দ্য ভাইরাল ফিভার সংক্ষেপে টিভিএফ ভারতের ওভার দ্য টপ প্ল্যাটফর্মে একটি অতি পরিচিত নাম। সোশ্যাল ড্রামা বানানোতে সিদ্ধহস্ত এই প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ প্রযোজনাই বাস্তবঘনিষ্ঠ ও প্রাসঙ্গিক। দর্শকেরা সহজে টিভিএফের সৃষ্টির সাথে নিজেদের দৈনন্দিন জীবন মেলাতে পারে। সম্প্রতি তাদের বহুল জনপ্রিয় ও আলোচিত সিরিজ কোটা ফ্যাক্টরির ২য় সিজন মুক্তি পেয়েছে। প্রথম সিজনের জনপ্রিয়তার কারণে খ্যাতনামা ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্স সিরিজটি অধিগ্রহণ করে। এর প্রথম সিজন দর্শকরা ইউটিউবে বিনামূল্যে দেখতে পেলেও দ্বিতীয় সিজনটি দেখতে হবে নেটফ্লিক্সেই।
প্রথম সিজনের প্রথম পর্ব মুক্তি পায় ২০১৯ সালের ১৬ এপ্রিল। এরপর দিন যত পেরিয়েছে মানুষের কাছে সিরিজটির আবেদন তত বেড়েছে। এখন পর্যন্ত ইউটিউবে সিরিজটির পর্বগুলো দেখা হয়েছে প্রায় ১৬ কোটি বার। রংবিহীন সাদা-কালো সিনেমাটোগ্রাফির সাথে প্রাকৃতিক অভিনয় ও জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়বস্তুর কারণে খুব সহজেই সিরিজটি দর্শকদের মনে জায়গা করে নেয়।
প্রথম সিজনের গল্প অগ্রসর হয় মূল চরিত্র ভৈভব পান্ডের দৃষ্টিকোণ থেকে। সে ভারতের খ্যাতনামা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় আইআইটি-তে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবার জন্য আসে রাজস্থানের একটি শহর কোটায়, যা পুরো ভারতে বিখ্যাত তাদের ভর্তি কোচিংগুলোর জন্য। অনেকটা বাংলাদেশের ফার্মগেটের মতো। পার্থক্য হচ্ছে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীরা ফার্মগেটে আসে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে আর কোটায় শিক্ষার্থীরা চলে যায় কলেজ জীবনের শুরুতেই। ভর্তি পরীক্ষাই সেখানে মূখ্য, আর উচ্চমাধ্যমিক ব্যাকফুটে।
এখানে আসার পর কোচিংয়ে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে প্রতি পদে পদে ভৈভব বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে থাকে ও শিখতে থাকে কীভাবে সমস্যা সমাধান করতে হয় আর করা না গেলে কীভাবে মানিয়ে নিতে হয়। এ যাত্রায় তার সঙ্গী হয় বালমুকুন্দ মীনা, উদয় গুপ্ত, শিভাংগি রানাওয়াত আর অতি অবশ্যই টিভিএফের পোস্টার বয় জিতেন্দ্র কুমার।
প্রথম সিজনের সাফল্যের পেছনে ছিল বাস্তবঘনিষ্ঠ গল্পের গাঁথুনি। প্রত্যেক দর্শক যারা পড়াশোনা বা অন্য কোনো কারণে বাড়ির বাইরে ছিল তারা নিজেদের খুব সহজেই ভৈভব, মিনা, উদয়, শিভাংগি, মিনাল ও ভার্তিকাদের সাথে নিজেকে মেলাতে পারবে। আর যারা ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবার উদ্দেশ্যে নতুন কোনো শহরে গিয়েছিল তারা তো অবশ্যই ভাববে আরে ঠিক এমনটা তো আমার সাথেও হয়েছিল ! নতুন জায়গায় ঘুম না আসা, মেসের খাবারের গলা দিয়ে নামতে না চাওয়া, ক্লাসের সবকিছু মাথার উপর দিয়ে চলে যাওয়া- বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে প্রথম আসা এক তরুণের অভিজ্ঞতা খুব সূচারূভাবে ফ্রেমবন্দি করতে পেরেছে টিভিএফ।
