনেমাটি ক্রিস্টোফার ম্যাকান্ডলেসের জীবনের সত্য ঘটনার উপর তৈরি করা। ১৯৯২ সালে ক্রিস্টোফার (এমিল হার্শ) কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে, নিজের জমানো ২৫ হাজার ডলার দাতব্য কাজে দিয়ে আরণ্যকের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়েন। ধনী পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও লাভজনক কোনো পেশায় না গিয়ে এই পথ নেন সিনেমার প্রধান চরিত্র। নিজেকে খুঁজে পাবার এই ভ্রমণে একটি ব্যাকপ্যাকই তার সঙ্গী থাকে। আমেরিকার পথে চার মাস ঘুরে অবশেষে আলাস্কাতে পৌঁছান ক্রিস্টোফার। আলাস্কার উদ্দেশ্যে বের হওয়া ক্রিস্টোফার কি নিজেকে খুঁজে পাবে?
শন পেনের লেখা এবং পরিচালনায় ২০০৭ সালে বের হওয়া সিনেমাটি সমালোচকদেরও অনেক পছন্দ হয়েছিলো।
When you want something in life, you just gotta reach out and grab it.
সিনেমাটির IMDB রেটিং: ৮.১/১০
ট্রেইলার:
৪. দ্য মোটরসাইকেল ডায়েরিজ (২০০৪)
কিংবদন্তি বৈপ্লবিক নেতা চে গেভারার যৌবনকালের সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি করা হয়েছে স্প্যানিশ ভাষার এই সিনেমাটি। চে গেভারার নিজের লিখা বই দ্য মোটর সাইকেল ডায়েরিজ থেকেই সিনেমাটি নির্মিত। চে এবং তার বন্ধু আলবার্তো গ্রানাদো একটি মোটর সাইকেলে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন পুরো দক্ষিণ আমেরিকা পাড়ি দেয়ার উদ্দেশ্যে। মেডিকেল কলেজের শেষ সেমিস্টারের আগের ছুটিতে দুই বন্ধু মোটর সাইকেলে চড়ে ব্রাজিল থেকে পেরু পাড়ি দেন।
পথে দুই বন্ধুর সাথে অনেক ঘটনা ঘটে। তারা অনেক অসমতা আর গরীবদের দুর্দশা দেখে পুরো মহাদেশ জুড়ে। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে গরীবদের অসমতা দেখে চে’র জীবন বদলে যায়। সামাজিক সমস্যা আর এই অসমতার কারণে তরুণ মেডিকেল ছাত্র চে’র ভিতরে বিপ্লবের চারা জন্মায়।
এই সিনেমাটি দেখে প্রিয় কোনো বন্ধুকে নিয়ে মোটর সাইকেলে চড়ে বেরিয়ে পড়ার ইচ্ছা জেগে উঠবে। ওয়াল্টার সালেসের পরিচালনায় সিনেমাটি দক্ষিণ আমেরিকার অনেকগুলো দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেখা পাওয়া গেছে।
Let the world change you, and you can change the world
সিনেমাটির IMDB রেটিং: ৭.৮/১০
ট্রেইলার:
৫. দ্য দার্জিলিং লিমিটেড (২০০৭)
সিনেমার নাম দেখেই বোঝা যায়, এই সিনেমার ব্যাপ্তি ভারতে। বাবা মারা যাওয়ার পর এক বছর তিন ভাইয়ের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিলো না। তিন ভাইয়ের একজন ফ্রান্সিস (ওয়েন উইলসন) মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় পাওয়া আঘাত সেরে ওঠার চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে পিটার (অ্যাড্রিয়েন ব্রডি) আর জ্যাকরা (জেসন) আছেন পারিবারিক সমস্যা নিয়ে। শেষমেশ তিন ভাই মিলে দেখা করে ঠিক করেন পুরো ভারত ঘোরার ভ্রমণে বের হবেন। নিজেদের মধ্যে বন্ধন অটুট রাখার চিন্তা করে তিন ভাই মিলে উঠে পড়েন বিলাসবহুল এক ট্রেনে।
