২০১৮ সালে সারাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বইয়ের মধ্যে একটি হলো ইসরাইলের লেখক ইউভাল নোয়া হারারির লেখা ‘টুয়েন্টি ওয়ান লেসন্স ফর দ্য টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’। বইটিতে একবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন সমস্যা, ক্রমান্বয়ে উন্নত হতে থাকা আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির মানবজীবনের উপর প্রভাব, রাজনীতির মেরুকরণসহ বিভিন্ন দিক নিয়ে নিজের মত তুলে ধরেছেন তিনি।
২১ শতকে এসে আমাদের মানবজাতি একটি ভিন্ন বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে। তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগতি, বিজ্ঞানের প্রসার, মানুষের মনে ধর্ম-বিশ্বাস ও জীবনমুখী চিন্তার পরিবর্তন হচ্ছে।
তথ্য-প্রযুক্তি, চিকিৎসা, যোগাযোগের ধরণ সবকিছুর দ্রুত পরিবর্তনের ফলে বদলে যাবে আমাদের জীবনধারা। তেমনি জলবায়ু পরিবর্তন, পারমাণবিক অস্ত্রের মতো এমন অনেক ইস্যু নিয়ে সমগ্র মানবজাতিকে চিন্তা ও কাজ করতে হবে, যা এর আগে কখনো আমাদের ভাবতে বা করতে হয়নি।
বইটির প্রথমে লেখক বর্তমানে বিশ্বের পরাশক্তিধর দেশগুলোর রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গী ব্যাখ্যা করেছেন। লেখকের মতে সব জাতি ঐতিহাসিকভাবে কোনো না কোনো আদর্শকে ধারণ করে এসেছে। আর রাজনৈতিক নেতারাও ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক চেতনার বাণী ব্যবহার করেছে।
কখনো সমাজতন্ত্র, কখনো গণতন্ত্র, কখনো বা জাতীয়তাবাদ- এসব নানা নামে এসব গল্প আমাদের বিশ্বাস, বাস্তবতাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। আবার জাতিতে জাতিতে দ্বন্দ্ব, যুদ্ধবিগ্রহের মতো হানাহানিতেও সবসময় চেতনা, নীতির দ্বন্দ্বে অমিল থাকা ভূমিকা পালন করে এসেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একদিকে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সের ‘গণতান্ত্রিক জোট’। অন্যদিকে অক্ষশক্তি ছিল একনায়কতান্ত্রিক জার্মান নাৎসিবাদ, মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ, জাপানের রাজতন্ত্র। বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল মূলত দুই ভিন্ন আদর্শের মাঝে।
বিশ্বযুদ্ধের পরও এই দৃশ্য পাল্টায়নি বরং রাজনৈতিক চেতনার প্রকাশভঙ্গীটুকু বদলায়। তখন পরাশক্তিধর দেশগুলো দুই ভাগে ভাগে হয়ে যায়; এক দিকে গণতান্ত্রিক পশ্চিমা জোট আর অন্য দিকে ছিল সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো। দুই রাজনৈতিক চেতনার উৎস ও প্রকাশ ছিল ভিন্ন।
কিন্তু অভিন্ন ছিল একটি জিনিস- দুই নীতির দেশই নিজেদের রাজনৈতিক ভিত্তিকে সেরা বলে দাবি করতো। অবশ্য সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার পতনের পর গণতন্ত্রই এই যাত্রায় জয়ী হয়।
২০ বছর আগেও ইউরোপীয়, আমেরিকান জোট রাশিয়া, চীনের জাতীয়তাবাদের সমালোচনা করতো। কিন্তু ট্রাম্পের আমেরিকার নির্বাচনে জয়লাভ, ব্রিটেনের ব্রেক্সিটের মাধ্যমে তারাই আজ জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকে গেছে। জার্মানি, ফ্রান্স, সুইডেনের মতো দেশে জাতীয়তাবাদ জনপ্রিয় হচ্ছে। ফলে আদর্শিকভাবে পশ্চিমা বিশ্ব এখন তাদের শত্রু দেশগুলোর নীতিই অনুসরণ করছে।
হারারির মতে এরকম নতুন বাস্তবতা ইতিহাসে প্রথম। ফলে বর্তমানে বিশ্ব ‘গল্প শূন্য’।
হারারি এই শতাব্দীতে প্রযুক্তির প্রভাবকে সব কিছুর থেকে আলাদা করে দেখেছেন। ২১ শতকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি হচ্ছে দ্রুত গতিতে। ফলে আজকের পৃথিবীর যে বাস্তবতা আমরা দেখছি, ১০ বছর পরও তা বদলে যাচ্ছে এবং ক্রমাগত প্রযুক্তির ফলে এর ধারা সামনেও অব্যাহত থাকবে।
বিগ ডেটা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্রমাগত উন্নতির কারণে বদলে যাবে ভবিষ্যৎ। ২০৫০ সালে নাগাদ পৃথিবীর প্রায় সব গাড়ি হবে স্বয়ংক্রিয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের জ্ঞানকে ছাড়িয়ে যাবে। মানুষের পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতির ফলে কমে যাবে অসুখ, বিসুখ বেড়ে যাবে গড় আয়ু। রোবটের ব্যবহার হবে বিভিন্নই ক্ষেত্রে। একজন মানুষকে কীভাবে রাখতে হবে, তার সাথে কীভাবে আচরণ করতে হবে- এসব বিষয় রপ্ত করে ফেলবে এসব প্রযুক্তি।
