বিচিত্র মুগ্ধতার দেশ জাপান। প্রযুক্তির জগতে মোড়ল হিসেবে গোটা বিশ্বে ছড়ি ঘোরায় তারা, কিন্তু তাদের কাজের পরিধি কেবল কাঠখোট্টা প্রযুক্তিতেই সীমাবদ্ধ নয়, শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্র সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেও রয়েছে তাদের ঈর্ষণীয় বিচরণ। জাপানের চলচ্চিত্রে অবদান বহুমুখী, কিন্তু পৃথিবীজুড়ে তাদের অসামান্য জনপ্রিয়তা অসাধারণ সব হরর মুভির (J-horror) জন্য। আজ তেমনই গা শিউরে ওঠা কালজয়ী কিছু হরর মুভি নিয়ে আড্ডা হবে।
থ্রি… এক্সট্রিমস (২০০৪)
শুরুতেই একটি Anthology মুভি; তিনটি ছোট ছোট গল্প নিয়ে তৈরি মুভিটি ভয়াল সুন্দর এক অভিজ্ঞতা দেবে দর্শককে। এই মুভিটি অবশ্য পুরোপুরি জাপানী নয়, পূর্ব এশিয়ার তিনটি দেশ হংকং, কোরিয়া এবং জাপানের বাঘা বাঘা পরিচালকেরা একেকটি গল্প তৈরি করেছেন।
প্রথম গল্পটির নাম ‘Dumplings’। শেষ যৌবনে পা রাখা অভিনেত্রী মিসেস লী ত্বকের লাবণ্য হারিয়ে ফেলছেন ক্রমশ। স্বামী তার প্রতি আর আকর্ষণ বোধ করছেন না, গোপনে অন্য নারীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। সংসার টিকিয়ে রাখতে ব্যাকুল মিসেস লী অনেক খুঁজে এক রহস্যময় মহিলার সন্ধান পেলেন, যিনি কথা দিয়েছেন তার হারানো যৌবন ফিরিয়ে দেবেন। সেজন্য ‘ডাম্পলিং’ নামে একটি খাবার খেতে হবে, কিন্তু খাবারটি তৈরিতে সেই মহিলা কী উপকরণ ব্যবহার করছে শুনে গা গুলিয়ে আসলো মিসেস লীর। প্রয়োজনের তাগিদে জোর করে হলেও সেটি খাওয়া শুরু করলেন তিনি, ফলও পেতে শুরু করলেন। নিজের হারানো লাবণ্য একটু একটু করে ফিরে আসতে লাগলো। কিন্তু খাবারটির উপকরণ যে বড় দুর্লভ! মরিয়া মিসেস লী চরম একটি সিদ্ধান্ত নিলেন, উপকরণ একদম নিজ থেকে সংগ্রহ করবেন।
দ্বিতীয় গল্পটির নাম ‘Cut’। এক তরুণ জনপ্রিয় পরিচালকের জীবনে ভয়াবহ বিভীষিকা নেমে এল এক রাতে, তারই সিনেমার এক অখ্যাত অভিনেতা তাকে এবং তার স্ত্রীকে অপহরণ করলো। কারণটা খুব সহজ- তীব্র ঈর্ষা। নিজের স্ত্রী-সন্তানকে আগেই খুন করে এসেছে সেই অভিনেতা, এবার পরিচালককে দিয়ে একটি মৃত্যু খেলা খেলাবে সে। খেলায় হেরে গেলে পরিচালকের স্ত্রীর আঙ্গুল একটি একটি করে কাটা হবে! সত্যিই কি উন্মাদটি নিজের স্ত্রী-সন্তানকে খুন করে এসেছে? পুরো ব্যাপারটিই কি একটি কুৎসিত রসিকতা, নাকি সত্যিই বীভৎস কিছু ঘটতে যাচ্ছে? কী সেই খেলা যার উপর জীবন-মৃত্যু নির্ভর করছে? পরিচালক খুব শীঘ্রই টের পেল সত্যিটা…।
মুভির তৃতীয় গল্পটি হচ্ছে ‘Box’। ঈর্ষা, দ্বন্দ্ব, পারিবারিক টানাপোড়েনের একটি গল্প, যার চরম সমাপ্তি ঘটে একটি বাক্সে, আগুনের লেলিহান শিখায়। কিন্তু সত্যিই কি সমাপ্তি ঘটে? নাকি সবকিছু ছিল কল্পনা? বাস্তব জগতে কি তবে ভয়াবহ কিছু অপেক্ষা করছে? এই গল্পটি নিয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না। মুভির তিনটি গল্পই অসম্ভব শৈল্পিক নান্দনিকতার সাথে তৈরি। ভয় যে এত অপূর্ব পরাবাস্তব রূপ ধারণ করতে পারে তা মুভিটি না দেখলে বোঝা সম্ভব নয়।
ইচি দ্য কিলার (২০০১)
ভয়াবহ নৃশংস মুভির তালিকায় এই মুভিটির নাম সবসময়ই থাকে। তবে এখানে নৃশংসতাকে চমৎকার নান্দনিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। জনপ্রিয় জাপানিজ মাঙ্গা অবলম্বনে তৈরি মুভিটির গল্প বেশ সোজা- দুই ইয়াকুজা (জাপানী মাফিয়া) গ্যাং এর মাঝে কোন্দল। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর কুখ্যাত খুনী কাকিহারা, যার নৃশংসতার গল্প সবচেয়ে পোড় খাওয়া অপরাধীর বুকেও আতঙ্ক জাগায়, মাঠে নামলো সদলবলে, নিখোঁজ নেতাকে খুঁজে বের করার লক্ষ্যে।
