সেলিনা কাইল নামের আকর্ষণীয় চেহারার সেই মেয়েটির জন্ম গোথামের জীর্ণশীর্ণ এলাকায় বসবাসরত এক দরিদ্র পরিবারে। তার মায়ের নাম মারিয়া এবং বাবার নাম ব্রায়ান। ম্যাগি নামের ছোট এক বোন ছিল তার। শত দরিদ্রতার মাঝে বড় হতে থাকে দুই বোন। দুজনের একজনও ঠিকমতো পায়নি বাবার স্নেহ, মায়ের মমতা। মেয়েদের রেখে নিজের পোষা বিড়ালদের নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতো তাদের মা। অত্যাচারি বাবার প্রধান কাজ ছিল মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে থাকা আর স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করা। পারিবারিক সহিংসতা এড়াতে তাই স্কুল ছুটির পর অধিকাংশ সময় জিমনেশিয়ামে কাটাতো সে।
একদিন স্কুল থেকে ফেরার পর মাকে ডাকছিল সেলিনা, বেশ ক’বার ডাকাডাকি করার পর তার সাড়া না পেয়ে সে উদ্বিগ্ন হয়ে গেলো। এমনটা তো হওয়ার কথা না। হঠাৎ সে বাথরুম থেকে রক্তের ধারা আসতে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলো। এরপর দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই ভয়ে চিৎকার করে উঠলো সেলিনা। বাথরুমে বাথটাবের উপরই পড়ে আছে তার মায়ের লাশ। আর লাশের ডান হাতের কাটা শিরা দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে আসছে তাজা রক্ত। মায়ের মৃত্যুর পরই তার জীবনে আসে অমূল পরিবর্তন। এদিকে স্ত্রীর মৃত্যুর পর নিজের উপর আরও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে ব্রায়ান। সেলিনা দেখতে অনেকটা তার স্ত্রীর মতো ছিল বলে তাকেও সে ঘৃণা করতে শুরু করে। দিন দিন তার মদ্যপানের পরিমাণ বাড়তে থাকে। অবশেষে অ্যালকোহলের বিষক্রিয়ায় মরণ হয় তারও। বিছানায় মৃত বাবাকে পড়ে থাকতে দেখে পুলিশকে ফোন করে সেলিনা। কথা বলা শেষ করে একটা ব্যাগে নিজের দরকারি জিনিসপত্র বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় সে এবং তার বোনকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় অনাথাশ্রমে।
গোথামের রাস্তার রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর জীবন শুরু হয় সেলিনার। পেটের দায়ে বিভিন্ন মুদি দোকানে খাবার চুরি করতে শুরু করে সে। কয়েকদিন যেতে না যেতেই এক দোকানে চুরি করার সময় ধরা পরে গেলে তাকেও পাঠিয়ে দেয়া হয় সেই অনাথাশ্রমে। সেখানেও নানারকমের ঝামেলা বাধানোর কারণে শেষমেশ তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় জুভেনাইল হলে (শিশু-কিশোরদের জন্য তৈরি বিশেষ বন্দিশালা)। তার বয়স ১৩ বছর পূর্ণ হবার পর তাকে আবার অনাথাশ্রমে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। সেখানে পৌঁছার কিছুদিন পর সে বুঝতে পারে যে, লোকচক্ষুর আড়ালে আশ্রমের নিয়ন্ত্রকরা টাকা আত্মসাৎ করে নিজেদের পকেট ভারী করছে। তাদের কার্যকলাপ লুকিয়ে লুকিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে একদিন ধরা পড়ে যায় সেলিনা। তাকে বস্তার মধ্যে ভরে গুণ্ডা দিয়ে নদীতে ফেলে দিয়ে আসা হয়। বহু কষ্টে সেই বস্তার ভেতর থেকে নিজেকে মুক্ত করে আবারও আশ্রমে ফিরে এসে সেখানে লুকিয়ে থাকে সে। সুযোগ বুঝে একদিন রাতের অন্ধকারে আশ্রমের অফিসে ঢুকে তাদের টাকা আত্মসাতের বেশ কিছু তথ্য জোগাড় করে সেলিনা এবং সেগুলো পুলিশের কাছে ফাঁস করে দেয়।
বয়স হবার পর দারিদ্র্যের অভিশাপে সেলিনা শেষমেশ পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়। খদ্দেরদের চাহিদা পূরণের ফাঁকে ফাঁকে চালাক সেলিনা হাতিয়ে নিতো মূল্যবান অলঙ্কারাদি, দামী ঘড়ি কিংবা টাকা পয়সা। দিন দিন তার চৌর্যবৃত্তির পরিধি বাড়তে শুরু করে। একসময় সে বিভিন্ন জাদুঘর ও ধনী ব্যক্তিবর্গের বাসাবাড়ি থেকে গয়না এবং হীরা চুরি করতে শুরু করে। এভাবেই চলে যাচ্ছিল তার জীবন। একদিন এক জাদুঘর থেকে মহামূল্যবান টোট্যাম চুরি করে পালানোর সময় হঠাৎ এক নিনজা এসে তার চুরি করা টোট্যামটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। সেলিনা সেই নিনজাকে অনুসরণ করে এক ওয়্যারহাউজে গিয়ে পৌঁছায়। ভেতরে প্রবেশ করে দেখে, ওয়্যারহাউজটি আসলে একটি মার্শাল আর্ট একাডেমি। তাকে ঢুকতে দেখে কাই নামের সেই নিনজাটি সেখানকার মার্শাল আর্ট শিক্ষককে (সেন্সেই) বলে যে, অনুপ্রবেশকারী এই মেয়েটি একটি চোর এবং তার গুরুতর শাস্তি হওয়া উচিৎ।
সেলিনাকে দেখে প্রথম ঝলকেই মুগ্ধ হয়ে যান সেন্সেই। তিনি সেলিনার কাছে বিনীতভাবে অনুরোধ করলেন তার একাডেমিতে যোগদানের জন্য। তিনি তাকে মার্শাল আর্টের সব জটিল নিয়ম কানুন শিক্ষা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। সেলিনা এই প্রস্তাবে অভিভূত হয়ে গেলো। সে সাথে সাথেই সেন্সেইয়ের প্রস্তাবে সম্মতি জানায়। নতুন করে শুরু হয় সেলিনার পথচলা। তবে খুব দ্রুত নতুন কায়দার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয় সেলিনা। তার অগ্রগতি দেখে সেন্সেই নিজেই অভিভূত হয়ে যান। কিন্তু বাধ সাধে কাই, তার সাথে সম্পর্ক দিন দিন খারাপ হতে থাকে সেলিনার। কাই তাকে সবসময় ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখতো এবং প্রশিক্ষণের সময় ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে আঘাত করতো। তার শত অবহেলা আর ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও, ধীরে ধীরে সেলিনা হয়ে ওঠে সেন্সেইয়ের সবচেয়ে পছন্দের ছাত্রী।
একরাতে টেলিভিশনে একটি খবর প্রকাশিত হয় যে, ব্যাটম্যান রবিনসন পার্কে গেছে। কৌতুহলবশত সেলিনা সেই পার্কে চলে যায় এবং একঝলকের জন্যে ডার্ক নাইট তার নজরে আসে, পরমুহূর্তেই কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। কিন্তু সেই এক ঝলকই ছিল তার জন্যে যথেষ্ট। ব্যাটম্যানকে দেখা মাত্রই তার বুক ধক করে উঠে। নতুন এক ভাবনা খেলে যায় তার মাথায়। সে চিন্তা করে দেখে, ব্যাটম্যান যদি এমন বেশ ধরে একই সাথে মানুষের আনন্দের এবং ভয়ের কারণ হতে পারে, তাহলে সে পারবে না কেন? যে-ই ভাবা, সেই কাজ; ব্যাটম্যানের মতো করে সে-ও কোনো এক চরিত্র ধারণ করতে সিদ্ধান্ত নেয়। মায়ের বিড়ালপ্রীতির কথা মাথায় রেখেই হয়তো সেলিনা তার জমানো সব অর্থ ব্যয় করে নিজের জন্যে একটি বিড়াল সদৃশ পোশাক তৈরি করে এবং কাজ হিসেবে চুরিবিদ্যাকে পুনরায় গ্রহণ করে নেয়।
একবার স্থানীয় এক জুয়েলারি দোকানে ডাকাতি করতে গেলে একদল নিরাপত্তা কর্মী তাকে আটক করে এবং তাদের মাঝে একজন তাকে ‘ক্যাটওমেন’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। নামটি তার ভীষণ পছন্দ হয়, সেদিনই যেন জন্ম হয় ক্যাটওমেনের। ব্যাটম্যানের প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকে তার। ঐদিকে চুরির অপরাধে তার পেছনে লাগে ব্যাটম্যানও। বেশ কয়বার সংঘর্ষের ফলে তাদের পরিচয় হয়। পরস্পরের প্রেমে পড়ে যায় তারা। তবে দুজন দুজনকে প্রচণ্ড ভালবাসলেও তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও নীতিগত পার্থক্যের কারণে তার কখনো এক হতে পারেনি।
কমিকসবুকের ইতিহাসের সর্বপ্রথম নারী সুপারভিলেন হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করে নেওয়া এই ক্যাটওমেনকে প্রথমবারের মতো কমিকস জগতে নিয়ে আসা হয়েছিল সেই ১৯৪০ সালে। ডিটেকটিভ সিরিজ থেকে আলাদা করে বের করার ব্যাটম্যান একক সিরিজের প্রথম ইস্যুতে দেখা মেলে ক্যাটওমেনের। তার সৃষ্টির পেছনে অবদান রেখেছেন ব্যাটম্যানের দুই স্রষ্টা বিল ফিঙ্গার এবং বব কেইন। কমিকস বইয়ের কোনো নারী চরিত্রের সহিষ্ণুতার বিকাশ ঘটানো ছিল কমিকস কোড কর্তৃপক্ষের আচরণ বিধির পরিপন্থি, তাই প্রথমদিকে ‘ক্যাট’ হিসেবে তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। পরে ১৯৫৪ সালে কমিকস কোড কর্তৃপক্ষ তাদের সেই নিয়ম তুলে নিলে ক্যাটকে পাঠকদের কাছে ‘ক্যাটওমেন’ হিসেবে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।
ক্যাটওম্যান এবং জোকার এই দুজনেই ছিল ব্যাটম্যান সিরিজের প্রথম দুই ভিলেন। শুরুর দিকে তাকে সুপারভিলেন হিসেবে তুলে ধরা, পরবর্তীতে তাকে খানিকটা এন্টিহিরো ভাব নিয়ে আসা হয় তার চরিত্রে। তাছাড়া সময়ের সাথে সাথে ডিসি কমিকস তাদের সিরিজগুলো কিছুটা পরিবর্তন ও পরিমার্জিত করে প্রকাশ করার কারণে কমিকস চরিত্রগুলোতেও দেখা যায় লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন। সেই সব একটু খতিয়ে দেখলে তাকে সরাসরি ব্যাটম্যানের শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করা যাবে না। কেননা, গল্পের খাতিরে প্রায়ই তাকে দেখা গেছে ব্যাটম্যানের প্রেমিকা এবং বড় দুর্বলতার একটি হিসেবে।
কমিকস বই এবং অ্যানিমেশন সিনেমা বাদেও মোশন ছবিতে ক্যাটওমেন হিসেবে হাজির হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে বেশ কয়েকজন অভিনেত্রীর। তবে সবাই যে সফল হয়েছেন তা না। ষাটের দশকে টিভিতে প্রচারিত ব্যাটম্যান টিভি সিরিজে এই চরিত্রে অভিনয় করেন তিনজন অভিনেত্রী, জুলি নিউমার, লি মেরিওয়েদার এবং এর্থা কিট। তাদের অসাধারণ পারফর্মেন্সের কারণেই সেলুলয়েডের পর্দায় ক্যাটওমেনের জনপ্রিয়তার সূচনা হয়। পরে ১৯৯২ সালে নির্মিত ‘ব্যাটম্যান রিটার্নস’ সিনেমায় ক্যাটওমেন চরিত্রে মিশেল ফাইফারের দুর্দান্ত অভিনয় সেই জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়ে দেয়।
তবে সেই জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে ২০০৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ক্যাটওম্যান’-এর কারণে। হ্যালি ব্যারি অভিনীত সেই সিনেমাটি দর্শক কিংবা সমালোচক কারোরই মন জয় করতে পারেনি। এমনকি ১০০ মিলিয়ন ডলার বাজেটের সেই সিনেমা বক্স অফিসেও তেমন সুবিধা করতে পারেনি। পরবর্তীতে ২০১২ সালে অ্যানা হ্যাথওয়ে ক্যাটওমেনের ক্ষুণ্ণ হওয়া সেই জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার করেন। বর্তমানে টিভিতে প্রচারিত গোথাম সিরিজে ক্যাটওম্যান হিসেবে আছেন ১৮ বছর বয়সী অভিনেত্রী ক্যামরেন বিকনডোভা।