চোখের ইশারায় যে বই লিখেছিলেন জিন-ডমিনিক-বাউবি

১৯৯৬ সাল, জানুয়ারির শেষ কিংবা ফেব্রুয়ারির শুরু। উত্তর ফ্রান্সের ক্যালে শহরের কাছে বার্কের সমুদ্রতীরে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। সে বাতাসে জানালার সফেদ পর্দাগুলো অল্প অল্প কাঁপছে, কখনো আবার ছন্দে ছন্দে দুলছে। বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর অবশেষে চোখ মেলে চাইলেন জিন-ডমিনিক-বাউবি। এর আগে দু-তিনবার চেতনা এলেও প্রায় অচেতনের মতোই আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি, নইলে এতক্ষণে হয়তো জেনে যেতেন যে তিনি আছেন সাগরের কোল-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ন্যাভাল হাসপাতালের ১১৯ নম্বর রুমে।

চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে তার মনে হলো, বেশ কিছু ‘সাদা অ্যাপ্রোন’ তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, কী যেন বলতে চাইছে তারা। কিন্তু মাথাটা এমন ভারি লাগছে কেন? অবসন্ন শরীরটা কিছুতেই নাড়াতে পারছেন না তিনি। অনেককিছুই বলে চলেছেন, কিন্তু কেউ তার কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করছে না কেন?

পেছনের গল্প

সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল, সুদর্শন, উচ্চাভিলাষী, প্রাণোচ্ছল জিন-ডমিনিক-বাউবি ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, লেখক এবং সম্পাদক। পেশাজীবনের শুরুতে কাজ করেছিলেন ‘কম্ব্যাট’ আর ‘লা কুয়োশিডিয়েন দে প্যারিস’ নামক দু’টি পত্রিকায়। এরপর ২৮ বছর বয়সে ‘লা মাশিন দে প্যারিস’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হন। পরবর্তী সময়ে কাজ করেন ‘প্যারিস ম্যাচ’ পত্রিকায় এবং শেষ অবধি তিনি ছিলেন ফ্রান্সের বিখ্যাত ফ্যাশন ম্যাগাজিন ‘এলি’র প্রধান সম্পাদক।

জিন-ডিমিনিক-বাউবি; Image Source: Alchetron.com

১৯৯৫ সালের ৮ ডিসেম্বর, শুক্রবার। পুরো সপ্তাহ খাটাখাটুনির পর বাউবি ছুটে গিয়েছিলেন প্যারিস থেকে পঁচিশ মাইল দূরে প্রাক্তন প্রেমিকা সিলভির বাড়িতে, ছেলে থিওফিলের কাছে। পরিকল্পনা ছিল, ছেলের সাথে দিনটি কাটাবেন থিয়েটার দেখে আর কোনো পরিচিত রেস্তোরাঁয় বসে ওয়েস্টার খেয়ে। সেই জুলাই মাসের পর থেকে থিওফিলের সাথে প্রাণ খুলে সময় কাটানোই তো হয়ে ওঠেনি বাউবির। কারণ, দশ বছর এক ছাদের নিচে থাকার পরেও বাকি জীবনটা একসাথে কাটানোর জন্য নিজেদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করতে পারেননি তারা। মাঝখানে ছেলে থিওফিল আর মেয়ে সেলেস্টের জন্ম হয়। পরে বাউবি প্রণয়ের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন সাংবাদিক এবং এলি ম্যাগাজিনের অন্যতম সমালোচক ফ্লোরেন্সের সঙ্গে, সিলভিও বেছে নেন অন্য একজনকে।

সেদিন থিওফিলকে সাথে নিয়ে নতুন কেনা বিএমডব্লিউ-তে চড়ে সবেমাত্র বেরিয়েছেন বাউবি। কিছু দূর যেতেই মনে হলো কেমন যেন অস্থির লাগছে, প্রচণ্ড ঘামছেন, সেইসাথে পাশ দিয়ে অতিক্রম করা গাড়িগুলোকে একটির বদলে দু’টি করে দেখছেন। পেছনের সিটে বসে থাকা বাউবি অচেতন হয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে ছেলেকে শুধু বলেছিলেন সিলভির বোন ডায়ান, যিনি পেশায় একজন নার্স, তাকে ডেকে আনতে। ব্যস, এরপর আর কিছু মনে নেই তার।

লকড-ইন-সিন্ড্রোম

ভোজনবিলাসী আর ভ্রমণপিপাসু বাউবি কখনো কল্পনাতেও হয়তো ভাবেননি, মাত্র ৪৩ বছর বয়সে থমকে যাবে তার জীবন, যেভাবে গভীর সমুদ্রে ধীরে ধীরে ডুবে যেতে থাকে ‘ডাইভিং বেল’। ১১৯ নম্বর রুমে সেদিন প্রথম জানতে পারলেন, তিনি আক্রান্ত হয়েছেন লকড-ইন-সিন্ড্রোমে, যেখানে মন আটকা পড়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত দেহের ভেতরে।

“নিজেকে মনে হচ্ছিল মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মতো। এক পলকেই জীবনের মর্মান্তিক সত্যটি আমি বুঝতে পারলাম, যা ছিল আমার কাছে পারমাণবিক বিস্ফোরণের চাইতেও ভয়ঙ্কর, গিলোটিন ব্লেডের চেয়েও শতগুণ ধারালো।”

বাউবি শুধুমাত্র এক চোখের পলক ফেলতে পারতেন, মাথা ঘোরাতে পারতেন এদিক থেকে ওদিক আর ছিল শ্বাসযন্ত্রের কিঞ্চিৎ ওঠানামা। এছাড়া তার পুরো দেহ ছিল নিথর, নিস্তব্ধ। বাকশক্তিও হারিয়েছিলেন পুরোপুরিভাবে। শব্দ করতে পারতেন বটে, তবে তা ছিল শুধুমাত্র শ্বাসযন্ত্রের ঘড়ঘড় আওয়াজ। কর্নিয়ায় সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য তার ডান চোখের পাতাটিও সেলাই করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। লকড-ইন সিন্ড্রোমে মূলত মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ডের মাঝে যোগাযোগ স্থাপনকারী যে ‘ব্রেইন-স্টেম’, তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ফলে, মস্তিষ্কের নির্দেশ পেশির কাছে পৌঁছাতে এত সময় নেয়, যতটা সময় লাগে মাথার খুলি থেকে এক ইঞ্চি পরিমাণ চুল গজাতে। আর আক্রান্ত ব্যক্তি হয়ে পড়েন নিজের দেহেই কারাবাসী। বিরল এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা এতই কম যে, ন্যাভাল হাসপাতালে বাউবি তার মতো আর মাত্র একজনের দেখা পেয়েছিলেন।

ন্যাভাল হাসপাতালের ১১৯ নম্বর কক্ষে জিন-ডমিনিক-বাউবি; Image Source: Aruma

স্ট্রোকের তিন সপ্তাহ পর কোমা থেকে সেরে উঠে এক ঝটকায় এ দুর্দশা মেনে নিতে কে পারে? এমন জীবন কি বাউবি চেয়েছিলেন? এমন জীবন কি কেউ কখনো চায়? তবুও কল্পনাশক্তির ডানায় চড়ে প্রজাপতির মতো নিজেকে শেষবারের মতো মেলে ধরেছিলেন তিনি। চোখের ইশারায় বইয়ের পাতায় তুলে এনেছেন শেষ দিনগুলোর কথা, অতীতের গ্লানি কিংবা সুখস্মৃতি। আনুমানিক প্রায় দুই লক্ষ চোখের পলকে রচিত হয়েছে চমকপ্রদ এক আত্মজীবনী- ‘দ্য ডাইভিং বেল অ্যান্ড দ্য বাটারফ্লাই’।

