“আমি জানি, শত্রুশিবিরে অবস্থানকারী ভদ্রমহোদয়গণ তাদের খুশিমতো আমার সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তা করে থাকেন। এসব ভদ্রলোকের মত পরিবর্তনের কোনো ইচ্ছা আমার নেই!” [এমিল লুডভিগের উদ্দেশ্যে জোসেফ স্তালিন, ১৩ ডিসেম্বর ১৯৩১]
ইয়োসিফ ভিসারিয়োনোভিচ জুগাশভিলি, যিনি জোসেফ স্তালিন নামেই সমধিক পরিচিত, ছিলেন একজন বলশেভিক বিপ্লবী, সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব এবং সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী। ১৯২৪ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৯ বছর তদানীন্তন বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক জীবনের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। কারো কারো দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন একজন মহান দেবতুল্য রাষ্ট্রনায়ক, আবার কারো কারো মতে তিনি একজন রক্তপিপাসু স্বৈরশাসক ছাড়া আর কিছু ছিলেন না। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নকে একটি বিশ্বশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার পশ্চাতে স্তালিনের অবদান অনস্বীকার্য। প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী (এবং তীব্র সোভিয়েতবিরোধী ও কমিউনিজমবিরোধী) উইনস্টন চার্চিল স্তালিনকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে, “স্তালিনের ক্ষমতায় আসার সময় রাশিয়ার হাতে ছিল কাঠের লাঙল আর যাওয়ার সময় ছিল পারমাণবিক অস্ত্র!”
প্রায় তিন দশক ধরে বিশ্বের প্রায় এক–ষষ্ঠাংশ ভূমির একচ্ছত্র শাসক ছিলেন স্তালিন। এর এহেন স্তালিনের প্রদত্ত ৬টি সাক্ষাৎকার নিয়ে বাসু আচার্য সম্পাদনা করেছেন ‘মুখোমুখি স্তালিন’ সংকলনটি। এই সাক্ষাৎকারগুলো থেকে একদিকে যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নের তদানীন্তন অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আর্থ–সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে স্তালিনের নিজস্ব মূল্যায়ন পাওয়া যায়, অন্যদিকে তেমনি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ওয়ালস্ট্রিট থেকে দণ্ডকারণ্য পর্যন্ত বিস্তৃত বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন সম্পর্কে তার মতামত পাওয়া যায়। একই সঙ্গে ব্যক্তি স্তালিন কেমন প্রকৃতির ছিলেন, তারও আভাস পাওয়া যায় এই সাক্ষাৎকারগুলো থেকে।
সংকলনে উল্লেখিত সাক্ষাৎকারগুলোর মধ্যে সময়ানুক্রমিকভাবে প্রথম সাক্ষাৎকারটি স্তালিন দিয়েছিলেন ১৯২৭ সালের ১৩ মে চীনের সান ইয়াৎ-সেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের। এই সাক্ষাৎকারে স্তালিন সেই সময়ে চীনে বিরাজমান রাজনৈতিক ও আর্থ–সামাজিক পরিস্থিতি, চীনে চলমান গৃহযুদ্ধ, চীনের কুয়োমিনতাং দলের আদর্শিক চরিত্র এবং চীনা কমিউনিস্ট আন্দোলনের পরিস্থিতি সম্পর্কে সুবিস্তৃত মতামত প্রদান করেছেন।
এই সুবিস্তৃত সাক্ষাৎকার থেকে তিনটি বিষয় স্পষ্ট: চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক, আর্থ–সামাজিক ও আদর্শিক পরিস্থিতি সম্পর্কে স্তালিনের বিস্তৃত ধারণা ছিল, রুশ মেনশেভিক ও সোশ্যালিস্ট রেভলিউশনারিদের তুলনায় তুরস্কের কামালবাদীদের ও চীনের কুয়োমিনতাঙের প্রতি তার উঁচু ধারণা ছিল এবং সেই মুহূর্তে চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লব সফল হওয়া সম্ভব বলে তিনি মনে করতেন না। স্তালিনের বিশ্লেষক সঠিক বলে প্রমাণিত হয় এবং ১৯৪৯ সালের আগে চীনের কমিউনিস্ট বিপ্লব সাফল্য অর্জন করতে পারেনি।
