সুপারম্যান মৃত। পৃথিবী এখন ধূসর, হতাশাপীড়িত এবং নিরাপত্তাহীন।
পৃথিবী নিজের অপার সম্ভাবনা টের না পেলেও তার মাঝে থাকা অ্যান্টি-লাইফ ইকুয়েশনের সন্ধান পেয়ে গেছে অন্ধকার জগতের শ্রেষ্ঠ দানব ডার্কসাইড। উন্মাদ বিজ্ঞানী লেক্স লুথারও জানিয়ে গিয়েছিল সেই মহাজাগতিক অপশক্তির কথা।
আর বিভিন্ন মেটাহিউম্যান, তাদের ক্ষমতা ও বিশ্বস্ততা নিয়ে এখনও ধোঁয়াশায় ব্রুস ওয়েন। তবুও সুপারম্যানকে দেওয়া প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে অতিমানবীয় ক্ষমতাসম্পন্ন যোদ্ধাদের একত্রিত করার চেষ্টা করে চলেছে।
‘ডন অভ জাস্টিস’-এর কাহিনীর রেশ ধরে এভাবেই শুরু হয় ডিসি এক্সটেন্ডেড ইউনিভার্সের মহাকাব্য জ্যাক স্নাইডার’স জাস্টিস লিগ। যে মুভিতে উঠে এসেছে ৫০০০ বছর আগের ইতিহাস, যে মুভিতে মানুষের পাশাপাশি যুদ্ধে লড়েছেন গ্রিক দেবতা, অ্যামাজোনিয়ান, আটলান্টিয়ান, গ্রিন ল্যান্টার্নেরা, যে মুভির ভিলেন পঞ্চাশ হাজার দুনিয়াকে ধূলিসাৎ করে হানা দিয়েছে পৃথিবীতে, সে মুভিকে মহাকাব্য বলাটাও আসলে বাড়াবাড়ি হবে না। আর এমন একটা ক্লাইম্যাক্সে জাস্টিস লিগ, স্টেপেনউলফ এবং ডার্কসাইডের মতো চরিত্রগুলোকে স্মরণীয়ভাবে বড় পর্দায় তুলে আনার জন্য হয়তো স্নাইডারের মতো একজন শিল্পবোধসম্পন্ন দূরদর্শীকেই প্রয়োজন ছিল।
রিভিউ
৪ ঘণ্টা ২ মিনিট দীর্ঘ এই সুপারহিরো এপিকের অস্তিত্ব নিয়ে জলঘোলা কম হয়নি। অবশেষে ওয়ার্নার ব্রসের স্ট্রিমিং সার্ভিস এইচবিওম্যাক্সের হাত ধরে গত ১৮ মার্চ মুক্তি পেয়েছে ছয়ভাগে ভাগ করা চলচ্চিত্রটি।
সুপারহিরো টিমআপ মুভির প্রধান জ্বালানি হলো মূল চরিত্রগুলোর মধ্যকার রসায়ন। রানটাইমে দীর্ঘতায় এক্ষেত্রে চরিত্রগুলোর ইন্টারকানেকশন হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, জোর করে চাপিয়ে দেয়া ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট ছিল না। ডার্কসাইড, স্টেপেনউলফ এবং প্যারাডিমনদের মতো মহাজাগতিক সত্ত্বাগুলোকে বাস্তবসম্মত এবং কমিক অ্যাকুরেট করে ফুটিয়ে তোলা একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল বৈকি। তাই ৪ ঘণ্টার হলেও সিনেমাটি ক্লান্তিকর হয়ে যায়নি কখনো। কিছু মুহূর্ত প্লটপয়েন্টের বাইরে ছিল, তবে তা মোমেন্টাম হারাতে দেয়নি।
কিছু অ্যাকশন সিকোয়েন্স প্লটে অপ্রয়োজনীয় হলেও তার বেশিরভাগই মনে রাখার মতো ছিল। অ্যাকোয়াম্যান ও তার পার্শ্বচরিত্রগুলোর উপস্থিতি তার স্ট্যান্ড-অ্যালোন মুভির কাহিনীকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে এখন পর্যন্ত এই ইউনিভার্সে তুলনামূলক নতুন চরিত্র হলো ফ্ল্যাশ এবং সাইবর্গ। আর স্নাইডারের জাস্টিস লিগে এই দুই সুপারহিরোই স্ব মহিমায় বিকশিত হয়েছে। শুধু ব্যাকস্টোরি আর অ্যাকশন দিয়ে নয়, তাদের বিভিন্ন সংলাপ আর বৈশিষ্ট্য দিয়ে মোটামুটি নিশ্ছিদ্রভাবে তাদের চরিত্র গড়ে তোলা হয়েছে। স্টুডিওর লক্ষ্য ছিল টিমআপ মুভিতে আকর্ষণীয়ভাবে চরিত্রগুলোর পরিচয় দিয়ে তাদের একক মুভি নির্মাণ করা। এখানে বিশেষ করে ফ্ল্যাশ এবং সাইবর্গের চরিত্র যেভাবে বিল্ডআপ করা হয়েছে, তাতে তাদের মুভির ব্যাপারে আগ্রহ না জেগে উপায় নেই।
২০১৭ সালের জাস্টিস লিগের সাথে তুলনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঢের এগিয়ে থাকবে স্নাইডারের এই সংস্করণ। যদিও জশ হুইডেনের সেই সিনেমার তুলনায় মান বিচারে যেকোনো মধ্যম মানের সুপারহিরো মুভিও হয়তো এগিয়ে থাকবে, মূলত নস্টালজিয়া ইফেক্ট ছাড়া মুভিটির তেমন মূল্যই ছিল না।
তবে স্নাইডারের গল্প বলার ধরনও কিছুটা দুর্বোধ্য। সাধারণ সিনেমার ফ্রেমকে রেনেসাঁ যুগের চিত্রকর্মে পরিণত করার অসামান্য দক্ষতা তার আছে নিঃসন্দেহে। তাই পাঁড় ভক্ত বাদে সাধারণ মানুষের কাছে তার পৌঁছানোর ক্ষমতা তুলনামূলক কম, আর ফ্র্যাঞ্চাইজি মুভির ক্ষেত্রে এই গুণটি না থাকলে আসলে চলে না।
মুভির অনন্য দিকের একটি হলো এর অ্যাসপেক্ট রেশিও। ৪:৩ অনুপাতে পরিচালকের ভিশন অনুযায়ী একদম বিশুদ্ধ ভিজুয়ালের স্বাদ পাওয়া গেলেও অনভ্যস্ত চোখে কিছুটা অস্বস্তি লাগতে পারে। এছাড়া স্নাইডারের সিগনেচার স্লো-মোশন শট কিছুক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। হ্যান্স জিমারের ওয়ান্ডার ওম্যান যেকোনো সময়েই রক্ত গরম করে দিতে বাধ্য, কিন্তু পাশাপাশি ব্যাকগ্রাউন্ডে আদিম হাহাকারময় মিউজিকের উপস্থিতি মনে হয় একটু বেশিই ছিল। শুরুর দিকে ফ্ল্যাশ এবং অ্যাকোয়াম্যানের অ্যাকশন সিকোয়েন্সে আরেকটু দুর্ধর্ষ মিউজিক দেওয়া যেত, সম্ভবত তাদের রহস্যে ঘেরা ইমেজ বজায় রাখার জন্য তা দেয়া হয়নি।
ব্যাটম্যানের চরিত্রের বাঁক অসম্পূর্ণ থেকে গেছে দুর্ভাগ্যবশত। লিগের অন্য সদস্যদের মতো অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা না থাকলেও ব্যাটম্যান হলো জাস্টিস লিগের নিউক্লিয়াস। তার মতো ক্ষুরধার মস্তিষ্ক এবং কৌশলী জ্ঞানসমৃদ্ধ একজন স্টেপেনউলফের ডেরায় কিংবা ক্রোধোন্মত্ত সুপারম্যানের কাছে তেমন কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই চলে গেছে, শুধুমাত্র সুপারম্যানের ওপর বিশ্বাস রেখে আর কিছু গ্যাজেটের ওপর ভরসা করে। এটা মেনে নেওয়া কঠিন। তাই সেদিক বিবেচনা করলে, বেন অ্যাফ্লেকের প্রতিভার অপচয়ই হয়েছে বলা চলে।
