কালো বরফ: দেশভাগের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিসত্তার ভাঙা-গড়ার আখ্যান

আধুনিক বাংলা মননশীল উপন্যাসের ধারায় মাহমুদুল হক নিঃসন্দেহে এক বড় নাম, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি রয়ে গেছেন পাদপ্রদীপের আড়ালে। তদুপরি তার সাহিত্য আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে বিশেষ সম্পদ বিশেষ। দেশভাগের প্রেক্ষাপটে লিখিত উপন্যাস ‘কালো বরফ’ সেই ভাণ্ডারের এক উল্লেখযোগ্য রত্ন।

বইয়ের প্রচ্ছদ, image courtesy : goodreads

কালো বরফ এক বিষণ্ণতার আখ্যান, ঐতিহাসিক পটভূমিতে ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব-মর্মবেদনার আখ্যান। উপন্যাসকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। উত্তম পুরুষে করা শৈশব স্মৃতিচারণ আর তৃতীয় পুরুষে লেখা বর্তমান, যে বর্ণনারীতির সাদৃশ্য আমরা পাই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ‘দূরবীন’ উপন্যাসে।

উপন্যাসের মূল প্রটাগনিস্ট আত্মভোলা অধ্যাপক আবদুল খালেক, ওরফে পোকা। প্রথমে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় দেশ-কাল-পাত্রের ভেদহীন, সর্বকালের সার্বজনীন শৈশব-আবেগানুভূতির মধ্যে, যে সময়ে তার জীবনে সাদা-কালোর কোনো ভেদ ছিলো না, সবটাই ছিল দারুণ রঙদার। বাবা, মা, মনি ভাইজান, টিপু ভাইজান, রানিবুবু, পুঁটি,  কেনারাম কাকা, ছবিদি’রা ছোট্ট পোকাকে অবিরত সুখস্বপ্ন দেখিয়ে যায়, তার ছোট্ট জগতে তারা একেকজন অধীশ্বর হয়ে ওঠে, নিজেদের অজান্তেই। সেই জগতের বর্ণনা দিতে গিয়ে কথাকার মাহমুদুল হক বিছিয়ে দেন তার জাদুকরী কুহকের জাল, যার প্রত্যেক ফোঁড় অভেদ্য হয়ে থাকে মানুষী মায়ায়,

যা কিছু নিঃশব্দ, যা কিছু শব্দময়, যা কিছু দৃশ্যগোচর, দৃশ্যাতীত, সবকিছুই একজোট হয়ে হাত ধরাধরি করে ঘিরে ধরে; অদ্ভুত এক বাজনার তালে তালে আস্ত একটি রাত মোমের মতো গলে পড়ে, জিনজার-হিনজার, জিনজার-গিনজার, জিনজার-হিনজার—পোকা শোনে,শুনতে পায়। পোকা পোকা হয়ে যায়।

লেখক নিজেই ভাঙেন এই মায়াজাল, যেমন এক জাদুকর স্বভাবসুলভ দর্পপ্রতিষ্ঠার জন্যেই জাগিয়ে তুলে চমকে দেন তার সম্মোহিত দর্শককে। ভাবালুতা আকাশ থেকে এক লহমায় তিনি মাটিতে নামিয়ে আনেন পাঠককে, আবদুল খালেককে সাক্ষী করে দাঁড় করান বাস্তবতার কর্কশ জমিনে। পোকা হয়ে ওঠে মনস্তাপে ভেঙে পড়া এক দুঃখবাদী-বিষণ্ন মধ্যবয়স্ক স্বামী, যাকে নিয়ে তার স্ত্রী নিদারুণ চিন্তাকাতর, কাতর জীবনযন্ত্রণায়। সাংসারিক জীবনের বৈষয়িক হিসাব-নিকাশে তিনি বড্ড আনাড়ি, অন্তর্দহনের উত্তাপে পেশাগত দায়িত্ব ছাড়া প্রাত্যহিকতার প্রতি তার চরম নির্লিপ্ততা। অহর্নিশ তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় তার দেশভাগপূর্ব মায়াজড়ানো শৈশব আর তখনকার প্রিয় মানুষগুলোর স্মৃতি।

দেশভাগের পর ‘মনুমেন্টের মতো মাথা তুলে দাঁড়ানো বিভেদ-অবিশ্বাস-মারদাঙ্গা ভাবকে তিনি মেলাতে পারেন না তার স্মৃতিকোষে গেঁথে থাকা সেই ‘ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড়ে’র সাথে। দারিদ্র্য—দহন, বাস্তবতার কষাঘাত, প্রবহমান সমাজের জটিলতার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে না পারার যন্ত্রণার আড়াল তিনি খুঁজে নেন সোনারকাঠি-রুপারকাঠিতে মোড়ানো তার সেই স্বর্ণোজ্জ্বল শৈশবে, নিজেকে তখন মুক্ত বিহঙ্গ ভাবেন, খুঁজে পান অন্য আরেক জগত।