এই সিনেমাতে ভারতের প্রাকৃতিক দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবে নিশ্চিত। ওয়েস অ্যান্ডারসনের করা এই সিনেমাতে অভিনয় করেছেন ওয়েন উইলসন এবং অ্যাড্রিয়েন ব্রডি।
সিনেমাটির IMDB রেটিং: ৭.২/১০
ট্রেইলার:
৬. দ্য বাকেট লিস্ট (২০০৭)
আমাদের অনেকরই হয়তো ইচ্ছা আছে মারা যাবার আগে অন্তত কিছু কাজ সেরে যাবার, কিংবা হয়তো একটি তালিকা! স্কাই ডাইভিং, স্কুবা ডাইভিং, বাঞ্জি জাম্পিং, প্যারিসে একরাত কাটানো এরকম কিছু। এই সিনেমাটি ঠিক এই ব্যাপারটি নিয়ে তৈরি করা। উচ্চবিত্ত এডওয়ার্ড কোল (জ্যাক নিকলসন) এবং কার মেকানিক কার্টার চেম্বারস (মরগান ফ্রিম্যান) দুজনই ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত। ভাগ্যের পরিহাস দুজনের ঠিকানা হয় এক হাসপাতালের রুমে।
কার্টার তার করা একটি তালিকার কথা বলে এডওয়ার্ডকে যে, মারা যাবার আগে এই জায়গাগুলো ভ্রমণ করতে চায়। এডওয়ার্ডের খুব পছন্দ হয় তালিকাটি। ডাক্তারের শত বারণ সত্ত্বেও দুজন মিলে বেরিয়ে যান তাদের তালিকা পূরণ করতে। পরবর্তী তিন মাস পুরো বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান তারা। আফ্রিকান সাফারি থেকে তাজমহল, প্যারিস থেকে উত্তর মেরু, এভারেস্টের বেস ক্যাম্প পর্যন্ত যায় তাদের এই দুঃসাহসিক ভ্রমণ।
তিন মাসের এই ভ্রমণ এডওয়ার্ড এবং কার্টার দুজনেরই জীবন বদলে দেয় ভয়ংকরভাবে। রব রেইনারের পরিচালনায় মরগান ফ্রিম্যান এবং জ্যাক নিকেলসনের অভিনয় করা এই সিনেমাটি দেখলে আপনারও মনে হবে একটি তালিকা করে ফেলি নিজের জন্য!
“ We live, we die and the wheels on the bus go round and round”
সিনেমাটির IMDB রেটিং: ৭.৪/১০
ট্রেইলার:
৭. জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা (২০১১)
তিন বন্ধু কবির (অভয় দেওল), ইমরান (ফারহান আক্তার) এবং অর্জুন (হৃতিক রোশন) নিজেদের কলেজ জীবনেই ঠিক করে যে, বন্ধুর আগে বিয়ে করবে তার ব্যাচেলর ট্রিপে স্পেনে যাবে। এই ভ্রমণের মধ্যে আরেকটা শর্ত হচ্ছে, তিনজন একটি একটি করে দুঃসাহসিক কাজ ঠিক করে রেখেছে, যা অপর দুজনকে করতেই হবে, যত ভয়ংকরই হোক না কেন!
যথাসময়ে কবিরের ব্যাচেলর ট্রিপে তিন বন্ধু স্পেনে যাত্রা শুরু করে। এই ভ্রমণ তাদের নিয়ে যায় বার্সেলোনার কোস্টা ব্রাভা থেকে থেকে ভ্যালেন্সিয়ার টমাটিনা উৎসবে। সেখান থেকে সেভিয়াতে। পথে তাদের দেখা হয় লায়লার (ক্যাটরিনা কাইফ) সাথে, যে তাদের সঙ্গ দেয়।
তিনজনের সেই দুঃসাহসিক কাজগুলো করতে গিয়ে নিজেদের ভিতরের ভয় কে জয় করে তিন বন্ধু। তিনজন এরই জীবন পরিবর্তন হয় এই ভ্রমণে। জয়া আক্তারের পরিচালনায় হিন্দি ভাষার এই সিনেমাটি দেখলে আপনার একবার না একবার ইচ্ছা করবেই স্পেন ঘুরে আসতে। স্পেনের ভূদৃশ্য পরিচালক খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন বড় পর্দায়।
Whenever the clouds of pain and sadness loomed,
Whenever tears came till the eyelashes,
Whenever this lonely heart got scared,
I told my heart, Oh Heart, why do you cry?
This is what happens in this world…
সিনেমাটির IMDB রেটিং: ৮.১/১০
ট্রেইলার: