যুক্তির ‘ফাঁদ’ থেকে মিলবে কি মুক্তি?

জুনায়েদ, বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় পড়তে গিয়েছিল। সেখানে জড়িয়ে গেল ভয়ঙ্কর এক যুক্তির ফাঁদে। উচ্চশিক্ষার পথ হয়ে গেল বন্ধ, উপরন্তু ভাগ্যে জুটল পুলিশি ঝামেলা। কোথাও যেন একটুও স্বস্তির দেখা নেই। কিন্তু যুক্তির ফাঁদে আটকা পড়লে মুক্তি কি মেলে সহজে? শ্বাস নেয়া যায় প্রাণখুলে?

সময়ের ফাঁদ অন্যরকম। জীবনের একপর্যায়ে সবাই এখানে আটকে যায়। মুহুর্তের নির্দিষ্ট কিছু হিসেব চুকিয়ে দিলেই মুক্তি। তবে যুক্তির ফাঁদ সেভাবে কাজ করে না। প্রকৃতপক্ষে, যুক্তির মারপ্যাঁচে গাঁথা হয় যে ফাঁদ, সেখান থেকে মুক্তির জন্য চাই পাল্টা যুক্তি। প্রতি-আক্রমণ না করে হার মানলেই সমস্যা। আক্রমণকারীর যুক্তির পাল্লা আরও বেশি ভারি হয়ে ওঠে তখন।

সময়ের ফাঁদ অন্যরকম; Image Source: Devian Art

কিন্তু জুনায়েদ কীভাবে ফাঁদে পড়ল? বন্ধু ক্রিসের প্রেমিকা, লুসানার হত্যারহস্যের প্রাইম সাসপেক্ট সে। ফাঁদে তো তাকে পড়তেই হতো। তাছাড়া দারুণ পারদর্শিতার সাথে গেঁথে ফেলা হয়েছে এই ফাঁদ, যার কারণে জুনায়েদের কাছে এসেই মিলে যেতে বাধ্য হয়েছে তদন্তের সব সূত্র। সন্দেহের তীর আর অন্য কোথাও গিয়ে বেঁধেনি। প্রকৃতপক্ষে, লুসানার মৃত্যুরহস্যের অপরাধী হিসেবে জুনায়েদ ছিল এক এবং অদ্বিতীয়।

জুনায়েদের নিশ্চিত ভবিষ্যতের ছবি মুহূর্তেই যেন বদলে গেল। পুলিশ থেকে শুরু করে হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের ডিটেকটিভ- জুনায়েদের সাহায্যার্থে কেউ সেভাবে এগিয়ে আসেনি। এভালিন ওয়াটসন তাকে জামিন পেতে সহযোগিতা করলেও জুনায়েদের জন্য সম্ভাবনার কোনো পথ আর খোলা ছিল না। ততক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জুনায়েদের ভর্তি প্রক্রিয়া স্থগিত করে দিয়েছিল। বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু আশা দরকার, সেটুকু উধাও হয়ে গিয়েছিল স্কলারশিপ বাতিল হওয়ার মধ্য দিয়ে।

জুনায়েদের আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করেই গল্পটা শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু তখনও যে লুসানার হত্যারহস্যের আসল সমাধানটুকু জানা বাকি। তদন্তের অন্য দিকগুলো কতখানি জোরালো ছিল, সেই সম্পর্কেও তো জানতে হবে। এরই লক্ষ্যে, সান্তাক্রুজে ঘটে যাওয়া একটি মার্ডার মিস্ট্রি ডালপালা ছড়িয়ে পৌঁছে গেল ঢাকার গোপীবাগে।

স্বদেশের মেধাবী যুবক কেন বিদেশ-বিভুঁইয়ে গিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিল? কে ছিল লুসানার প্রকৃত হত্যাকারী? আবারও গজিয়ে উঠেছে নতুন একটি রহস্য, যার সমাধানের লক্ষ্যে এগিয়ে এসেছে রিপোর্টার তন্ময় চৌধুরী। দীর্ঘদিনের পরিচিত আমিনুল তো সঙ্গে আছেই, এবারের অভিযানে আরও যোগ দিয়েছে থার্ড আইয়ের মতো প্রাইভেট ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি। এ এক ভয়ঙ্কর যুক্তির খেলা। ফাঁদ কেটে ফাঁদ তৈরির দুর্দান্ত এই খেলার শেষ কোথায়?

