২০০২ সালের অক্টোবরে, ইরাক যুদ্ধের ছয় মাস আগে, নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক স্কট অ্যান্ডারসন (Scott Anderson) লিবীয় নেতা মোয়াম্মার আল-গাদ্দাফির একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণের জন্য সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে আল-কায়েদার সাথে সম্পৃক্ততা, গণবিধ্বংসী অস্ত্র উৎপাদনসহ একের পর এক নানা অজুহাত তৈরি করছিল। স্কট অ্যান্ডারসন ঐ সাক্ষাৎকারে গাদ্দাফিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমেরিকা যদি আসলেই ইরাক আক্রমণ করে, তাহলে কে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে?“
দীর্ঘ সেই সাক্ষাৎকারে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে গাদ্দাফি তার স্বভাবসুলভ নাটকীয় ভঙ্গিতে দীর্ঘ বিরতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু এই প্রশ্নটির উত্তর যেন তার তৈরিই ছিল। বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “বিন লাদেন।“
গাদ্দাফি বলেছিলেন,
কোনো সন্দেহ নেই ইরাক আক্রমণ করলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে আল-কায়েদা। ইরাক হয়ে উঠবে আল-কায়েদার আক্রমণের স্টেজিং গ্রাউন্ড। কারণ সাদ্দামের সরকার যদি ধ্বসে পড়ে, ইরাকে অরাজকতা নেমে আসবে। যদি সেটা ঘটে, তাহলে আমেরিকার উপর আক্রমণ জিহাদ হিসেবে বিবেচিত হবে।
সে সময় কেউ গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু এখন অনেক বিশ্লেষকই এ ব্যাপারে একমত যে, মধ্যপ্রাচ্যে গত এক দশকের যে সঙ্কট, দেশে দেশে গৃহযুদ্ধ, আল-কায়েদা ও আইসিসের উত্থান, তার সব কিছুর মূলে আছে ২০০৩ সালে আমেরিকার ইরাক আক্রমণ। ঐ সাক্ষাৎকারের প্রায় দেড় দশক পরে লেখা “Fractured Lands: How the Arab World Came Apart” বইটির কাহিনীও তাই স্কট অ্যান্ডারসন শুরু করেছেন ইরাক আক্রমণের সময় থেকেই।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নিয়ে, আরব স্বৈরাচারদের উত্থান-পতন নিয়ে, রাষ্ট্রগুলোর ভাঙ্গাগড়া নিয়ে গত কয়েক বছরে অনেক বই লেখা হয়েছে। এর মধ্যে জটিল তাত্ত্বিক বই যেমন আছে, মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে গবেষণা করা ইতিহাসবিদদের লেখা বই যেমন আছে, তেমনি আছে সংবাদ সংগ্রহ করতে মধ্যপ্রাচের দেশে দেশে, যুদ্ধের ময়দানে ময়দানে ঘুরে বেড়ানো সাংবাদিকদের লেখা, যারা সঙ্কটগুলো দেখেছেন খুবই কাছ থেকে, যারা কথা বলেছেন ভুক্তভোগীদের পরিবারের সাথে, প্রত্যক্ষ করেছেন তাদের সুখ-দুঃখ।
সেরকমই একজন সাংবাদিক স্কট অ্যান্ডারসন এবং সেরকমই একটি বই Fractured Lands। বইটিতে কোনো জটিল তত্ত্ব নেই, দীর্ঘ ইতিহাস নেই, আছে শুধু ছয় জন ভুক্তভোগীর কাহিনী – দুজন ইরাকের, একজন ইরাকি কুর্দিস্তানের, একজন সিরিয়ার, একজন মিশরের এবং একজন লিবিয়ার। এবং তাদের কাহিনীর মধ্য দিয়েই লেখক তার পাঠকদেরকে আরব বিশ্বে ঘটে যাওয়া গত এক-দেড় দশকের ঘটনাবলি সম্পর্কে একটা ধারণা দিতে চেষ্টা করেছেন।