স্তালিন দ্বিতীয় সাক্ষাৎকারটি দিয়েছিলেন ১৯২৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মার্কিন শ্রমিক শ্রেণির একটি প্রতিনিধিদলকে। এই সাক্ষাৎকারে স্তালিনের তাত্ত্বিক জ্ঞান সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, কারণ এতে তিনি মার্ক্সবাদ–লেনিনবাদ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। একই সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, লিয়ন ত্রৎস্কির সঙ্গে স্তালিনের মতপার্থক্য, সোভিয়েত অর্থনীতি ও পুঁজিবাদী শিল্পের সঙ্গে তাদের সহায়তার সীমা, সোভিয়েত ইউনিয়নে জাতিগত সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে গৃহীত নীতি ও ধর্মের প্রতি সোভিয়েত রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি– এই বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে।
এই সাক্ষাৎকারের একটি কৌতূহলোদ্দীপক অংশ হচ্ছে, সোভিয়েত ইউনিয়নে জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি যে সাম্যের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, স্তালিন নির্দিষ্টভাবে একটি উদাহরণের মাধ্যমে সেটিকে তুলে ধরেছেন। তিনি মন্তব্য করেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল ‘সোভিয়েতসমূহের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদে’র ৬ জন সভাপতির মধ্যে একজন করে জাতিগত রুশ, ইউক্রেনীয়, বেলোরুশীয়, আজারবাইজানি, তুর্কমেন ও উজবেক রয়েছেন। স্তালিন বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই মত প্রকাশ করেছেন, কোনো ‘বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রে’ এই ধরনের সাম্য প্রতিষ্ঠা কখনোই সম্ভব নয়।
স্তালিন তৃতীয় সাক্ষাৎকার প্রদান করেছেন ১৯২৭ সালের ৫ নভেম্বর ৮০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলকে। এদের মধ্যে ছিলেন জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, তদানীন্তন চেকোস্লোভাকিয়া, চীন, বেলজিয়াম, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার শ্রমিক শ্রেণির প্রতিনিধিরা। সোভিয়েত ইউনিয়নে ভিন্ন দল গঠনের স্বাধীনতা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা, তেলশিল্প এবং অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়ে স্তালিন এই সাক্ষাৎকারে সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। একই সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং জাতিপুঞ্জে যোগদানে সোভিয়েত রাষ্ট্রের অনীহা নিয়েও এই সাক্ষাৎকারে আলোচনা হয়েছে।
সাক্ষাৎকার শেষে স্তালিনের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। প্রতিনিধিরা তাকে সাক্ষাৎকার প্রদানের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলে তিনি মন্তব্য করেছেন, আন্তর্জাতিক শ্রমিকশ্রেণির প্রতিনিধিদের কাছে জবাবদিহিতা করা সোভিয়েত রাষ্ট্রের নেতাদের কর্তব্য! বলাই বাহুল্য, এক্ষেত্রে স্তালিন বিনয়ের অবতার হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন এবং এর মধ্য দিয়ে বহির্বিশ্বের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। বস্তুত এই সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্যই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী ইতিবাচক ধারণার বিস্তার।
সংকলনে উল্লেখিত চতুর্থ সাক্ষাৎকারটি স্তালিন প্রদান করেছেন ১৯৩১ সালের ১৩ ডিসেম্বর জার্মান লেখক এমিল লুডভিগকে। এই সাক্ষাৎকারে সমাজতন্ত্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন দিক (বিশেষত ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা) আলোচিত হয়েছে, কিন্তু এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশে আলোচনা হয়েছে স্তালিনের নিজস্ব জীবন ও জীবনদর্শন নিয়ে। এই অংশে এসে একদিকে যেমন স্তালিনের নম্রতা ও বিনয় ফুটে উঠেছে, অন্যদিকে আবার ব্যক্তিগত জীবনের অপ্রীতিকর সত্য গোপন করার স্বভাবও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