আর এদিকে ডিসির আরেক তুরুপের তাস- সুপারম্যানকে তিনটি চলচ্চিত্রে দেখা দিলেও তার বাবা-মায়ের প্রভাব, নিজস্ব দ্বিধাদ্বন্দ্ব এবং সাংঘাতিক কিছু অ্যাকশন সিকোয়েন্স বাদে খুব বেশি স্মরণীয় মুহূর্ত উপহার দিতে পারেনি। সাংবাদিক ক্লার্ক কেন্ট হিসেবে তার জীবন, লেক্সের সাথে তার সম্পর্কের ডাইনামিকসহ উপভোগ্য অনেক প্লট এখনো দেখানো বাকি।
যদি কোনো অল্টারনেট ইউনিভার্সে ২০১৭ সালেই স্নাইডারের সংস্করণটি মুক্তি পেত, তাহলে কী হতো বলে মনে হয়? ৪ ঘণ্টার স্ক্রিনটাইম থাকলে হলসংখ্যা কমে যেত নিশ্চিত। সবচেয়ে নিখুঁত দৃশ্যপট দেখা দিত, যদি মুভির কিছু অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দিয়ে এবং ব্যাটম্যানকে ব্যাটল সিনগুলোকে একটু মুখ্য ভূমিকা দিয়ে ২০১৭ সালে এই মুভিটি মুক্তি দেয়া হতো। এর ফলে সফলতার সম্ভাবনা বেড়ে যেত নিঃসন্দেহে, আমরা হয়তো জাস্টিস লিগ ২ ও পেয়ে যেতাম খুব দ্রুতই। ওয়ার্ল্ড অভ ডিসি যে বর্তমানের চেয়ে বহুগুণে এগিয়ে থাকত, তা নিশ্চিত। আর পরের স্ট্যান্ড-অ্যালোন মুভিগুলো দিয়ে যেকোনো কাহিনীর ফাঁকই ভরাট করা সম্ভব ছিল। কাস্টিং তো দর্শকেরা সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছেন, প্রজেক্টের সাথে দুর্দান্ত সব পরিচালকেরাও যুক্ত ছিলেন বা আছেন, তারপরও ওয়ার্নার ব্রস বারবার পরিচালকদের কাজে বাগড়া দেবার মাশুল দিচ্ছে। তবে শেষমেশ, নিজস্ব টোন থেকে সরে না গিয়ে স্নাইডার তার ট্রিলজি আমাদেরকে পৌঁছে দিতে পেরেছেন, এটাই সান্ত্বনা।
স্নাইডারকাটের ইতিহাস
ক্রিস্টোফার নোলানের ব্যাটম্যান ট্রিলজি দারুণভাবে সফল হওয়ার ফলে ওয়ার্নার ব্রসের পক্ষ থেকে সুপারম্যান রিবুট করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ইতোমধ্যে মারভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্স তাদের টিমআপ মুভি করে বক্স অফিস কাঁপানো শুরু করেছে। ডিসির রসদে আছে অসামান্য সব কমিকাল প্লটলাইন, জাস্টিস লিগকেও আগে কখনো দেখা যায়নি বড় পর্দায়, তাই ভক্তদের উত্তেজনার কোনো সীমা রইল না। ‘ওয়াচম্যান’-এর মতো জটিল, দার্শনিক এবং দুনিয়া কাঁপানো কমিকসকে সফলতার সাথে বড় পর্দায় তুলে আনায় পরিচালক হিসেবে বেছে নেয়া হলো জ্যাক স্নাইডারকে। তার হাত ধরে ২০১৩ সালে ‘ম্যান অভ স্টিল’ মুক্তি পাওয়ার কিছুদিন পরেই বলা হলো, এর সিকুয়েল হিসেবে আসছে ‘ব্যাটম্যান ভার্সাস সুপারম্যান: ডন অভ জাস্টিস’। ২০১৬ সালে মুক্তি পাওয়া সেই সিনেমায় ওয়ান্ডার ওম্যান, লেক্স লুথারসহ নতুন সব চরিত্র আনা হলো, ব্যাটম্যানের ভূমিকায় নেয়া হলো বেন অ্যাফ্লেককে।
