প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় ১৯১৮ সালে। এরপর আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় ১৯৩৯ সালে। মাঝের ২১ বছর ছিল টানপোড়েনের সময়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা কোনোমতে মানুষ কাটিয়ে উঠছে, নিজেদের সংসার সাজিয়ে নিচ্ছে, তখনও হয়তো কারো ধারণাতেই নেই আর কিছুদিন পরেই ঘটতে চলছে মানব ইতিহাসের অন্যতম অমানবিক সব ঘটনা। ধ্বংসস্তূপ থেকে পুনর্গঠনের সময়েই জন্ম কথাসাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের, ১৯৩৩ সালে, অবিভক্ত ভারতের খুলনায়। পিতা মতিলাল ও মা কিরণবালার সংসারের তৃতীয় পুত্র তিনি। কথাসাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী হলো ‘জীবন রহস্য’।
বর্তমানে বাজারে বইটির যে সংস্করণ সহজলভ্য সেটা প্রকাশিত হয়েছে, ভারতের মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স থেকে। ২৩১ পৃষ্ঠার বইটির প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হয়েছে লেখকের পোর্ট্রেট। ক্রিমরঙ্গা কাগজে ছাপা ও শক্ত-পোক্ত বাধাইয়ের বইটি ওজনেও অনেক হালকা। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স বরাবরই তাদের প্রুফ রিডিং ও বইয়ের প্রোডাকশন নিয়ে অনেক সতর্ক। এই বইটিও তার ব্যতিক্রম নয়। পুরো বইয়ে কোনো বানান ভুল বা ছাপার অসঙ্গতি চোখে পড়েনি। তবে ভারত থেকে প্রকাশিত হওয়ায় বাংলাদেশে বইটির দাম একটু বাড়তির দিকে। বাংলাদেশের কাগজ প্রকাশনী থেকে প্রথমে নতুন এক অধ্যায় সংযোজন করে এই একই বই প্রকাশ করা হয়েছে ‘এ জীবনের যত মধুর ভুলগুলি’ নামে।
অন্যান্য আত্মজীবনীর মতো এই বইয়ে জন্ম থেকে শুরু করে পরিবারের বর্ণনা, বেড়ে ওঠা, কর্মজীবনের বিবরণ ইত্যাদি গৎবাঁধা রাস্তায় হাঁটা হয়নি। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় অনেকটা গল্প শোনানোর মতো করে তার জীবনের পরত একে একে উন্মোচন করেছেন। আবার জীবনের গল্প বলার ফাঁকে, কখনো কখনো তার লেখালেখি নিয়ে বা জীবন নিয়ে তার যে ভাবনা, জীবনের বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ, তার জীবন-দর্শন নিয়েও আলোচনা করেছেন। ফলে আমরা যত বইয়ের পাতা ধরে এগোতে থাকি, ব্যক্তি শ্যামলের সাথে তত গভীরভাবে পরিচিত হতে থাকি, একইসাথে তার জীবনবোধ সম্বন্ধেও সম্যক ধারণা লাভ করি। মূলত, এই বই পড়ার পরে পাঠক বুঝতে পারবেন যে ব্যক্তি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় আর লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে আসলে কোনো বিভেদ নেই।
বইটি পড়ার সময়ে আরেকটা জিনিস পাঠকের গোচরীভূত হবে, সেটা হচ্ছে লেখকের ভাষা। ছোট ছোট বাক্যে, বৈঠকী চালে লেখক তার কথা বলে গিয়েছেন। কিন্তু ভালোমতো লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় প্রতিটি বাক্যে, প্রতিটি শব্দে কী গভীর জীবনবোধ মিশে আছে! শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তার নিজের ভাষা নিয়ে বলেছেন,
“জীবন থেকে, আশপাশের মানুষের ভিতর থেকেই লেখার বীজ পাই। সে বীজ নানান অভিজ্ঞতা- কল্পনা- স্বপ্নের আলোয় অঙ্কুরিত হয়। গল্পের পা থাকে তাই জীবনের মাটিতেই। অভিজ্ঞতা, কল্পনা, স্বপ্ন- এই ত্রি-শিরার কিশলয়ে ভাষালক্ষ্মীর বারিধারা নিয়ে আমি কোনওদিন ভাবিনি। মাথা ঘামাইনি।কারণ ভাষা আমার কাছে মনের ভিতরকার অস্ফুট, অসম্পূর্ণ স্বগতোক্তির মতোই। যা কিনা মনে মনে আপনা আপনি ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। তাই আমি একটা একটা করে তুলে এনে কাগজে বসিয়ে দিই। আশ্চর্যবোধের পাশে সম্পূর্ণ বাক্য।“
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
এই কারণেই শ্যামলবাবুর ভাষা এক প্রাকৃতিক প্রাঞ্জলতা লাভ করেছে, ফলে তার লেখার বিষয়বস্তু যতই গভীর হোক না কেন, লেখার ভেতরে প্রবেশ করতে পাঠককে বিন্দুমাত্র কষ্ট করতে হয় না।
‘জীবন রহস্য’ বইয়ে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় নিজের কথা বলেছেন, নিজের জীবন ও জীবনের সাথে জড়িত সবার কথাই কমবেশি বলেছেন; মানে আত্মজীবনীতে মানুষ যা করে আর কী। তবে প্রশ্ন হচ্ছে- কেন এই আত্মজীবনী অন্যগুলোর থেকে আলাদা? কেন এটা পড়তে হবে?