মূল চরিত্র ভৈভব হলেও সিরিজটির প্রাণ হলেন পদার্থবিদ্যার শিক্ষক জিতু ভাইয়া। যিনি শিক্ষার্থীদের জন্য একইসাথে শিক্ষক ও মেন্টরের ভূমিকা পালন করেন। প্রথম সিজনে প্রতিটি প্রধান চরিত্রকেই খুব ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। আরেকটা বিষয় না বললেই নয়, হাস্যরসের ব্যবহার। স্থূল রসিকতা করে লোক হাসানোর চেষ্টা করে নেই। সৃষ্টিতে হিউমার আসে অবলীলায়, খুবই সূক্ষ্মভাবে। এভাবেই বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত ও বন্ধুদের সাথে অনেক স্মৃতি জমানোর মাধ্যমে ভৈভব কোটায় তার প্রথম বছর শেষ করে।
দ্বিতীয় সিজন শুরু হয় প্রথম সিজনের শেষ থেকে। শুরুর শট থেকেই আমরা বোঝা যায় এই সিজনও অসাধারণ হতে যাচ্ছে। কোটার সবচেয়ে বিখ্যাত কোচিংয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে খুশিতে উড়তে থাকা ভৈভবকে মাটিতে টেনে নামানো হয় প্রথম দিনেই; রঙ্গিন থেকে সেই ট্রেডমার্ক সাদা-কালো টোনে উত্তরণের সিনের মাধ্যমে দেখানো হলো সব আগের মতোই আছে ভৈভবের জীবনের রং ফিরে আসতে হলে যেতে হবে আরো বহুদূর।
এই সিজনের সিনেমাটোগ্রাফি আর ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ছিল খুব নিখুঁত। বিশেষ করে লং শট ও টপ শট গুলোর মাধ্যকে সিনেমাটোগ্রাফার শ্রীধরা নামযোশী নিজের জাত চিনিয়েছেন। প্রথম সিজনের সাথে দ্বিতীয় সিজনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা হচ্ছে এই সিজনে ভৈভবের দৃষ্টিকোণ থেকে সরে এসে পুরো ভর্তি পরীক্ষার যে ভয়াবহ রকমের চাপ ও সেই চাপের প্রভাবের উপর এই সিজনে বেশি আলোকপাত করা হয়েছে। সাবপ্লট হিসেবে ছিল শিক্ষার্থীদের পুঁজি করে কোটি টাকার কোচিং ব্যবসার একটু ঝলক। সাথে তোলা হয়েছে কিছু প্রশ্ন, সামাজিক স্টেরিওটাইপ ও লিঙ্গ বৈষম্যও উঠে এসেছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে।
প্রতিটি এপিসোডের বিষয়বস্তু জোরালো হলেও চিত্রনাট্য প্রথম সিজনের তুলনায় একটু দুর্বল মনে হয়েছে। তবে তা পুষিয়ে যায় অসাধারণ ভিজুয়াল দিয়ে। দূর থেকে তিনটি চিমনি দিয়ে ধোয়া বের হবার দৃশ্যটি দ্বারা সম্ভবত ‘চেরনোবিল’কে আর ভৈভবকে কম্বলে জড়িয়ে ভেসপায় করে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি দ্বারা ‘থ্রি ইডিয়টস’কে স্মরণ করা হয়েছে। এ ধরনের যেসব চলচ্চিত্র বা সিরিজ আছে যেমন, থ্রি ইডিয়টস, লাখো ম্যায় এক ইত্যাদি সেগুলো অনেক বেশি জাজমেন্টাল। এ দিক দিয়েই টিভিএফ অনন্য।
এসপির্যান্টস হোক বা কোটা ফ্যাক্টরি কখনোই একতরফাভাবে সিস্টেমকে দোষারোপ করে না। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বাস্তব জীবনের ঘটনাবলী তুলে ধরে দর্শকদের কাছে বাকিটুকু ছেড়ে দেয়। তবে এই সিজনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল জিতু ভাইয়ার নিজের একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য সংগ্রামের চিত্র। আশা করি পরের সিজনে এই প্লটটি আরো ভালোভাবে তুলে ধরা হবে।
অভিনয়ের দিক দিয়েও সবাই তাদের সেরাটা দিয়েছেন। ভৈভবের চরিত্রে মায়ুষ মোরে, উদয় গুপ্তর চরিত্রে আলম খান, জিতু ভাইয়ার চরিত্রে জিতেন্দ্র কুমার, শিভাংগির চরিত্রে আশ্বাস চানা সবাই তাদের সেরাটা দিয়েছেন। তবে ভার্তিকার চরিত্রে রেভতি পিলাইকে সময়ে সময়ে একটু নিষ্প্রভ লেগেছে, বিশেষ করে ভৈভবের সাথে যুগল সিনগুলোতে।
অভিনয়ের দিক দিয়ে সব আলো কেড়ে নিয়েছেন টিভিএফের ইনসাইডার ম্যান সামির সাক্সেনা মহেশ্বরী স্যারের চরিত্রে। তার উপস্থিতি মাত্র কিছু সময়ের জন্য হলেও সেই অল্প সময়েই তিনি ফাটিয়ে দিয়েছেন! একদম সেক্সিস্ট, আলফা মেলের চরিত্রে নিজেকে এমনভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন যে তার প্রতিটি বৈষম্যমূলক বক্তব্যের সময় দর্শকের মনে হবে ঠিকই তো আছে এই লোকের তো এভাবেই বলার কথা! ১ম সিজনে মতো না হলেও ২য় সিজনও বেশ ভালোভাবেই দর্শকদের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছে।
পিচার্স থেকে শুরু করে ইয়ে মেরি ফ্যামিলি, ট্রিপলিং, কিউবিকলস, এস্পির্যান্টস, গুল্লাক, পঞ্চায়েত ইত্যাদিতে টিভিএফের শক্তিমত্তা নিহিত তাদের গল্পে। আসলে ঠিক গল্পে নয়, গল্প বলার ধরনে। এমন নয় যে নতুন কোনো গল্প বলছে, আমাদের হাজার বার শোনা গল্পগুলোই আসলে বলছে। নিজেদের জীবনকেই তাদের স্বভাবজাত উইটের সাথে এমনভাবে উপস্থাপন করে যে মুগ্ধ না হতেই হয়।
আরো একটা বিষয় হচ্ছে, তারা মিডল ক্লাস সেন্টিমেন্ট খুব ভালভাবে স্পর্শ করতে পারে। ফলে নিজেদের সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের অন্তরে ঢুকে যাবার ক্ষমতা টিভিএফ দেখিয়েছে। আমরা যখন কোনো বড় বাজেটের থ্রিলার, সায়েন্স ফিকশন বা ফ্যান্টাসি সিরিজ দেখি তার বিশালতায় মুগ্ধ হলেও সেই গল্পগুলোর জীবনের চেয়েও বড় চরিত্রের কারণে বেশিরভাগ সেগুলো আমাদের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। যেমন ব্রেকিং ব্যাডের কথাই ধরা যাক, আমরা যখন ওয়াল্টার হোয়াইটকে দেখি তখন কিন্তু তাকে অচেনা কেউ মনে হয় না। একদম নিজের পরিচিত গন্ডিরই একজন মনে হয়, এর ফলে, আমরা তার সাথে আরো ভালো ও দৃঢ় ভাবে সংযোগ স্থাপন করতে পারি, তার জীবনের উত্থান-পতন আমাদেরকেও স্পর্শ করে। টিভিএফ সেভাবেই তাদের কাজগুলো করে যেন দর্শকের মনে চরিত্রগুলো একদম গেঁথে যায় তার সাথে যোগ হয় টেকনিক্যাল ও সিনেম্যাটিক ব্রিলিয়ান্স।
গুল্লাকের দ্বিতীয় সিজনের শেষ দৃশ্য, এস্পির্যান্টসের বৃষ্টিতে ভেজা সন্দীপ ভাইয়ার ফাঁকা দৃষ্টি, অভিলাষের বাসে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলা- সন্দীপ ভাইয়া, জীতু ভাইয়া, মীনা, পঞ্চায়েতের বিকাশদের মতো এমন সব চরিত্র তৈরি করে যা সিরিজ শেষ হবার পরেও দর্শকদের মনে অনেকদিন পর্যন্ত রেশ রেখে যায়।