নতুন ক্রমে পুরোনো অক্ষর

হাসপাতালে বাউবিকে দেখাশোনার জন্য যে ক’জন ডাক্তার ছিলেন, তাদের মধ্যে স্পিচ থেরাপিস্ট স্যান্ড্রিনকে বাউবি তার বইতে বলেছেন ‘গার্ডিয়ান এঞ্জেল’ বা রক্ষাকর্তা। তিনিই বাউবিকে পরিচয় করিতে দেন অক্ষরের ইএসএ (ESA) সংস্করণের সঙ্গে, শিখিয়ে দেন চোখের ইশারায় অন্যের সাথে মনের ভাব প্রকাশের অভিনব এক পদ্ধতি। বাউবিকে কিছু জিজ্ঞাসা করা হলে তার যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তবে তিনি একবার চোখের পলক ফেলতেন। আর উত্তর যদি ‘না’ হয়, তবে তা করতেন দু’বার।

চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে স্পিচ থেরাপিস্ট হাতে ধরে রেখেছেন ESA ক্রমের অক্ষরগুলো; Image Source: threethousandversts.blogspot.com

উপরের অক্ষরগুলো একটু মনোযোগ দিয়ে দেখুন, ফরাসি ভাষায় নিত্যদিনের ব্যবহৃত শব্দগুলোতে যে ধ্বনিগুলো সবার প্রথমে আসে এবং সবচেয়ে বেশিবার উচ্চারিত হয়, সেভাবেই পর্যায়ক্রমে অক্ষরগুলোকে সাজানো হয়েছে। যিনি বাউবির সঙ্গে কথা বলতে চাইতেন, তিনি শুরু থেকে অক্ষরগুলোকে পর্যায়ক্রমে বলে যেতেন আর লক্ষ রাখতেন বাউবির চোখের দিকে। বাউবি চোখের পলক ফেলামাত্র সে অক্ষরে থেমে যেতেন, লিখে ফেলতেন খাতায়। আবার একই ক্রমের পুনরাবৃত্তি করে যেতেন, যতক্ষণ না বাউবি কী বলতে চাইছেন- তা পরিষ্কার হয়।

বুঝতেই পারছেন, কাজটি ছিল অনেক বেশি ধৈর্য আর সময়সাপেক্ষ। তাই কাছের কিছু মানুষ আর হাসপাতালের দু’জন ডাক্তার ছাড়া আর সকলে অল্পতেই হাল ছেড়ে দিতেন। রসিকতা ভরে বাউবি তার বইতে বলেছেন,

“আমি একবার আমার চশমা (lunettes) চাইছিলাম, প্রত্যুত্তরে আমাকে বলা হয়েছিলো চাঁদে (lune) গিয়ে আমি কী করতে চাই?”

তবে আরেকজন এ পদ্ধতিতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত, বইয়ের উৎসর্গ অংশে থিওফিল আর সেলেস্টের নামের পর যার প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন বাউবি। তিনি আর কেউ নন, ক্লড ম্যান্ডিবিল। যিনি দু’মাস ধরে প্রতিদিন অসীম ধৈর্যে বাউবির চোখের ইশারায় অক্ষরের পর অক্ষর লিখেছেন, শব্দের পর শব্দ গেঁথেছেন, যেখানে বাউবির মনের কথাগুলো উচ্চৈঃস্বরে আমরা আজও শুনতে পাই।

বইয়ের কিছু অংশ

জীবনে প্রথমবারের মতো হুইলচেয়ারে বসে কেমন লেগেছিল বাউবির, যখন নিষ্ঠুরভাবে ভেঙে গিয়েছিল তার সব স্বপ্ন? কত দেখার বাকি ছিল, উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলেন কিংবা নাটক, বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়ানোর কত পরিকল্পনা! আর ওইযে নিজের হাতে তৈরি করা সেই বিশেষ পানীয়, যা বাজারে আনতে চেয়েছিলেন? ভাগ্য যেন তার দিকে তাকিয়ে নির্মম উল্লাসে হাসছে।

হলঘরের আয়নায় হুইলচেয়ারে বসা নিজেকে প্রথমবারের মতো দেখে আঁতকে উঠেছিলেন বাউবি।

“আমি এমন একজনকে দেখেছিলাম, যার মুখ ছিল বাঁকানো, নাক ছিল থ্যাবড়ানো, মুখে ছিল রাজ্যের ভয়। এক চোখ সেলাই করা, আরেক চোখ যেন এখনই ঠিকরে বেরিয়ে আসবে। ঘোলাটে সেই চোখের দিকে আমি ততক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম, যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি বুঝেছি- প্রতিচ্ছবিটি আমার নিজের।”