তখনও পর্যন্ত কাস্টিং, নতুন মুভির পরিচালক কিংবা প্লটলাইন ঠিক করা সহ ডিসি ইউনিভার্স তথা ‘ওয়ার্ল্ড অভ ডিসি’-এর বেশিরভাগ সৃজনশীল সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন স্নাইডারই। ঝামেলা বাঁধল, ‘ডন অভ জাস্টিস’ মুক্তির পরপরই। প্রথম সপ্তাহান্তে ৪০০ মিলিয়নের বেশি আয় করলেও বিলিয়ন পেরোতে পারেনি ডিসির প্রথম টিমআপ মুভি, সমালোচকেরাও সুনজরে দেখেননি একে। পরে জানা গেল, স্টুডিও প্রায় ৪০ মিনিটের মতো ফুটেজ কেটে এটিকে থিয়েটারে মুক্তি দিতে বাধ্য করেছে। পরে মুক্তি পাওয়া সোয়া তিনঘণ্টার বর্ধিত সংস্করণটি অবশ্য বিবলিকাল রেফারেন্স এবং ইস্টার এগ সম্বলিত একটা ভিজুয়াল মাস্টারপিস।
কিছুদিন আগেই ব্যাটম্যান ট্রিলজি শেষ হওয়ায় হয়তো তারা বেন অ্যাফ্লেককে স্ট্যান্ড-অ্যালোন মুভি দিতে চায়নি, কিন্তু সিদ্ধান্তটা ঠিক ছিল না। তাড়াহুড়া করে ‘ডেথ ইন দ্য ফ্যামিলি’, ‘ডেথ অভ সুপারম্যান’ প্লট ঢুকিয়ে, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বচরিত্রগুলোকে ঠিকমতো বিকশিত না করে, সুপারম্যানকে কিছুটা ‘আউট অভ ক্যারেক্টার’ দেখিয়ে তারা সাধারণ দর্শকদের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছাতে পারেনি, কমিকস ভক্তদের প্রত্যাশাও মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে কিছুটা। তারপরেও ২০১৬ কমিককনে আসা জাস্টিস লিগের প্রথম ফুটেজ আবার সাড়া জাগিয়ে তুলেছিল।
এরপরেই বাঁধল গোল। ওয়ার্নার ব্রোসের চেয়ারম্যান কেভিন ফুজিহারার মনে হলো, সিরিয়াস প্লটলাইন আর ডার্ক সিনেমাটোগ্রাফির কারণেই মনে হয় বিভিএস সফল হয়নি। স্নাইডারের মেয়ের আত্মহত্যার ছুতোয় সরিয়ে দেয়া হলো তাকে। নিজের ব্যাটম্যান স্ট্যান্ড-অ্যালোন মুভি পরিচালনার কথা ছিল বেন অ্যাফ্লেকের। তিনি কাহিনী সাজাচ্ছিলেন ‘দ্য গেম’ মুভির আদলে, আরখাম অ্যাসাইলামের ‘রোগ’জ গ্যালারি’কে ঘিরে। সরিয়ে দেয়া হলো তাকেও। জাস্টিস লিগে জোর করে হাস্যরস এবং পাঞ্চলাইন ঢোকানোর জন্য আনা হলো জস হুইডেনকে। স্নাইডার এবং হুইডনের শুট করা ফুটেজ থেকে এক ঘণ্টা করে নিয়ে মাত্র দুই ঘণ্টার মুভি দিয়ে বড় পর্দায় আবির্ভূত হলো জাস্টিস লিগ এবং খাপছাড়া ভাবের কারণে দর্শক-সমালোচক সবাইকে চরমভাবে হতাশ করল।
তার কিছুদিন বাদেই জ্যাক স্নাইডার ভক্তদের সাথে তার অসম্পূর্ণ ভিশনের নানা তথ্যাবলী, কনসেপ্ট আর্ট শেয়ার করা শুরু করেন ভেরো নামের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ভক্তরা স্টুডিওর কাছে পিটিশন শুরু করে, স্নাইডারের সংস্করণ মুক্তি দেবার জন্যও, যদিও এর অস্তিত্ব সম্পর্কে কেউই নিশ্চিত করে কিছু বলছিলেন না।