ফাঁদ, ভুক্তভোগীকে বিপদে ফেলার চমকপ্রদ এক কৌশল। যুক্তির কারুকাজে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে সেটা। আলোচিত বইয়ের মূল কাহিনি জুড়ে বর্ণিত হয়েছে এমন এক ফাঁদ কিংবা কৌশলের গল্প, যার পরতে পরতে কঠিন যুক্তির মারপ্যাঁচ। মূলত এই যুক্তিই বইয়ের প্রাণ, যা লেখক বেশ চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন বইয়ের পাতায়। ফাঁদ তৈরির কাজটাও যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে। তবে তন্ময় চাইলে ফোন নাম্বারের সাহায্যেই জুনায়েদকে ট্রেস করতে পারত। এত কাঠখড় না পোড়ালেও চলত বোধহয়।

পুরো কাহিনির অধিকাংশ জুড়ে আমেরিকার সান্তাক্রুজ; Image Source: Visit The USA

পুরো কাহিনির অধিকাংশ জুড়ে আমেরিকার সান্তাক্রুজ। লেখক খুব সুন্দরভাবে সেখানকার দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ফুটিয়ে তুলেছেন। ইয়ট ভ্রমণের সময়টুকু বইয়ের অন্যতম আকর্ষণীয় দিক বলে মনে হয়েছে। প্রাচুর্য আর বিলাসিতার অনবদ্য উপস্থাপন পাঠককে শুরু থেকেই ফাঁদে আটকে রাখতে সক্ষম হবে।

বইয়ের পাতায় এভালিন ওয়াটসনের উপস্থিতি ছিল একদম ঝটিকা সফরের মতো। দারুণ চৌকস এই নারীকে চমৎকার এক ব্যক্তিত্ব হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন লেখক, যার কারণে এভালিনকে পাঠকদের বেশ পছন্দ হবে। সে তার পেশাগত কাজের দিক দিয়ে যতখানি রুক্ষ, মানবিকতার দিয়ে দিয়ে ঠিক ততখানি কোমল।

অন্যদিকে ক্রিসকে শুরুর দিকে বেশ আত্মবিশ্বাসী এক চরিত্র বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু শেষাংশে এসে পুরো ব্যাপারটাই কেমন যেন বদলে গেল। আসলে পরিস্থিতির ফাঁদে পড়লে মানুষ কীভাবে আমূল পাল্টে যেতে পারে, সেটা এই বইয়ের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক।

তবে সময়, পরিস্থিতি কিংবা যুক্তির ফাঁদের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ মূলত অর্থের ফাঁদ। ‘ফলো দ্য মানি’ থিওরির মধ্য দিয়ে কাহিনির গতিকে দুর্দান্ত একটা মোড় ঘুরতে দেখা যায়। অতিপ্রাকৃতিক কিছু স্বাদ এ অভিজ্ঞতাকে আরও বেশি উপভোগ্য করে তুলেছে।

আমিনুল ও বকুলের গল্প এগিয়েছে বইয়ের মূল কাহিনির স্রোতের সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে। একই লেখকের ‘রক্ত’ পড়তে গিয়েও এদের উপস্থিতি চোখে পড়েছিল। রাশভারি পরিবেশে খানিকটা হালকা আমেজের যোগান দিতে এই দুই চরিত্রের ভূমিকা যথেষ্ট কার্যকর বলে মনে হয়েছে।

সানজিদা স্বর্ণার প্রচ্ছদ বইয়ের আরেকটি আকর্ষণীয় দিক। লুসানার মার্ডার মিস্ট্রির প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। একটু গভীরভাবে প্রচ্ছদের দিকে তাকিয়ে থাকলেই পাঠক জিনিসটা ধরতে পারবেন। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিতেও খুব একটা সমস্যা হবে না আশা করছি।

এই মার্ডার মিস্ট্রির সমাধানকারী তন্ময়; Image Source: Duluth News Tribune

তন্ময় চৌধুরীর বুদ্ধির জোরে রহস্যের জট শেষমেশ খুলে যায়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকার রহস্য সমাধানের কাজটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য হতো না। আর এজন্যই মূলত থার্ড আই ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির এত প্রাসঙ্গিকতা। তাছাড়া তন্ময়ের অবদান ছাড়া কিছুই সম্ভব হতো না আসলে। নিজের দেশের একজন মানুষের ন্যায়বিচারের জন্য তার ভূমিকা যথেষ্ট প্রশংসনীয় বলে মনে হয়েছে। হয়তো মৃত্যুর ফাঁদ থেকে জুনায়েদকে আর বাঁচানো যায়নি। তবে মানবমনের ঘৃণার বিষাক্ত ফাঁদ থেকে নিঃসন্দেহে মুক্তি পেয়েছে সে।

মার্ডার মিস্ট্রি জনরার বই হিসেবে ‘ফাঁদ’ যথেষ্ট উপভোগ্য। ক্ষুদ্র আকারের এক বই, যেখানে প্রাধান্য বিস্তার করতে দেখা যায় আমেরিকার সান্তাক্রুজের এক হত্যা রহস্যকে। যে রহস্যের ফাঁদে জড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশের এক যুবকের আত্মহননের বিষণ্ণ গল্প। এই বিষণ্ণতা পাঠককে কতখানি স্পর্শ করতে পারবে, তা পাঠকের উপর নির্ভর করছে। তবে মার্ডার মিস্ট্রি যাদের পছন্দের জনরা, তারা চাইলে পড়ে দেখতে পারেন।

বই: ফাঁদ
লেখক: গোলাম কিবরিয়া
ধরন: মার্ডার মিস্ট্রি
প্রকাশনী: বর্ষাদুপুর

This article is in Bangla. It is a book review of 'Fad', a murder mystery by Golam Kibria.

Featured Image: Musitrature

Related Articles

Exit mobile version