স্তালিনের পঞ্চম সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাহিত্যিক হার্বার্ট জর্জ ওয়েলস, যিনি এইচ. জি. ওয়েলস নামেই সমধিক পরিচিত। ১৯৩৪ সালের ২৩ জুলাইয়ে গৃহীত এই সাক্ষাৎকারটি চিত্তাকর্ষক, কারণ এর ভাষা যতটা না সাক্ষাৎকারের মতো, তার চেয়ে বেশি বিতর্কের মতো। ওয়েলস নিজে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা রাখতেন, এজন্য বিতর্কটি হয়ে উঠেছে জমজমাট। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট কর্তৃক গৃহীত ‘নিউ ডিল’ এবং ইংল্যান্ডের ‘চার্টিস্ট আন্দোলন’ থেকে শুরু করে ফরাসি ও রুশ বিপ্লব – এই ব্যাপক ও বিস্তৃত বিষয়ে স্তালিন এবং ওয়েলসের মধ্যে এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
কিছু কিছু ইতিহাসবিদ উল্লেখ করে থাকেন, স্তালিনের ‘বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য’ ছিল নিম্ন পর্যায়ের এবং অন্যান্য শীর্ষ বলশেভিক বিপ্লবীদের মতো দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থান না করার কারণে পশ্চিমা বিশ্ব সম্পর্কে তার সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। ‘স্তালিন–ওয়েলস সংলাপ’ নামে পরিচিত এই সাক্ষাৎকারে ইতিহাসে প্রচলিত এই বক্তব্যের বিপরীত চিত্র ফুটে ওঠে। এই সংলাপ থেকে স্পষ্ট অনুধাবন করা যায়, পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক, আর্থ–সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিস্থিতি সম্পর্কে স্তালিনের সুবিস্তৃত ধারণা ছিল এবং সেগুলোকে সূচারুরূপে বিশ্লেষণের সামর্থ্যও তার ছিল।
সংকলনের সর্বশেষ সাক্ষাৎকারটি স্তালিন প্রদান করেছেন ১৯৫১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিনিধিদেরকে। এই সাক্ষাৎকারে ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পরিস্থিতি এবং কমিউনিস্টদের কর্মপন্থা নিয়ে স্তালিন বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এই আলোচনার মধ্যে তার দুটি মূল্যায়ন প্রণিধানযোগ্য। প্রথমটি হচ্ছে, ভারতের তদানীন্তন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট বিপ্লব সফল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই এবং চীনে কমিউনিস্টরা যেভাবে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে, সেটি ভারতে সম্ভব নয়। বাস্তবিকই ভারতে কমিউনিস্ট বিপ্লব সংঘটিত হয় নি এবং কমিউনিস্টপন্থী বিভিন্ন গেরিলা আন্দোলন সাফল্যের মুখ দেখেনি।
স্তালিনের দ্বিতীয় মূল্যায়নটি বাংলাদেশ সম্পর্কিত। স্তালিন মন্তব্য করেছেন, বাংলার বিভাজন কৃত্রিম এবং প্রথম সুযোগেই বাংলার যে অংশ পাকিস্তানের সাথে আছে তা পাকিস্তান থেকে খসে পড়বে। স্তালিন তার এই মূল্যায়ন প্রদান করেছিলেন ১৯৫১ সালে। এর বিশ বছরের মধ্যেই ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলা পাকিস্তান থেকে ‘খসে পড়ে’ এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯৫১ সালে যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সবে তিন বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, তখন স্তালিন এই মূল্যায়ন দিয়েছিলেন, এটা সত্যিই আশ্চর্যের।
স্তালিনের এই ছয়টি সাক্ষাৎকার থেকে বেশ কয়েকটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