বাউবিকে নিয়ম করে বিভিন্ন ডাক্তার দেখতে আসতেন, তাকে নিয়ে যাওয়া হতো পুনর্বাসন কক্ষে, কখনো আবার হাসপাতালের মাঝে থাকা বিশাল হলঘরে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পছন্দের জায়গাটির নাম দিয়েছিলেন ‘সিনেসিটা’। এখান থেকে দেখতে পেতেন সাগরতীরে দাঁড়িয়ে থাকা আকাশছোঁয়া সেই ‘লাইটহাউজ’। পুরো দৃশ্যটি সিনেমার মতোই, যে সিনেমার পরিচালক তিনি নিজে। সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়া মাত্রই লাইটহাউজে আলো জ্বলে উঠত, আর একইসাথে বেঁচে থাকার আশাও যেন ছড়িয়ে পড়ত দিগন্ত থেকে দিগন্তে।

স্ট্রোকের সপ্তাহেই বাবার সাথে দেখা করেছিলেন বাউবি, সিনেমার একটি দৃশ্যে তা-ই ফুটে উঠেছে; Image Source: Chicag Reader

দুর্ঘটনার সপ্তাহেই বৃদ্ধ বাবাকে দেখতে গিয়েছিলেন বাউবি, গল্প করতে করতে বাবার দাড়ি কামিয়ে দিয়েছিলেন। আজ যখন তাকে একটি শিশুর মতো স্নান করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন যেন সেই ছবিটিই বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ৯২ বছর বয়সী বৃদ্ধ বাবা তার অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বেরোতে পারতেন না, তবুও ছেলেকে পাঠাতেন পুরোনো দিনের ছবি, যা দেখে বাউবি হারিয়ে যেতেন পেছনের সোনালি কোনো দিনে। দুঃখভরে বাউবি বলেছেন,

“আমরা দু’জনেই কি নিজেদের জায়গা থেকে লকড-ইন-সিন্ড্রোমে আক্রান্ত নই?”

প্রতিটি পাতায় যেন বলতে চেয়েছেন, ছোট্ট এ জীবনে আমরা ঠিক কতখানি তুচ্ছ, চোখের পলকেই যে জীবন বদলে যেতে পারে? আবার এই আমরাই আমাদের কল্পনার মতোই বিশাল। প্রতি পরতে পরতে তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, সুখের সংজ্ঞা আসলে কী।

খাবার-দাবারের বেলায় বেশ খুঁতখুঁতে ছিলেন, সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন সসেজ দিয়ে তৈরী নতুন নতুন রেসিপি। যার রান্নাঘরে থাকত সবচেয়ে মিহিগুঁড়ো মশলা, বাজারের সবচেয়ে তাজা শাকসবজি, সরাসরি পানি থেকে ধরে আনা মাছ- আজ তাকেই শরীরে ক্যালরির চাহিদা পূরণ করতে হচ্ছে নলের মধ্য দিয়ে পাকযন্ত্রে প্রবেশ করানো হলুদ রঙের তরলে। এখন আপাতত মুখ দিয়ে ক্রমাগত গড়িয়ে পড়া লালারস মুখের ভেতরে দিয়ে গলায় আটকে রাখতে পারলেই তিনি মোটামুটি সুখী। সদা কর্মব্যস্ত বাউবি এখন জীবনের বহমানতা খুঁজে পান প্রতি সকালে রাতের পোশাক বদলে নেওয়ার মাঝে। আত্মার শান্তি খুঁজে পান, যখন মনে করেন- ঘুমানোর আগে মেয়ে সেলেস্ট তার জন্য প্রার্থনা করছে। নির্মল আনন্দ খুঁজে পান, প্রিয় মানুষ বা কোনো বন্ধু তাকে দেখতে এলে।