কিন্তু তার তদন্তে বাধা হয়ে দাঁড়ালো রহস্যময় এক চরিত্র- ইচি, দয়ামায়াহীন বোধশূন্য এক কিলিং মেশিন, রক্তের হোলি বইয়ে দিতে ওস্তাদ এক উন্মাদ। ভয়ের বদলে কৌতূহল জাগলো কাকিহারার মনে, অমানুষিক অত্যাচারের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দিল সে। কে এই ইচি? কোথায় পাওয়া যাবে নিখোঁজ নেতাকে? কাকিহারা বনাম ইচির দ্বন্দ্বে কে জিতবে? বিচিত্র নৃশংস সব ঘটনার ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলে গল্প, মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে আপনাকে প্রতিটি মুহূর্ত।
ওনিবাবা (১৯৬৪)
তালিকার সবচেয়ে পুরনো মুভিটির গল্পও বহু বছর আগের- চতুর্দশ শতাব্দীর জাপানের গৃহযুদ্ধের সময়কে কেন্দ্র করে। ‘Onibaba‘ শব্দটির অর্থ প্রেত। এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের সাদাকালো যুগের একটি মুভি। সমালোচকেরা বলেন, ভয় নিয়ে যদি কেউ কবিতা লিখে, তার চলচ্চিত্রের রূপান্তর হতো এই মুভিটি। লালসা, লোভ, ঘৃণা, প্রতারণা- মানুষের অন্ধকার দিকগুলোর বিচিত্র এক মিশেল এর পরতে পরতে, মুভির চরিত্রগুলোর ভেতর একদম ডুবে যাবেন আপনি, অজানা এক আতঙ্ক ঘিরে ধরবে মন, আপাতদৃষ্টিতে শান্ত সমাহিত পটভূমির পেছনের অদেখা ভুবনে তলিয়ে যাবেন নিজের অজান্তে।
ব্যাটল রয়্যাল (২০০০)
ভবিষ্যতের জাপানের কথা। হাই স্কুলের একদল ছাত্র স্কুলের পক্ষ হতে একটি চড়ুইভাতিতে গেল, কিন্তু আনন্দের বদলে তাদের জীবনে নেমে এলো বিভীষিকা। সবাইকে পথে গ্যাস প্রয়োগে অজ্ঞান করা হলো। জ্ঞান ফেরার পর দেখলো একটি জনমানবহীন দ্বীপে বন্দী তারা, সবার গলায় যান্ত্রিক কলার। কলারের সাথে বোমা সংযুক্ত, কর্তৃপক্ষকে অমান্য করলেই সেটি বিস্ফোরিত হবে! প্রত্যেকের জন্য বিভিন্ন মরণঘাতী অস্ত্র রয়েছে। জানানো হলো বেয়াড়া উঠতি বয়সীদের নিয়ন্ত্রণে জাপান সরকারের বার্ষিক ‘Battle Royale Act’-এর জন্য মনোনীত হয়েছে তারা। নিয়মটা খুব সহজ, সবাইকে খুন করতে হবে! কেবলমাত্র একজন বেঁচে ফিরতে পারবে এ মরণখেলা থেকে, সেজন্য নিশ্চিত করতে হবে বাকি সবার মৃত্যু। অবিশ্বাস, আতঙ্ক, বিশ্বাসঘাতকতা আর নৃশংসতার এক জান্তব নরক নেমে এলো সেই দ্বীপে।
কোয়াইদান (১৯৬৪)
তালিকার শেষে আরো একটি Anthology মুভি, সেই ষাটের দশকের। ‘Kwaidan‘ শব্দের অর্থ ‘অদ্ভুতুড়ে গল্প’, মুভিটি মূলত চারটি বিচিত্র ভয়াল গল্প নিয়ে তৈরি। মুভিটি যতটা না ভয়ের, তার চেয়ে এটি অনেক বেশি আদৃত এর অপূর্ব মুগ্ধকর পরাবাস্তব দৃশ্যায়নের জন্য। আপনি অদ্ভুতুড়ে এক রূপকথার স্বপ্নীল জগতে হারিয়ে যাবেন মুভিটি দেখতে গিয়ে। দেখার চেয়ে এটিতে অনুভূতির বিষয়টি মুখ্য। সেজন্যই মুভিটি বিদেশী ভাষায় সেরা চলচ্চিত্রের জন্য অস্কার মনোনয়ন পেয়েছিলো।
প্রথম গল্পের নাম ‘The Black Hair’, খুব দরিদ্র এক দম্পতির গল্প। স্বামী সামুরাই যোদ্ধা আর স্ত্রী তাঁতী। দারিদ্র্যের বোঝা সইতে না পেরে স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দূর শহরে পাড়ি জমালো স্বামী, সেখানে সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়েথা করে সংসার পাতলো। অর্থবিত্ত এলো বটে, কিন্তু সুখের দেখা মিললো না জীবনে। ভুল বুঝতে পেরে হতভাগিনী স্ত্রীর কাছে ফিরে এলো সামুরাই, মনে ক্ষীণ আশা- হয়তো আবার সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। সত্যিই কি সুখের দেখা পেল সে? ফেলে আসা প্রিয়তমা স্ত্রী তার জন্য অপেক্ষা করে আছে বছরের পর বছর ধরে, সে কি কেবলই ভালবাসার টানে, নাকি অন্য কিছু?