#ReleasetheSnyderCut ব্যাপারটি অনেকটা মরীচিকার মতোই হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে গত বছরের শেষে গ্যাল গ্যাডট, জেসন মোমোয়াসহ ওয়ার্ল্ড অভ ডিসির সব তারকা নিজেদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করা শুরু করেন। ভক্তদের কাছে হার মেনে স্টুডিও স্নাইডারকাটের অস্তিত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয়। স্নাইডারকে আরও ১০০ মিলিয়ন দেওয়া হয়, পোস্ট প্রোডাকশনের জন্য। এ অর্থ মূলত ভিজুয়াল ইফেক্টসের পেছনেই ঢেলেছেন তিনি, ২০১৫ সালে শুট করা ব্যাটম্যানের ড্রিম সিকোয়েন্সের সাথে মিলিয়ে এপিলোগটাই কেবল নতুন করে শুট করা।
এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত জানতে পড়ে আসতে পারেন এখানে- স্নাইডার কাট: স্টুডিওর বিরুদ্ধে ডিরেক্টর আর ফ্যানদের যুদ্ধ।
মূল প্লট আলোচনা (স্পয়লার সমৃদ্ধ)
স্নাইডার তার কাহিনীর জন্য সংলাপ নয়, দৃশ্য ধারণের ওপর নির্ভর করেন বেশি। সেকারণে তার পরিচালনার তিনটি মুভির আনাচে-কানাচে বহু কমিক রেফারেন্স ছড়িয়ে থাকে। জাস্টিস লিগের কাহিনী মোটামুটি সোজাসাপ্টাই, তারপরেও বোঝার সুবিধার্থে মুভি দেখার পর পড়ে নিতে পারেন নিচের ব্যাখ্যাটি। ‘ওয়ার্ল্ড অভ ডিসি’-এর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্লটপয়েন্ট আছে এখানে, সুতরাং স্পয়লার অ্যালার্ট!
ডন অভ জাস্টিসে ডুমসডের সাথে লড়াইয়ের ফলে সুপারম্যানের মৃত্যুর সময়ে পৃথিবীর দিকে দিকে পৌঁছে যায় হুঁশিয়ারি সংকেত। পৃথিবী এখন অভিভাবকহীন, যেকোনো সময়ে মাদারবক্সের সন্ধানে পৃথিবীতে চলে আসবে পরাজাগতিক অপশক্তির দল। এই তিনটি মাদারবক্স হলো অপরিসীম ক্ষমতার উৎস। একটি বাড়িকে গুঁড়ো করে ফেলতে একটি ম্যাচের কাঠিই যথেষ্ট, কিন্তু ধুলো থেকে একটি বাড়ি বানিয়ে ফেলা সম্ভব মাদারবক্স ব্যবহার করে। ৫০০০ বছর আগে ডার্কসাইড এই তিনটি মাদারবক্স নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিল। তার উদ্দেশ্য ছিল, পৃথিবীকে টেরাফর্ম করে ধ্বংস করে ফেলা। সেইসময়ে ওয়ান্ডার ওম্যানের জাতি আমাজনিয়ান ও অ্যাকোয়াম্যানের জাতি আটলান্টিয়ানেরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিল মানুষের পাশাপাশি।
যুদ্ধে আমরা দেখি গ্রিক দেবতা জিউস এবং অ্যারিসকে, যারা কিনা যথাক্রমে ওয়ান্ডার ওম্যানের বাবা এবং প্রথম ওয়ান্ডার ওম্যান মুভির ভিলেন। যুদ্ধে একজন গ্রিন ল্যান্টার্ন ইয়ালান গুরকে মারা যেতে দেখা যায়। সবার সম্মিলিত শক্তি ডার্কসাইড এবং তার দলকে পিছু হটতে বাধ্য করে। সেসময়ে অবশ্য ডার্কসাইড ছিল তার প্রাথমিক ফর্ম উক্সাসরূপে ছিল। মাদারবক্সগুলো রয়ে যায় অ্যামাজোনিয়ানদের দ্বীপ থেমেস্কেইরা, পানির নিচের রাজ্য আটলান্টিস এবং আমাদের পৃথিবীতে। তাদের ধর্মীয় নীতি বলে, যদি কখনো এই মাদারবক্স জেগে ওঠে, তাহলে তা ডাক দেবে অ্যাপোকোলিপ্স গ্রহের নেতাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে পৃথিবীতে থাকা মাদারবক্সটি আবিষ্কৃত হয়। সেটি আবিষ্কার করে নিজের দুর্ঘটনাকবলিত সন্তান ভিক্টরকে সাইবর্গে পরিণত করেন সাইলাস স্টোন। সাইবর্গ কিন্তু টার্মিনেটর জাতীয় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সওলা মেশিন নয়, তার মানবসত্তাটিও সমানভাবে সক্রিয়। নিজের এই অবস্থাকে মেনে নিতে পারনি ভিক্টর।
ডিজিটাল জগতের দুনিয়ায় তার বিচরণ করার ক্ষমতা ঐশ্বরিক পর্যায়ের। কোনো ফায়ারওয়াল, কোনো এনক্রিপশন তাকে দমাতে পারবে না। দুনিয়ার টেলিকমিউনিকেশন, ওয়াল স্ট্রিটের শেয়ারবাজারের হিসেব সে চাইলেই এদিক-সেদিক করে দিতে পারে। সাইবর্গের এই ক্ষমতা, সেইসাথে মাদারবক্সের সাথে তার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ দর্শকদের কাছে দারুণভাবে প্রদর্শন করেছেন স্নাইডার। ভিক্টর আসলেই এই মুভির অতি গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র।
জডকে ডুমসডেতে পরিণত করার পরে ক্রিপ্টোনিয়ান স্কাউট শিপে লেক্স লুথার দেখেছিল, মাদারবক্স হাতে থাকা স্টেপেনউলফকে। তার সতর্কবার্তার কারণে ব্যাটম্যান মেটাহিউম্যানদের খুঁজে বের করা শুরু করে। অ্যামাজোনিয়ানদের আর্টেমিস তীর হাতে পেয়ে বিপদসংকেত টের পায় ওয়ান্ডার ওম্যান, ব্যাটম্যানের সাথে জোট বাঁধে সে। তবে শুরুতে মিউজিয়ামে ওয়ান্ডার ওম্যানের মনোমুগ্ধকর অ্যাকশন সিকোয়েন্সটি কাহিনীর সাথে খুব একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ডাকাতকে ল্যাসো দিয়ে ধরে তাকে এর ক্ষমতা বোঝানোর সংলাপটিও স্পুন-ফিড করার মতো।
এরপর আমরা পরিচিত হই ব্যারি অ্যালেন, তথা ফ্ল্যাশের সাথে। এই স্পিডস্টারের সাথে আইরিস ওয়েস্টের প্রথম পরিচয়, তার মায়ের মৃত্যুর দায়ে বাবার জেল খাটা- এসবকিছুর পাশাপাশি তার গতিময় জীবনের সাথে পরিচিত হয় দর্শক। কমিক অনুযায়ী, নীল বিদ্যুৎওলা স্পিডস্টার হবার জন্য এই ব্যারি অ্যালেনের গতি আরও বেশি হবার কথা, হয়তো এক্ষেত্রে এ ইউনিভার্সে ভিন্ন কোনো নিয়ম দেখানো হচ্ছে। দু’বার টাইম ট্রাভেল করতে দেখা গেছে তাকে, প্রথমবার সুপারম্যানকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য মাদার বক্সকে পাওয়ার আপ করার কারণে, আর দ্বিতীয়বার স্টেপেনউলফের সাথে লড়াই করার সময়ে।