কখনো স্মরণ করেছেন প্রথম প্রেমিকা জোসেফাইনের কথা, কখনো বলেছেন সবচেয়ে কাছের বন্ধু ভিনসেন্টের কথা, মনে করেছেন নিজের ছেলেবেলার গল্প কিংবা প্যারিসের যে ভবনে তিনি কাজ করতেন, সেখানকার দৃশ্যপট। সবকিছু আগের মতোই আছে, তিনিই শুধু হারিয়ে গেছেন। জীবনে ভালো থাকার ছোট ছোট মুহূর্তগুলো আমরা কত সহজে ভুলে যাই, কত মূহূর্তকে ইচ্ছে করে ছেড়ে দিই। কখনো কী ভেবে দেখেছি, দিনশেষে সেই মুহূর্তগুলোই হয়তো আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল!

তবুও বারবার এই পঙ্গুত্ব আর বন্দিদশা থেকে মুক্তি খুঁজেছিলেন বাউবি।

কেমন হতো, যদি আমি একটি ব্যাঙ হয়ে যেতাম?

আমি সবকিছু অনুভব করতে চাই, ভালোবাসতে চাই, জীবনটাকে উপভোগ করতে চাই, ঠিক তেমনভাবে, যেভাবে এখন আমি নিঃশ্বাস নিতে চাই।

গায়ের চাদরখানি ছুঁড়ে দিয়ে, বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে, চারদিকে ঘুরে ঘুরে শুধু বলতাম, এটি শুধুই একটি স্বপ্ন!

বইটির ফরাসি সংস্করণ প্রকাশিত হবার দু’দিন পরেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে জিন-বাউবি পরলোকগমন করেন। 

সিনেমা বনাম বাস্তবতা

১৯৯৭ সালে বাউবির জীবনের শেষ দিনগুলো নিয়ে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ডকুমেন্টারি মুক্তি পেয়েছিল। ২০০৭ সালে রোনাল্ড হারউডের চিত্রনাট্যে আর জুলিয়ান স্ন্যাবলের পরিচালনায় ‘দ্য ডাইভিং বেল অ্যান্ড দ্য বাটারফ্লাই’ চলচ্চিত্র হিসেবে মুক্তি পায়। এতে জিন-ডমিনিখ-বাউবির চরিত্রে অভিনয় করেন জনপ্রিয় ফরাসি অভিনেতা ম্যাথিউ অ্যামালরিক। সিনেমাটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পরিচালক বিভাগে, গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ডে সেরা পরিচালক এবং সেরা বিদেশি ভাষার ফিল্ম বিভাগে পুরস্কৃত হয়। একইসাথে অস্কারের চারটি বিভাগের জন্যও মনোনয়ন পায় বাউবির এই জীবনকাহিনী।

সাধারণত বইয়ের গল্প থেকে চলচ্চিত্র তৈরির ক্ষেত্রে আকর্ষণ ধরে রাখার জন্য কিছু কিছু অংশ হয়তো একটু ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু এই সিনেমায় বাউবির জীবনের বেশ অনেকখানি প্রধান অংশই পরিবর্তিত রূপে দেখানো হয়েছে। আর এতে অনেক সমালোচক কিংবা যারা বইটি পড়েছেন, বাউবির কাছের অনেক বন্ধুবান্ধব, এমনকি ফ্লোরেন্স নিজেও অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন।

দুই সন্তানের সাথে বাউবি; Image Source: Press Reader

তার মৃত্যুর পর তার সন্তানেরাই হবেন তার উত্তরাধিকারী, এটাই স্বাভাবিক, আর সে সুবাদে প্রাক্তন প্রেমিকা এবং সন্তানদের মা সিলভি’র সাথেই পরিচালক সিনেমার কাহিনীর ব্যাপারে যোগাযোগ করেছিলেন। বাস্তব জীবনে বাউবি ছিলেন দুই সন্তানের জনক, কিন্তু সিনেমায় তার তিনটি সন্তান দেখানো হয়। শিশুশিল্পী হিসেবে পরিচালকের নাকি তিনজনকেই পছন্দ হয়েছিল। তাই কাকে রেখে কাকে বাদ দেবেন, তা তিনি বুঝতে পারছিলেন না। আর তাই সিলভির সম্মতিতেই তিনজনকে পর্দায় দেখানোর সিদ্ধান্ত হয়।