বইয়ের বড় একটি জুড়ে এসেছে মিশরের লাইলা সুয়েইফ এবং তার পরিবারের কথা। কীভাবে সেই ১৯৭২ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে, প্রেসিডেন্ট সাদাতের আমলে তিনি আন্দোলন শুরু করেছেন, কীভাবে তার স্বামীর সাথে মিলে মোবারকের আমলেও সেই আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন, কীভাবে তার স্বামী জেলে যাওয়ার পরেও ভেঙে না পড়ে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন, এবং নিশ্চিত পরিণতি জেনেও কীভাবে তার ছেলেমেয়েদেরকেও প্রেসিডেন্ট সিসির বিরুদ্ধে আন্দোলনের রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াতে নিষেধ করেননি। তার এবং তার সংগ্রামী পরিবারের জীবনীর মধ্য দিয়ে যেন মিশরের এক টুকরো ইতিহাসই ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক।
এরপর আছে লিবিয়ার মিসরাতা শহরের এক তরুণ মাজদি আল-মাঙ্গুশের কথা, যে গাদ্দাফির আমলে বিমানবাহিনীতে প্রশিক্ষণরত ছিল। ২০১১ সালে বিদ্রোহ শুরু হলে তাকে এবং তার সঙ্গী ক্যাডেটদেরকে প্রথমে ত্রিপোলিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর একসময় তাকে ফেরত পাঠানো হয় তার নিজের শহর মিসরাতায়, যা ছিল বিদ্রোহীদের অন্যতম প্রধান ঘাঁটি। তাকে সেখানে পাঠানো হয় স্পাই হিসেবে, পদত্যাগের ভান করে বিদ্রোহীদের সাথে মিশে গোপনে সংবাদ পাঠানোর জন্য। কিন্তু ফিরে গিয়ে সে যখন দেখতে পায় তার পরিবারের সবাই, বন্ধুদের সবাই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছে, তখন তাকে সেই কঠিন প্রশ্নের মোকাবেলা করতে হয়- তার কাছে কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? দেশের সরকার, সেনাবাহিনী? নাকি পরিবার, বন্ধুবান্ধব?
আছে ইরাকি কুর্দিস্তানের আজার মিরখানের কথা, যার বাবা হেসো মিরখান ছিলেন কিংবদন্তী কুর্দি নেতা মুস্তফা বারজানির প্রধান লেফটেন্যান্ট। তাদের জীবন কেটেছিল সাদ্দাম হোসেনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এবং অন্য কেউ পাশে এসে না দাঁড়ানোয় কখনো তাদের সঙ্গী হয়েছিল ইরান, কখনো আমেরিকা। বইয়ে উঠে আসে আইএসের বিরুদ্ধে কুর্দি পেশমার্গাদের যুদ্ধের কথা, এবং সেই যুদ্ধে আজার মিরখানের নেতৃত্বের কথা। তার পাশাপাশি উঠে আসে কুর্দিদের উপর আরবদের দীর্ঘকালীন শোষণের প্রতিক্রিয়ায় আরবদের বিরুদ্ধে তাদের প্রচণ্ড ক্ষোভের কথাও।
এরপর আসে সিরিয়ার হোমস শহরের যুবক মাজ্দ ইবরাহিমের কথা, যুদ্ধের কারণে যার নিস্তরঙ্গ জীবন ওলট-পালট হয়ে যায়, যাকে এবং যার পরিবারকে বাঁচতে হয় পালিয়ে পালিয়ে- হোমস থেকে দামেস্কে, এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায়, এক বাসা থেকে আরেক বাসায়। ফ্রি সিরিয়ান আর্মির হাতে পড়ে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে তাকে ফিরে আসতে হয় কেবল ভাগ্যের জোরে। এবং এরপর যখন আইএস ক্রমেই তাদের এলাকার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে, তখন তাদেরকে আবার সিদ্ধান্ত হয়, এবার তারা পালিয়ে কোথায় যাবে?
এরপর বলা হয়েছে ইরাকের কুত আল-ইমারা শহরের ইংরেজি শিক্ষার্থী খুলুদ আল-জাইদির কথা। সাদ্দামের পতনের পর দখলদার মার্কিন সেনাদের পাশাপাশি যখন কিছু বেসরকারি সংস্থাও ইরাকে আসে মানবাধিকার, নির্বাচনসহ বিভিন্ন ব্যাপারে কাজ করতে, তখন এরকমই একটি দলের সাথে যুক্ত হয় খুলুদ, ইরাকের নারীদের ভোটাধিকারের পক্ষে কাজ করার জন্য। কিন্তু সেটাই তার জীবনকে ওলটপালট করে দেয়। স্থানীয় ইরাকি প্রতিরোধ বাহিনীর কাছে সে চিহ্নিত হয় দখলদারদের সহযোগী হিসেবে। দেশ ছেড়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাকে। কিন্তু বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে, ভাইবোনদেরকে কোথায় যাবে সে?