লেখকের মতে এর নেতিবাচক প্রভাবও আছে। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে তা কেড়ে নেবে মানুষের চাকরি। অটোমেশন, অর্থাৎ স্বয়ংক্রিয়করণের প্রভাবে ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর ৫০% চাকরি থাকবে না। কারখানার শ্রমিকসহ চিকিৎসক, ব্যাংকার, উকিল, পত্রিকার লেখক, ব্যবসায় বিশ্লেষক ইত্যাদির মতো অনেক চাকরি অটোমেশনের দখলে চলে যাবে।
লেখকের মতে, এর প্রভাব হবে বৈশ্বিক। উন্নত দেশে অটোমেশনের কারণে যে বড় একটা অংশ বেকার হয়ে পড়বে, তাদেরকে সেই দেশগুলো কীভাবে কাজে লাগাবে, সেটিই বড় চ্যালেঞ্জ।
হারারির মতে, এর সবচেয়ে বড় ক্ষতির শিকার হবে ‘বাংলাদেশ’র মতো রপ্তানিনির্ভর দেশগুলো। অটোমেশনের প্রভাবে গার্মেন্টস শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে। ভারত ফ্রিল্যান্সিং-এ সবচেয়ে বড় দেশ, সরকার এই খাতের প্রসারে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। কিন্তু এসব কাজও প্রযুক্তির গহ্বরে চলে যাবে।
তবে নতুন প্রযুক্তির প্রভাবে অনেক কর্ম সংস্থান সৃষ্টি হবে। কিন্তু তা হবে পরিমাণে সামান্য। উচ্চ স্কিলের চাকরিগুলোই টিকে থাকবে তখন। এ ধরনের ঘটনাগুলোর প্রভাব সমাজজীবনেও পড়বে। বদলাবে সরকারের নীতি, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী কিংবা জীবনাচরণ। কিন্তু এর প্রভাব পুরোপুরি ইতিবাচক না হয়ে নেতিবাচকই যে হবে- সেটিও নিশ্চিত করে বলা মুশকিল।
এই শতাব্দীতে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে খুব দ্রুত। বিজ্ঞানীরা এর নেতিবাচক দিক সম্বন্ধে অবহিত করে সতর্ক করলেও সে বিষয় ঐকমতে আসছে না বিশ্ব। এভাবে চলতে থাকলে কয়ক দশকে মধ্যে আমাদের চরম মূল্য দিতে হবে।
লেখকের মতে আমাদের এই শতাব্দীতে এটি এমন এক ইস্যু, যার সমাধানে এক সাথে কাজ করতে হবে। কিন্তু জাতীয়তাবাদের উত্থানের ফলে কোনো দেশই জলবায়ু ইস্যুতে নিজের উন্নতির গতিকে শ্লথ করতে চাইবে না। ফলে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতে মানবজাতি নিজেদের ফেলতে যাচ্ছে।
হারারি মনে করেন, এই শতাব্দীতে পারমাণবিক ক্ষমতাধর দেশগুলো সহজে যুদ্ধে জড়াতে চাইবে না। কিন্তু ইতিহাস বলে রাগ, ক্ষোভ, ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণে মতো বিষয়গুলোই বড় বড় যুদ্ধের পেছনে ইন্ধন দিয়ে এসেছে। ফলে মূর্খের মত বিশ্ব যুদ্ধে জড়ানোর সম্ভাবনা যে পরাশক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে নেই- তা বলা যাবে না।
বইটিতে লেখক নিজের অনেক বিষয়ে মত তুলে ধরেছেন। তিনি এই শতাব্দীর বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করেছেন, আলোচনা করেছেন সম্ভাবনা নিয়েও। কিন্তু তার লেখায় সমস্যার কথাই বেশি উঠে এসেছে। এসবের প্রতিকারে কি করণীয় সেসব বিষয়ে ব্যাখ্যা কম করেছেন।
অনেক বিষয়ে তিনি জেনারেলাজেশন বা সাধারণীকরণের আশ্রয় নিয়েছেন, যা অনেক পাঠকের কাছে পছন্দ নাও হতে পারে। তিনি বিভিন্ন ধর্মকে এই যুগে অকার্যকর বলে আখ্যা দিয়েছেন, কিন্তু তিনি সেকুলার চিন্তা কীভাবে মানসিক চাপ, সমস্যার মুক্তি দেবে তার উপযুক্ত ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।
কেন বইটি পড়বেন?
আমাদের পৃথিবী আমাদের ধারণার থেকেও দ্রুত বদলাচ্ছে। আগামী দিনের পৃথিবীর সাথে আজকের বাস্তবতা মেলালে চলবে না। ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাই বদলাতে হবে নিজেকেও। যে গৎবাঁধা নিয়মে আমরা থেকে অভ্যস্ত, তা এখন পরিবর্তনশীল।
এই শতাব্দী আমাদের জন্য নিয়ে আসবে নতুন নতুন চমক, ভিন্ন জীবনবাস্তবতা। কিন্তু আমাদের অধিকাংশই এই ব্যাপারে অসচেতন। বইটি একজন পাঠকের ভবিষ্যতের পৃথিবীর সম্বন্ধে ধারণা পাল্টে দেবে। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের জন্য বইটি অবশ্যই একবার পড়া উচিত।
বইয়ের নাম: টুয়েন্টি ওয়ান লেসন্স ফর দ্য টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি || লেখক: ইয়ুভাল নোয়া হারারি
প্রকাশক: স্পাইজেল ও গ্র, জোনাথন কেইপ || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম