‘ম্যান বাইটস ডগ’ তার বীভৎস, অন্ধকার জগতে দর্শককে টেনে নিতে বেশি সময় ব্যয় করেনি। বলা যায়, প্রারম্ভিক দৃশ্য থেকেই সেই কাজটি করেছে। এই দৃশ্যে দেখা যায়, ট্রেনের কামরার বাইরে সরু গলিটায় দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক। নারীটি বাথরুমে যাবে বলেই এসেছিল। যুবক খুব বিনীতভাবেই সরে জায়গা দিল। কিন্তু সে এগোতেই পেছন থেকে তার বা রশি কিছু একটা দিয়ে, গলা প্রচণ্ড শক্তিতে পেঁচিয়ে ধরে। ওই অবস্থাতেই টেনে পাশের কামরাটায় নিয়ে যায়। নারীটি শ্বাস নেওয়ার জন্য হাসফাঁস করতে থাকে বিরতিহীনভাবে। কিন্তু গলার ফাঁস তাতে আরো শক্ত হয়। হাত-পা ছোঁড়া পুরোপুরি বন্ধ করা অব্দি ফাঁস আর হালকা হয় না। কেন এই খুন? কোনো কারণ ছাড়া।
পরের দৃশ্যটা সিনেমার এই অদ্ভুতুড়ে প্রকৃতিকে আরো জটিল করেছে। সেই নারীর লাশটাকে একটা বস্তাবন্দী করেছে ওই যুবক। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলছে; কমবয়সী কিংবা মধ্যবয়স্ক কোন লাশ হলে, ব্যাগে লাশের ওজনের তিনগুণ ওজনের পাথর বা কিছু দিতে হবে, লাশটা পানির নিচে ডুবে থাকার জন্য। বয়স্ক কিংবা শিশু হলে পাঁচগুণ। আবার বামন হলে সেক্ষেত্রে দ্বিগুণ। কারণ উচ্চতা কম হওয়ার কারণে তাদের দেহের হাড়গুলোর ভার বেশি। এমনভাবে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে এসব ব্যাখ্যা করছে, যেন কেউ এসব বিষয়ে তার কাছ থেকে দীক্ষা নিতে এসেছে আর সে গর্ব করে মাস্টারি ফলাচ্ছে। আবার পরক্ষণে মনে হয়, ফোর্থ ওয়াল ব্রেক করে সরাসরি দর্শককেই বলছে এসব। কিন্তু না, তৃতীয় দৃশ্যেই জানতে পারা যায়, তিন-চারজনের একটা নবিশ ফিল্মমেকার দল তার উপর একটা ডকুমেন্টারি বানাচ্ছে!
সে যে সাইকো, সে ব্যাপারে তো সন্দেহ প্রথম দুই দৃশ্যের পর থাকার কথা নয়। বেলজিয়ামের অন্ধকার অলিগলি ধরে, কখনো ঘরে ঢুকে, কখনো নির্জন রাস্তায় দুর্বলকে; সে তার শিকার বানায়। নাম বেনোয়া। তার মা, দাদীর কাছে তো সে সভ্য, শান্ত ছেলেটা। কারো গায়ে হাত তুলবে, এটা তারা দুঃস্বপ্নেও বিশ্বাস করবে না। বেনোয়ার বন্ধুবান্ধবও আছে। বেনোয়া সিরিয়াল কিলার জানার পরও, তারা বন্ধু! উল্টো বলে, ও ওর মতো কাজ করছে। আমাদের তো ক্ষতি করছে না! এরপর বেনোয়া একের পর এক লাশ জমাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। খুনের ক্ষেত্রে তার নিজস্ব থিওরি আছে। কখনো সে খুন করে কারো যন্ত্রণা একেবারেই দূর করে দিতে। কখনোবা পুঁজিবাদের বিরোধী হয়ে। কখনো স্রেফ ঝোঁকের বশে। খুনের ক্ষেত্রে লিঙ্গ, বয়স, ধর্ম, বর্ণ এসব নিয়ে সে কোনো বাছবিচার করে না। তবে গোটা আবহটা আর হাস্যরসে ভরা বিদ্রূপ হিসেবে রইল না। ধীরে ধীরে তার খুনের তরিকা আরো বেশি বীভৎস হয়ে উঠল।
সেইসাথে তার উপর ডকুমেন্টারি বানানো এই ফিল্মমেকার দলও খুনে করায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া শুরু করল। একটা ঘরে ঢুকে যৌনমিলনে লিপ্ত দম্পতিকে তারা হেনস্তা করল। স্বামীর মাথায় পিস্তলের নল ঠেকিয়ে, তার সামনেই তার স্ত্রীর উপর একে একে তারা সবাই চড়াও হলো। তারপর খুব নৃশংসভাবে তাদের হত্যা করলো। পুরনো কারখানায় ঢুকে অন্য আরেক পক্ষের উপর অহেতুক চড়াও বেনোয়া আর তার ফিল্মমেকার দল। গোলাগুলিতে ফিল্মমেকার দলের একজন মারা পড়ে। ওদিকে অজান্তে তারা খুন করে ফেলে ইতালিয়ান এক মাফিয়ার ছোটভাইকে। পরিস্থতি এবার হয়ে ওঠে আরো তমসাচ্ছন্ন। ভায়োলেন্সটা আর মজার রইল না। তার চরমতম নির্মম আর ভয়াল রূপেই সামনে এল।
‘ম্যান বাইটস ডগ’ (১৯৯২) একটি মকুমেন্টারি সিনেমা। মকুমেন্টারি নিয়ে স্বল্প এবং সহজ কথায় বলতে হয়, একটা ফিকশনাল গল্পকে ডকুমেন্টারির মতো করে উপস্থাপন করা। এবং মকুমেন্টারির অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকতে হবে। তা হলো, মকুমেন্টারি সমাজের কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর ব্যঙ্গাত্মক বা বিদ্রূপাত্মক বক্তব্য রাখে। এই জায়গাটায় এসেই, মকুমেন্টারি, স্যুডো-ডকুমেন্টারি থেকে একটু ভিন্ন। কারণ স্যুডো-ডকুমেন্টারি ফিকশনাল ডকুমেন্টারি হলেও, ওভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের তেমন কোনো দায় তার নেই। তো ‘ম্যান বাইটস ডগ’ বক্তব্য রাখে ভায়োলেন্সের প্রতি মানুষের এবং গণমাধ্যমের তীব্র আকর্ষণ নিয়ে। ভায়োলেন্সের প্রতি সাধারণ মানুষের তীব্র আকর্ষণটা বর্তমান সময়ে আরো নগ্নভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। মানুষের ভেতরে তো একটা পশুত্ব লুকিয়ে আছেই। গণমাধ্যম কি সেটাকে আরো সাধারণীকরণের পথে ঠেলে দিচ্ছে না?
এখনকার সিনেমা-সিরিজের দুনিয়ায় ঢুকলে দেখা যাবে ভায়োলেন্ট কনটেন্টের একচেটিয়া আধিপত্য। এ যে মানুষের ভেতরের সেই অন্ধকারেরই বহিঃপ্রকাশ। তার ভেতরে যে পশুটা লুকিয়ে আছে, স্রেফ সভ্যতার জন্য বেরিয়ে আসছে না বলেই শৃঙ্খলা ছিল, ধীরে ধীরে এসব কনটেন্ট তার খাবার হয়ে পড়ছে। মস্তিষ্ককে খাওয়াচ্ছে সে। ভায়োলেন্সের প্রতি আকর্ষণ দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। মনোবিজ্ঞানীরা এসবের প্রভাব খতিয়ে দেখছেন এখন আরো গুরুত্বসহকারে, যে চিত্র এই সিনেমা ১৯ বছর আগেই দেখিয়েছে। গণমাধ্যম যে এসব ঘটনা জনগণের সামনে আনছে, তারাও কি ধীরে ধীরে এই ভায়োলেন্সের সাথে আরো সংযুক্ত হচ্ছে না? পরোক্ষ অংশগ্রহণকারী হচ্ছে না? সেই ‘হ্যাঁবোধক’ উত্তরটাই এই সিনেমা দেখায়।
বেনোয়ার সিরিয়াল কিলিংকে ডকুমেন্টেশন করতে গিয়ে ধীরে ধীরে এই ফিল্মমেকার দলও সরাসরি অপরাধে অংশগ্রহণ করে। গণমাধ্যমের এমন অংশগ্রহণ নিয়ে তো বছর কয়েক আগে ‘নাইটক্রলার’ (২০১৪) নামে এক অনবদ্য নির্মাণের দেখা মিলেছিল। মিডিয়ার এই আগ্রাসনের পাশাপাশি, সেসব দেখে মানুষের তা নিয়ে কথা বলা, টিআরপি বাড়ানোর যে চর্চা, আরো দেখতে চাওয়ার বাসনা; সেটা তো মানুষের ‘ভয়ারিস্টিক’ আচরণের দিকটাকেই প্রকাশ করে, যা এই সিনেমা উপস্থাপন করে।
‘ম্যান বাইটস ডগ’ শুধু ভায়োলেন্স নিয়ে মানুষের আকর্ষণকেই নয়, বরং টিভির রিয়েলিটি শো’র বিষয়টাকে ব্যঙ্গ করে। ৯০ দশকে ইউরোপ, আমেরিকায় এই রিয়েলিটি টিভি তো একটা ‘ফেনোমেনা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ‘দ্য ট্রুম্যান শো’র মতো গ্রেট সিনেমা যে বিষয়ে আলাপ করেছে, ‘ম্যান বাইটস ডগ’ সেটাকে এক চরম অস্বস্তিদায়ক, অন্ধকারাচ্ছন্ন রূপ দিয়েছে। এই ধারাতেই আবার অলিভার স্টোন নির্মাণ করেছিলেন ‘ন্যাচারাল বর্ন কিলার্স’ (১৯৯৪)। ব্যঙ্গবিদ্রূপ রেখেছিলেন। তবে ভায়োলেন্সের দিকে, এই সিনেমার মতো এতটা চরমে যাননি। আবার রন হাওয়ার্ডের ‘এডটিভি’ও রিয়েলিটি শো’র ফেনোমেনা নিয়ে বিদ্রূপাত্মক হিউমার রেখেছিল।
এই সিনেমা অবশ্য সিরিয়াল কিলারের মনস্তত্ত্ব নিয়ে বিশ্লেষণের দিকে যায়নি। সমাজে ভায়োলেন্সের আগ্রাসন, তা নিয়ে মানুষের আকর্ষণ, বাস্তবের সিরিয়াল কিলারদের নিয়ে মানুষের চর্চা; যা মানুষের স্বাভাবিক একটা বিকৃতিকেই উপস্থাপন করে, রিয়েলিটি শো’র মাধ্যমে ভয়ারিজমের চর্চা করা- এসবকেই ব্যঙ্গ আর বিদ্রূপে দেখিয়েছে শুধু।
তবে বিস্মিত হতে হয়, এই সিনেমার সাহস দেখে, অবাধ্য হওয়ার ক্ষমতা থেকে। ভায়োলেন্সকে গ্রাফিক করে তোলা নিয়েই বলা হোক, আর সমাজ ও তার মানুষের একটা বিকৃত আকর্ষণকে বিদ্রূপের সাথে তিরস্কারের কথাই বলা হোক; দুই জায়গাতেই অবাক করে এই সিনেমার সাহস, অবাধ্যতা। ইচ্ছেমতো ‘ওভার দ্য টপ’ হয়েছে। কোন ‘এক্সট্রিম’কেই আমলে নেয়নি। একদম শুরু থেকেই ব্ল্যাক কমেডির টোন ধরে রেখেছিল, যার কারণে একটার পর একটা লাশ পড়তে দেখেও দর্শক হেসেছে। কিন্তু তৃতীয় অঙ্কে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সেই হাস্যরসটা ছিনিয়ে নিয়ে পুরোপুরি জান্তব হররের দিকে ভিড়েছে।
অস্বস্তিদায়ক ভায়োলেন্স দেখিয়ে, দর্শকের মুখের হাসি উড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে বা সোজা কথায় দর্শককে ‘মক’ করার মাধ্যমেই এই সিনেমা নিজের বাঁকানো উপায়ে হাস্যরস দেওয়ার জায়গাটাকেই আবার নতুন করে কেন্দ্রে এনেছে। একটা পরিত্যক্ত ভবনে ঢুকে গোলাগুলির ওই দৃশ্যটার কথাই ধরা যাক। বেনোয়া আর তার ফিল্মমেকার দল কয়েকজনকে খুন করার পর সামনে এগোতেই দেখতে পায়, ক্যামেরাসমেত আরেকটা দলকে। দ্বিতীয় দলটা এই লাশগুলোর উপর ডকুমেন্টারি বানাচ্ছে। এই দৃশ্যটাই সিনেমার অদ্ভুত প্রকৃতি আর খুবই বাঁকানো এবং ডার্ক হিউমারটাকে প্রদর্শন করে।
‘ম্যান বাইটস ডগ’ যে খুবই স্বল্প বাজেট কিংবা নো বাজেটে তৈরি, তা অবশ্য এর প্রোডাকশন দেখলেই বোঝা যায়। সিনেমার ওই ফিল্মমেকারের দলই এই সিনেমার সত্যিকারের ফিল্মমেকারেরা। রেমি ভেলভক্স, আন্দ্রে বোঁজেল, বেনোয়া পোলভুর্দে। হ্যাঁ, সিনেমার সিরিয়াল কিলার চরিত্রে অভিনয় করা বেনোয়াও তিন ফিল্মমেকারের একজন। বাজেট না থাকায় সম্পাদনা, সিনেমাটোগ্রাফি, অভিনয় সবকিছু নিজেদেরই করতে হয়েছে। এবং বলাই বাহুল্য যে, তা তাদের নৈপুণ্যই প্রদর্শন করেছে।
বর্ণবাদী, বৈষ্যম্যবাদী সিরিয়াল কিলারের এই চরিত্রে বেনোয়ার অভিনয় ত্রুটিহীন। চরিত্রটাকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে ফেলেছেন রীতিমতো, যার কারণে এই সিরিয়াল কিলার চরিত্রটার একটা প্রোটোটাইপই হয়ে গেছেন। সিনেমার মিথ্যা ডকুমেন্টারির একটা আদর্শ সাবজেক্ট হিসেবেই তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। একইসাথে একটা কমনীয়তাও তার চেহারায় আর বাচিক অভিনয়ে কাজ করে, যা নৃশংসভাবে খুন করার সময় তার চেহারায় একটা বৈপরীত্য এনে তার উপস্থিতিকে আরো অস্বস্তিজনক অবস্থায় নিয়ে গেছে শিকারের সামনে।
পাশাপাশি তার নিজস্ব দার্শনিক চিন্তাও আছে। চরিত্রটা কবিতা পাঠ করে, পিয়ানো বাজাতে পারে। আবার হাসিমুখে চুরির নানান কলাকৌশলও সাক্ষাৎ আগন্তুকের সাথে অনায়াসে বলতে পারে। তারপর একটা হাসি দিয়ে হুট করে সে যখন খুনি হয়ে ওঠে, পরিবর্তনটা এত সূক্ষ্ম আর ত্বরিত যে, সামনের জনের মুখটা ‘হাঁ’ করা অবস্থাতেই থেকে যায়।
গোটা সিনেমাটা সাদাকালোতেই শ্যুট করা হয়েছে, যাতে করে ডকুমেন্টারির মেজাজটা আরো ভালোভাবে ধরা যায়। এবং সাথে ইমেজারিগুলোতে ‘গ্রেইনি লুক’ আনা হয়েছে। ইমেজারিগুলোকে নোংরা বাস্তবতায় চুবিয়ে আরো প্রগাঢ়ভাবে বাস্তবিক করে তুলতে এই গ্রেইন ইফেক্ট ব্যবহার করা হয়েছে। সাদাকালোর টোনটাকে আরো ডার্ক করার পাশাপাশি কম্পোজিশনকেও আরো নিখুঁত করেছে এই ইফেক্ট। তবে প্রয়োজনের চেয়ে খানিকটা দীর্ঘ হয়েছে। দ্বিতীয় অঙ্কের মাঝামাঝি কিছুটা ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছিল দেখার অভিজ্ঞতা, যদিও গতিটা শীঘ্রই আবার আগের অবস্থায় এসেছে তৃতীয় অঙ্কে প্রবেশের মুখে। সম্পাদনায় কাঁচি চালিয়ে সিনেমার প্রভাবটাকে মাঝের অংশে ভোঁতা হতে না দিয়ে, গোটা সময়ই অভিঘাতী করার সুযোগ ছিল।
শেষত; ‘কাল্ট’ স্ট্যাটাস প্রাপ্ত ‘ম্যান বাইটস ডগ’ প্রকৃতার্থেই ভীষণরকম মৌলিক, প্রচণ্ড সাহসী, বুদ্ধিদীপ্ত এবং বেপরোয়া একটা কাজ। তুমুল অস্বস্তিতেও সরিয়ে রাখা যায় না। সাক্ষাৎ, ‘পিস অভ আর্ট’ বলতে হয়! ভায়োলেন্সের মধ্য দিয়েই যেন তা শৈল্পিকতা ছুঁয়েছে। এটি প্রশ্ন তুলেছে, বিদ্রূপ করেছে, বাস্তবতায় প্রোথিত নৃশংসতাকে দেখিয়েছে এবং নোংরা দাঁতের হাসির উপর একটা শিক্ষাও ছুঁড়ে মেরেছে। এই আর্টের বিমূর্ততাকে গ্রহণ করাটা সহজ নয়, আবার বর্জন করাটাও অযৌক্তিক।