বাংলা কথাসাহিত্যে জাদুবাস্তবতা যতটা স্বপ্রতিভভাবে শ্যামল গাঙ্গুলীর লেখায় এসেছে আর কারো লেখায় তেমন স্বতস্ফুর্তভাবে ভাবে আসেনি। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় যখন লেখা শুরু করেছেন, তখন মার্কেজের বাংলা অনুবাদ তো দূরের কথা, ইংরেজি ভাষান্তরও একদমই দুর্লভ। শ্যামল বলতে গেলে তেমন পড়ুয়াও ছিলেন না, তাহলে তার লেখায় এমন সাবলীল ম্যাজিক রিয়ালিজম উৎসারিত হলো কীভাবে?
উত্তর হচ্ছে- শ্যামলবাবুর জীবন। তিনি জীবনের প্রতি মোড়ে মোড়ে এমন সব ঘটনা বা দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন যে তার জীবনটাই আস্ত মার্কেজের উপন্যাস হয়ে গেছে। একদম কাঁচা কৈশোরে দুর্ঘটনাক্রমে শুয়েছেন বারবণীতার সাথে; সেই খবর পরিবারে, পাড়ায় চাউড় হলে উপেক্ষিত, একঘরে হয়েছেন সবার থেকে। বন্ধুরা দেখলে পালিয়ে গেছে, বন্ধুর বাসায় গেলে বন্ধুর মা মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। তার পুরো কৈশোর কেটেছে একধরনের হীনম্মন্যতায়, পারিপার্শ্বিকতার সাথে মানিয়ে নিতে, নিজের জগত নিজেকেই তৈরি করে নিতে হয়েছে।
প্রথম যৌবনে স্বৈরিণী প্রাক্তনের প্রভাবে নিজেদেরই সহপাঠী-বন্ধুর দ্বারা নিগৃহীত হয়েছেন, ন্যাড়া হতে হয়েছে। সেই অপমানে বাড়ি থেকে পালিয়ে অন্যের বাসায় চাকরগিরি করেছেন, সেখান থেকেও পালিয়ে সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় গিয়ে ফিল্মের সুপারস্টারের ভড়ং ধরার সুযোগও ছাড়েননি। এই সব ঘটনা শ্যামলবাবুর জীবনের টিপ অব দ্য আইসবার্গ মাত্র।
আত্মস্মৃতি নাকি আত্মোপলব্ধি বলা মুশকিল! যেন ছোট্ট স্ক্রিনে নিজের জীবনের টেস্ট ম্যাচ দেখতে দেখতে রানিং কমেন্ট্রি করছেন, বিশ্লেষণ করছেন অভিজ্ঞ ধারাভাষ্যকার। কখনো নিজের কথা বলতে বলতে তিনি সম্পূর্ণ অন্য জগৎ সৃষ্টি করে ফেলেছেন, বুনে ফেলেছেন জাদুবাস্তব এক জগৎ। জীবনের প্রতি পরতে তিনি চারপাশকে, নিজেকে, সম্পর্কগুলো আবিষ্কার করেছেন নতুন করে। জীবন এক আশ্চর্য জাদুর প্রদীপ হয়ে ধরা দিয়েছে তার হাতে। তাই হয়তো জাদুবাস্তবতা তার লেখায় আসে প্রকৃতিগতভাবেই। যেটা শহীদুল জহির, মানিককে আনতে হয় অনেক কায়দা করে তবুও তাতে মার্কেজের গন্ধ লেগে থাকে, মনে হয় ল্যাটিন কোনো গাছ বাংলাদেশের মাটিতে এনে জোর করে পুতে দেওয়ায় সেটি হাসফাস করছে।
“লেখার উদ্দেশ্য একটিই। তা হল উন্মোচন। অনুসন্ধানের পথে পথে এই উন্মোচন। বিনা মন্তব্যে সরল বাক্য সাজিয়ে এগিয়ে যাওয়াই আমার পদ্ধতি। আমি বলতে চাই সবচেয়ে কম। আর চাই—আমার না-বলাটুকু পাঠকের মনে ক্রমিক পুনঃ-সৃষ্টি হতে থাকুক। সে-ই পথ খুঁজে পাক।“
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
শ্যামলবাবু তার কথা রেখেছেন; তিনি উন্মোচিত করেছেন তার জীবনকে, জীবনবোধকে। তিনি তার জীবন নিয়ে যতটা না বলেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি পাঠকদের বুঝিয়ে দিয়েছেন ওই না-বলা দিয়েই। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় লেখা পড়া সবসময়ই অনন্য এক অভিজ্ঞতা। প্রতিথযশা এই কথাসাহিত্যিক মৃত্যুবরণ করেন ২০০১ সালে। তার আত্মজীবনী, এই জনরায় বাংলা ভাষার অনন্য এক মাইলফলক হিসেবেই উদ্ধৃত থাকবে।