ফ্ল্যাশকে সহজেই দলে নিয়ে নিতে পারলেও অ্যাকোয়াম্যানকে লিগে ঢোকাতে কিছুটা বেগ পেতে হয়। মায়ের প্রতি রাগ থাকায় আটলান্টিসের ট্রাইডেন্ট হাতে নেবার কোনো ইচ্ছেই ছিল না তার, যদিও পৃথিবীকে ঘোর বিপদে দেখে ঠিকই নিজের অতিমানব সত্ত্বাকে মেনে নেয় সে।
সুপারম্যানের মৃত্যুর শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে না পারা লয়েস লেইনের সাথে দেখা করতে যান তার মা মার্থা কেন্ট। কিন্তু আসলে তিনি মার্শিয়ান ম্যানহান্টার, ‘ম্যান অভ স্টিল’ মুভির ডিফেন্স সেক্রেটারি। এই দৃশ্যটি কেন মুভির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা অবশ্য পরিষ্কার হয়নি।
মাদারবক্স দিয়ে সুপারম্যানকে পুনরুজ্জীবিত করা, তার স্বল্পস্থায়ী স্মৃতিভ্রংশ হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত জাস্টিস লিগের সাথে যোগ দিয়ে স্টেপেনউলফকে হারানোর ব্যাপারটুকু অবশ্য সোজাসাপ্টা। সাইবর্গ আর ফ্ল্যাশ মিলে তিনটি মাদারবক্সের ইউনিটিকে ভঙ্গ করার চেষ্টা করছিল ডার্কসাইডকে ঠেকানোর জন্য। একপর্যায়ে সুপারম্যান এসে হাজির হলেও সুযোগটি তারা হাতছাড়া করে ফেলে। তখন ফ্ল্যাশ টাইম ট্রাভেল করে সময়কে পিছিয়ে নিয়ে যায়, তারপর সুপারম্যান এবং সাইবর্গ মিলে কাজ সমাধা করে। তবে পোর্টালের দুইপাশে জাস্টিস লিগ আর ডার্কসাইডের মুখোমুখি হবার ব্যাপারটি ড্রামাটিক এলিমেন্ট বাদে তেমন কিছু যোগ করেনি।
স্টেপেনউলফ সম্পর্কে ডার্কসাইডের আঙ্কেল। মাদারবক্স খুঁজতে গিয়ে পৃথিবীতে অ্যান্টি-লাইফ ইকুয়েশনের সন্ধান পায় সে। এই ইকুয়েশন এতই ক্ষমতাশালী, যে এর মাধ্যমে যেকোনো প্রাণীকে বশে আনা যাবে, এমনকি সুপারম্যানকেও। তাই মাদার বক্সের ইউনিটি ঘটিয়ে ডার্কসাইডকে এখানে নিয়ে আসার চেষ্টা করে সে। ইউনিটি ঘটানো গেলে ডার্কসাইড এই পৃথিবীকে বিকৃত করে তার গ্রহের মতো বানিয়ে ফেলতে পারবে, সেইসাথে গ্রহের প্রত্যেককে প্যারাডিমনে রূপান্তরিত করে ফেলতে পারবে। স্টেপেনউলফের অভিযান ব্যর্থ হয়, মাদারবক্সগুলোও ধ্বংস হয়। তবে না, এই প্লটের আরও অনেক কিছু বাকি আছে।
সবার শেষে ব্যাটম্যানের নতুন ‘নাইটমেয়ার’ ড্রিম সিকোয়েন্স বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়। ‘ডন অভ জাস্টিস’-এ দেখানো সিকোয়েন্সের সাথে মিল রেখে এখানেও আছে কিছুটা পরিণত ফ্ল্যাশ এবং ইভিল সুপারম্যান। কমিকের ‘ইনজাস্টিস’ প্লটলাইনের আদলে এই ডিস্টোপিয়ান পৃথিবীর কাহিনী। আগের মুভির ড্রিম সিকোয়েন্সের শেষে ফ্ল্যাশ টাইম ট্রাভেল করে জানাতে চায়, লয়েসকে দিয়েই হয়তো পৃথিবীকে বাঁচানো সম্ভব। তখন অবশ্য ব্যাটম্যান ঠিকমতো চিনতই না লয়েসকে। পৃথিবী মূলত ধ্বংসের মুখে গেছে অ্যান্টি-লাইফ ইকুয়েশনের জন্য। এর মাধ্যমে সুপারম্যানকে অ্যাপোকলিপ্সের দাসে পরিণত করেছে ডার্কসাইড, সেইসাথে হত্যা করেছে লয়েসকে।