শুরুর দিকের একটি দৃশ্যে দেখা যায়, বাউবি স্পিচ থেরাপিস্টকে বলছেন, তিনি মৃত্যু চান। কিন্তু ফ্লোরেন্স, যার সাথে শেষ তিন বছর প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন বাউবি, তিনি এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, “বাউবি কখনোই নিজের মুখে নিজের মৃত্যু কামনা করেননি, শুধুমাত্র সিনেমার আবেগ ধরে রাখার স্বার্থে এমন একটি দৃশ্য দেখানো কখনোই সমীচীন নয়।” বাউবির স্ট্রোক করার দৃশ্যে সিনেমায় দেখানো হয়, গাড়িটি তিনি নিজেই চালাচ্ছিলেন। কিন্তু বাস্তবে সেদিন গাড়িতে একজন ড্রাইভার ছিলেন, বাউবি আর থিওফিল পেছনের সিটেই বসেছিলেন।

ফ্লোরেন্স বেন সাদৌন, বাউবির জীবনের শেষ প্রেমিকা (নভেম্বর ২০১৮); Image Credit Denis Rouvre

পুরো সিনেমা জুড়ে দেখনো হয়েছে, জীবনের অন্তিম মুহূর্তগুলোতে সিলভি তাকে সাহস জুগিয়েছেন, আর প্রেমিকা ফ্লোরেন্সকে স্বার্থপর এবং ভীতু এক চরিত্রে উপস্থাপন করা হয়, যিনি একবারের জন্যও তাকে দেখতে আসেননি। এমন একটি দৃশ্য ছিল, যেখানে ফ্লোরেন্স বাউবিকে ফোনে বলছেন,

“তোমাকে এভাবে দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত নই। আমার স্মৃতিতে আমি তোমাকে পুরোনো বাউবির মতোই রাখতে চাই।”

দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফ্লোরেন্স বলেছেন,

“ব্যাপারটি মোটেই এমন ছিল না। বাউবির সাথে এমন ফোনালাপ আমার কখনোই হয়নি। উপরন্তু আমি তাকে আগে যেভাবে ভালোবেসেছি, তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একইভাবে আমি তার পাশে ছিলাম।”

বইয়ের অনেকগুলো অংশে বাউবি ফ্লোরেন্সের কথা উল্লেখ করেছেন। একটি অংশে এ-ও ছিল যে, ফ্লোরেন্স আর তার বন্ধুরা মিলে তাকে হাসপাতালে সঙ্গ দিচ্ছেন। বইটিতে সিলভির কথা বাউবি কেবল একটিমাত্র অংশে লিখেছিলেন, যেখানে বাবা দিবসের দিন সিলভি তার সন্তানদের নিয়ে তাকে দেখতে আসেন।  

অনেক সমালোচকই তাই বলছেন, সিনেমার এই পরিবর্তনগুলো বাউবির চরিত্রকে কিছুটা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে। আর এতে করে প্রকৃত বাউবি হয়তো মলিন হয়ে থাকলেন পর্দার বাউবির আড়ালে।

শেষ করা যাক, বইটির একেবারে সমাপ্তির কথাগুলো দিয়ে,

“এই বিশাল মহাজগতের কোথাও এমন কোনো চাবি কি আছে, যা আমার ‘ডাইভিং বেল’কে ভাঙতে পারবে? আছে এমন কোনো রেললাইন, যার কোনো শেষবিন্দু নেই? এমন কোনো মুদ্রা কি আছে, যার বিনিময়ে আমি আমার স্বাধীনতা ফিরে পাব?”

This article is in Bangla language. This is a review of the memoir 'The Diving Bell and The Butterfly' written by Jean-Dominique-Bauby, who suffered from the locked-in-syndrome after a stroke. Only with the blink of one of his eye, he depicted the whole book. Later a film was released in 2007 based on the script of this memoir.

All the necessary references are hyperlinked inside the article.

Featured Image Source: Emileereads.com

Related Articles

Exit mobile version