লেখক মাহমুদুল হক, image courtesy : bd-pratidin.com

বইয়ের শুরুতে উল্লেখ আছে, ১৯৭৭ সালের ২১-৩০ আগস্ট মাহমুদুল হক রচনা করেন ‘কালো বরফ’ উপন্যাসটি, কিন্তু এর প্রকাশকাল অনেক পরে—১৯৯২ সালে। মাত্র দশ দিনে লেখা হলেও হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’র মতো এ আখ্যানের প্রেরণা লেখকের আত্মজীবন থেকে উদ্‌গত। সাতচল্লিশে ধর্মের দোহাই দিয়ে জন্ম হয় অদ্যপি বৈরীভাবাপন্ন ভারত আর পাকিস্তানের। দেশবিভাগের তরঙ্গঘাত অন্য অনেকের মতোই বিধ্বস্ত করে লেখকের পরিবারকেও। ১৯৫১ সালে স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে উত্তর—চব্বিশ পরগনা থেকে তার পুরো পরিবার চলে আসে ঢাকায়। নিজের ছিন্ন অতীত, শূন্যে ঝুলে থাকার যন্ত্রণা, বেগ-আবেগ সঞ্চয় করে মাহমুদুল হক লেখেন বাহুল্যহীন-মেদহীন ঝরঝরে এবং তার নিজের ভাষাতেই ‘কমপ্যাক্ট’ উপন্যাস ‘কালো বরফ’।

দেশভাগভিত্তিক উপন্যাস, গল্প, চিত্রনাট্যের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। দেশভাগের নানামাত্রিক বিশ্লেষণ সেখানে পাওয়া যায়। ‘কালো বরফ’ উপন্যাসের অনন্যতা এখানেই যে, অন্যান্য সকল উপন্যাসে উঠে আসা দেশভাগের আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক সলুক সন্ধান এখানে মুখ্য হয়ে ওঠেনি, বরং অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে এসেছে ক্ষুদ্র, তবে শৈল্পিক বয়ানে বৃহৎ হয়ে ওঠা ব্যক্তিসত্তার মেটামরফোসিস।

গতানুগতিক রাজনৈতিক মানদণ্ডে সামষ্টিক জীবনের ক্ষয়ক্ষতির চেয়ে সামষ্টিকতার চাপে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া ব্যক্তির অন্তর্চৈতন্যই লেখকের শিল্পীমানসে বড় অভিঘাত রেখেছে। তার অভীষ্ট শেকড়হারা-বাস্তুছাড়া-শৈশবের জীবনহারা মানুষেরা, যাদের কেউ কেউ অনিকেত বোধে আক্রান্ত হয়ে বয়ে বেড়ায় গভীর অসুখের অস্থিরতাকে। আর তাই আমরা দেখি আবদুল খালেককে, কখনো খুঁজে ফেরেন শৈশবের গিরিবালাকে, কখনো বা মাধুকে। ভারতবর্ষের মতো যেন ছিন্ন হয়ে যায় আবদুল খালেকের অন্তর্সত্তাও- একদিকে পোকা, যে কিনা মায়ের আদর-বকুনি, মনি ভাইয়ের দুরন্তপনা, করুণা দিদিমণির স্নেহমাখা করুণা, ছবি’দি আর রানিবুবুর ভালোবাসার কাঙাল; আরেকদিকে বয়সী অধ্যাপক আবদুল খালেক- চিরজীবন শূন্য খোঁজা, নৈরাশ্যবাদী, জীবনের ভারে ন্যূব্জ এক নিঃসঙ্গ দ্বীপচারী।

জীবনরহস্যের এ জটিল দৃশ্যায়ন দেখতে দেখতে উপলব্ধি হয়- সত্যিই জীবন কতোটা জটিল! ব্যক্তিহৃদয়কে এভাবে চিড়ে দেখার উপোযোগী ভাষা, প্রচণ্ড সংক্রমণ-শক্তিসম্পন্ন প্রকাশভঙ্গি ‘কালো বরফ’কে পরিণত করে অসাধারণ মনস্তাত্ত্বিক এক উপাখ্যানে।

অসাধারণ মনস্তাত্ত্বিক এক আখ্যান, image courtesy : batighar, dhaka

আবদুল খালেকের ব্যক্তিজীবনের কাহিনী ছাড়াও উপপ্লটে ছবি’দির সাথে মনি ভাইয়ের কৈশোরিক প্রেম, অম্ল-মধুর সম্পর্ক, রানিবুবুর বেড়াল, পুঁটিদির গাছ আর মাছেদের সাথে কথা বলা উপন্যাসের গতিকে আকর্ষণীয় করেছে। দে‌শত্যাগ কালে ছবি’দি এবং মনি ভাইয়ের বিদায়মুহূর্ত, বিদায় মুহূর্তের চুম্বকবাক্য, “পাশে দাঁড়িয়ে মনিভাইজান, মনিভাইজানের জামার পকেটে একটা ফিতে, ফিতেয় চুলের গন্ধ, যে গন্ধে অনেক দুঃখ, যে দুঃখে অনেক ভালোবাসা, যে ভালোবাসায় অনেক ছেলেবেলা…” – এবং মনি ভাইয়ের শেষ পরিণতিতে বাকরুদ্ধ হয়ে যেতে হয় পাঠককে। মাহমুদুল হকের ঐন্দ্রজালিক লেখনীতে সেই বিদায়ের বিবর্ণ-বিষণ্ন সুর, নানা রঙের দিনগুলির স্মৃতি জমাট বাধে আবদুল খালেকের মস্তিষ্কের কোনো এক গোপন প্রকোষ্ঠে। রবি ঠাকুরের চেতনার রঙে যেমন পান্না হয়ে ওঠে সবুজ, চুনি রাঙা- মাহমুদুল হকের জীবনসেঁচা অভিজ্ঞতার পরশে সেই জমাট বরফ হয় ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, অপেক্ষায় থাকে পাঠকের মুগ্ধ উত্তাপের!

This Bengali article gives review of the book 'Kalo Borof' by Mahmudul Haque.

Featued image : meghchil.com

Related Articles

Exit mobile version