সবশেষে বলা হয়েছে সাদ্দামের জন্মস্থান তিক্রিতের এক যুবক ওয়াকাজ হাসানের কথা। ইরাক আক্রমণের সময় সে ছিল কিশোর, কিন্তু পরবর্তীতে মার্কিন আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট বাস্তবতায় ২০১৪ সালে যখন আইএসের আবির্ভাব ঘটে, তখন সে এবং তার ভাই যোগ দেয় সংগঠনটিতে। কোনো ধর্মীয় উগ্রপন্থার কারণে না, নিছক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে। আইএসের হয়ে একাধিক হত্যাকাণ্ডেও অংশ নেয় সে। পরবর্তীতে একটা সময় নিজের ভুল বুঝতে পারে সে। কিন্তু আইএসের ভেতর থেকে বের হওয়া কি সহজ কথা?
স্কট অ্যান্ডারসন প্রায় দেড় যুগ মধ্যপ্রাচ্যে সমর-প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু এই বইটি লেখার পূর্বে তিনি এবং চিত্র সাংবাদিক পাওলো পেলেগ্রিন নতুন করে দেড় বছর সময় নিয়ে চষে বেড়িয়েছেন লিবিয়া থেকে সিরিয়া পর্যন্ত। এ সময়ে তারা শত শত মানুষের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন। শুধুমাত্র সাবেক আইএস সদস্যদের মধ্য থেকেই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অন্তত বিশ জনের। আর সেসব সাক্ষাৎকার থেকেই অ্যান্ডারসন এমন ছয়জনের গল্প বেছে নিয়েছেন, যাদের কাহিনীর মধ্য দিয়ে সংক্ষেপে আরব বিশ্বের বর্তমানে পরিস্থিতির একটি প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র ফুটিয়ে তোলা যায়।
তবে একইসাথে এটিকে নেতিবাচকভাবেও দেখা যায়, যেহেতু অত্যন্ত জটিল রাজনৈতিক সঙ্কটকে এখানে মাত্র ছয়টি কাহিনীর মধ্যে সরলীকরণ করে দেখানো হয়েছে। এছাড়াও বইটির আরেকটি ত্রুটি হচ্ছে, এখানে গল্পগুলো চরিত্র অনুযায়ী এগোয়নি, সময় অনুযায়ী এগিয়েছে। চরিত্রগুলো যদি পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত হতো, তাহলে এটি অর্থবহ হতো। কিন্তু তা না হওয়ায় কিছুক্ষণ পর পর এক চরিত্রের কাহিনী থেকে অন্য চরিত্রের কাহিনীতে চলে যাওয়ার কারণে পড়তে একটু কষ্ট হয়।
বইটি আকারে খুব বেশি বড় না, মাত্র ২৪০ পৃষ্ঠা। এত অল্প পরিসরের একটি বই থেকে আরব বিশ্বের সংকট সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানার আশা করা যায় না। যারা নিয়মিত পত্রপত্রিকায় মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাপ্রবাহ অনুসরণ করেন, ছয়টি গল্প জানার বাইরে তাদের এ বই থেকে নতুন কিছু শেখার নেই। কিন্তু যারা এ বিষয়ে তেমন কিছু জানেন না, তারা সংক্ষেপে মোটামুটি একটি ধারণা পাওয়ার জন্য বইটি পড়তে পারেন। বই আকারে প্রকাশিত হওয়ার আগে এটি নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনের সম্পূর্ণ একটি সংখ্যা জুড়ে প্রকাশিত হয়েছিল। কাজেই বইটি কেনার প্রয়োজন নেই, অনলাইনেই নিউ ইয়র্ক টাইমসের ওয়েবসাইটের এই লিঙ্ক থেকে সম্পূর্ণ বইটি বিনামূল্যে পড়া যাবে।