প্রথমত, স্তালিন কেবল সোভিয়েত ইউনিয়নের নয়, উত্তর আমেরিকা থেকে শুরু করে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা ও রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে ধারণা রাখতেন, এবং এই ধারণা ছিল সুবিস্তৃত ও সর্বব্যাপী। এর মধ্য দিয়ে স্তালিনের ‘বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য’ নিয়ে যেসব ইতিহাসবিদ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, তাদের ধারণা ভ্রান্ত হিসেবে প্রমাণিত হয়। ১৯৫১ সালের সাক্ষাৎকারে স্তালিন পূর্ব বাংলা সম্পর্কে তার মূল্যায়ন দিয়েছেন, যখন সেই সময়ের সিংহভাগ বিশ্বনেতা পূর্ব বাংলা ঠিক কোন জায়গায় সেই বিষয়টিও স্পষ্টভাবে বলতে পারতেন না।
দ্বিতীয়ত, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রচারমাধ্যম ছিল রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত এবং সেখানে রাষ্ট্রনির্ধারিত পন্থার বাইরে বক্তব্য রাখার স্বাধীনতা প্রচারমাধ্যমের ছিল না। কিন্তু এই সাক্ষাৎকারগুলোতে বিদেশি সাংবাদিকরা স্তালিনকে মুক্তভাবে প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছেন এবং আক্রমণাত্মক প্রশ্ন করা থেকেও বিরত থাকেননি, কিন্তু স্তালিন স্বস্তিকর-অস্বস্তিকর সব ধরনের প্রশ্নেরই বিস্তারিত উত্তর দিয়েছেন। এই উত্তরগুলোর সত্যতা কতটুকু ছিল, সেটি যাচাই করা কঠিন, কিন্তু এর থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, স্তালিন তার গৃহীত নীতিগুলোকে সঠিক হিসেবে বিবেচনা করতেন, বাস্তবে সেগুলো সঠিক বা ভুল যা-ই হোক না কেন।
তৃতীয়ত, বহির্বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে স্তালিনের মূল্যায়ন থেকে এটি স্পষ্ট যে, বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট বিপ্লব সফল হবে বা কমিউনিজম প্রতিষ্ঠিত হবে, এই ধরনের ধারণায় তার আস্থা ছিল না। পশ্চিম ইউরোপ, চীন ও ভারতে কমিউনিস্ট বিপ্লব ঘটা সম্ভব কিনা, এই প্রশ্নগুলোর জবাবে স্তালিন মূলত নেতিবাচক উত্তর দিয়েছেন এবং তার মূল্যায়নের কারণগুলো বিশেষভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে অন্য বলশেভিক নেতাদের (যেমন: লিয়ন ত্রৎস্কি বা নিকোলাই বুখারিন) তুলনায় স্তালিনের বাস্তববাদিতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পরবর্তীতে স্তালিন যে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে ‘সোভিয়েত দেশপ্রেম’ ধারণার বিস্তার ঘটিয়েছিলেন, এর একটি কারণ ছিল সম্ভবত তার এই উপলব্ধি যে, বিশ্বব্যাপী রাতারাতি কমিউনিস্ট বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার সুযোগ সীমিত।
সর্বোপরি, স্তালিনের সাক্ষাৎকারগুলো বিস্তৃত এবং তথ্যপূর্ণ, কিন্তু এগুলোতে যেসব বক্তব্য রাখা হয়েছে, সেগুলোরই সবই যে ‘ধ্রুব সত্য’ এমনটি ভেবে নেয়ার কোনো কারণ নেই। এমিল লুডভিগকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে স্তালিন সরাসরি তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তথ্য গোপন করেছেন। এর মধ্য দিয়ে এটি স্পষ্ট যে, স্তালিনের সব বক্তব্য যে সত্যি এমন নয়। এজন্য স্তালিনের এই সাক্ষাৎকার থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে প্রচুর তথ্য জানা যাবে ঠিকই, কিন্তু এই তথ্যগুলো সত্যি না মিথ্যা সেটা যাচাই না করে সেগুলোকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না।
সামগ্রিকভাবে, ‘মুখোমুখি স্তালিন’ সংকলনটি থেকে সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিন, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বিশ্ব সম্পর্কে সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের দৃষ্টিভঙ্গি বিস্তারিতভাবে জানা সম্ভব। এজন্য বিশ্ব রাজনীতি এবং বিশেষত বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী পাঠকদের জ্ঞান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই সংকলনটি বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বইয়ের নাম: মুখোমুখি স্তালিন
সংকলক: বাসু আচার্য
প্রকাশক: র্যাডিক্যাল, কলকাতা
প্রকাশকাল: ২০১৬ (২য় সংস্করণ)