দ্বিতীয় গল্প ‘The woman in the snow’। প্রচণ্ড দুর্যোগপূর্ণ এক তুষার ঝড়ের রাতে গহীন বনে বন্ধু মাঝির কুটিরে আশ্রয় নিলো এক কাঠুরে। সেখানে ঢুকে যা দেখলো তাতে তার আত্মা উড়ে যাওয়ার দশা! ‘Yuki-onna’ নামে জঙ্গলের প্রেতাত্মা খুন করেছে তার বন্ধুকে, তাকেও খুন করতে উদ্যত হলো। কিন্তু দয়া হলো প্রেতাত্মার, প্রাণভিক্ষা দিল এক শর্তে- এই কুটিরে যা হয়েছে, তা কাকপক্ষীও যেন কোনোদিন জানতে না পারে। সেবারের মতো প্রাণে বেঁচে যাওয়া কাঠুরে বেশ কিছুদিন পর দেখা পেল তার ভালোবাসার। অপূর্ব সুন্দরী এক রমণী, Yuki তার নাম। আর দেখতে সে একদম Yuki-onna-র মতো! এ কি নেহাত কাকতাল, নাকি অমঙ্গলের হাতছানি? কি ঘটলো তারপর কাঠুরের জীবনে?
তৃতীয় গল্পের নাম ‘Hoichi the earless’। এই গল্পে গানের সাথে প্রাচীন জাপানী যুদ্ধের অপূর্ব সুন্দর কিছু দৃশ্য রয়েছে, শুধু সেটি দেখার জন্য হলেও মুভিটি দেখা সার্থক। হইচি এক অন্ধ সংগীতশিল্পী। সবার কাছে তার সুনাম একটি গীতিকাব্যের জন্য- ‘Tale of the Heike’, সেই একাদশ শতাব্দীর জাপানের রাজাদের যুদ্ধ অবলম্বনে রচিত এক মহাকাব্যিক সংগীত। তার গানে মুগ্ধ হয়ে ডাক পড়লো রাজপরিবার থেকে, নিশুতি রাতে সংগীত পরিবেশনার জন্য হইচিকে নিতে আসে রাজার প্রহরী। কিন্তু গীর্জার পুরোহিতেরা দ্বন্দ্বে পড়লেন, অন্ধ হইচি আসলে কাদের জন্য গান করতে যায় গভীর রাতে? তারা কি সত্যিই মানুষ, নাকি অশরীরী জগতের বাসিন্দা?
চতুর্থ গল্পটি তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত। এর নাম ‘In a cup of tea’। প্রকাশকের অপেক্ষায় বসে রয়েছেন এক লেখক। বসে থাকতে থাকতেই তার মাথায় এলো বিচিত্র এক গল্প। লিখতে শুরু করলেন তিনি- এক সামুরাই যোদ্ধার গল্প, যে কিনা চায়ের কাপ থেকে শুরু করে পানির পাত্রে সবখানে দেখতে পায় অদ্ভুত এক মুখের প্রতিচ্ছবি! লেখক বুঝে পেলেন না, কোথা থেকে আচানক এমন আজব গল্প খেলে গেল তার মাথায়। লিখতে লিখতে টের পেলেন, ব্যাপারটা কেবল গল্পই নয়, বাস্তবেও অদ্ভুতুড়ে কিছু ঘটতে চলেছে!
ফিচার ইমেজ- rogerebert.com