যা-ই হোক, নতুন ড্রিম সিকোয়েন্সে জাস্টিস লিগের সাথে জোট বাঁধতে দেখা যায় জোকারকে, যদিও ট্রেলারের আলোচিত সংলাপ “উই লিভ ইন অ্যা সোসাইটি হয়্যার অনার ইজ অ্যা ডিসট্যান্ট মেমোরি” তাকে বলতে দেখা যায়নি! প্রমোশনাল শটেও জোকারের আরও কিছু দৃশ্যের আভাস দেয়া হয়েছিল।
একটি প্রশ্ন প্রায়ই আসে যে, ব্যাটম্যানই কেন পূর্বাভাস দেখল? তার উত্তর হতে পারে, মার্শিয়ান ম্যানহান্টারের উপস্থিতি। জ’ন জো’নজ অনেক ক্ষমতাধর এক অতিমানব, তার পক্ষে টেলিপ্যাথি করা কিংবা ভবিষ্যতের টুকরো টুকরো স্মৃতি কাউকে দেখানো অসম্ভব কিছু না। লেক্স লুথার এবং ডেথস্ট্রোকের ইয়টে মিটিঙের দৃশ্যটি ভবিষ্যতে ভিলেনের ইনজাস্টিস লিগ গঠনের আভাস দেয়।
ডিসি এক্সটেন্ডেড ইউনিভার্সে জাস্টিস লিগের সদস্যদের ভবিষ্যৎ
সামনে জেমস গানের পরিচালনায় আসছে সুইসাইড স্কোয়াডের দ্বিতীয় কিস্তি, তবে এবারে থাকছেন না জ্যারেড লেটো এবং উইল স্মিথ। ২০২২ সালে আসবে রবার্ট প্যাটিনসনের ‘দ্য ব্যাটম্যান’। পরিচালক এই মুভির অনুপ্রেরণা হিসেবে বেছে নিয়েছেন ‘দ্য লং হ্যালোউইন’ এবং ‘ব্যাটম্যান ইগো’ কমিকসকে। সেইসাথে বিশ্বের সেরা গোয়েন্দা ব্রুস ওয়েনের রহস্য সমাধানের কাহিনীতে প্রভাব ফেলবে ‘সেভেন’, ‘চায়নাটাউন’-এর মতো ক্লাসিক মিস্ট্রি থ্রিলারগুলো। একই বছর আসবে ফ্লাশের প্রথম স্ট্যান্ড-অ্যালোন মুভি।
ধারণা করা হচ্ছে, কমিকসের জনপ্রিয় প্লট ‘ফ্লাশপয়েন্ট প্যারাডক্স’ কে ব্যবহার করে ডিসি ইউনিভার্স রিবুট হয়ে যাবে এবং বেন অ্যাফ্লেক, হেনরি ক্যাভিলের সুপারহিরো আর্ক শেষ হয়ে যাবে। মুভিতে থাকছেন প্রাক্তন ব্যাটম্যান মাইকেল কিটনও। ২০১৯ সালে সিডাব্লিউ চ্যানেলে অ্যারোভার্সের ‘ক্রাইসিস অন ইনফিনিট আর্থ’ ক্রসওভার ইভেন্টে টিভি ফ্ল্যাশ এবং মুভি ফ্ল্যাশকে মুখোমুখি হতে দেখা যায়। একইভাবে ‘স্মলভিল’ সহ এযাবৎ ডিসির যত প্রজেক্ট হয়েছে, প্রায় সবকিছুকেই মাল্টিভার্সের অংশ করে নেওয়া হচ্ছে।
নিজেদের প্রথম মুভি দিয়ে সফল হওয়ায় ‘অ্যাকোয়াম্যান’ এবং ‘শাজাম’ চরিত্র দু’টি পাচ্ছে সিকুয়েল। এইচবিওম্যাক্সে আসবে ১০ এপিসোডের ‘গ্রিন ল্যান্টার্ন’ সিরিজ। স্নাইডারের কাটে মার্শিয়ান ম্যানহান্টার এবং ইনজাস্টিস প্লটলাইনের আভাস দিলেও জাস্টিস লিগের সিকুয়েলের আশা এখন পর্যন্ত দুরাশা। একইভাবে অ্যাফ্লেক এবং ক্যাভিলের আর কোনো স্ট্যান্ড-অ্যালোন মুভি আসার সম্ভাবনাও শূন্যের কোঠায়। লেক্স লুথার এবং ডেথস্ট্রোককেও ভিলেনদের লিগ বানাতে দেখা যাবে না। জ্যাক স্নাইডার আপাতত ওয়ার্নার ব্রোসের সাথে আর কাজ করছেন না বলে জানিয়েছেন।